১.১২ রুমানিয়ার অবস্থা

রুমানিয়ার অবস্থা কি আমাদের দেশের চেয়েও খারাপ?

আপাতদৃষ্টিতে সেইরকমই মনে হয় বটে। কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে? আমাদের চার জনের দলটির মধ্যে বাদল ও আমি কলকাতাবাসী, ভাস্কর ও অসীম বহুকাল প্রবাসী। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আলাদা হবেই। রুমানিয়ায় মাংস পাওয়া যায় না, দুধ নেই, মাখন নেই, এরকম প্রয়োজনীয় অথচ অপ্রাপ্তব্য বস্তুর তালিকা অতি দীর্ঘ। ইংল্যান্ড ফ্রান্সে এই অবস্থা অকল্পনীয়, পয়সা থাকলে সেখানে সব কিছুই পাওয়া যায়। ওই সব দেশে বিক্রেতারাই খদ্দেরদের নানারকম প্রলোভন দেখায়, নিছক খাবারের জিনিস কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। ওই সব দেশের দোকানে ঢুকলে কুড়ি রকমের মাংস, বারো রকমের রুটি, সাত রকমের দুধ, পাঁচ রকমের ডিম, চল্লিশ রকমের বিস্কিট ইত্যাদির মধ্যে পছন্দমতন বেছে নিতে যা সময় লাগে। ভাস্কর আর অসীমের মনে এই তুলনা আসবেই।

বাদল বলল, আমাদের কলকাতার অবস্থাও এর চেয়ে অনেক ভালো। টাকা থাকলে সব কিছু পাওয়া যায়।

আমি বললাম, না, পাওয়া যায় না।

বাদল বলল, মাছ, মাংস, রুটি, ডিম, এসব পাওয়া যায় না?

আমি বললাম, না।

বাদল খানিকটা হকচকিয়ে যেতে আমি খানিকটা রহস্য করে বললাম, মনে করুন, কলকাতার সব লোক একদিন মাংস খাবে ঠিক করল তখন কি লাইন দিয়েও সবাই মাংস পাবে? মনে করুন, পশ্চিম বাংলার সব মানুষ ভাবল, তাদের প্রতিদিন ডিম খাওয়া উচিত, তত ডিম পাওয়া যাবে বাজারে? আমাদের দেশের শতকরা পঞ্চাশ ষাটজন লোক জীবনে কখনও মাখন খায়নি, তারাও যদি মাখন খেতে চায়, তার জোগান দেওয়া যাবে?

আমাদের দেশের শতকরা পঞ্চাশ জনেরও বেশি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নীচে, তাদের কোনও ক্রয়ক্ষমতাই নেই, তাদের জন্য ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনও হয় না। আমাদের দেশে কংগ্রেসি কিংবা বামপন্থী কোনও সরকারই দারিদ্র্যসীমার বিশেষ হেরফের ঘটাতে পারেনি। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষরাই কখনও পাউরুটি কিংবা বিদ্যুৎ কিংবা পেট্রোল না পেলে চেঁচামেচি করে, সরকারও তাদেরই মনতুষ্টির চেষ্টা করে। আর দেশের যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ প্রায় কিছুই পায় না, তারা নীরবই থেকে যায়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু রোজগার থাকে, মাংস-মাখন-ডিম-কফি এসব, আমাদের শুধু ডাল-ভাতের মতনই, ওদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, সকলেরই এগুলো পাওয়ার কথা, রুমানিয়ায় সকলে সেগুলো এখন পাচ্ছে না বলেই এত কথা উঠছে। তাহলেও এদেশে কেউ এখনও না খেয়ে নেই, শহরের ফুটপাথে ভিখিরির পাল জোটেনি। সুতরাং আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা চলে না।

অসীম বলল, ভারতের চেয়ে এখানকার অবস্থা অবশ্যই ভালো। এখানে তবু তো সব লোক লেখাপড়ার সুযোগ পায়, না খেয়ে কেউ মরে না, সকলেরই কিছু না কিছু কাজ আছে, শহরে আবর্জনার স্তূপ জমেনি।

