‘আমি দাঁড়িয়ে আছি এই নারীসুলভ ভূমিদৃশ্যের সামনে
যেন আগুনের সামনে একটি বালক
ঠোঁটে অস্পষ্ট হাস্য চোখে অশ্রুবিন্দু
এই দৃশ্যের সামনে আয়না ঝাঁপসা হয়ে যায়,
আয়না ঝকঝক করে, প্রতিফলিত হয় দু’টি নগ্ন শরীর
এক ঋতুর প্রতি অন্য ঋতু’
–পল এলুয়ার
শহর দিয়ে কোনও দেশকে প্রকৃতভাবে চেনা যায় না। খুব বড় কোনও শহর কিংবা রাজধানী সেই দেশের মস্তিষ্ক ঠিকই, তাতে অনেকরকম বাহার থাকে বটে, আবার শিরঃপীড়াও কম থাকে না। প্রত্যেক বড় শহরই তার ভেতরে ভেতরে কিছু ক্ষত লুকিয়ে রাখে। কোথাও বেশি, কোথাও কম। কলকাতায় অনেক বস্তি-টস্তি আছে, তা বলে লন্ডন-প্যারিস-নিউ ইয়র্ক-প্রাগ-মস্কো-বেইজিং-এ বস্তি-ব্যারাক-বেশ্যালয় একেবারে নেই, তাও তো নয়!
আমরা ঠিক করেছিলাম, ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলই বেশি করে দেখব। রাত কাটাব ছোট্ট কোনও সরাইখানায়। বাঁধা পথে যাব না। আজকাল উন্নত দেশগুলির উন্নতির প্রধান চিহ্ন হচ্ছে রাস্তা। সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য রাস্তা এবং কোথাও একটুও ভাঙাচুরো নয়। ব্যস্ত মানুষদের জন্য আছে সুপার হাইওয়ে কিংবা অটো রুট, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চওড়া কংক্রিটের রাস্তা, এবং সেইসব রাস্তায় পড়লেই বোঝা যায়, প্রতিদিন এই বহু ব্যবহৃত পথের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষের নজর আছে। অবশ্য সেজন্য রাস্তা ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে পয়সাও নেওয়া হয় যথেষ্ট।
অটো রুটগুলি যেহেতু জনবসতি এড়িয়ে চলে, তাই দৃশ্য হিসেবে একঘেয়ে। আমার ভালো লাগে না। আমাদের কোথাও পৌঁছবার তাড়াহুড়ো ছিল না বলে আমরা গ্রাম্য পথ ধরেছিলাম। গ্রামের রাস্তা দেখলেই বোঝা যায় একটা দেশের প্রকৃত শক্তি কতখানি। এই সব দেশে এমন একটা গ্রামও নেই, যেখানে গাড়ি করে পৌঁছনো যায় না। গ্রামকে বঞ্চিত করে এরা এখন আর শহরের মাথা ভারী করে না, বরং শহরের অনেক সুযোগ-সুবিধে এরা গ্রামের দ্বারপ্রান্তে এনে দেয়।
ছোট রাস্তা মানেই একটু ঘোরা পথ। তাতেও ক্ষতি নেই, আমরা মোটামুটি মানচিত্র ধরে নেমে যাচ্ছি নীচের দিকে। পোয়াতিয়ে ছাড়িয়ে ঘুরতে-ঘুরতে আমরা এক সময় নেমে এলাম সমুদ্রের ধারে। সমুদ্র মানে আটলান্টিকের ব্যাক ওয়াটার। ম্যাপে দেশের মধ্যে ঢুকে পড়া এক চিলতে নীল রেখা দেখালেও প্রকৃতপক্ষে সামনে এলে সমুদ্র বলেই মনে হয়। আকাশ ও জলের রং একই রকম নীল, পরপার দেখা যায় না। এখানে গাড়িসদ্ধ ফেরিতে পার হতে হবে। আর কী সুন্দর দিনটা। জাহাজের ডেকে দুটি ছেলে তাদের গায়ের জামা খুলে রোদ পোহাতে লাগল। সাহেবরা যেমন ঘরের মধ্যেও গলা-টেপা টাই পরে থাকে, তেমনি লোকজনের সামনেও খালি গা হতে এদের দ্বিধা নেই। যুবক দুটির। স্বাস্থ্য এমন চমৎকার যে তাদের তরুণ দেবতার মতো মনে হয়! কেন দেবতার মতন মনে হল? আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। আমাদের সব দেব-দেবীরাই খুব ফরসা! বহুকাল ধরে আমাদের পুরাণ, ধর্মগ্রন্থগুলিতে এরকমই বর্ণনা দেওয়া আছে। মানুষ তার ভগবান কিংবা ঠাকুর-দেবতাদের তো নিজের আদলেই গড়েছে, তা হলে ভারতীয়দের মতন চেহারার কেউ দেবতা হতে পারবে না কেন? কালো মানুষদের জন্য কালো ঈশ্বর নেই?
