একজন শীর্ণকায় প্রৌঢ় ব্যক্তি এলেন একটু পরে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় অধ্যাপক। গাড়ি-ঘটিত কারণে দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি আমার দিকে ফিরে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, নমস্কার, কেমন আছেন?
সুদূর রিগা শহরে বসে একজন ল্যাটভিয়ান অধ্যাপকের মুখে বাংলা ভাষা শুনলে রোমাঞ্চিত হতেই হয়।
এঁর নাম ভিকটর ইভবুলিস, ইনি ল্যাটভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কোনও সরকারি প্রয়োজনে বাংলা শেখেননি। শিখেছেন নিজের আগ্রহে, মূল বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ পড়বার জন্য।
আলেকজান্ডারের গুরু তাঁকে বলেছিলেন, তুমি যেখানেই যাও, যত কিছুই দেখো, শেষ পর্যন্ত দেখবে মানুষের চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছুই নেই! ছোট্ট দেশ ল্যাটভিয়া, যার জনসংখ্যাই মাত্র পঁচিশ লাখ, সেখানকার একজন মানুষ প্রাচ্যের কবি রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করবার জন্য বাংলার মতন একটি দুরূহ ভাষা শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, এটা বিস্ময়কর নয়?
খাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে নানারকম গল্প হতে লাগল। আজ একেবারে ফুল কোর্স লাঞ্চ। সুপ দিয়ে আরম্ভ, সুইট ডিস দিয়ে শেষ, সঙ্গে ওয়াইন। এখানকার খাবারে প্রথম দিকে থাকে দু-একটি কোল্ড ডিস, অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের চিজ, হ্যাম, স্মোকড ফিস, কয়েক রকমের স্যালাড। তারপর আসে মেইন ডিস বা হট ডিস, রোস্ট চিকেন বা বিফের নানারকম রূপান্তর, বড়-বড় মাছও পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ইভবুলিস মাঝে-মাঝে আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলছেন, অন্যদের সঙ্গে কখনও ইংরিজিতে, কখনও রাশিয়ানে; এ ছাড়া তিনি ফরাসি ও জার্মান জানেন, তাঁর মাতৃভাষা ল্যাটভিয়ান। ইনি মাতৃভাষায় রবীন্দ্রনাথের ওপর বই লিখেছেন, পরে তা রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিছুদিনের জন্য শান্তিনিকেতনেও থেকে গেছেন কয়েক বছর আগে, কলকাতা সম্পর্কে ওঁর অভিজ্ঞতা বেশ মজার। উনি যখন কলকাতায় আসেন, সেই বছরেই কলকাতায় বন্যা হয়েছিল, তিন-চারদিন পথ-ঘাট ও অনেক বাড়িই বেশ খানিকটা জলের তলায় ছিল।
অন্যরা আমাদের কথাবার্তা কৌতূহলের সঙ্গে শুনছিলেন, একজন জানতে চাইলেন, আচ্ছা, তোমাদের কলকাতাতেই তো মেট্রোরেল হচ্ছে?
এই নিয়ে এই প্রশ্ন আমি তিনবার শুনলুম বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতার উল্লেখ শুনেই কেউ কেউ এই কথাটা জিগ্যেস করেন। যেন এটাই কলকাতার একমাত্র পরিচয়। পৃথিবীর বহু শহরেই মেট্রো রেল আছে, সুতরাং কলকাতায় মেট্রোরেল হওয়া এমনকী বিশেষ সংবাদ?
পালটা প্রশ্ন করে আমি ব্যাপারটা জেনে নিলুম। আসলে, কলকাতা সম্পর্কে বিশেষ কিছুই কেউ জানে না। তবে আমাদের মেট্রো রেলের প্রাথমিক স্তরে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা এসে নানারকম সুপরিশ করেছেন, মস্কো শহরের মাটির সঙ্গে কলকাতার মাটির খানিকটা মিল আছে বলে কোন ধরনের পাতাল রেল এখানে উপযোগী হবে, সে ব্যাপারে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা পরিকল্পনায় সাহায্যে করেছেন, সেই খবর এখানকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সুতরাং কলকাতা সম্পর্কে অনেকে শুধু ওই সংবাদটাই জানে।
আমি বললুম, কলকাতায় বন্যা হয়েছিল শুনে আপনারা ভাবছেন পাতাল রেল চালু হওয়ার পর আবার যদি বন্যা হয়, তখন কী হবে? তখন কী যে হবে, তা আমিও জানি না!