ভাস্কর বলল, সমাজতন্ত্র আসবার আগে কি এখানে কেউ না খেয়ে থাকত? ইউরোপের কোন দেশের নোক না খেয়ে থাকে? তথাকথিত ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর সাধারণ মানুষও এদের তুলনায় ভালো খেতে-পরতে পায় না? সেখানেও সব লোক কাজ পায়, কাজ না থাকলে সরকার বেকার-ভাতা দেয়। এখানে সবাই কাজ পায় তবু কাজ করে না।

আমি আর তর্কের মধ্যে যেতে চাই না। তুলনা করে লাভ নেই। সমাজতন্ত্র সমস্ত মানুষের মধ্যে সমবন্টনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচাবার কথা বলেছিল, এই আদর্শ ব্যবস্থাকে কে অস্বীকার করবে? তবু অতিরিক্ত ক্ষমতালোভী একটা শ্রেণি তৈরি হয়ে গেল, তাদের জন্য এই আদর্শ ব্যর্থ হয়ে গেল। এ জন্য মনের মধ্যে একটা বেদনাবোধ থেকেই যায়।

আমাদের রুমানিয়ায় ফেরার পালা এবার শেষ হল। আমাদের বাড়িউলি মাদাম দিদার ইচ্ছে আমরা আরও কয়েকটা দিন থেকে যাই। আমাদের কাছ থেকে চার দিনের ঘর ভাড়া হিসেবে উনি যত ডলার পেয়েছেন, তা এখানকার সাধারণ মানুষের তিন মাসের মাইনে। সুতরাং আমাদের আরও কয়েকটা দিন ধরে রাখার আগ্রহ তো ওঁর থাকবেই। ওঁর মতে, ভারতীয়রা বেশ ভালো লোক, পছন্দ মতন পেলে উনি একজন ভারতীয়কে বিয়ে করতে চান। আমাদের দলে অসীমই একমাত্র অকৃতদার এবং অতিশয় সুপাত্র এবং বয়েসের দিক দিয়েও মাদাম দিদার সঙ্গে মানিয়ে যাবে। আমরা তিনজনে অসীমের নাম প্রস্তাব করায় অসীম তৎক্ষণাৎ এ দেশ থেকে একটা দৌড় লাগাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।

ছুটি ফুরিয়ে গেছে বলে ভাস্কর ও অসীম ফিরে যাবে যে-যার শহরে এবং ওদের ফিরতে হবে হাঙ্গেরি হয়ে। বাদল আর আমি যাব পোল্যান্ড। ওরা দু’জন গেল রেল স্টেশানের দিকে, আমরা দুজন বিমানবন্দরে।

বুখারেস্ট শহর ছাড়িয়ে বিমানবন্দরটি বেশ দূরে। আমাদের ফ্লাইট ডিলেইড, বসে থাকতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। বিদ্যুৎসংকটের জন্য এয়ারপোর্টের অধিকাংশ জায়গাই অন্ধকার, দু-এক জায়গায় টিমটিম করে আলো জ্বলছে। রেস্তোরাঁয় খাবারদাবার কিছু নেই। এখানে অপেক্ষা করাটা মোটেই সুখকর নয়। আমাদের কাছে যে সামান্য কিছু রুমানিয়া টাকা রয়ে গেছে তা খরচ করে ফেলবার জন্য আমরা দুটো বিয়ার নিয়ে বসলাম। রেস্তোরাঁয় আর বিশেষ লোক নেই। এক কোণের টেবিলে তিনটি যুবক বসে নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথা বলছে, এক সময় আমি তাদের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন?

ওরা ভূত দেখার মতন চমকে উঠল, একজন বিস্ফারিত চোখে জিগ্যেস করল আপনি বাংলার কথা বলছেন? সত্যি? কানে ভুল শুনছি না তো!

