প্যারিস শহরের বিখ্যাত রেল স্টেশন গার দু নর-এর অনুকরণে বুখারেস্ট-এর প্রধান রেল স্টেশনের নাম গারা দে নরড হলেও, আমি এর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনেরই মিল গেলাম বেশি। ইউরোপের আর কোনও স্টেশনে আমি এত মাল বইবার কুলি দেখিনি। হাওড়া স্টেশনে যেমন লাল জামা পরা লাইসেন্সড কুলি ছাড়াও আরও কিছু ছুটকো-ছাটকা লোক মাল বইবার কাজ করে এখানেও আমরা কামরা থেকে নামার পর সরকারি কুলিরা
এগিয়ে আসবার আগেই এক খোঁচা-খোঁচা দাড়ি ভরতি মুখ, প্রায় বৃদ্ধ, আমাদের দুটো সুটকেস তুলে নিয়ে দৌড় লাগাল।
ট্রেনে ভাস্কর দুটি গ্রিক মেয়ের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছিল, মেয়ে দুটি ভাঙা ভাঙা ইংরিজি জানে। আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও ভাস্কর বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। কারণ ইংরিজি বলা মানুষ খুঁজে বার করা খুব দুষ্কর। মেয়ে দুটি ডাক্তারির ছাত্রী, সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে বুখারেস্ট পড়তে এসেছে। এই মেয়ে দুটি আগেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল যে বুখারেস্ট রেল স্টেশনে চোর-জোচ্চোরের খুব উপদ্রব, পকেটের টাকাকড়ি সব সময় সামলে রাখতে হবে, নজরে না রাখলেই সুটকেস-ব্যাগ উধাও হয়ে যেতে পারে। হোটেল বাছতে হবে খুব দেখে শুনে, কারণ অধিকাংশ হোটেলই ঠকায়। রাস্তার কোনও লোক যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সাহায্য করতে আসে, তা হলে ধরে নিতে হবে, তার কোনও বদ মতলব আছে। এসব কথা আমাদের খুব অচেনা লাগে না।
সেই মালবাহক প্রৌঢ়ের পিছু পিছু ছুটলাম আমরা। কত ভাড়া দিতে হবে, তা আমাদের আন্দাজ নেই, খুচরো দু-চার ডলার দিতেই সে খুব কৃতজ্ঞ ভঙ্গি করল। পরে জেনেছি, এখানকার মধ্যবিত্তদের মাসিক উপার্জন একশো ডলারের মতন।
গ্রিক মেয়ে দুটি আমাদের বিশ্বাসযোগ্য হোটেল খুঁজে দিতে সাহায্য করতে চেয়েছিল, কিন্তু কাছাকাছি একটা টুরিস্ট অফিস দেখে অসীম বলল, আগে ওদের কাছ থেকেই সন্ধান নেওয়া উচিত। আমি আর বাদল রইলাম মাল পাহারা দিতে, বাকিরা চলে গেল সেদিকে। তারপর বেশ কিছু সময় চলে গেল। স্টেশনে বেশ কিছু লোক এমনিই ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনে হয় যেন অলস, বেকার। কেউ-কেউ আমাদের কাছাকাছি এসে বসছে। আবার উঠে যাচ্ছে, কেউ একটু দূর থেকে তেরছাভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমি ভাবছি, এর মধ্যে কেউ কি আমাদের কোনও ব্যাগ তুলে নিয়ে পালাবার মতলব আঁটছে? কেউ খুব কাছ ঘেঁষে এলে আমি বেশি সতর্ক হয়ে উঠছি। এক সময় আমার মনে হল, এরকমভাবে সব লোককে সন্দেহ করা অতি বিশ্রী ব্যাপার। দু-চারটি ছ্যাঁচড়া-ছিনতাইবাজ থাকতে পারে, বাকিরা অবশ্যই সাধারণ, ভদ্র মানুষ। কিন্তু রুমানিয়া সম্পর্কে আগে থেকে এত সাবধান বাণী শুনেছি যে সকলকেই যেন অবিশ্বাস করতে হয়, আবার মনের মধ্যে মানুষ সম্পর্কে এরকম অবিশ্বাস পুষে রাখতেও খারাপ লাগে। আমি অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করলাম। জানি যে, বাদলের অতি সতর্ক নজর এড়িয়ে আমাদের কোনও জিনিসে কারুর হাত ছোঁওয়াবার সাধ্য নেই।
