‘সুন্দর দিনগুলি, সময়ের ইঁদুরেরা চিবিয়ে খাচ্ছে
একটু একটু করে আমার জীবন
হা ভগবান! এই বসন্তে
প্রায় আঠাশ বছরে পৌঁছব
এর মধ্যেও অনেকটাই বাজে খরচ হয়ে গেছে, ইস!
–গিয়ম আপোলিনেয়ার
এবার ফরাসি দেশের অন্য একটি দিকে অভিযান। কয়েকটি চরিত্রও নতুন। এর আগে আমি পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে আমন্ত্রণ পেয়ে ঘোরাঘুরি করেছি বটে, কিন্তু দ্বিখণ্ডিত জার্মানির কোনও অংশেই পা ছোঁয়াবার সুযোগ ঘটেনি। সেই সুযোগ পাওয়া গেল, ফ্রাংকফুর্টের বিশ্ব বইমেলার সৌজন্যে। সেবারে, ১৯৮৬ সালে, বিশ্ব বইমেলায় ভারত ছিল বিশেষ আকর্ষণ, সেই সূত্রে চোদ্দো-পনেরো জন ভারতীয় লেখক লেখিকাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেই তালিকায় কী করে যেন এই অধমেরও একটা স্থান জুটে গেল। এমন সুযোগ পাওয়া খুব আনন্দের তো বটেই, তার সঙ্গে খানিকটা আশঙ্কাও মিশে থাকে। এমনি এমনি তো নেমন্তন্ন করে নিয়ে যাচ্ছে না, সেমিনারে একখানা বক্তৃতাও দিতে হবে। বক্তৃতার প্রসঙ্গ উঠলেই আমার হৃৎকম্প হয়।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে মার্ক টোয়েনের একটা চমৎকার গল্প বলা যেতে পারে।
পশ্চিম দেশগুলিতে এক ধরনের আনুষ্ঠানিক ভোজের প্রচলন আছে। কোনও উপলক্ষে চাঁদা তোলার জন্য কিংবা কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য ভালো কোনও হোটেলে ফর্মাল ডিনার হয়, লোকেরা অনেক টাকা দামের টিকিট কেটে সেই ডিনার খেতে আসে। খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি একটি বক্তৃতা দেন। সুখাদ্যের সঙ্গে সেই বক্তৃতাটি উপরি পাওনা।
সে-রকম একটি ভোজসভায় মার্ক টোয়েন একবার প্রধান অতিথি হয়েছিলেন। খাওয়াদাওয়া চুকে যাওয়ার পর মার্ক টোয়েনকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হল। মার্ক টোয়েন প্রথম উঠতেই চাইলেন না, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, অন্যদের পেড়াপেড়িতে শেষ পর্যন্ত তাঁকে বেজার মুখে দাঁড়াতেই হল। কিন্তু বক্তৃতার বদলে তিনি একটা গল্প শোনালেন। মার্ক টোয়েন বললেন, রোমান সম্রাটদের আমলে একবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সবাই জানেন নিশ্চয়ই, রোমান সম্রাটদের কিছু কিছু নিষ্ঠুর বিলাসিতা ছিল। গ্ল্যাডিয়েটররা লড়াই করতে-করতে একজন আর একজনকে খুন করছে, সেই দৃশ্য সম্রাট-সম্রাজ্ঞী উপভোগ করতেন। কিংবা স্টেডিয়ামের মাঝখানে বেঁধে রাখা হত কোনও ক্রীতদাস কিংবা ভিনদেশি বন্দিকে, তারপর একটি ক্ষুধার্ত সিংহকে ছেড়ে দেওয়া হত সেখানে। সিংহটা সেই জ্যান্ত মানুষটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, তাই দেখে উল্লাসে হাততালি দেবেন সম্রাট-সম্রাজ্ঞী ও পারিষদরা।
সেই রকমই একবার এক বিদেশি কবিকে ধরে এনে বেঁধে রাখা হয়েছে। তিন চার দিন ধরে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি, এমন সময় একটা সিংহকে ছেড়ে দেওয়া হল খাঁচা থেকে। সিংহটা বুক কাঁপানো গর্জন করে ছুটে গিয়ে সেই বন্দিকে প্রথম কামড়টা দিতে যাবে, এমন সময় বন্দিটি কী যেন বলে উঠল। সেই কথাটা শুনেই সিংহটা থেমে গেল, বুজে গেল তার হাঁ করা মুখ, ল্যাজ ঝুলে পড়ল। লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে সিংহটা বিমর্ষভাবে ফিরে গেল খাঁচার মধ্যে।
সবাই হতবাক। এমন কাণ্ড কখনও ঘটেনি। সম্রাটের আদেশে তক্ষুনি বন্দি সেই কবিকে নিয়ে আসা হল তাঁর সামনে। সম্রাট বললেন, তোমাকে মুক্তি দিয়ে দেব। তার আগে সত্যি করে বলো তো, তুমি সিংহটাকে কী বলে ফেরালে?