যুবক তিনটি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আমাদের কাছাকাছি এসে বসল। ওদের দুজনের বয়েস একুশ-বাইশ, অন্য জনের ত্রিশ-বত্রিশ হবে। বয়স্ক ছেলেটি চালু ধরনের, অন্য দুজন একেবারেই সরল নিরীহ। ওদের কাহিনি খুবই করুণ। রুমানিয়ায় ঢুকতে ভারতীয় বাংলাদেশিদের ভিসা লাগে না, ওরা তবু ঢাকা থেকে ভিসা নিয়ে এসেছে, এখানে তবু ওদের আটকে দিয়েছে। ওদের প্লেনের টিকিট এক দিকের, এখানে ইমিগ্রেশান থেকে সন্দেহ করা হয়েছে যে, ওরা বেড়াতে আসেনি, কাজ খুঁজতে এসেছে। ওদের উদ্দেশ্য সত্যিই তাই।

বাদল বলল, তোমরা আর কোনও দেশ খুঁজে পেলে না? রুমানিয়ায় এসেছ কাজ খুঁজতে?

অল্প বয়সীদের একজন জিগ্যেস করল, কেন দাদা, দেশটা খারাপ?

বাদল বলল, ভাগ্যিস ঢুকতে পারনি। ভেতরে গেলে কাজ তো পেতেই না, ক’দিন বাদে না খেয়ে থাকতে হত।

কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, বয়স্ক ছেলেটি অন্য দুজনকে স্বপ্ন দেখিয়ে এনেছে। এর আগে সে আরও কিছু ছেলেকে ঢাকা থেকে চালান করেছে অন্য দেশে। তার ধারণা, রুমানিয়ায় ঢোকা সবচেয়ে সহজ, তারপর এখান থেকে কোনওক্রমে জার্মানিতে পৌঁছে যেতে পারবে। জার্মানি হচ্ছে সমস্ত সুযোগ সন্ধানীদের স্বর্গ। অল্পবয়েসি ছেলে দুটির ইতিহাস-ভূগোল সম্পর্কেও কোনও ধারণা নেই, ঢাকায় কলেজ ইউনিভার্সিটি প্রায়ই বন্ধ থাকে, পাস করলেও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, তাই বিদেশের হাতছানিতে ওরা প্রলুব্ধ হয়েছে। এটাকে ঠিক অ্যাডভেঞ্চারও বলা যায় না, ওরা দেশ ছেড়েছে হতাশায়। মরিয়া হয়ে প্লেন ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করেছিল, এখন সবই গেল।

ওদের তিনজনকে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে এই এয়ারপোর্টে। একটা নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। চারদিন ধরে ওরা রয়েছে। অন্য কোনও দেশ ওদের নামতে দেবে না, এখান থেকে ঢাকার সরাসরি কোনও ফ্লাইট পেলে তাতে ওদের পাঠানো হবে। এর মধ্যে সেপাই-সান্ত্রিরা নানা ছুতোয় ঘুষ নিচ্ছে ওদের কাছ থেকে। কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে। আজ সকালেই একজন পুলিশ ওদের বলেছে, একশো ডলার দাও, দু-ঘণ্টা বাদে ওদের শহরে পাচার করে দেবে। একশো ডলার গেল, দু-ঘণ্টা পরে জানা গেল, সেই পুলিশটি কয়েকদিনের জন্য ছুটিতে চলে গেছে। আবার আর একজন সেই একই আশ্বাস দিয়েছে।

ওদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। একজন বলল, দাদা, সাহেবরা যে এত ঘুষ নিতে পারে, তা আমরা জানতাম না। এখানে প্রত্যেকে ঘুষ চায়। আমাদের একেবারে ফতুর করে দিচ্ছে। এখানে ওরা দুবেলা খেতে দেয় বটে, কিন্তু যা খাই কিছুই ভালো লাগে না।

বাঙালি পেয়ে ওরা আমাদের ছাড়তে চায় না। কিন্তু ওদের সাহায্য করার কোনও উপায়ই আমরা খুঁজে পেলাম না। আমাদের একটু পরেই চলে যেতে হবে। বাদল আর আমি প্রস্তাব দিলাম তোমাদের টাকা পয়সা যদি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে, আমরা কিছু দিতে পারি। পরে না হয় দেশে ফিরে গিয়ে কোনওসময় শোধ করে দিও।