জিরঁদ প্রণালী পেরিয়ে খানিকটা নামলেই বোরদো শহর।
যারা দ্রাক্ষা-আসব রসিক, তাদের কানে বোরদো নামটা শোনালেই চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটবে। বোরদো’র ওয়াইন ভুবনবিখ্যাত। তা ছাড়া বোরদো শহরের খ্যাতির অনেক কারণ আছে।
ভাস্কর ব্রিটিশ নাগরিক, অসীম ফরাসি। বহু শতাব্দী ধরে ফরাসি-ইংজেরদের ঝগড়া এখনও তলায় তলায় রয়ে গেছে, ক্ষণে ক্ষণে শ্লেষ-বিদ্রূপ ছোঁড়াখুঁড়ি হয়। আমাদের এই দুই বাঙালি বন্ধুও এক এক সময় ব্রিটিশ ও ফরাসি হয়ে যায়।
বোরদো শহরটি বড়ই সুশ্রী। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে গারোন নদী, শহরের মধ্যে বড় বড় উদ্যান, ক্যাথিড্রাল এবং একটি বিখ্যাত বেল টাওয়ার।
নানারকম মূর্তি শোভিত একটি বিশাল ফোয়ারার কাছে আমরা মধ্যাহ্নভোজে বসেছি, এমন সময় ভাস্কর বলল, এই শহরটাকে বেশ সুপুরুষ দেখতে। ইংরেজরা বানিয়েছে তো!
অসীম সঙ্গে-সঙ্গে বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, ভাস্কর? খোদ ব্রিটেনে এত সুন্দর শহর একটাও আছে যে ফ্রান্সে এসে এমন গড়বে ইংরেজরা?
ভাস্কর বলল, বোরদো একসময় ইংরেজদের সম্পত্তি ছিল না? রাজা দ্বিতীয় হেনরি এটা বিয়ের যৌতুক হিসেবে পায়নি? দ্বিতীয় রিচার্ডের জন্ম হয়েছিল এই শহরে। তুমি ইতিহাসের কি জানো না।
অসীম বলল, ওসব ইস্কুলের ইতিহাস সবাই জানে। এই জায়গাটা ইংরেজদের ছিল সে কতকাল আগে! এটা একসময় ছিল রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে, তারপর ইংরেজরা কিছুদিন রাজত্ব করে গেছে, কিন্তু ফিফটিনথ সেঞ্চুরিতে ফরাসিরা এটা আবার জিতে নেয়। এই যে এখানকার এত বড় বড় সব বাড়িঘর, আর বাগান দেখছ, সব ফরাসি আমলে তৈরি। বোরদো ফ্রান্সের খুব বড় একটা ব্যাবসার কেন্দ্র।
.