কবিটি বলল, হে সম্রাট, আমি সিংহটাকে শুধু মনে করিয়ে দিলাম, খাচ্ছ খাও! কিন্তু মনে রেখো, এরপর তোমাকে একটা আফটার ডিনার স্পিচ দিতে হবে।
যাই হোক, ফ্রাঙ্কফুর্টের বিশ্ব বইমেলা দেখার সুযোগ, জার্মানির অন্যত্র ঘোরাঘুরি, ঐতিহাসিক বার্লিনের প্রাচীর সন্দর্শন এই সব ভালো ভালো সম্ভাবনার বিনিময়ে সেমিনারে একটা অতি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিতে আমি মনকে রাজি করিয়ে ফেললাম। তা ছাড়া জার্মানি গেলে আর একবার ফ্রান্সও ছুঁয়ে আসা যাবে। ফ্রাংকফুর্ট থেকে ফ্রান্সের দূরত্ব মাত্র এক ঘণ্টা।
অসীমকে চিঠি লিখতেই সে জানাল, তুমি ফ্রাংকফুর্টে যাওয়ার দিন সাতেক আগেই প্যারিস চলে এসো। আমি অফিস থেকে ছুটি নিচ্ছি। একটা নতুন দিকে বেড়াবার পরিকল্পনা করে রেখেছি, চলো, আগে সেই দিকটা দেখে আসব। তারপর বইমেলাতে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
ফ্রাংকফুর্ট বিশ্ব বইমেলায় প্রতি বছর কলকাতা থেকে যোগ দিতে যান বাদল বসু। ইনি আনন্দ পাবলিশার্স-এর কর্ণধার। সেখানে বাংলা বইয়ের স্টল সাজিয়ে একলা বসে থাকেন। সে বছর কলকাতা থেকে অনেক প্রকাশক গিয়েছিলেন, কিন্তু অন্য কোনও কোনও বছরে বিশ্ব বইমেলায় বাংলা বই দেখা যায় একমাত্র আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলে।
বাদল বসু আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনি কি স্বা তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন? তা হলে আমার স্ত্রীকেও এর সঙ্গে নিতে পারি।
স্বাতী কোনওক্রমে কথাটা শোনামাত্র আর দ্বিরুক্তির অবকাশ পাওয়া গেল না। এ কালের স্ত্রীরা ‘পতির শূন্যে সতীর পুণ্য’তে বিশ্বাসী নয়। চরম শরীর খারাপ থাকলেও কোথাও বেড়াতে যাওয়ার নাম শুনলেই স্বাতী চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এমনই ওর ভ্রমণের নে তা ছাড়, জার্মানি থেকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী ট্রবার্টা আলাদাভাবে স্বা তাঁকে নেমন্তন্ন করেছেন, বইমেলা কর্তৃপক্ষও আমন্ত্রিত লেখকদের স্ত্রীদের আতিথ্য দিতে রাজি। সুতরাং বিশেষ অতিরিক্ত খরচের ব্যাপার নেই।
বাদল বসুর স্ত্রীর নাম কুমকুম। এটা তার ডাক নাম, অন্য একটা কী যেন ভালো নাম আছে, সেটা মনেই থাকে না। কুমকুমই তো ভালো নাম। যেমন বাদলের পোশাকি নাম দ্বিজেন্দ্রনাথ, কিন্তু বাদল নামটিতেই তাকে ঠিক ঠিক মানায়।
শরৎকালের এক সকালে আবার আমরা পৌঁছলাম ফ্রান্সে। বাদল সস্ত্রীক উঠল তার বাল্যবন্ধু শুভেন্দু চৌধুরীর অ্যাপার্টমেন্টে, আমি আর স্বাতী অসীম রায়ের আবাসে। গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই আমার মনে হল, অসীমের টিভি সেটটার অবস্থাটা আগে দেখতে হবে। বসবার ঘরে এসে আমি প্রথমেই টিভির পাশে চলে গেলাম। চার-পাঁচ বছর ধরে যেমন দেখছি, সেই রকমই পেছনের ডালাটা সম্পূর্ণ খোলা, সমস্ত তার-ফার, যন্ত্রপাতি বেরিয়ে আছে। বছরের পর বছর ধরেই অসীম ওটা সারাবার কথা ভেবে যাচ্ছে। ডালাটা ধরে এদিক ওদিক নাড়াচাড়া করলেই অবশ্য ছবি ফোটে, কাজ চলে যায়।
সারা বাড়ির আর কোনও পরিবর্তন হয়নি, এমনকি আমি একবার যে কম্বল ও তোক পুড়িয়ে ফুটো করে দিয়েছিলাম, সে সবও অবিকল এক জায়গায় রয়েছে। কিন্তু অসীমের রান্নাঘরটা দেখে আমরা চমৎকৃত। এ যে একেবারে নতুন রান্নাঘর। আগে ছিল মলিন ওয়ালপেপার, এখন ঝকঝকে নতুন, পাখি আঁকা সুদৃশ্য টালি সারা দেওয়ালে। নানারকম কাঠের খোপ, অনেক বাহারি ব্যবস্থা। এই সব কাজই অসীম নিজের হাতে করেছে। দেওয়ালে টালি বসানো, কাঠ কাটা, পেরেক, ইস্কুরুপ মারা, ঘষাঘষি, রং করা সব কিছু। এসব দেশে মিস্তিরি ডাকতে গেলে প্রচুর খরচ, তাই অনেককেই ছাদ সারাই থেকে জলের কল বদলানো পর্যন্ত সব কাজ শিখে নিতে হয়, নানারকম বই আছে এ সব বিষয়ে, সুবিধেজনক যন্ত্রপাতিও পাওয়া যায়। আমাদের দেশ থেকে যেসব ভালো ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক ও অধ্যাপকরা ও সব দেশে বসতি নেয়, তারা কিছু দিনের মধ্যেই খুব ভালো রাঁধুনি, ছুতোর ও কলের মিস্তিরি, ঘরামি ও মালি হয়ে যায়।
অবশ্য অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মতন যদি কারুর ভাগ্যে অতিশয় পতিব্রতা ও দশভুজা স্ত্রী থাকে, তার কথা আলাদা। শুনেছি কবি অলোকরঞ্জন এখানও চা বানাতে জানেন না। এক দিন ফাঁকা বাড়িতে তিনি একটা ডিম সেদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, সসপ্যানের মধ্যে একটা ডিম রেখে সেটা চাপিয়েছিলেন উনুনে, কিন্তু সসপ্যানের মধ্যে যে খানিকটা জলও দিতে হয়, সেটা তাঁর জানা ছিল না। তার ফলে ডিমটার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল কে জানে!