খানিক বাদে অসীম সদলবলে ফিরে এল, সঙ্গে একজন গোলগাল, মাঝ বয়সি মহিলা যুক্ত হয়েছে। বার্তা এই যে, পর্যটক দফতর থেকে জানা গেছে, শহরের কোনও হোটেল খালি নেই, কারণ এখানে ট্রেড ফেয়ার আছে। একমাত্র উপায়, কারুর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকা। ওই দফতর থেকেই একজন মহিলাকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, তার বাড়িতে চার জনের স্থান হবে।
মহিলার নাম মাদাম দিদা। তাঁর ইংরিজি জ্ঞান দশ-বারোটি শব্দে সীমাবদ্ধ। তাতেই কাজ চলে যাবে। ট্যাক্সিতে অনেক রাস্তা ঘুরে আমরা তার বাড়িতে পৌঁছোলাম। এই এলাকার চতুর্দিকেই ফ্ল্যাট বাড়ি। এরকম এলাকা আজকাল পৃথিবীর সব শহরেই দেখা যায়। একই ধাঁচের সব বাড়ি, ভেতরে খুপরি এলাকা আজকাল পৃথিবীর সব শহরেই দেখা যায়। একই ধাঁচের সব বাড়ি, ভেতরে খুপরি খুপরি ফ্ল্যাট। দু-খানা ছোট ছোট শয়নকক্ষ, একটি বসবার ঘর, রান্না ঘর ও বাথরুম। এই ফ্ল্যাটটার বিশদ বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বাথরুমের ফ্লাশ কাজ করে না। রং করা টিনের বাথটবের মধ্যে একটা বালতি। ইউরোপের আর কোনও দেশে আমি বালতি নামক বস্তুটি আগে দেখিনি। সভ্য দেশে চব্বিশ ঘণ্টাই কলে জল থাকে, সুতরাং বালতির প্রয়োজন কী? এই বালতিতে জল নিয়ে কমোড পরিষ্কার করতে হবে। সব সভ্য দেশেই দুটি কল থাকে, একটি দিয়ে অবিরাম গরম জল পাওয়ার কথা। এখানে অনেক সময় কোনও কলেই জল থাকে না। একটা সরু টয়লেট পেপারের রোল রয়েছে। সেটাও মনে হয় নেহাৎ সাজাবার জন্য, তাও মোটা হলদে ও শিরিষ কাগজের মতন খসখসে। অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দেশেই টয়লেট পেপার অতি নিম্ন মানের। রুমানিয়াতে এই বস্তুও খুব দুর্লভ। এই সব দেশের লোক ইংল্যান্ড-ফ্রান্সে বেড়াতে গেলে নিশ্চয়ই ভাববে, কেন তাদের দেশ এই অতি প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিসটিও বানাতে পারে না? ভাস্কর নিজের পশ্চাদদেশের প্রতি মায়াবশত বিলেত থেকে ভালো জাতের টয়লেট পেপার সঙ্গে এনেছে। মোট কথা, আমাদের যে কোনও মধ্যবিত্ত বাড়ির তুলনাতেও এ বাড়ির বাথরুম বেশ খারাপ।
মাদাম দিদা বিধবা, তাঁর স্বামী কেমিস্ট ছিলেন, বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। সতেরো-আঠারো বছরের একটি মাত্র ছেলে তাঁর সঙ্গেই থাকে। ফ্ল্যাটটাতে ঢুকেই মনে হয়েছিল, এখানে আমাদের চারজনের জায়গা হবে কী করে? ছেলের ঘরে একটি সিঙ্গল খাট, অন্য ঘরের খাটটি নব-বিবাহিতের পক্ষে আদর্শ হলেও দুজন পুরুষের পক্ষে অনুপযুক্ত। বসবার ঘরের সোফাটি টেনে নিলে একজনের বিছানা হতে পারে। তা হলে চতুর্থজন শোবে কোথায়? মাদাম দিদা জানালেন যে বাকি একজনের জন্য মেঝেতে বিছানা পেতে দেওয়া হবে। বসবার ঘরের মেঝেতে রয়েছে একটা নোংরা, ক্ষয়ে যাওয়া কার্পেট।
ব্যবস্থা দেখে ভাস্কর খেপে উঠল। আমাদের মাথাপিছু দৈনিক কুড়ি ডলার দিতে হবে। সমস্ত কাগজপত্রে লেখা আছে যে কুড়ি ডলারে এখানকার প্রথম শ্রেণির হোটেলে ঘর পাওয়ার কথা। এত টাকা খরচ করেও আমরা এত কষ্ট সহ্য করতে যাব কেন?