ভাস্কর বলল, ইংরেজরাই এই জায়গাটাকে সভ্য করে দিয়ে গেছে। আগে এরা ব্যাবসা-বাণিজ্যেরও কিস্যু জানত না।
আমিই বা এখানে একটু বিদ্যে ফলাতে ছাড়ি কেন? গাড়ি চলবার সময় আমার যেহেতু কোনও কাজ নেই তাই আমি জায়গাগুলোর কিছু কিছু তথ্য-বিবরণ ও ইতিহাস পড়ে নিই। আমি বললাম, আসলে এই চমৎকার শহরটার উন্নতির মূলে আছে আফ্রিকা।
ওরা অবাক হয়ে তাকাতেই আমি আবার বললাম, এই সব বড় বড় গির্জা-ক্যাথিড্রাল ও স্তম্ভওয়ালা বাড়িগুলো তৈরি হয়েছে কালো মানুষদের টাকায়। ইংরেজরা শোষণ করেছে ভারতবর্ষ আর এরা শোষণ করেছে আফ্রিকা। এই বোরদো’র বিশেষ সমৃদ্ধি হয়েছিল দু
বছর আগে, তখন এরা আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে এনে চালান দিত ওয়েস্ট ইন্ডিজে। তা ছাড়াও আফ্রিকা থেকে আনত চিনি আর কফি। আর সেখানে এরা বিক্রি করত মদ আর বন্দুক। একেই বলা হত ‘ত্রিকোণ ব্যাবসা’।
অসীম আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল।
বোরদো শহর ছাড়িয়ে আমরা যেতে লাগলাম ক্রোশের পর ক্রোশ আঙুর খেতের পাশ দিয়ে। এখানকার জমির দাম নাকি সোনার টুকরোর সমান। যতদূর চোখ যায়, শুধু আঙুর গাছ, সেগুলি বুক সমান উঁচু মাচার ওপর তুলে দেওয়া। লাল ও সাদা আঙুর ফলে আছে। আমাদের দেশ হলে নিশ্চিত চতুর্দিকে পাহারার ব্যবস্থা করতে হত, কিন্তু এখানে কোথাও জনমনুষ্য নেই, কাঁটা তারের বেড়া নেই। গাড়ি থামিয়ে নেমে আমরা এক জায়গায় বেশ কিছু আঙুর তুললাম, শিকারি কুকুর নিয়ে কেউ বন্দুক হাতে তেড়ে এল না।
অসীম বলল, শুধু আঙুরের তো দাম বেশি নয়, ওয়াইন তৈরি হওয়ার পর মূল্য হয়। এমনি খাবার জন্য কেউ কয়েক থোকা আঙুর তুললে এরা গ্রাহ্য করে না।
আঙুর খেতের সামনে লাল লাল ফুল দেখে আমার প্রথমে ধারণা হয়েছিল, ওই বুঝি আঙুরের ফুল। তা নয়, ওগুলো এক ধরনের গোলাপ, সামনের দিকে দু-এক সারি ওই গাছ লাগিয়ে রেখেছে খুব সম্ভবত শোভা বৃদ্ধির জন্য হয়তো অন্য কারণও থাকতে পারে, কিন্তু খেতগুলির সামনের দিকে ফুলের পাড় দেখতে চমৎকার লাগে। এ দেশের চাষিদেরও সৌন্দর্যবোধ আছে।
প্রথম রাত কাটাবার জন্য আমরা উঠলাম একটা ছোট্ট হোটেলে। প্রায় প্রত্যেক গ্রামের প্রান্তেই দুটো-তিনটে করে হোটেল। এত হোটেল, তবু জায়গা পাওয়া সহজ নয়। সন্ধের পর হোটেলের সন্ধানে আমাদের গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে যেতে হয়, অনেক হোটেলের সামনেই লেখা আছে সব ঘর ভরতি। কোনও হোটেলে ঘর খালি থাকলেও পরিবেশটা আমাদের পছন্দ হওয়া দরকার, একেবারে জনবসতির মাঝখানে আমরা থাকতে চাই না।