অসীমের রান্নাঘরটা একেবারে চকচকে নতুন হয়ে গেলেও অনেক দিনের একটা তোবড়ানো কেতলি, যেটার তলাটা একেবারে ঝিরকুট কালো হয়ে গেছে, সেটা সে ফেলেনি। একটা হাতল ভাঙা ডেকচি, কয়েকটা চলটা ওঠা কাপও যথাস্থানে রয়েছে। অসীম বোধহয় এ-সবগুলোকে অ্যান্টিক বানাতে চায়।
পুরো একটা রান্নাঘর বানিয়ে ফেলেছে, অসীমের হাতের কাজ ভালোই। যদিও দু একটা টালি ঈষৎ বাঁকা হয়েছে, তাতে কিছু আসে যায় না। অসীমের স্বভাবের অদ্ভুত দিক হচ্ছে এই যে, সে আশা করে, নতুন কেউ এলে তার রান্নাঘরটার প্রশংসা করবে। কিন্তু তারা যদি দু-একটা টালির বক্রতা সম্পর্কে উল্লেখ না করে, তা হলে অসীম বলবে, সেই লোকগুলোর পর্যবেক্ষণ শক্তি নেই!
অসীম টেলিফোন কোম্পানিতে বড় চাকরি করে তো বটেই, তা ছাড়া প্যারিস শহরে সে একটা রেস্তোরাঁর মালিক হয়েছে। সারাদিন অফিস করার পর প্রায় সন্ধেবেলাতেই সে তার রেস্তোরাঁ দেখতে যায়। প্রথমে সে তার এক সিলোনিজ বন্ধুর সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে রেস্তোরাঁর ব্যাবসা শুরু করেছিল, এখন জড়িয়ে পড়েছে পুরোদস্তুর। এ ছাড়া তার ছবি তোলার শখ, প্রাইজ পাওয়ার মতন ছবি তোলে, বই পড়ে, রবিবার সকালে বাগানের পরিচর্যা করে ও ঘাস ছাঁটে। ব্যাচেলর মানুষ, নিজস্ব একটা বাড়ি, অর্থ চিন্তা নেই, যখন যা খুশি করতে পারে। অসীমের এই একলা স্বাধীন জীবন ঠিক ঈর্ষাযোগ্য কি না আমি বুঝতে পারি না। আমাদের সকলেরই একাকিত্ব সম্পর্কে মোহ আছে। শহুরে জীবনের হুড়োহুড়ি থেকে কিছুদিন বাইরে গিয়ে কিছু দিনের নির্জন বাস আমিও বেশ উপভোগ করি, কিন্তু কয়েক দিন পরেই তো মন আকলি-বিকুলি করে। মানুষ বন্ধু-বান্ধবদের সংসর্গ পাওয়ার জন্য ছুটে যায়। আবার জীবনের একটা পর্বে বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকে হু হু করে, সেই উপলব্ধির নির্মমতাও বড় সত্য। অসীমের অবশ্য বেশ কয়েকজন ভালো বন্ধু বান্ধবী আছে, সে একটা ফাঁকা বাড়িতে থাকে বটে, কিন্তু তাকে ঘিরে একটা বৃত্তও আছে। এ এক অন্যরকম জীবন, ঠিক ঘরোয়া বাঙালিপনাও নেই, আবার পুরোপুরি পশ্চিমিও নয়।
দুপুরবেলা বসা হল ম্যাপ ও বইপত্র নিয়ে। এবার যাওয়া হবে কোন দিকে? অসীম আগে থেকেই খানিকটা এঁকে রেখেছে, আমায় বলল, নর্মান্ডির দিকে গেলে কেমন হয়? একেবারে সমুদ্র পর্যন্ত চলে গিয়ে ধার দিয়ে দিয়ে এগোব। ওদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনও আছে। তারপর একেবারে ম-সাঁ-মিশেল দেখে আসব। সেটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলতে পারো।
আমি মঁ-সাঁ-মিশেল নামটা আগে শুনিনি। জিগ্যেস করলাম, সেখানে কী আছে?