অধ্যাপক ইভবুলিস বললেন, কলকাতার যানবাহনে অনেক গোলমাল, আলোর ব্যবস্থা বড়ই খারাপ…।
বাংলাভাষা-প্রেমিক এই ল্যাটভিয়ান অধ্যাপক কলকাতায় এসে যে অনেক অসুবিধে ভোগ করেছেন তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে দুঃখের সুর ছিল, অভিযোগের নয়।
আমাকে আরও চমকে দিয়ে তিনি এরপরেই বললেন, আপনাদের ‘দেশ’ পত্রিকা আমি মাঝে মাঝে পড়ি। দেশ পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লেখা হয়েছে, সে সংখ্যাটিও আমার কাছে আছে।
বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী এসেছিলেন এই রিগা শহরে, অধ্যাপক ইভবুলিসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। রিগা-র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন দেশ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায়, সে লেখাটি আমিও পড়েছিলাম, তবে অনেকদিন আগের কথা, ভালো মনে নেই।
অধ্যাপক ইভবুলিস তাঁর বাড়িতে সন্ধেবেলা আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। দুপুরে হোটেলে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে এবং বিকেলবেলা শহরটায় খানিকটা ঘোরাঘুরি করে তারপর যখন নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, তখন সারগেই বলল, একটু দাঁড়ান, সুনীলজি!
দৌড়ে সে কোথায় চলে গেল, একটু বাদেই সে ফিরে এল কয়েকটি ফুল নিয়ে। তুষারশুভ্র কয়েকটি টিউলিপ ফুল, সেলোফিন কাগজে সুন্দর করে মোড়া। সারগেই বলল, অধ্যাপকের স্ত্রীর হাতে আপনি এটা দেবেন।
এর আগে রাস্তায় অনেককেই আমি এরকম ফুল হাতে নিয়ে যেতে দেখেছি। বড় বড় মোড়ে ফুলের দোকান। এদেশে কারুর বাড়িতে দেখা করতে গেলেই ফুল নিয়ে যাওয়া প্রথা। বিমান-যাত্রীদেরও আমি ফুল নিয়ে নামতে দেখেছি, প্রিয়জনের সঙ্গে প্রথম দেখা হতেই আগে তার হাতে ফুল তুলে দেয়। গাদাগুচ্ছের ফুল নয়, একটি বা দুটি বা তিনটি।
সোভিয়েত দেশে প্রত্যেক শহরেরই বাইরের দিকে প্রচুর ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছে। প্রায় একই রকম চেহারা। সারা দেশের প্রতিটি পরিবারকে ফ্ল্যাট দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন সরকার, সে তো এক বিস্ময়কর, বিরাট কর্মযজ্ঞের ব্যাপার।
সারগেই আগে কখনও রিগা শহরে আসেনি, তার পক্ষে ঠিকানা খুঁজে যার করা কঠিন হত, তাই এ পি এন-এর একজন প্রতিনিধি নিয়ে এলেন আমাদের। তবু যাতে আমাদের চিনতে অসুবিধে না হয় সেইজন্য অধ্যাপক ইভবুলিস নিজেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তায়।
স্বাভাবিক কারণেই এইসব ফ্ল্যাটবাড়িগুলি বহুতল। ছোট-ছোট লিফট, এক সঙ্গে তিনজনের বেশি ধরে না। একজনকে অপেক্ষা করতে হবে, অধ্যাপক ইভবুলিস নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের আগে তুলে দিলেন।
আগেই জেনেছিলুম, অধ্যাপকের স্ত্রী মাদাম আর্তা দুমপেই একজন নামকরা ভাস্কর। দরজা যিনি খুললেন, তিনি একজন সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী রমণী, যৌবন এখনও উত্তীর্ণ হয়নি। আমি তাঁর হাতে ফুল তুলে দিতেই তিনি সহাস্যে আমাদের ভেতরে আহ্বান জানালেন।
প্রথমেই আমরা দেখতে গেলুম তাঁর স্টুডিও। সেখানে পা দেওয়া মাত্র ডানদিকের একটি মূর্তি দেখিয়ে অধ্যাপক ইভবুলিস জিগ্যেস করলেন, এটা কার, চিনতে পারেন?