হোটেলগুলির ভাড়া কিন্তু বেশি নয়। মাথা পিছু ষাট-সত্তর টাকা পড়ে। হোটেল মালিকদের সঙ্গে দরাদরি করার খুবই ইচ্ছে ভাস্করের, কিন্তু তারা ইংরিজি না বুঝলে ভাস্কর খুবই নিরাশ হয়ে যায়। কেউ কেউ ভাঙা ইংরিজি বলে এবং টুরিস্টদের কাছে সেই ইংরিজি জ্ঞান জাহির করতেও চায়। অসীম এত বছর এদেশে আছে, তার ধারণা, হোটেলের ভাড়া একেবারে নির্দিষ্ট, এখানে দরাদরি করার প্রশ্নই নেই, কিন্তু ভাস্কর ইংরিজি বলার একটু সুযোগ পেলে কিছুতেই ছাড়ে না। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, হোটেলের মালিকের সঙ্গে দু’মিনিটের আলাপে গলাগলি বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে দশ-কুড়ি টাকা ভাড়া কমিয়েও ফেলে।
অধিকাংশ হোটেলেই খাবারের ব্যবস্থা নেই। গাড়ি পার্ক করে, পোশাক বদলে আমরা রাত্তিরবেলা হেঁটে-হেঁটে রেস্তোরাঁ খুঁজতে যাই। সত্যিকারের গ্রাম, কিন্তু একটাও খোলার চালের বাড়ি কিংবা ভাঙা বাড়ি চোখে পড়ে না। দোকানগুলি জিনিসপত্রে ঠাসা। তবে রেস্তোরাঁয় ঢুকলে যে-সব পুরুষদের দেখা যায়, তারা অধিকাংশই ইতালিয়ান কিংবা গ্রিক। ওইসব গরিব দেশ থেকে শ্রমিকরা এখানকার গ্রামের খেতে-কলকারখানায় কাজ করতে আসে, ফরাসি তরুণরা উন্নত কাজের আশায় শহরে চলে যায়।
ভাস্কর আর অসীমের মতন দুই ব্যক্তিত্বের এক ঘরে স্থান হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া নাক ডাকার একটা সমস্যা আছে। দু’টি ঘরের একটিতে থাকে অসীম আর মৃণাল, অন্যটিকে ভাস্কর ও আমি। ভাস্করের বেশি রাত জাগা স্বভাব, অসীম সারাদিন গাড়ি চালায় বলে পরিশ্রান্ত থাকে, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চায়। ভাস্কর আর মৃণাল দুজনেই গাড়ি চালানোতে দক্ষ, কিন্তু অসীম ওদের হাতে কিছুতেই নিজের গাড়ি ছাড়বে না। কারণ ওরা ইংরিজিমতে গাড়ি চালায়, ফরাসি মতটা তার ঠিক উলটো। ফরাসি গাড়ির স্টিয়ারিং বাঁদিকে, ইংরিজি গাড়ির ডান দিকে। বস্তুত রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ শুধু ব্রিটেন, ভারত আর দু চারটে কলোনিতে ছাড়া সারা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
ভাস্করের সঙ্গে আমার অনেক রাত পর্যন্ত গল্প চলে।
প্রথম রাতে ভাস্কর একসময় আমাকে জিগ্যেস করল, হ্যাঁ রে, ওই লুদ গ্রামের মার্গারিট নামে মেয়েটার সঙ্গে তোর যদি সত্যিই দেখা হয়ে যেত, তা হলে তুই কী করতিস?
আমি চুপ করে রইলাম।
ভাস্কর আবার বলল, মেয়েটা তোকে এত ভালোবাসতো, সে বেঁচে থাকলে তোর সঙ্গে হঠাৎ সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে কেন? মেয়েটার সব কথা শুনে মনে হয়, এরকম করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি তবু চুপ করে রইলাম।
ভাস্কর বলল, এই পৃথিবীটা এত খারাপ হয়ে গেছে যে, যারা সত্যিকারের ভালো, তাদের যেন জায়গা নেই। আমাদের মতন তেয়োঁটে লোকরাই শুধু এখানে টিকে থাকতে পারে। মার্গারিটের জন্যই তুই ফ্রান্স এত ভালোবাসিস, তাই না?