আগে থেকে এই জায়গাটার নাম না জানা আমার অপরাধ, সেই জন্যই অসীম আমাকে ধমক দিয়ে বলল, গেলেই দেখতে পাবে।
এবারে প্রশ্ন উঠল, ভাস্করকে নেওয়া হবে কি না। ভাস্কর প্রত্যেকবার আমাদের সঙ্গে যায়। ভাস্কর না থাকলে জমে না। কিন্তু ভাস্করের সেই হেঁচকির অসুখ আজও সারেনি, বরং বেড়েছে, ইংল্যান্ডে ওদের ব্যাবসার ব্যাপার নিয়ে কিছু গণ্ডগোল চলছে। সে জন্য এ সময় ভাস্করকে টেনে আনা ঠিক হবে না। তা ছাড়া এক গাড়িতে পাঁচ জনের বেশি যাওয়া অসুবিধেজনক; অসীমের গাড়িটা হচ্ছে পেজ, তাতে পাঁচজনেই বেশ আঁটাআঁটি হয়। ভাস্কর থাকবে না বলে আমার মনটা খচখচ করলেও মেনে নিতেও হল। অবশ্য ইংল্যান্ডে ভাস্করের বাড়িতে একবার যেতে হবেই।
দু-একদিন প্যারিসে থেকে আবহাওয়া গায়ে সইয়ে নিতে হয়। প্যারিসের বাতাস অতি হালকা। আজকাল ইউরোপে পরিবেশ ও বাতাস দূষণের প্রশ্ন উঠেছে খুবই, কিন্তু আমরা কলকাতা থেকে গিয়ে তার কিছু টেরই পাই না। এই সব জায়গায় এলে টের পাওয়া যায়, কলকাতার হাওয়া ধোঁয়া ও ধুলোয় কতটা ভারী।
স্বাতী এর আগে একবার ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডা ঘুরে গেলেও কুমকুম দেশের বাইরে আগে কখনও আসেনি। বাংলার বাইরেও খুব বেশি ঘোরাঘুরি করেনি। প্রথম বিদেশ বলতেই একেবারে প্যারিস। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, তার ব্যবহারে কোনও আড়ষ্টতা নেই, কোনও কিছুতেই সে ঘাবড়ায় না। স্বাতীর থেকে সে অনেক বেশি স্মার্ট। স্বাতী পাক্কা তিন বছর ফরাসি শিখেছে, কিন্তু প্যারিসে এসে সে একটাও কথা বলতে পারে না, লজ্জায় তার মুখ ফোটে না, যদিও আমি অন্য লোকের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা ফ্রেঞ্চ বলতে গেলে স্বাতী আমার ব্যাকরণের ভুল ধরে। এদিকে কুমকুমের কোনও অসুবিধে নেই, সে ইংরিজি-বাংলা মিলিয়ে দিব্যি কাজ চালিয়ে দেয়। দোকান থেকে একা একা গিয়ে জিনিস কিনে আনে। কুমকুমের ভাবখানা এই, ফরাসি সাহেবরা ফ্রেঞ্চ বলে তাতে কী হয়েছে, তা বলে কি আমাকেও ওদের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ বলতে হবে? কেন, ওরা কী আমাদের দেশে গিয়ে বাংলা বলে? কিংবা, সাহেবদের দেশে পার্কগুলো খুব সুন্দর হবে, দোকানপাট খুব সাজানো-গোছানো হবে, এতেই বা অবাক হওয়ার কী আছে? এ-রকমই যে হওয়ার কথা, তা তো সবাই জানে! এর উলটো কিছু হলেই বরং অবাক হওয়ার ব্যাপার ছিল! হ্যাঁ, যদি দেখতাম, এখানকার রাস্তাও কলকাতার মতন ভাঙাচোরা আর নোংরা, তা হলে বলতাম, ম্যাগোঃ, এই নাকি তোমাদের প্যারিস!
কুমকুমের ব্যবহার দেখে আমার সুকুমার রায়ের কিছু কিছু চিঠির কথা মনে পড়ে। প্রথম বিলেতে গিয়ে সুকুমার য়ায় তাঁর বাবাকে ও মাকে অনেকগুলি চিঠি লিখেছিলেন, যা অনেক কাল পরে ছাপা হয়েছে। সেকালে ইংল্যান্ড ছিল অনেক দূরের দেশ। জাহাজে তিন সপ্তাহের ধাক্কা। অথচ লন্ডন শহর সম্পর্কেও সুকুমার রায়ের কোনও বিস্ময়বোধ নেই, সবই যেন তাঁর জানা। বরং কোনও একটা দোকানে গিয়ে বিশেষ কিছু ব্লক বা ফটোগ্রাফির সরঞ্জাম খোঁজ করেও পাওয়া যাচ্ছে না, বলে তিনি বেশ বিরক্তি প্রকাশ করছেন! অথচ তাঁর পরেও কত বঙ্গসন্তান লন্ডনে গিয়েই একেবারে গদোগদো হয়ে গেছে!