ওদের একজন বলল, আপনাদের কাছ থেকে নিলে সে টাকাও চলে যাবে। কোনও লাভ নেই। আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলে, যখন দেখবে ঘুষ পাওয়ার আর কোনও আশা নেই, তখন ওরা নিজেদের গরজেই আমাদের ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবে।

ভারাক্রান্ত মনে ছেলে তিনটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বিমানের দিকে হেঁটে গেলাম। তারপর ওদের কী পরিণতি হল জানি না। আশা করি, সুস্থভাবে তারা দেশে ফিরে গিয়ে দুটি মাছের ঝোল-ভাত খেতে পেয়েছে।

আমরা ওয়ারশ পৌঁছলাম সন্ধের পর। এখানে আমাদের অভ্যর্থনা হল চমকপ্রদ। ওয়ারশ-তে আমাদের থাকার জায়গা ঠিক করে আসিনি। সেরকম বিশেষ চেনাশুনোও কেউ নেই। তবে ফ্রাংকফুর্টে থাকার সময় লন্ডনে টেলিফোনে কথাবার্তা হয়েছিল বিশিষ্ট শিল্প-সমালোচক আকুমল রামচন্দরের সঙ্গে। আকুমলের সঙ্গে পোল্যান্ডের খুব যোগাযোগ। আমরা ওয়ারশ যাব শুনে, দিন হিসেব করে আকমলও চলে এসেছে। বিমান বন্দরের বাইরে এসে দেখি আকুমল দুটি পোলিশ যুবককে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকুমল তো বাংলা জানেই, তা ছাড়া পোলিশ যুবকদ্বয়ের একজন বেশ পরিষ্কার বাংলায় বলল, আসুন, পোল্যান্ডে স্বাগতম। কোনও কষ্ট হয়নি তো?

এই যুবকটির নাম পিওতর বালসেরোউইভস, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ব নিয়ে পড়াশুনো করে। অন্যজনের নাম জাসেক ফ্রাকৎসাক (কিংবা ফ্রমসাফ), একজন প্রখ্যাত গ্রাফিক শিল্পী। ট্যাক্সি ধরতে হল না, জাসেক এর নিজের গাড়ি আছে। সেই গাড়িতে উঠে আরও ভালো খবর পাওয়া গেল যে, আকুমল আমাদের জন্য থাকার জায়গাও ঠিক করে ফেলেছে।

আগেই শুনেছিলাম যে ওয়ারশ-তে সাধারণ হোটেল পাওয়া দুষ্কর, নামি হোটেলগুলি এতই দামি যে আমাদের প্রায় সাধ্যাতীত। কিন্তু আকুমলের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের তুলনা নেই। অনেক হোটেলের সে সন্ধান নিয়েছে বটে, কিন্তু আমরা এখানে পৌঁছোবার মাত্র দু ঘণ্টা আগে একটা চায়ের আসরে সে অনেকের মধ্যে বসে আমাদের থাকার জায়গার প্রসঙ্গ তুলেছিল। তখন শিক্ষা বিভাগের একজন কর্তাব্যক্তি একটি গেস্ট হাউসের ঘর ঠিক করে দেন আমাদের জন্য। সে গেস্ট হাউসটিও সাধারণ নয়, আর্ট হিস্টোরিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত, খরচ যৎসামান্য। অর্থাৎ পণ্ডিত ব্যক্তিরাই শুধু সেখানে থাকার অধিকারী, এই প্রথম আমাদের মতন দুজন অপণ্ডিতের সেখানে পদার্পণ।

গেস্ট হাউসটি পুরোনো শহর। সেন্ট জনস ক্যাথিড্রালের কাছাকাছি এই এলাকাটি টুরিস্টদের একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। অর্থাৎ যেখানে সবাই বেড়াতে আসে, আমরা রাত্রিবাস করব সেখানেই। বাড়িটি পুরোনো আমলের, এক একটা ফ্লোর এখনকার দেড়তলার সামন তো হবেই এবং লম্বা কাঠের সিঁড়ি। আমাদের ঘর চার তলায়। খুবই প্রশস্ত কক্ষ, কাছেই বাথরুম ও রান্নাঘর, চমৎকার ব্যবস্থা। প্রথম রাত্তিরেই যাতে আমাদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে না হয়, সে বন্দোবস্তও করে রেখেছে আকুমল। মালপত্র রেখেই আমাদের আবার রওনা দিতে হল। জীবনে যাঁদের দেখিনি, যাঁদের নামও শুনিনি, সেরকম একটি পরিবারে আমাদের নেমন্তন্ন আছে।