এবার আমি হেসে বললাম, আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি সাঁওতাল পরগনা।
পরের রাতটা আমরা কাটালাম লাস্কোর কাছে এক গ্রামের মধ্যে। এবার কোনও হোটেলেও নয়, এক চাষির বাড়িতে।
দরদোন উপত্যকা পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম লাস্কোতে। এই অঞ্চলের প্রকৃতি দেখলে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময় জাগে। দরদোন-এর এমন সুবিশাল ও গভীর গিরিখাদ আমি আগে বা
পরে কখনও দেখিনি। আর লাস্কো, এখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র। বেশিদিন আগের কথা নয়, মাত্র এই ১৯৪০ সালে আদিম মানুষদের এই চিত্রসম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে। পাহাড় ও জঙ্গল এলাকা, চারটে ছেলে এখানে তাদের একটা হারানো কুকুর খুঁজতে-খুঁজতে লাস্কোর গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
সন্ধের পর আমরা পৌঁছলাম সেই অঞ্চলে। পরদিন গুহা দেখা হবে, আগে রাত্তিরের মতন থাকার ব্যবস্থা করা দরকার। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে উৎসাহী লোকেরা লাস্কোর গুহাচিত্র দেখতে আসে বলে এখানে নানারকম হোটেল আছে। রাস্তার ধারে ধারে গাছের গায়ে টাঙানো বিজ্ঞাপন দেখছিলাম, কোনও-কোনও চাষির বাড়িতেও রাত্রির শয্যা ও সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা আছে।
আমিই বেশি উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, হোটেলের বদলে চাষির বাড়িতে থাকব। ওদের জীবনযাপনটাও খানিকটা দেখা হবে। আমার এই প্রস্তাবে অসীম প্রথমে রাজি হতে চায়নি, কারণ মূল রাস্তা ছেড়ে অনেকটা ভেতরে যেতে হবে, লাস্কো গুহা দেখতে হলে যাওয়া-আসায় পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার বেশি লেগে যাবে। অনেক পীড়াপীড়িতে অসীম গাড়ি ঘোরাতে রাজি হল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই রাত্রিবাসে আমাদের হর্ষ-বিষাদ মিশ্রিত এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
চাষির বাড়িটি দোতলা, পাথরের। কাছাকাছি হাঁস-মুরগি রাখার জায়গা আর গোরুর গোয়াল। সবই বেশ পরিচ্ছন্ন। বেল বাজাতে দরজা খুললেন এক মধ্যবয়স্কা মহিলা। চাষির বউ বললে আমাদের মনে যে ছবি ফোটে তার সঙ্গে কোনও মিল নেই, বেশ ঝলমলে স্কার্ট পরা, এবং এখনও তাঁকে বেশ রূপসিই বলা যায়, মুখখানায় ভালো মানুষের ছাপ আছে, হাসিটি সহৃদয়। ইনি একবর্ণও ইংরিজি জানেন না, সুতরাং অসীমকেই কথাবার্তার ভার নিতে হল।