এতটুকু ছোট ফ্ল্যাটে চারজন আত্মীয় এসে পড়লেও স্থান সংকুলান হওয়ার কথা নয়। তবু চারজন পেয়িংগেস্টকে নিয়ে আসা হল। কেন? বাড়িতে বিদেশি অতিথি রাখার জন্য নিশ্চয়ই লাইসেন্স লাগে, সরকারের পক্ষ থেকে এসব বাড়ি পরিদর্শন করার ব্যবস্থা নেই! এর আগে অন্যান্য দেশেও আমরা পেয়িংগেস্ট হয়ে থেকেছি, সে সব জায়গায় অতিথিদের কী কী সুবিধে দেওয়া হবে, তার একটা নির্দিষ্ট তালিকা থাকে। বুডাপেস্টেও আমরা এর চেয়ে অন্তত দশগুণ আরামে ছিলাম।
আমাদের উম্মা দেখে মাদাম দিদা শেষ পর্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে স্বীকার করলেন যে, আসলে তাঁর লাইসেন্স মাত্র দুজন অতিথি রাখার জন্য। কিন্তু আমাদের চারজনকে দেখে লোভে পড়ে তিনি নিয়ে এসেছেন। আমাদের স্থান দেওয়ার জন্য তাঁকে শুতে হবে রান্নাঘরে, ছেলেকে পাঠাতে হবে অন্য বাড়িতে।
শুধু তাই নয়, পরে আমরা শহর ঘুরে জেনেছিলাম, অনেক হোটেলের ঘর খালি আছে, টুরিস্ট দফতরের কর্মীটি আমাদের মিথ্যে কথা বলেছিল। নিশ্চিত তার সঙ্গে মাদাম দিদার কমিশনের ব্যবস্থা আছে।
আমরা সহজেই বাসস্থান পালটে ফেলতে পারতাম, কিন্তু আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম, এই ক্ষুদ্র রুমানিয়ায় পরিবারটি নিছক দারিদ্র্যের জন্যই এমন লোভী হয়েছে এবং নিজেরাও অনেক অসুবিধে ভোগ করছে, আমাদেরও খানিকটা মেনে নিয়ে এদের সাহায্য করাই উচিত।
বাদল বলল, চার-পাঁচদিন থাকব, কী আর এমন কষ্ট হবে। হোটেলে থাকার চেয়ে কারুর বাড়িতে থাকা অনেক ভালো। অসীমেরও সে রকমই হত। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভাস্করকে ঠান্ডা করা হল।
চারজনের মধ্যে মেঝেতে কে শোবে, সেটা ঠিক করা মুশকিল, কারণ প্রত্যেকেই রাজি, তাই লটারি করা হল এবং বলাই বাহুল্য এই দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী হলাম আমিই!