শহরের অন্য প্রান্তে সেই বাড়ির গৃহকর্তা একজন সাংবাদিক, তাঁর নাম অ্যানড্র টারনডস্কি। ইনি রয়টারের ওয়ারশ প্রতিনিধি। কথাবার্তা শুনে পাক্কা ইংরেজ মনে হলেও পদবিটা খটকা জাগায়। এঁর বাবা-মা পোলিশ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেই তাঁরা পোল্যান্ড ছেড়ে চলে যান। অ্যানড্র’র জন্ম সুইটজারল্যান্ডে, কৈশোর কেটেছে, স্কটল্যান্ডে, লেখাপড়া করেছেন অক্সফোর্ডে। তারপর চাকরির সূত্রে ঘুরেছেন সারা পৃথিবী। পোল্যান্ডে এসে ইনি এখন পোলিশ ভাষা শিখছেন এবং এখানকার ঘটনাবলি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ শুধু জীবিকার কারণের চেয়ে অনেক বেশি। এঁর স্ত্রীর নাম ওয়াফা, গৌরাঙ্গিনী হলেও তাঁকে ঠিক মেমসাহেব বলে মনে হয় না। বসবার ঘরের দেওয়ালে দু-একটা ভারতীয় মোটিফ দেখে সন্দেহ হয়, ইনি ভারতীয় নাকি? কথা বলে জানা গেল, ওয়াফা লেবাননের মেয়ে, তিনিও সাংবাদিক ছিলেন এবং একসময় দু’জনেই ছিলেন দিল্লিতে। এঁর কথার মধ্যে বেশ একটা আপন-আপন সুর আছে। রান্না-বান্নায় লেবানন, পোল্যান্ড, ব্রিটেন ও ভারতের ছোঁয়া আছে। আকুমল বানিয়েছে স্যালাড ও পাঁপড় ভাজা। এই সাংবাদিক দম্পতির পাঁপড় ভাজা খুব প্রিয়। এ বাড়ির খাবার টেবিলে বসলে বোঝা যায় না যে এ দেশে খাদ্যদ্রব্যের কোনও অভাব আছে।

কোনও একটা নতুন শহরে এসে পরিবেশটা বুঝে নিতে অন্তত একটা দিন সময় লাগে। ওয়ারশতে এসে আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেশ একটা অন্তরঙ্গ আবহাওয়া পেয়ে গেলাম। শিল্পী জাসেক বেশ ঝকঝকে ইংরিজি বলে এবং জোর দিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। সমস্ত কথাই পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে। অ্যানড্র আমাদের কাছে রুমানিয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইছিলেন কিন্তু জাসেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার পোল্যান্ডের প্রসঙ্গে টেনে আনে। জাসেক এবং আকুমল দুজনেই আগেকার শাসনতন্ত্রের ঘোর বিরোধী, ওদের মতে পোল্যান্ড দুঃশাসন মুক্ত হয়েছে। অ্যানড্র ভবিষ্যতের জন্য চিন্তিত। এই পরিবর্তনের কতটা সুফল পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সংশয় আছে।

আকুমল বাইরের মানুষ হলেও গত এক দশক ধরে পোল্যান্ডের সমস্ত ঘটনা তার নখদর্পণে। তবু আমরা জাসেক-এর কাছেই জানতে চাইলাম, পূর্ববর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে তার প্রধান অভিযোগ কী কী।

