২৫. বাংলা সন-তারিখ-মাস

বাংলা সন-তারিখ-মাসের সঙ্গে আমাদের জীবনের কোনও যোগ নেই এখন। টাকা পয়সার লেনদেন, অফিসের মাইনে, ছুটি, ভ্রমণ ও সবই ইংরেজি মতে হয়। সুতরাং বাংলা মাসের হিসেবের দরকারও তো নেই। এমনকি এ বছর দুর্গা পুজো কবে জিগ্যেস করলে যে কেউ বলবে অতই অক্টোবর।

আমাদের স্বাধীনতা হয়েছিল ১৫ আগস্ট, সেটা কত বাংলা তারিখে তা ক’জন জানে তাতে সন্দেহ আছে, কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ শিশুদের জন্মতারিখ অবশ্য বাংলায় লিখে রাখা হয়। বিয়ে, পৈতে, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশনে অবশ্য এখনও কোনও রহস্যময় কারণে, যদিও সর্বসাধারণের সুবিধের জন্য নেমন্তন্নর কার্ডে ইংরেজি তারিখটি দেওয়া থাকে যথারীতি। জন্মতিথির হিলেব অনুযায়ী প্রতি বছর আমাদের জন্ম তারিখ বদলাবার সম্ভাবনা, কিন্তু ইংরেজি কায়দা অনুযায়ী আমরা ইংরেজিতেই নির্দিষ্ট জন্ম তারিখ ঠিক করে ফেলেছি আজকাল। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটিই ২৫শে বৈশাখের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেছে।

বিয়ে-পৈতে-শ্রদ্ধর নেমন্তন্নতে আমি বিশেষ যাই না বলে গত এক বছরে অরিখ বিষয়ে সচেতন হবার তেমন সুযোগ হয়নি। তবে বাংলা মাস ও ঋতুর এখনও বলতে গেলে একচ্ছত্র আধিপত্য আছে এক জায়গায়, বাংলা কবিতায়। সেখানে এখনো কাল বৈশাখীর বদলে মার্চ মাসের ঝড় আসেনি। আশ্বিনের সাদা মেঘের বদলে সেপ্টেম্বরের আকাশ বললে ঠিক ছবি ফোটে না। কোজাগরি পূর্ণিমা ঠিক কোন মাসে হয় খেয়াল না থাকলেও কবিরা ওই রকমই লেখেন, জ্যৈষ্ঠের দুপুর না লিখলে ঠিক খাঁ খাঁ গরম হয় না। ইংরিজি মতে তো হেমন্তকাল বলে কিছু নেই-ই কিন্তু বাংলায় আছে। সুতরাং কবিতা পড়বার বা লেখবার সময় বাংলা মাস ও ঋতুর কথা আমারও মনে পড়েছে বারবার। এ রকম বর্ণনায় অবশ্য রসাভাসও ঘটে মাঝে-মাঝে। বাংলা বর্ণনায় ‘চৈত্রের রুক্ষ প্রান্তর’ এরকম বর্ণনা লেখা হচ্ছে অনেক কাল থেকে, এখনো লেখা হয়। ছবিটা হচ্ছে এই ফসল কাটা হয়ে গেছে, নতুন ফসল বোনা হয়নি, এমন অবস্থায় পড়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত জমি। কিন্তু ট্রেনে করে বর্ধমানের মধ্য দিয়ে যাওরার সময় দেখি, ওই সময়ে দু-পাশের মাঠে সবুজের ঢেউ খেলছে। ইরিগেশনের কল্যাণে যে চাষের সময় ওলট পালট হয়ে গেছে, তা

অনেকের খেয়াল নেই। ‘বাঘের থাবার মতো বাবের হিমানী’ লিখেছিলেন ভারতচন্দ্র। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই আর মাঘ মাসে লেপ গায়ে দিতে হয় না। এ বছর মাঘে পাখা খুললে ভালো হত, বরং শীত পড়ল ফাল্গুনের শেষে।

গত বছর আমি দু-বার মৃত্যুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। একবার এখানেই, একবার পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। অশ্লেষা মঘার কোনও যোগাযোগ ছিল কিনা জানি না। তবে দু-যারেই, তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। বিশিষ্ট ভদ্রলোকের মতন মৃত্যু আমায় বলেছিলেন, এখন বিশেষ ব্যস্ত আছি তবে আপনার নাম লিখে রাখছি, যথাসময়ে দেখা হবে।