আর একটি চমক। মূর্তিটি রবীন্দ্রনাথের।
ঘরে ছোট-বড় অনেক ভাস্কর্যের প্লাস্টার কাস্টিং রয়েছে, কিছু-কিছু মূর্তি অসমাপ্ত। বাস্তবানুগ কাজও যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক বিমূর্ত কাজ, নানান আকারের নারী মূর্তিও রয়েছে অনেক। কাজগুলির মধ্যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে মিশে আছে কাব্য সুষমা। বেশ বড় একটা হল ভরতি মূর্তিগুলি ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগলুম আমরা।
ঘরটির ছাদ সাধারণ ঘরের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ উঁচুতে, ওপরের স্কাই লাইট দিয়ে আসছে প্রচুর আলো। একজন শিল্পীর স্টুডিও-র পক্ষে একেবারে আদর্শ। সাধারণ ফ্ল্যাট বাড়ির কোনও অ্যাপার্টমেন্ট কি এই রকম হয়!
এ বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতেই অধ্যাপক ইভবুলিস বললেন, তাঁদের সরকার তাঁদের জন্য বিশেষ সুবিধে দিয়েছে, স্বামী ও স্ত্রীর জন্য দুটি আলাদ অ্যাপার্টমেন্ট বরাদ্দ করে তারপর দুটিকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এত বড় একটি অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া পঁচিশ রুবল। টাকার হিসেবে সাড়ে তিনশো টাকার কাছাকাছি। কলকাতায় এরকম একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া হবে অন্তত তিন হাজার টাকা, আমেরিকার কোনও ছোটখাটো শহরে আট-ন’শো ডলার তো হবেই। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৮ সাল থেকে নাকি বাড়ি ভাড়া বাড়েনি। সরকারি ফ্ল্যাটের ভাড়া লাগে মাইনের শতকরা তিন টাকা। গ্যাসের জন্য খরচ যোলো কোপেক। টেলিফোনের জন্য প্রতি মাসে বাঁধা দু-কবল পঞ্চাশ কোপেক, তাতে যত ইচ্ছে লোকাল কল করা যায়। এক রুবলের ক্রয়ক্ষমতার আন্দাজ খানিকটা এই ভাবে বোঝা যেতে পারে, এক রুবলে দশ কিলো আলু কিংবা এগারোটা ডিম কিনতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ এক কিলো আলু আর একটা ডিমের দাম প্রায় সমান। সরকার নিয়ন্ত্রিত বলে সারা বছরের জিনিসপত্রের দাম কখনও বাড়ে-কমে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে যে-কোনও ব্যক্তির নিম্নতম আয় দুশো রুবলের কিছু কম, মার্কিন দেশে সাড়ে আটশো ডলার, আর আমাদের দেশে নিম্নতম আয় বলে তো কিছুই নেই, শতকরা পঞ্চাশ জনেরই তো সারা বছরে রোজগারের কোনও ঠিক-ঠিকানাই থাকে না–তবু তারা বেঁচে থাকে।
মাদাম আর্তা দুমপেই খুবই খ্যাতনাম্নী ভাস্কর। তিনি বড় বড় মূর্তি গড়ার জন্য সরকারের কাছ থেকে ডাক পেয়েছেন অনেকবার। রিগা শহরের কোথায় কোন মূর্তি বসানো হবে, সে ব্যাপারে যে উপদেষ্টা কমিটি আছে, তিনি তার সদস্যা। এসব ছাড়াও তিনি নিজের শখেই ভাস্কর্যের কাজ করেছেন অনেক, তার নিয়মিত প্রদর্শনী হয় স্বদেশে ও বিদেশে। উনি ব্রোঞ্জ এবং পাথরের কাজ করেন। ওঁর কবজিতে নিশ্চয়ই খুব জোর আছে, কিন্তু মুখের হাসিটি বড় সরল।
ওঁদের একটি সন্তান। ষোলো-সতেরো বছরের সেই ছেলেটিকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। মাদাম আর্তা দুমপেই নিজে ইংরেজি জানেন না। তবে ওঁদের ছেলে ইংরিজি শিখছে। তিনি ছেলেকে বললেন, খোকা, তুই এঁর সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বল-না!