বাদল বসুকে যারা কলকাতায় দেখেছে, তারা বিদেশে দেখলে চট করে চিনতেই পারবে না। কলকাতায় বাদলের প্রতিদিনের পোশাক ধুতির ওপর সাদা শার্ট। ক্যালকাটা ক্লাব কিংবা রাজভবনে নেমন্তন্ন থাকলেও বাদল বসু ধুতি-শার্ট আর চটি বদলাবে না। কিন্তু শীতের দেশে গিয়ে কোট-প্যান্ট পরতেই হয়। সাহেবি পোশাক পরলে অনেকের মেজাজটাও সাহেবি হয়ে যায়, বাদলের ক্ষেত্রে হয়ে যায় ঠিক তার উলটো। কলকাতায় ধুতি-শার্ট পরা যে বাদল বসুর এত হাঁকডাক ও ব্যক্তিত্বের দাপট, তারই গলার স্বরটা কেমন যেন চুপসে যায় কোট-প্যান্ট আর জুতো মোজা পরার পর। অবশ্য বিদেশেও বাড়ির মধ্যে ওইসব ধড়াচুড়ো ছেড়ে লুঙ্গিটা পরে কোমরে গিঁট দিতে না দিতেই আবার কণ্ঠস্বরের তেজ ফিরে আসে। মেদিনীপুরের ছেলে বাদল, প্যারিস হোক বা লন্ডনই হোক, লুঙ্গিটা না পরলে তার ঠিক জুত হয় না।
দু-একদিন প্যারিসের রাস্তায় সবাই মিলে বেড়াতে-বেড়াতে আমি লক্ষ করলাম, বাদলের বন্ধু শুভেন্দুদাকে সবাই যেন একট একটু ভয় পায়। এমনকি অসীম পর্যন্ত। মাঝে মাঝে সকলের ওপরই দাদাগিরি করার স্বভাব অসীমের, সেও শুভেন্দুকে ধমকে কথা বলার সাহস পায় না। যদিও শুভেন্দু চৌধুরী খুবই সুদর্শন ও শান্ত ধরনের মানুষ। কখনও গলার আওয়াজ উঁচুতে ওঠে না, তবু তাকে সবাই এমন সমঝে চলার কারণ তার মুড। কখন কীসে তার মুড় নষ্ট হয়ে যাবে তার কোনও ঠিক নেই, সেই জন্য সবাই সব সময় সতর্ক থাকে। মুড নষ্ট হয়ে গেলেই শুভেন্দু একেবারে গম্ভীর হয়ে যাবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটাও কথা বলবে না। শুভেন্দু নিজে কখনও কারুকে সামান্য আঘাত দেয় না, কোনও আড্ডার পরিবেশ তার পছন্দ না হলে সেখান থেকে সে নিঃশব্দে সরে পড়ে। কখনও কোনও জায়গায় একসঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব হলে শুভেন্দু একবার যদি বলে সেখানে সে যাবে না, তা হলে কিছুতেই আর তাকে রাজি করানো যাবে না। কেন সে যাবে না, সে কারণও সে জানাবে না।
অসীম একা বাড়িতে থাকলেও অনেকের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে, নিয়মিত অন্যদের খবরাখবর নেয়। সত্যিকারের একাকিত্ব ভোগ করে শুভেন্দু, স্বেচ্ছায়। আমার চেনাশুনো সমস্ত বাঙালিদের মধ্যে শুভেন্দুর মতন এমন নীরবতা উপভোগ করতে বা পালন করতে আর কারুকে দেখিনি। একেবারে অন্যরকম চরিত্রের মানুষ বলেই তাকে আমার বেশ পছন্দ হয়।
শুভেন্দু সিগারেট খায় খুব কম। কিন্তু কোনও সময়ে যদি চেনা কারুর কাছ থেকে সে একটা সিগারেট চায়, তা হলে বুঝতে হবে তার মেজাজ তখন ভালো আছে। সে হাসবে, কথা বলবে। কিছুক্ষণের জন্য যেন সে বাস্তব জগতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তখন।
আমাদের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার জন্য শুভেন্দুকে কোনও প্রস্তাবই দেওয়া হল না। দিলেই হয়তো সে প্রত্যাখ্যান করবে, এই ভয়ে।
এক সন্ধেবেলা আমি হাঁটতে-হাঁটতে আমাদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়েছি, স্বাতী আমার কাছে এসে বলল, এই, তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন? মার্গারিটের কথা মনে পড়ছে বুঝি?
আমি বললাম, তা তো মনে পড়বেই! পড়বে না?
স্বাতী বলল, এখন যদি হঠাৎ রাস্তায় মার্গারিটের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তা হলে কেমন হয়?
আমি বললাম, তা হলে…তা হলে সবাই মিলে একসঙ্গে হইহই করা হত। মার্গারিট তোমাকে এমন সব ছোট ছোট ছবির গ্যালিরিতে নিয়ে যেত, যার সন্ধান অনেকেই জানে না।
স্বাতী বলল, মার্গারিটকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, এই যে রাস্তা দিয়ে অনেক মেয়ে যাচ্ছে, অনেকেই খুব সুন্দর, এদের মধ্যে মার্গারিটকে ঠিক কার মতন দেখতে ছিল বলো তো?