মেঝেতে শুতে আমার মোটেই খারাপ লাগে না, তবে বারান্দার দিকের দরজার তলা দিয়ে একটা শিরশিরে বাতাস এসে বড় জ্বালাতন করল সারারাত। শীতের রাতেও ঘর গরম করা যাবে না, একটা রুম হিটার থাকলেও সেটার ব্যবহার নিষিদ্ধ। এখনও অবশ্য শূন্যের দিকে পারদ নামেনি, কিন্তু ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। তখনও বুখারেস্টের মানুষ বিদ্যুতের অভাবে ঘর গরম করতে পারেনি, ইউরোপের অন্য কোনও দেশে এ অবস্থা অকল্পনীয়।
‘লোডশেডিং’ এই বাক্যবন্ধ নিতান্তই পশ্চিমবঙ্গীয় ইংরিজি, কিন্তু এই ব্যাপারটিতে বুখারেস্ট শহর অনায়াসেই কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এখানকার অনেক রাস্তায় আলো থাকে না। এমনকি পরে আমরা এয়ারপোর্টেও অন্ধকার দেখেছি। তবে লাইন দেওয়ার প্রতিযোগিতায় সাম্প্রতিক বুখারেস্ট কলকাতার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। আমরা পাউরুটি, চিনি, কেরোসিন, ডিজেলের লম্বা লাইন দেখেছি কলকাতায়, এখানে সর্বত্র লাইন, কোনটা যে কীসের জন্য, তা বোঝা দুষ্কর। লাইনে যারা দাঁড়ায়, তারাও অনেক সময় জানে না। পথ চলতি মানুষ কোনও একটা দোকানের সামনে লাইন দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে, কিছু একটা তো পাওয়া যাবে। বর্তমানে এখানে অপ্রাপ্য দ্রব্যের তালিকা বিশাল। দুধ-মাছ-মাংস থেকে টয়লেট পেপার পর্যন্ত। দুধ নেই, সুতরাং আইসক্রিমও নেই। হাঙ্গেরিতে সব দোকানে আইসক্রিম দেখেছি, পাশের দেশ রুমানিয়ায় আইসক্রিম অদৃশ্য। আমরা স্কুলে পড়বার পর স্কুল-গেটের সামনে এক রকম জিনিস পাওয়া যেত, গুঁড়ো করা বরফের মধ্যে লাল বা নীল রঙের একটু সিরাপ মেশানো, সেটাই চেটে চেটে খেতাম। অনেকদিন পর সেই জিনিস দেখলাম রুমানিয়ায়, ক্রিমবিহীন আইসক্রিম, বয়স্ক লোকেরাও তাই-ই খাচ্ছে।
একদিন এখানকার মেট্রো রেলে রাত্তিরবেলা চলন্ত কামরার মধ্যে মুরগির ডাক শুনে চমকে উঠেছিলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, কোনও চ্যাংড়া ছেলে বুঝি ইয়ারকি করছে। দু তিনবার শোনার পর লক্ষ করে দেখি, সত্যিই একজন লোক তার কোটের আড়ালে ঢেকে একটা জ্যান্ত মুরগি নিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের ট্রেনে জ্যান্ত মুরগি? অন্য কারুর মুখে এ ঘটনা শুনলে আমি বিশ্বাস করতাম না। এখানে মুরগি এখন এতই দুর্লভ যে একজন কেউ কোনওক্রমে একটা যোগাড় করে এই অবস্থাতেই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য যাত্রীরা তার দিকে তাকাচ্ছে ঈর্ষার চোখে। সকালবেলা মেট্রোয় যেতে-যেতে দেখেছি, অনেক অফিসযাত্রীর ফিটফাট পোশাক, গলায় টাই রয়েছে বটে, কিন্তু গালে দু-তিন দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সাহেব জাতি দাড়ি রাখে, অথবা প্রতিদিন দাড়ি কামায়, এত লোক খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে অফিস যায়, এমন আগে দেখিনি। স্থানীয় একজনকে কারণটা জিগ্যেস করায় সে বলেছিল, ব্লেড পাওয়া যাচ্ছে না। ওদের মুখের কাছে গিয়ে কথা বলো না, কারণ টুথপেস্টও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকে দাঁতও মাজে না।
রুমানিয়ানরা শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-দর্শন-জ্ঞান চর্চায় যথেষ্ট উন্নত। সেই জাতির এরকম শোচনীয় অবস্থা কেন? শুধু আজ নয়, পাঁচ-সাত বছর ধরেই নানা অনটন চলছে। এর জন্য দায়ী শুধু চাউসেস্কু আর তার দলবল? এই দুষ্টচক্রকে নিবৃত্ত করার কোনও উপায় এখানকার রাষ্ট্রব্যবস্থায় ছিল না?