কিন্তু ছেলেটি বেশ লাজুক, এই বয়েসের ছেলেরা যেমন হয়, সে দু-একটা কথা বলে ঘাড় নীচু করে রইল। এঁদের সংসারটি দেখে বেশ ভালো লাগে, স্বামী পণ্ডিত ও অধ্যাপক, সবসময় বইপত্তরের মধ্যে ডুবে আছেন, স্ত্রী কঠিন পাথর কেটে সৃষ্টি করছেন শিল্প, একটিমাত্র ছেলে এখন পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত।
ভিক্টর ইভবুলিস রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষ খবর রাখেন না। অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চেনেন। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে ওঁর যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এবং এ বিষয়ে ওঁর একটি থিয়োরিও আছে। ওঁর ধারণা ভারতী সাহিত্য ইওরোপীয় সাহিত্যকে নানাভাবে যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করেছে। ইন্ডিয়ান ইনফ্লুয়েন্স অন ওয়েস্টার্ন লিটারেচার, এই শিরোনামে ওঁর বিস্তৃত প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে। অথচ, আমরা এর উলটোটাই ভাবি।
‘দেশ’ পত্রিকার সেই পুরোনো সাহিত্য সংখ্যাটি তিনি জমিয়ে রেখেছেন সযত্নে। ভূদেব চৌধুরীর প্রবন্ধটি দেখিয়ে আপশোশ করে উনি বললেন, এই দেখুন, আমার স্ত্রীর করা রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটির একটি ছবি এতে ছাপা হয়েছিল, কিন্তু পুরোটা নয়। অর্ধেক। এতে মূর্তিটি ঠিক বোঝা যায় না।
আমারও আপোশ হল, আমি ক্যামেরাটা ভুল করে ফেলে এসেছি হোটেলে। এই মূর্তিগুলির এবং এই সুন্দর পরিবারটির অনেক ছবি তোলা যেত।
স্বামী-স্ত্রী মিলে আমাকে অনেকগুলি ছবি, বই ও নানান লেখার জেরক্স কপি উপহার দিলেন।
মাদাম আর্তা দুমপেই আমাদের খাওয়ালেনও খুব। ইনি একজন রন্ধন শিল্পীও বটে। নানান রকম খাবার করেছেন, তার মধ্যে মাংসের টুকরো, সবজি ও চিজ ফুটিয়ে একটা রান্নার স্বাদ অ
বিদায় নেবার সময় ভিক্টর ইভবুলিস আমাকে বললেন, আমার এই ফ্ল্যাটে আপনিই দ্বিতীয় বাঙালি এলেন। এর আগে যিনি এসেছিলেন, তাঁকে আপনি নিশ্চয়ই চিনবেন না। তিনি লেখক নন, কিন্তু আমার খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন।
যে-কোনও বাঙালিকে আমার পক্ষে চেনা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, তবু আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই প্রথম বাঙালিটিকে আমি চিনতে পারলুম। এঁর নাম উদয় চট্টোপাধ্যায়, খড়গপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক, সাহিত্যপ্রেমিক, নিজেও কবিতা লেখেন। প্রবাসে এসে চেনা কারুর কথা শুনলে ভালো লাগে।
রাত্তিরে হোটেলে ফিরে সারগেই-এর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ এক সময় সে লাফিয়ে উঠল। এই যাঃ, দারুণ ভুল হয়ে গেছে তো!
আমি জিগ্যেস করলুম, কী হল?
দারুণ চিন্তিতভাবে সারগেই বলল, আমাকে এক্ষুনি একবার রেল স্টেশনে যেতে হবে। ট্রেনে কন্ডাকটর গার্ড আমাদের টিকিট পরীক্ষা করতে নিয়েছিল, সেই টিকিট তো আর ফেরত দেয়নি! আমাকে টাকা-পয়সার হিসেব রাখতে হবে, টিকিটের কাউন্টার পার্ট না দেখালে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট আমাকে ধরবে!
আমি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ কালো। বললুম, এই রাত্তিরে তোমাকে আবার দৌড়োতে হবে স্টেশনে? সে তো বেশ দূরে!
সারগেই ক্ষুণ্ণভাবে বলল, যেতেই হবে, সুনীলজি। মহিলাটির উচিত ছিল না নিজে থেকেই আমাদের টিকিট ফেরত দেওয়া? সেটাই তো নিয়ম।
আমি জিগ্যেস করলুম, আমি যাব তোমার সঙ্গে?