আমি বললাম, কারুর মতনই নয়। মার্গারিটকে তেমন একটা সুন্দরী বলা যায় না। তবে সে অন্যরকম। এইসব সুন্দর-সুন্দর মেয়েদের সঙ্গে তার তুলনা দেওয়া চলে না।
যুক্তি দিয়ে আমি বুঝি, হঠাৎ রাস্তায় মার্গারিটের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তার সেরকম স্বাভাবিক জীবন থাকলে সে কিছুতেই হঠাৎ আমকে চিঠি লেখা বন্ধ করত না। কিন্তু চোখ এই যুক্তি মানে না। মাঝে মাঝে কোনও কোনও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠি। ঠিক যেন মনে হয়, দূর থেকে মার্গারিট হেঁটে আসছে আমার দিকে। চেহারার মিল না থাকলেও ফরাসি মেয়েদের হাঁটার ভঙ্গির মধ্যে কিছুটা মিল খুঁজে পাই।
একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর স্বাতী বলল, তুমি বলেছিলে, প্রথমবার যখন তুমি ফরাসিদেশে এসেছিলে, তখন তোমার মনে হয়েছিল, এখানে সবাই কবি। তারপর সত্যি সত্যি কোনও ফরাসি কবির সঙ্গে তোমার আলাপ হয়নি? এখানে এসে আমরা কি শুধু বাঙালিদের সঙ্গে মিশব আর বাঙালিদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাব? আমার খুব ইচ্ছে করে কোনও ফরাসির বাড়ি যেতে, দু-একজন কবি কিংবা শিল্পীকে দেখতে।
বেলজিয়ামের এক কাব্যসম্মেলনে একবার বেশ কিছু ফরাসি কবির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। অনেকে ঠিকানা ও নিজেদের কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়েছিল আমাকে। সে সব কিছুই আনিনি সঙ্গে। তবে আর একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তার নাম পিলিপ লামবিয়ার। প্যারিসে একটি ‘মেইজোঁ দ্য পোয়েজি’ অর্থাৎ ‘কবিতা-ভবন’ আছে, পিলিপ লামবিয়ার তার পরিচালক। সেখানে প্রচুর কবিতার বই ও পত্রপত্রিকা থাকে, মাঝে মাঝেই বসে একক কবিতা পাঠের আসর, অন্য সময় তরুণ-তরুণী কবিরা আসে আড্ডা দিতে। সেখানে যাওয়া যেতে পারে।
তারপর মনে পড়ল ভ্যারনার ল্যামবারসির কথা। এই ভ্যারনারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়, বেশ কিছু বছর আগে। নারায়ণ মুখার্জি এক সকালবেলা তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল আমাদের ফ্ল্যাটে। ভ্যারনারের চেহারায় এমনই বৈশিষ্ট্য আছে যে প্রথম দেখলে চমকে উঠতে হয়। তার মাথার চুল ধপধপে সাদা, মুখভরতি শুভ্র দাড়ি, অথচ চোখ ও মুখ তারুণ্যে উজ্জ্বল, তার বয়েস তখন চল্লিশেরও কম। আই সি সি আর-এর আমন্ত্রণে সে ভারত দর্শনে এসেছিল।
ভ্যারনার ফরাসি নয়, বেলজিয়ান। অতটুকু দেশ বেলজিয়াম, সেখানেও ভাবা সমস্যা আছে, ফ্লেমিশ ও ফরাসি ভাষাভাষীদের মধ্যে রেষারেষি ফুটে ওঠে কখনও কখনও। বেলজিয়ামে থেকে যারা ফরাসি ভাষায় লেখে, মূল ফরাসি সাহিত্যে স্থান পেতে হলে তাদের প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়। এরকম দু-চারজনই পেরেছেন শুধু। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত মরিস মেটারলিংক। এককালে তাঁর দুটি নাটক ‘মন্না ভান্না’ আর ‘নীল পাখি’ বাংলাতেও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেকের ধারণা, রবীন্দ্রনাথ তাঁর রূপক নাটকগুলি রচনা করার সময় মেটারলিংকের লেখার প্রভাবে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়েসে এক বছরের ছোট ছিলেন মেটারলিংক কিন্তু নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন দু’বছর আগে।
ফরাসি সাহিত্যে স্থান পাওয়ার জন্য মেটারলিংককে বেলজিয়াম ছেড়ে ফ্রান্সে বসবাস করতে হয়েছিল। ভ্যারনার ল্যামবারসিও তাঁর এই বিখ্যাত পূর্বসুরীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। শুধু দেশ নয়, নিজের স্ত্রী ও কন্যাকেও পরিত্যাগ করে সে প্যারিসে সংসার পেতেছে।
ভ্যারনার খুব নম্র ও মৃদুভাষী মানুষ। প্রতিটি কথাই চিন্তা করে বলে। তার কবিতাও খুব সূক্ষ্ম ধরনের। আগাগোড়া বিমূর্ত বলা যেতে পারে। ভ্যারনারের একটা সংকল্প শুনে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সে একজন কবি, সুতরাং সে প্রতিজ্ঞা করেছে, জীবনে এক লাইনও পদ্য লিখবে না!