আরও একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল গত বছর, তাঁর নাম সাতচল্লিশ। আগে ভদ্রলোকের সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল ভেবেছিলুম উনি হবেন বিষণ্ণ কিংবা নৈরাশ্য আক্রান্ত। কিন্তু সাতচল্লিশ সে রকম নন, একটু গাম্ভীর্য মাখানো হলেও সুরসিক, বেশ মজবুত চেহারা এবং মাথা ভরতি অনেক পরিকল্পনা। আমি একটা দেওয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়েছিলুম, তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় বললেন, ইতস্তত করছেন কেন। উঠে আসুন! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি, এখনও অনেকটা দূরে যেতে হবে তো! ওর সঙ্গে খানিকটা যাওয়ার পর উনি আর একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, তাঁর নাম আটচল্লিশ।

বেশ কয়েকটি পাহাড়ের সঙ্গেও পরিচয় হল এই এক বছরে। একটি পাহাড় ওড়িশায়, একটি পাহাড় মধ্যপ্রদেশে, একটি পাহাড় ইউরোপে, একটি ক্যানাডায়। মধ্যপ্রদেশের পাহাড়টির সঙ্গে ক্যানাডার পাহাড়টির শুধু এইটুকুই তফাৎ যে, দ্বিতীয়টিতে বরফ জমে। ওড়িশার পাহাড়টিতে উঠেছিলাম জিপে, ইউরোপের পাহাড়টিতে আরও আরামদায়ক গাড়িতে, মধ্যপ্রদেশের পাহাড়টিতে পায়ে হেঁটে আর ক্যানাডার পাহাড়টিতে বিদ্যুৎচালিত চেয়ারে। ভারতের প্রায় সব পাহাড়ের ওপরেই একটা মন্দির থাকে, পাশ্চাত্যে কিন্তু অত উঁচুতে গির্জা বানায় না। ধর্মের জন্য অত কষ্ট ওরা দাবি করে না। ক্যানাডার পাহাড়টির নাম ব্যানফ, ভারী চিত্ররূপময় জায়গাটি, ওপরে শুধু খাবার জায়গা, শখের জিনিসপত্তরের দোকান আর দৃশ্য দেখবার ব্যবস্থা। পাশের জঙ্গল থেকে কয়েকটি বনো ভেড়া সেখানে ছিটকে চলে এসেছে, লোকেরা তাদের আদর করে খাবার দিচ্ছে, কেউ তাদের খাদ্য বানাবার জন্য মারতে ছুটল না।

ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ইওরোপ বা ক্যানাডার যে কোনও পাহাড়ের ওপর দাঁড়ালেই কিন্তু আকাশটাকে একই রকম দেখায়।

গত বছর বেশ কয়েকটি জঙ্গলও দেখা হল।

কোনও জঙ্গলই একবার কেন, পাঁচবার দেখলেও ঠিক চেনা যায় না। কোনও জঙ্গলের সঙ্গে বেশি ভাব হয়ে গেলেও আর বেশি ভালো লাগে না। একটু ছমছমে রহস্যময় থাকাই জঙ্গলের মূল আকর্ষণ। সেই হিসেবে সুন্দরবনকে কক্ষপণা ঠিক চেনা যায় না। বিশেষত আমাদের মতন শহুরে মানুষের পক্ষে। রাত্তির বেলা সপ্তমুখী নদী ধরে ভয়াল জঙ্গলের পাশ দিয়ে নৌকো চড়ে যাওয়া, কোথাও কোনও শব্দ নেই, শুধু সেই নির্জনতার অঙ্গ হিসেবেই মাঝে-মাঝে ট-র-র-র, ট-র-র-র করে একটা রাতপাখির ডাক। গরমের জন্য ছই এর বাইরে এসে হাওয়া খাচ্ছিলুম, মাঝি বলল, বাবু কার্তিক মাসের হিম লাগাবেন না। কালোরাডোর জঙ্গল তেমন গা ছমছমে নয়, বরং বেশি নয়ন শোভন, তবু সেখানে ঘুরতে-ঘুরতে পথপ্রদর্শকটি যখন হঠাৎ বলল, সাবধান, এই সময় কিন্তু র‍্যাটল সাপ বেরোয়…তখন আমার ওই সুন্দরবনের মাঝিটির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।

প্রত্যেকটি নতুন নদী দেখারই একটা বিশেষ আনন্দ আছে। ব্রহ্মপুত্র এক রকম লাগে, মিসিসিপি অন্যরকম। তবে জঙ্গলের মাঝখান-চেরা নদী দেখলে আমার বুকের মধ্যে কিছু একটা লাফিয়ে ওঠে। সে রকম কোনও নদীর ধারে শেষ বিকেলের নরম আলোয় দাঁড়ালে আপনা থেকেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আঃ বেঁচে থাকা কী সুন্দর।