সারগেই বলল, না, না, আপনি গিয়ে কী করবেন? আমার কতক্ষণ লাগবে তার ঠিক নেই। আজ রাত্তিরের ট্রেন যদি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে হয়তো ওই মহিলাকে আর পাবই না।
সারগেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।
তারপর আমি ঘণ্টাখানেক বই পড়লুম। ভিক্টর ইভবুলিসের বাড়িতে খানিকটা ভদকা ও ব্র্যান্ডি পান করেছিলুম, তার প্রভাবেই কিনা জানি না, বেশ গরম লাগছে। উঠে খুলে দিলুম সব জানলা।
রিগা শহরে লেনিনগ্রাদের চেয়ে শীত অনেক কম। তবু বাইরে বেরুবার সময় গরম কোট সঙ্গে রাখতে হয়, এখানে যখন-তখন বৃষ্টি নামে, বৃষ্টির পর শীত-শীত লাগে বেশ। মাঝে-মাঝে বেশ অসুবিধে হয়। রাস্তায় শীত, সেজন্য ফুলহাতা জামা, সোয়েটার, কোট ইত্যাদি পরে বেরুতে হয়, তারপর কোনও হোটেল বা অফিস বা বাড়িতে ঢুকলেই গরম লাগে, কারণ সেসব জায়গাতে সেন্ট্রাল হিটিং। ওভারকোট খুলে রাখা যায়, কিন্তু সোয়েটার ইত্যাদি তত খোলা যায় না। এক এক সময় আমার কপালে ঘাম বেরিয়ে যায়। সারগেই এর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, সেই যে চামড়ার জ্যাকেটটা তাকে প্রথম দিন পরতে দেখেছি, তারপর সেটা আর ও একদিনও খোলেনি।
সারগেই এখনও ফেরেনি? বেরিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে টোকা মারলুম। কোনও সাড়া নেই।
আবার খানিকটা বই পড়ার চেষ্টা করলুম, কিন্তু মন বসছে না। এখনও গরম লাগছে। সেন্ট্রাল হিটিং কমানো-বাড়ানোর ব্যবস্থা এক এক জায়গায় এক এক রকম। এ ঘরে সেই ব্যবস্থাটা যে ঠিক কোথায় খুঁজে পেলুম না। জানলা দিয়ে কোনও হাওয়া আসছে না।
এক এক সময় হোটেলের বন্ধ ঘরের মধ্যে বড় অস্থির লাগে। শুধু বই পড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ঘুমও আসছে না। আমি ভাবলুম, এখন টাটকা বাতাসের মধ্যে খানিকক্ষণ ঘুরে এলে কেমন হয়?
শার্ট-প্যান্ট পরাই ছিল, ওভারকোট নিয়ে, পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে পড়লুম হোটেল থেকে। রাস্তায় কিছু লোকজন এখনও হাঁটাহাঁটি করছে। আমি গির্জার বাগানটা কোনাকুনি পার হয়ে চলে এলুম অন্য রাস্তায়। আমার ইচ্ছে নদীর ধারে যাওয়া। হোটেলের রাস্তা হারিয়ে ফেলার কোনও সম্ভাবনা নেই। রিগা শহরে উঁচু বাড়ির সংখ্যা খুব কম, পেছন ফিরে তাকালেই আমাদের হোটেলের আলো দেখতে পাওয়া যায়।
অচেনা শহর, এখানকার ভাষাও আমার সম্পূর্ণ অজানা। এখানে ইংরিজি জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু আমার আড়ষ্ট বোধ হচ্ছে না, গা ছমছম করছে না। সহজাত অনুভূতি দিয়েই ভয়কে টের পাওয়া যায়। আজকাল পশ্চিমের অধিকাংশ শহরই খুব হিংস্র, রাত্তিরবেলা একা একা চলাফেরা করা রীতিমতন বিপজ্জনক। কিন্তু সকাল থেকে রিগা শহরে কয়েকবার ঘুরেই আমার মনে হয়েছে, এখানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ চিন্তার প্রয়োজন নেই।
যে পথ দিয়ে আমি এখন হাঁটছি, সে পথটি রীতিমতন জনবিরল। মাঝে-মাঝে দু একটি লোক আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। একটু বাদে আমি পরিবেশের কথা ভুলে গেলুম। ওভারকোটের পকেটে এক হাত, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মাথা নীচু, গুনগুন করে সুর ভাঁজছি, “আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন, বাতাসে…”।
এখন আমি পৃথিবীর যে-কোনও শহরের, যে-কোনও রাস্তার, যে-কোনও একজন মানুষ।