অধিকাংশ কবিই গল্প-উপন্যাসে ছুঁতে চায় না। কিন্তু তারা সমালোচনা, প্রবন্ধ কিংবা ভ্রমণকাহিনি লেখে, সমসাময়িক লেখকদের খোঁচা মারা রম্য রচনা লিখতে ছাড়ে না। কবিদের গদ্য সাধারণত ঔপন্যাসিকদের চেয়েও ভালো হয়। কিন্তু ভ্যারনার কোনও গদ্যই লিখবে না। পৃথিবীর এত দেশ ঘুরেছে, তবু ভ্রমণকাহিনিও নয়! এ কথাটা শুনে হৃদয়ঙ্গম করতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। আমাকে এতরকম গদ্য লিখতে হয়, অথচ এই একজন এক লাইনও গদ্য লিখবে না, কী সুখে আছে এই লোকটা!
প্যারিসে ভ্যারনারের সঙ্গে আমার আগে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। বেলজিয়াম ছেড়ে এসে প্রথম প্রথম সে বেশ অসুবিধেয় পড়েছিল। প্লাস দ্য লা কঁক-এ একটা প্রাসাদ-বাজার আছে, সেখানে একটা দোকানে সেলস ম্যানেজারের চাকরি নিতে হয়েছিল তাকে। আমাদের নারায়ণ মুখার্জিও তখন প্যারিসে। নারায়ণকে স্বাতী অনেকদিন ধরেই চেনে। এক পাড়ার ছেলে হিসেবে। আর কলকাতার তরুণ সাহিত্যিক মহলে নারায়ণ ফরাসিবিদ হিসেবে পরিচিত। ফ্রান্সে সে তখন গবেষণা করছে, তার সূত্রেই আবার যোগাযোগ হয়েছিল ভ্যারনারের সঙ্গে।
সারা ভারতবর্ষ ঘুরলেও কলকাতা সম্পর্কে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ জন্মে গেছে ভ্যারনারের। সে দ্বিতীয় বিবাহ করেছে প্যাট্রিসিয়া নামে একটি তরুণী কবিকে, এবং হনিমুন করতে নববধূকে নিয়ে এল কলকাতায়। পৃথিবীতে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা থাকতে কেউ কি কলকাতার গরমে, নোংরায়, ভিড়ে, গাড়ির হর্নের বিকট শব্দের মধ্যে মধুযামিনী যাপনের কথা ভাবতে পারে? সেবার ভ্যারনার সস্ত্রীক উঠেছিল আমাদের বাড়িতে। বলেছিল, জানো তো বিয়ের আগেই আমি প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে শর্ত করেছিলাম, কলকাতায় হনিমুন করতে যাব কিন্তু, রাজি তো?
প্যাট্রিসিয়ার মতন এমন নরম, লাজুক মেয়ে খুব কম দেখা যায়। সে কথা প্রায় বলেই না। শুধু হাসে। আমাদের বাড়িতে কত রকম অসুবিধে, বাথরুম-টাথরুম তো আর সাহেবদের মতন নয়, আর রান্নাও নিছক বাঙালি ধরনের, তবু কোনও কিছুতেই তার আপত্তি নেই। কোনও অভিযোগ নেই কলকাতা সম্পর্কে। সব কিছুই তার ভালো লাগছে।
ওদের নিয়ে একদিন গিয়েছিলাম শহর ছাড়িয়ে গঙ্গা দেখতে। ডায়মন্ড হারবার পার হয়ে হারউড পয়েন্টের কাছটা একেবারে ফাঁকা, নদীও অনেক চওড়া। সেখানে একটা নৌকো ভাড়া করে ঘোরা হল। মাঝগঙ্গায় এসে ভ্যারনার জিগ্যেস করল, এখানে সাঁতার কাটা যায় না?
আমরা কেউ সাঁতারের জন্য তৈরি হয়ে আসিনি। তা ছাড়া, মাঝিরা বলল, সমুদ্রের কাছাকাছি বলে এখানকার গঙ্গায় মাঝে মাঝে ছোট ছোট হাঙর দেখা যায়। সেই ভয়ে এখানকার মাঝনদীতে কেউ সাঁতার কাটতে নামে না।
ভ্যারনার সেই সতর্কবাণী গ্রাহ্য করল না। সে অনেকটা আপন মনে বলল, মানুষের জীবনটা কত সংক্ষিপ্ত, তার মধ্যেও কত সময় আমরা নষ্ট করি।
তারপর আবার বলল, এই নদী কী অপূর্ব। নদীতে অবগাহন না করলে নদীকে ঠিক উপভোগ করা যায় না।
স্ত্রীর দিকে ফিরে জিগ্যেস করল, নামব?