এঁদের বাড়িতে এঁরা গোটা চারেক ঘর রেখেছেন সারা বছরই ভাড়া দেওয়ার জন্য। জায়গাটার প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর, তা ছাড়া ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, তাই খদ্দেরও ঠিক জোটে। এখন ঠিক দু’টি ঘর খালি আছে। আমরা দোতলায় উঠে দেখলাম, ঘরগুলো সাধারণ হোটেলের চেয়েও অনেক ভালো সাজানো, বিরাট বিরাট খাট, পরিষ্কার শয্যা, সিল্কের ওয়াড় দেওয়া লেপ। ভাড়া কিন্তু হোটেলের চেয়ে কম। সকালবেলা এই মহিলাই আমাদের চা ও ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দেবেন, তার জন্য অতিরিক্ত কিছু লাগবে না। আমরা সবাই চোখে চোখে সম্মতি জানালাম।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ভাস্কর আর পারল না। মহিলার দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আই অ্যাম ভাস্কর ডাট। কামিং ফ্রম লন্ডন। ভেরি প্লিজড টু মিট ইউ! মহিলাটি হাসি মুখে বললেন, জ্য ন পার্ল পা অংলে! ইংরিজি জানি না। লন্ডনে কখনও যাইনি। আমার নাম ওদেৎ। আমার স্বামী দোকানপাট করতে গেছে, একটু বাদেই ফিরবে।
ভাষার ব্যবধান সত্বেও মহিলার সঙ্গে ভাস্করের ভাব জমে গেল। তিনি আমাদের কফি তৈরি করে খাওয়ালেন, এটা হিসেবের বাইরে। আগামীকাল সকালে উনি নিজেদের পালিত মুরগির ডিম খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এসব দেশে ফার্ম এগস রীতিমতন বিলাসিতার দ্রব্য।
গোলাবাড়িটার চারপাশ ঘুরে দেখতে-দেখতে আমার মনে হচ্ছিল, র্যাঁবোর মা, ভাই বোনেরা যে বাড়িতে থাকত, সেটাও কি এরকমই দেখতে ছিল? সেই বাড়িটাও কি ছিল দোতলা? এই চাষিদের অবস্থা বেশ সচ্ছলই তো মনে হয়। আমেরিকার চাষাদের দেখেছি বিরাট ধনী। সে-দেশে ক্ষুদ্র চাষি নেই-ই বলতে গেলে। আমি দেখিনি একটিও। আমাদের দেশের অধিকাংশ চাষি মাত্র দশ-পনেরো বিঘে জমি চাষ করে, তাও সেচের জল পায় না, প্রকৃতির ওপর নির্ভরতা অনেকখানি। এক একটি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য দু’পাঁচ বিঘে বিক্রি করে দিতে হয়। ফলে তারা দিন দিন দারিদ্যসীমার অনেক নীচে নেমে যায়।
হাত-মুখ ধুয়ে নৈশভোজের জন্য রেস্তোরাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ার পর অসীম বলল, এই লাস্কো জায়গাটা শুধু গুহাচিত্রের জন্যই বিখ্যাত নয়। একটা বিশেষ খাবরের জন্যও এই জায়গাটার খুব নাম আছে। তবে খাবারটা খুব দামি।
ভাস্কর বলল, যতই দাম হোক, স্থানীয় ভালো খাবার আর ভালো ওয়াইন খেতেই হবে। জিনিসটা কী?
অসীম বলল, ফোয়া গ্রা। তোমরা নাম শোনোনি?
আমরা তিনজনেই মাথা ঝাঁকালাম দু’দিকে। ভাস্কর বলল, কী রে সুনীল, তুই তো একটু-আধটু ফ্রেঞ্চ জানিস, তুইও শুনিসনি? তোর বান্ধবী মার্গারিট তোকে এই ফোয়া মোয়া কী বলছে অসীম, সেটা খাওয়ায়নি?