জাসেক শুধু শিল্পী নয়, খুবই ইতিহাসমনস্ক। ইতিহাস ও সাহিত্য থেকে মাঝে মাঝেই উদ্ধৃতি দেয়। সে বলল, মানুষ অনেক কিছু সহ্য করতে পারে, কিন্তু বেশিদিন ভণ্ডামি সহ্য করতে পারে না। যুগ যুগ ধরে পোলিশরা বহু অত্যাচার সহ্য করেছে, বিদেশি শক্তি এ দেশটাকে বারবার টুকরো-টুকরো করেছে, এক সময় পোলান্ডের নামটাও পৃথিবীর ম্যাপ থেকে মুছে গিয়েছিল, তবু এদেশের মানুষ কখনও আত্মমর্যাদা হারায়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এদেশের ষাট লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, তবু তো ভেঙে পড়েনি এ জাতটা। সমাজতন্ত্রের রাস্তা ধরে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে এই জাতটা আবার উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তারপর একদলীয় শাসন এমন একটা স্বৈরতন্ত্রের পর্যায়ে গেল, বাতে গড়ে উঠল একটা নতুন অ্যারিস্টোক্রাট শ্রেণি, যারা দেশকে মানুষকে সমাজতন্ত্রের স্তোক বাক্য দেয়, আর নিজেরা বেশি-বেশি সুবিধে ভোগ করে। তাদের পতন অনিবার্য ছিল।

কথায়-কথায় লেক ভালেনসার কথা এসে পড়ে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষে তখন হাওয়া গরম। সলিডারিটির নেতা ভালেনসা শুধু পোল্যান্ডের নয়, পূর্ব ইউরোপের সবকটি দেশের পালা বদলের নেতা। ১৯৮০ সালে তাঁর নেতৃত্বে এক বিরাট শ্রমিক আন্দোলন পোল্যান্ড কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যে দেশ শাসন করছে ওয়ার্কার্স পার্টি, সে দেশের শ্রমিকরাই বিদ্রোহ করে কেন? তা হলে কারা প্রকৃত শ্রমিক? মার্শাল ল জারি করে সলিডারিটির আন্দোলন সাময়িকভাবে দমন করা গেলেও জনতার রোষ আবার ফুসে ওঠে।

পূর্বতন সরকারের পতনের পর লেক ভালেনসা বলেছিলেন, তিনি শ্রমিক, তিনি সরকারের কোনও পদ চান না। কিন্তু এতবড় একটা ইতিহাস বদলের নায়কের মর্যাদা অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য। কয়েকমাসের মধ্যে নিজেকে কিছুটা অবহেলিত মনে করে ভালেনসা মত বদল করে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন-প্রার্থী হয়েছেন।

জাসেক কিন্তু ভালেনসার সমর্থক নয়। ভালেনসা-কে সে অবশ্যই হিরো মনে করে, তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাও মান্য করে, কিন্তু ভালেনসা প্রেসিডেন্ট হোন, এটা সে চায় না।

জাসেক বলল, ভাসেনসা হেরে গেলে আমি দুঃখিত হব, আর জিতলে হতাশ হব।

কথাটা ধাঁধার মতন, ঠিক বোঝা যায় না।

অ্যানড্রু বললেন, ভালেনসা নির্বাচনে হেরে গেলে তাঁর খুবই অসম্মান হবে। এতবড় একটা কাণ্ড যিনি ঘটালেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যিনি এনে দিলেন, তাঁকেই দেশের মানুষ ভোট দেবে না, এটা অকৃতজ্ঞতা নয়? কিন্তু জাসেক-এর মতন বুদ্ধিজীবীরা ভালেনসাকে রাষ্ট্রপতির পদে চায় না, কারণ ভালেনসা ঠিক শিক্ষিত নন। তিনি একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তাঁকে অন্যভাবে সম্মান জানানো যেতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর দরকার কি? দেশ গড়ার জন্য একজন উপযুক্ত লোক দরকার, তাই না জাসেক?

জাসেক বলল, ভালেনসা একজন ইলেকট্রিশিয়ান বলেই যে তাঁকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসাতে আমাদের আপত্তি তা নয়। আমাদের আশঙ্কা অন্য। বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা হিসেবে যাঁকে আমরা এত শ্রদ্ধা করি তিনি যদি ক্ষমতার আসনে বসার পর বদলে যান? যদি তিনিও আস্তে-আস্তে রূপান্তরিত হয়ে, হয়ে ওঠেন এক স্বৈরাচারী? তাহলে যে আমাদের দুঃখের শেষ থাকবে না।