প্যাট্রিসিয়া সঙ্গে-সঙ্গে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
জুতো-জামা-প্যান্ট খুলে ফেলে, শুধু জাঙ্গিয়া পরে ভ্যারনার লাফ দিল মাঝগঙ্গায়।
আমার মনে পড়ল জামসেদপুরের কাছে সুবর্ণরেখা নদী দেখে অ্যালেন গিনসবার্গও ঠিক এই রকমই ব্যবহার করেছিল। তখন সন্ধ্যা ঝুঁকে পড়েছে জলের ওপর, দূরের পাহাড় অস্পষ্ট। অ্যালেন বলল, বাঃ! তারপর জামা-প্যান্ট খুলে জলে নেমে গেল।
ওদের নদী-দর্শন আর আমাদের নদী-দর্শন আলাদা। ওদের অতীন্দ্রিয় অনুভূতিগুলিও শরীর-মাধ্যম।
ভ্যারনার ল্যামবারসির প্যারিসের বাড়িতে খেতে গেছি বার দু-এক। একবার বিজয়া মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও আরও কেউ কেউ সঙ্গে ছিল। সেবার ভ্যারনারকে ফোন করতেই সে চলে এল। একদিন এক কাফেতে অনেকক্ষণ আড্ডা হল ও পরবর্তী রাতে নেমন্তন্ন করল আমাদের। প্যাট্রিসিয়া স্বা তাঁকে বিশেষ পছন্দ করে, স্বাতী এসেছে শুনে সে তার লাজুক স্বভাবেও উচ্ছ্বসিত।
খাঁটি ফরাসি সংসার নয়, বেলজিয়ান-ফ্রেঞ্চ মিশ্র পরিবার। শুধু দু’জন। ওদের অ্যাপার্টমেন্টটি বেশ ছোট। প্যারিসের বুকে পুরোনো আমলের পাঁচতলা বাড়ি, কিন্তু লিফট নেই, সরু কাঠের সিঁড়ি। ভ্যারনার স্বা তাঁকে ও আমাকে ওদের বাড়িতে কয়েকদিন থাকার জন্য খুব পেড়াপিড়ি করেছিল, কিন্তু আমরা বুঝেছিলাম, তাতে ওদের খুবই কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। একখানা শোওয়ার ঘর ও একটি বসবার ঘর, তাও বেশ ক্ষুদে ক্ষুদে। প্যাট্রিসিয়া স্কুলে পড়ায়, ভ্যারনার তখন বেলজিয়ান সরকারের একটি চাকরি পেয়েছে। সুতরাং বোঝা যায়, প্যারিসের বাড়ি ভাড়া কী সাংঘাতিক। তবে, কবি-দম্পতির এমন ছোট্ট বাসাই মানায়। যেন বৃক্ষচূড়ে কপোত-কপোতী।
সেবার গেছি অসীম, স্বাতী ও আমি। নানারকম সুখাদ্য। প্যাট্রিসিয়া জানাল যে সে কিছুই রান্না করেনি, সবই বেঁধেছে ভ্যারনার। ভ্যারনার গদ্য লেখে না বটে, কিন্তু তার রান্নার শখ আছে। সে বলে, অনেকের যেমন বাগান করা কিংবা ফোটোগ্রাফির বাতিক থাকে, তেমনি তার শখ রান্না। সে রান্নাটাকেও শিল্পের স্তরে নিয়ে যেতে চায়।
অসীম এখন একটা রেস্তোরাঁ চালাচ্ছে, সুতরাং রান্না সম্পর্কেও মতামত দেওয়ার তার একটা অধিকার আছে। সেও স্বীকার করল যে শ্যাম্পেন দিয়ে পাখির মাংসের পদটি অত্যুত্তম।
ভ্যারনার সম্পর্কে এত কথা মনে পড়ার আর একটি কারণ আছে। মানুষের মধ্যে যে কত রহস্য তা আমি সেদিন একটি কথা শুনে নতুন করে অনুভব করেছিলাম। এখনও মানব প্রকৃতির অনেকটাই আমরা জানি না।
ভ্যারনারকে সেদিন প্রশ্ন করা হচ্ছিল যে কলকাতা সম্পর্কে তার এত আকর্ষণের কারণ কী? কেন সে বারবার কলকাতায় যেতে চায়?
ভ্যারনার বলল, ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে এর প্রধান কারণ আমার মা। তিনি থাকেন বেলজিয়ামে, বেশ অসুস্থ। একবার আমি মায়ের শিয়রের পাশে বসে নানান দেশে বেড়াবার গল্প বলছি, বিভিন্ন শহরের নাম বলতে-বলতে যেই কালকাতার নাম বলেছি, মা অমনি মাথা উঁচু করে বললেন, ওই তো! ওই কলকাতাই তোর জায়গা।
আমরা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার মা কখনও কলকাতায় গিয়েছিলেন? কিংবা পিয়ের দ্য লাপিয়ের-এর বই পড়েছেন?
ভ্যারনার বলল, না। মা বিদেশে বিশেষ যাননি। ওই বইও পড়েননি। তবু মা বললেন, ওই কলকাতা থেকে তোর একটা বই বেরুবে। নিশ্চয়ই বেরুবে। তুই যখন মরবি, তখন কলকাতায় যাবি। মরার পক্ষে কলকাতাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা।
ভ্যারনারের মা কেন এই কথা বলেছিলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।