রুমানিয়ার চাষিরা এক সময় যথেষ্ট সম্পন্ন ছিল। ১৯৬৫ সালের সংবিধানে সমস্ত চাষের জমিকে সামাজিক সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে চাষিদের বাধ্য করা হয় রাষ্ট্রীয় খামার কিংবা সমবায়ে যোগ দিতে। চাষিদের মনস্তত্বের কোনও গুরুত্ব দেওয়া হল না, সমাজতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তোলার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হল না, একটা ব্যবস্থা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হল ওপর থেকে। সব কিছু চলতে লাগল এক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায়, যা আসলে সমাজতন্ত্র-বিরোধী।
রুমানিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল চাউসেস্কু আর একটা উদ্ভট কাণ্ড করেছিলেন। গ্রামের চাষিদের বাড়িঘর ভেঙে-গুড়িয়ে সেখানে তৈরি করিয়েছিলেন লম্বা লম্বা ফ্ল্যাটবাড়ি। যে-সব চাষিরা নিজস্ব বাড়িতে ফুলগাছ-টমেটো গাছ, গোরু-ছাগল-মুরগি নিয়ে থাকত, তারা সেইসব নিয়ে উঠে যাবে দশতলার ফ্ল্যাটে? যত ছোটই হোক, তবু একটি পরিবারের নিজস্ব বাসস্থান নির্বাচন ও ইচ্ছেমতন সাজাবার স্বাধীনতাটুকুও যদি না থাকে, তবে তা কীসের সাম্যবাদ।
দ্রুত বড় বড় কলকারখানা স্থাপন করে দেশটাকে শিল্পোন্নত করার ঝোঁকে কৃষি মার খেয়েছে। ড্যানিয়ুব নদী থেকে বিশাল খাল কাটা কিংবা বুখারেস্টে মেট্রো রেল বানাবার জন্য এত অর্থের বিনিয়োগ হয়েছে যা দেশের অর্থনীতির পক্ষে অনুপযুক্ত। তবু এ দেশের জাতীয় উৎপাদনের একত্রিশ ভাগই কৃষিদ্রব্য, সুতরাং দেশের মানুষের খাদ্যাভাব থাকার কথা ছিল না। কিন্তু রুমানিয়ার সরকার বিদেশি মুদ্রা অর্জনের জন্য খাদ্যদ্রব্য, পেট্রল, খনিজ অন্যান্য দেশে চালান দিয়ে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করেছে বছরের পর বছর। কাগজেকলমে দেখানো হত যে এই সব রপ্তানি করে রুমানিয়ার বৈদেশিক ঋণ অনেক কমিয়ে ফেলা হয়েছে, এখন অবশ্য প্রকাশ পাচ্ছে যে, ওইসব বিদেশি মুদ্রা দিয়ে চাউসেস্কু আর তার পত্নী অঢেল ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়েছে, বাথরুমে পর্যন্ত নিয়েছে সোনার কল।
হাঙ্গেরিতে থাকার সময় আমরা লক্ষ করেছি, রুমানিয়ার সাধারণ মানুষদের এ রকম দুরবস্থা নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং রুমানিয়ানদের সম্পর্কে হাঙ্গেরিতে অবজ্ঞা বা বিদ্বেষের ভাব বেশ প্রবল। ট্রানসিলভানিয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা ক্ষত আছে বটে, কিন্তু এই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের সাধারণ মানুষও পরস্পরের প্রতি কোনও সমভ্রাতৃত্ব বোধ করে না? শ্রেণিহীন সমাজের আদর্শ যারা গড়তে চায়, সেখানেও জাতিভেদ!
