প্রায় চব্বিশ বছর আগে ইতালিতে আন্তর্জাতিক কবিতা সপ্তাহ উপলক্ষে একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কবি সম্মেলনের কথা এবার বলা যেতে পারে। সম্মেলনটি উল্লেখযোগ্য নানা কারণে বহু প্রখ্যাত কবির উপস্থিতিতে এবং ঝগড়াঝাটিতে। অবশ্য আন্তর্জাতিক বলতে শুধু ইওরোপ এবং আমেরিকার কবিরা, এডেন বন্দরের এ পাশের দেশের কেউ ছিল না।
আমি ছিলাম নিতান্ত দর্শক বা শ্রোতা।
কবি সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জিয়ান কালো মিনোত্তি তিনি ত সভা আরম্ভ হবার সময়ে নির্দিষ্ট থিয়েটার হলে এসে দেখলেন, উদগ্রীব, শ্ৰোতায় হল ভরতি, কিন্তু একটিও কবির দেখা নেই। মিনোত্তি ব্যস্ত হয়ে টেলিফোন করলেন সালভাদোর কাশিমোদোকে-ইতালির নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত প্রবীণ কবি। কাশিমোলদা তখন দাড়ি কামাচ্ছিলেন, কাতর মিনোত্তি তখন অনুরোধ জানালেন, একটু তাড়াতাড়ি আসুন। আপনার শ্রোতারা বিষম ব্যস্ত হয়ে আছে।
তারপর তিনি ফোন করলেন পাবলো নেরুদাকে। নেরুদা তখন বাথটবে গা ডুবিয়ে স্নান করছেন। চলে আসুন, যে অবস্থায় আছেন চলে আসুন। এমন সময় ঢুকলেন আমেরিকার মহিলা কবি বারবারা গেস্ট। যাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সভাপতি। শ্রীমতি গেস্টকে দিয়েই কবিতা পাঠ শুরু হল।
একটু পর একে-একে অন্য কবিরা আসতে লাগলেন। এক-একজন ঢুকছেন আর হলের মধ্যে গুঞ্জন। চকচকে কামানো গাল নিয়ে কাশিমোদো আর ভিজে মাথায় এলেন নেরুদা। পাবলো নেরুদা নিজের কবিতা পড়লেন উদ্দাত্ত সুরেলা গলায় কিছু আবেগের সঙ্গে। তারপর কাশিমোদো। আস্তে শান্তভাবে পড়ার পর কাশিমোদো, প্রকাশ্যে বললেন, তিনি নেরুদার কবিতা পড়ার ধরন একটুও পছন্দ করেননি। আমি আমার কবিতা পাঠ করি, আবৃত্তি করি না। আমরা কবি, আমরা অভিনেতা নই।…আজকাল রামাশ্যামাও কবিতা লিখছে। কিন্তু কবিতা লেখা অত সহজ নয়। এদের বন্ধ করিয়ে দেওয়া উচিত। কবিতা লেখা আমার মতো পেশাদারদেরই কাজ।
এ কথায় মৃদু হেসে নেরুদা বললেন, কাশিমোদো নিশ্চয়ই খুব ভালো কথাই বলেছেন –অবশ্য উনি কী বলেছেন তা যদি বুঝতে পারা যায়।
সভা আরম্ভ হবার আধ ঘণ্টা পর ঝড়ের মতো ঢুকলেন রাশিয়ার প্রখ্যাত কবি ইভগেনি এডটুশেংকো। এসেই চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন। এজরা পাউণ্ড এসেছেন কি না। না, আসেননি। যাক বাঁচা গেল। এডটুশেংকো আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন। এজরা পাউন্ড সভায় থাকলে তিনি আসবেন না। কারণ, পাউন্ডের সঙ্গে কবিতা পড়লে দেশে ফিরে গিয়ে তাঁকে আবার প্রচুর বকুনি খেতে হবে হয়তো। কারণ, পাউন্ড