আমি বললাম, আমরা সেবার যখন প্যারিসে এসেছিলাম, আমাদের পয়সা খুবই কম ছিল, দামি খাবারের কথা চিন্তাও করিনি।
অসীম আমাদের ফোয়াগ্রা মাহাত্ম্য বুঝিয়ে দিল। তৈরির প্রক্রিয়াটি অতি নিষ্ঠুর ধরনের। এক ধরনের খয়েরি রঙের বড় বড় রাজহাঁসকে কয়েক দিন ধরে জোর করে খাবার খাওয়ানো হয়। তার ঠোঁট ফাঁক করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়ে শস্যের দানা। জোর করে গিলতে গিলতে একসময় হাঁসটার মুমূর্ষ দশা হয়। তখন তার পেট চিরে যার করে নেওয়া হয় শুধু লিভারটা। সেই লিভারটাই ওই বিশেষ খাদ্য, হাঁসের মাংসটা নয়। একটা হাঁসের লিভার আর কতটুকু, সেই জন্য ফোয়া গ্রা বানাবার জন্য অনেক হাঁস মারতে হয়।
জঙ্গলের মধ্যে একটা ছবির মতন সুশ্রী, নিরিবিলি রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম আমরা। প্রথমেই অর্ডার দেওয়া হল ফোয়াগ্রা আর বোরদো’র হোয়াইট ওয়াইন! ফোয়া গ্রা দিয়ে গেল নাপতে বাটির মতন ছোট্ট পোর্সলিনের কটিতে, দেখতে অনেকটা মাখনের মতন। পাতলা পাঁউরুটির টোস্টের ওপর ছোট ছোট টুকরোতে মাখিয়ে খেতে হয়। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বে দুলতে-দুলতে প্রথমবার মুখে দিলাম।
অনেক বিখ্যাত খাদ্যই প্রথমবার মুখে দিয়ে মনে হয়, দূর ছাই, এ আর এমন কী! এমন আমার হয়েছিল কাভিয়ের খেয়ে। আমি জীবনে প্রথম কাভিয়ের খাই লন্ডনে। কাস্পিয়ান হ্রদের স্টার্জন মাছের এই ডিমও পৃথিবীতে অতি দুর্মূল্য খাদ্য। প্রথমবার খেয়ে আমার মনে হয়েছিল, এর এত দাম? এর চেয়ে আমাদের ইলিশের ডিম অনেক ভালো। পরে রাশিয়াতে গিয়ে আমি আবার বেশ কয়েকবার কাভিয়ের খেয়ে তার টেস্ট অ্যাকোয়ার করেছিলাম। প্রথম যার শ্যাম্পেইন কিংবা রয়াল স্যালিউট আস্বাদ করেও আমাকে হতাশ হতে চেয়েছিল।
কিন্তু ফোয়া গ্রা প্রথম মুখে দিয়েই মনে হল, এমন সুস্বাদু দ্রব্য আগে কখনও খাইনি। মুখের মধ্যে যেন একটা আনন্দের উপলব্ধি ছড়িয়ে যায়।
ওইটুকু খাবার পাঁচ মিনিটে শেষ। ভাস্কর বলল, মুখে দিতে দিতেই যে মিলিয়ে গেল, অসীম, আবার অর্ডার দাও! আমি সব দাম দেব!
ওদেশে ওদের সুবিধে এই, পকেটে টাকা-কড়ি কম থাকলেও অসুবিধে নেই। যে কোনও জায়গায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যায়। গ্রামের রেস্তোরাঁও সেইসব কার্ড মান্য করে।
অসীম বলল, দামের জন্য নয়, বেশি ফোয়া গ্রা খেলে পেট গরম হতে পারে শুনেছি!
ভাস্কর বলল, গুলি মারো পেট গরম। আগে তো প্রাণ ঠান্ডা হোক।
আবার এল ফোয়া গ্রা। সেই সঙ্গে হোয়াইট ওয়াইন তো থাকবেই। এখানকার ওয়েটাররা এমন চালু যে কিছু একটা খাবারের অর্ডার দিলে অমনি জিগ্যেস করে, কী ওয়াইন দেব? যেন, সঙ্গে ওয়াইন পান না করাটা একটা বর্বরতা।
প্রায় ঘণ্টা দু-এক ধরে আমরা ডিনার খেলাম। পেট গরম কিংবা মাথা গরম হল কি না জানি না, মেজাজটা খুব ফুরফুরে হয়ে গেল। আকাশ ভরে গেছে জ্যোৎস্নায়। রেস্তোরাঁর মধ্যে অন্য আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে।
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই মিলে গান গাইতে ফিরলাম সেই চাষির বাড়ির দিকে।