হাঙ্গেরিতে একজনও বাঙালি বা ভারতীয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। একদিকে বাঙালিদের ঘরকুনো বলে বদনাম আছে, আবার পৃথিবীর বহু দুর্গম অঞ্চলেও বাঙালির সন্ধান পাওয়া যায়। আফ্রিকার নাইরোৰি শহরের টিমে আমি একজন বাঙালির নাম দেখেছিলাম। আমার দেখা জায়গাগুলোর মধ্যে শুধু বুলগেরিয়া আর সাংহাই শহরে কোনও বাঙালির খোঁজ পাইনি। অতিশয় জনবহুল সাংহাই শহরে কোনও ভারতীয়ের সন্ধান পাওয়াও দুষ্কর। হাঙ্গেরিতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-চারজন ভারতীয় আছে বটে, কিন্তু কেউ তাদের ঠিকানা বলতে পারেনি, ভারতীয় দূতাবাসে ফোন করেও কিছু সুবিধে হয়নি।
রুমানিয়ায় এসে আমরা আমাদের দূতাবাসে ফোন করে কোনও ভারতীয়ের সন্ধান চাইলাম। ওঁরা যে মহিলার নাম ও ঠিকানা দিলেন, তিনি একজন বাঙালি। গোটা রুমানিয়ায় দূতাবাসের বাইরে ভারতীয় বলতেও ওই একজনই। শ্রীমতী অমিতা বসুর নামের সঙ্গে আমরা আগেই পরিচিত, তিনি একজন লেখিকা, ‘দেশ’-’আনন্দবাজারে’ তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের ফোন পেয়েই অমিতা বসু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আপনারা যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন, আমি আপনাদের কাছে চলে আসছি।
অমিতা বসু অনেক বছর আগে তাঁর স্বামীর সঙ্গে এসেছিলেন এ দেশে। স্বামী এসেছিলেন চাকরির সূত্রে, অমিতা অবসর সময়ে রুমানিয়ার ভাষা শিখে নিয়েছিলেন, তারপর ওই ভাষা থেকে কিছু কিছু অনুবাদ করেন বাংলায়। বছর দু-আড়াই বাদে এই দম্পতি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। কিছুদিন বাদে অমিতা আবার একা রুমানিয়াতে যান একটা অনুবাদক-সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে। তারপর থেকে তিনি এই দেশের সঙ্গে যেন একটা অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে অমিতা এখানে একা-একা রয়ে গেছেন দীর্ঘকাল। চাউসেস্কুর আমলের যাবতীয় কাণ্ডকারখানা ও গণঅভ্যুত্থান তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, চরম দুঃসময়ে আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন।
গত শতাব্দীর রুমানিয়ার প্রখ্যাত কবি, বলা যায় রুমানিয়ার জাতীয় কবি মিহাইল এমিনেস্কু-কে নিয়ে গবেষণা করেছেন অমিতা। মিহাইল এমিনেস্কুর খ্যাতি এখন আন্তর্জাতিক, যদিও আমাদের বাংলাতে তেমন পরিচিত নন। এই কবি বেঁচেছিলেন মাত্র ঊনচল্লিশ বছর, লিখেছেনও খুব কম, তাতেই তিনি চিরস্মরণীয়। রুমানিয়ায় ভাষা ল্যাটিন ভাষার অন্তর্গত, কিছু কিছু শ্লাভিক শব্দ এর মধ্যে ঢুকে গেলেও এই ভাষার আত্মীয়তা অনেকটাই ফরাসি-ইতালিয়ানের সঙ্গে। এখানকার কবি-সাহিত্যিকরা এককালে পশ্চিম ইউরোপের সাহিত্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, কেউ কেউ পশ্চিমি সাহিত্যকেও মাতিয়েছেন। ফ্রান্সে সিম্বলিজম-এর পূর্ববর্তী যে ডাডাইজম, তার অন্যতম প্রবক্তা ত্ৰিস্তান জারার জন্ম রুমানিয়ায়। একালের বিখ্যাত নাট্যকার ইউজিন আয়েনেস্কোও রুমানিয়ান। আমাদের জানাশোনা সাহিত্য পরিধির মধ্যে আরও দুটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। রোমান আমলে সম্রাট অকটোভিয়ান অগাস্টাস মহান ল্যাটিন কবি ওভিদ-এর ওপর রাগ করে তাঁকে রুমানিয়ার কৃষ্ণ উপসাগরের তীরে নির্বাসন দিয়েছিলেন। আর পঞ্চদশ শতাব্দীতে এখানকারই এক পরগণার রাজকুমার শত্রুদের ছিন্নমুণ্ড বর্শার ডগায় গেঁথে, কোনও রাসায়নিক দ্রব্য মাখিয়ে জীবন্তর মতন করে রাখতেন। তাঁকে নিয়েই কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প প্রচলিত হয়, আয়ার্ল্যান্ডের ঔপন্যাসিক এই চরিত্রটি নিয়ে ভ্যাম্পায়ারের গল্প লিখে বিখ্যাত হন।