একসময় ছিলেন ইহুদি বিদ্বেষী, ফাঁসিস্তদের সমর্থক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মুসোলিনিকে সমর্থন করে নেতারা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সব কবেকার কথা। তারপর পাউন্ডের ওপর কত নির্যাতন গেছে। কতদিন রইলেন উন্মাদ আশ্রমে–তখন ইতালিতে প্রায় নির্বাসিত হয়ে আছেন। কিন্তু সেই পুরোনো কথা তুলেই প্রতিবাদ করেছিলেন এডটুশেংকো, নিজে পড়লেনও ওঁর কবিতা, কবি ইয়ার–যেটা রাশিয়ার ইহুদি বিদ্বেষীদের আক্রমণ করে লেখা। কবিতা পড়া শেষ করেই এডটুশেংকো আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন হল ঘর থেকে। একেবারে শহর ছেড়েই চলে গেলেন মনে হল। খুব ভদ্রতাসম্মত মনে হল না ওঁর ওরকম বেরিয়ে যাওয়া।
সিফেন স্পেন্ডার এডটুশেংকোর ওই রকম ব্যবহার দেখে বিড়বিড় করে বললেন, ‘ওকে যত দেখেছি–ততই ওর প্রতিভা এবং কবিতা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগছে’।
আমেরিকার বিটনিকদের অন্যতম প্রধান কবি। দীর্ঘস্থায়ী লরেন্স ফের্লিংগেটি কবিতা পড়ার আগে একটা ছোট ভূমিকাও করেছিলেন। আমি একজন পুরুষ কবি! আমার কবিতা সবচেয়ে সমসাময়িক বিষয়কে ভিত্তি করে, অর্থাৎ রাজনীতি। আমেরিকা কবিতায় সত্যিকারের নতুন জিনিস এনেছে। বাকি ইওরোপীয় কবিরা এখনও গাছপালা নিয়ে লেখে।
সভার একেবারে শেষের দিকে একজন ক্ষীণকায় বৃদ্ধ ভিড় ঠেলে ঢুকলেন। শরীরের চামড়া শুকিয়ে গেছে, ধূসর মুখের রং, চোখ দুটি কোটরাগত কিন্তু তীব্র উজ্জ্বল! চুল দাড়ি সমস্ত পাকা। এজরা পাউন্ড। পাউন্ড মঞ্চে উঠে শূন্য চোখে চারিদিকে তাকালেন। কতদিন পর কবিতা পড়া। দুর্বল ভাঙা-ভাঙা গলায় পাউন্ড পরপর দশটি কবিতা পড়লেন। সেই এককালের দুর্দান্ত বেপরোয়া এজরা পাউন্ডের ছায়ামূর্তি যেন তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে। যেন কবিতা পড়া শুরু করার পর নিজের সৃষ্টি শব্দের ধ্বনি কানে ভালো লেগে গেল সেইজন্য দশটা কবিতা পড়লেন। পড়া শেষ হবার পর প্রবল সমর্থনে ও সম্মান প্রদর্শনে ফেটে পড়ল হল ঘর। দশ মিনিট ধরে সব লোক দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিতে লাগল। অভিভূত হয়ে গেলেন পাউন্ড। বারবার কী যেন বলতে গেলেন। কিন্তু শ্রোতাদের উচ্ছাস আর থামে না। তারপর থেমে গেলে, পাউন্ড বললেন, ‘এ কী, না না, এটা ভুল। এটা তোমাদের যুগ। আমাকে আর তোমাদের দরকার নেই।’
সভা শেষ হলে, অবসাদে ভেঙে পড়েছিলেন মিনোত্তি। এতগুলো বিপরীত চরিত্রের কবিকে সামলানো কি সোজা কথা। মিনোত্তি বললেন, আমি ১০০ জন গুন্ডাকেও সামলাতে পারি। কিন্তু দশজন সাধারণ কবিকেও আর পারব না।