মিহাইল এমিনেস্কু অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ফরাসি সাহিত্য থেকে। আবার রুমানিয়ার প্রাচীন গাথা ও উপকথা, দেশের মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকসাহিত্যের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। এই দুই ধারা মিশিয়ে তিনি রুমানিয়ান সাহিত্যে এক নতুন রূপ এনে দেন। দুঃখের বিষয়, এই প্রতিভাবান কবি বেশিদিন বাঁচলেন না, ব্যর্থ প্রেম, পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা, নৈরাশ্যবোধ থেকে শেষপর্যন্ত এক পাগলাগারদে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পরেও ফরাসি সাহিত্য ও রুমানিয়ার লোকসাহিত্যের একটা মিশ্র রূপ এখানে চলে আসছিল, পরবর্তীকালে অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব যথেষ্ট দেখা যায়।
অমিতা বসু এখানে একজন এমিনেস্কু বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। আবার রবীন্দ্রনাথকে এ-দেশের মানুষের কাছে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত করার জন্য তিনি রবীন্দ্র রচনাবলি অনুবাদেও হাত দিয়েছেন। রুমানিয়াব ও বাংলা, এই দু-ভাষাতে লেখাতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। এখানকার বাংলার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তিনি বাংলা-রুমানিয়ায় অভিধান একটা তৈরি করেছেন, সেটা খুবই মূল্যবান কাজ।
এক সময় আমি জিগ্যেস করলাম, আপনার বাংলা বিভাগ কেমন চলছে? ক’জন ছাত্রছাত্রী?
উত্তর না দিয়ে তিনি চুপ করে চেয়ে রইলেন।
আমাদের ডাক শুনে চলে আসবার পর অমিতার সঙ্গে অল্পক্ষণেই ভাব জমে গেল। শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি সবদিকেই সজাগ এই মহিলার রসিকতাবোধ খুব প্রবল। আমাদের সঙ্গে নিয়ে বুখারেস্ট শহরটি দেখাবার সময় তিনি গত বছরের ভয়াবহ দিনগুলির কথা বলতে-বলতে নানারকম কৌতুক কাহিনিও শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু লক্ষ করছিলাম, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলতে চান না। সে বিষয়ে প্রশ্নও করা যায় না। একবার শুধু বলেছিলেন, আপনারা চরজন বাঙালি এসেছেন, আপনাদের তো একদিন আমার ফ্ল্যাটে রান্না করে খাওয়ানো উচিত। কিন্তু কিছুই যে পাওয়া যায় না এখানে।
বাংলা বিভাগ সম্পর্কে আমার কৌতূহলের উত্তরে, একটু সময় নিয়ে, নির্লিপ্ত গলায় তিনি বললেন, এখন বুখারেস্টে কোনও বাংলা বিভাগ নেই। উঠে গেছে!
বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও হিন্দি পড়াবার ব্যবস্থা ছিল। গত এক-দেড় বছর ধরে হিন্দির কোনও অধ্যাপক ছিল না, হিন্দি জানা এক রুমানিয়ান মহিলা সেই ক্লাস নিচ্ছিলেন। তা নিয়ে আমাদের দূতাবাসের হিন্দিওয়ালাদের খুব মাথাব্যথা দেখা দিল। হিন্দির কেউ নেই, অথচ বাংলার একজন দেশি অধ্যাপিকা রয়েছে, এ কখনও হতে পারে? হিন্দি রাষ্ট্রভাষা, হিন্দির দাবি আগে! হিন্দি প্রেমিকারা এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বারবার উত্যক্ত করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা-হিন্দি দুটো বিভাগই তুলে দিয়েছেন।
অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন অমিতার কোনও জীবিকা নেই।
এরপর যে প্রশ্নটা আমাদের সকলেরই মনে এসেছিল সেটা অসীম জিগ্যেস করল, চাকরি নেই, তা হলে আপনি এখানে চালাবেন কী করে?
অমিতা বললেন, যেমন করে হোক আমি চালাব। দেশে ফিরব না। আমার ছাত্র ছাত্রীরা আমাকে ভালোবাসে। চরম বিপদ আর দুঃখের দিনগুলিতে আমি ওদের সঙ্গে থেকেছি। এখন ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারব না। শেষপর্যন্ত কী হয়, আমি দেখতে চাই।
আস্তে-আস্তে কথা বললেও তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা তীব্র জেদ ফুটে ওঠে। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এমন সাহসিনী খুব কমই দেখা যায়।