মিসেস টেলারের বয়স শুনলুম উনআশি কিন্তু দেখলে মনে হয়, অনেক-অনেক কম। শান্ত শীতলশী মুখের মধ্যে যেন জননীর ছায়া আছে! কথা বলেন খুব আস্তে। বিশাল ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী! কিন্তু এক সময় তিনি কবিতা লিখতেন। বললেন, হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথকে আমার মনে আছে। এখনো যেন স্পষ্ট দেখতে পাই তাঁর সেই অসাধারণ রূপবান মূর্তি।
আমি জিগ্যেস করলুম, আপনার তখন বয়স নিশ্চয়ই খুব কম ছিল।
-হ্যাঁ, আমি তখন কচি খুকি প্রায়। নিউইয়র্কের একটা হোটেলে দাসীর কাজ করি আমার ভুরু দুটি তখন জিজ্ঞাসার দ্বিতীয় ব্রাকেট হয়েছে দেখে তিনি হেসে বললেন, হ্যাঁ, আমি তখন একটা হোটেলে বাসন ধোয়ার কাজ করতুম, সপ্তাহে দশ ডলার মাইনে। তখনও ডনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি।
মিসেস টেলারের শিল্পপতি স্বামী পাশে বসেছিলেন, মৃদু হাসলেন, বললেন, জুডি, তখন তোমার চুলের রং কালো কুচকুচে ছিল।
মিসেস টেলার হাসতে-হাসতে বললেন। এখন রূপোলি! কিন্তু তুমি তো রুপোর রং পছন্দ করো। হ্যাঁ, তারপর একদিন বিকেল বেলা আমার বন্ধু গটফ্রিড (সে ছিল সত্যিকারের ভালো কবি, আহা বেচারা অল্প বয়সে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়) হঠাৎ টেলিফোন করে জিগ্যেস করল, আমি একজন ইনডিয়ান কবির বক্তৃতা শুনতে যাব কি না। আমি প্রথমটা খুব অবাক হয়েছিলাম, কারণ জানো তো, ইন্ডিয়ান শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে এখানকার আদি অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের কথা। রেড ইন্ডিয়ানরা আবার কবিতা লেখে তাও আমি শুনতে পাব নিউইয়র্কে বসে। গটফ্রিডের যত পাগলামি। একটু পরেই সব বুঝতে পারলুম। গটফ্রিড যোগব্যায়াম করতো, হিন্দু বৌদ্ধ শাস্ত্র সম্পর্কে কৌতূহল ছিল, ও অনেক খবর রাখতো। ওর মুখে আমি প্রথম টেগোরের নাম শুনলুম। তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন এবং শুধু কবি নন, মানুষ হিসেবেও মহাপুরুষ।
আমার তখন একটিই ভদ্রগোছের গাউন ছিল, সেটাও সেদিন একটু আগে কেচে দিয়েছি। এখানকার খুকিদের মতো তখন আমরা ট্রাউজারস পরে পথে-পথে বেরুতে পারতম না তাড়াতাড়ি ইস্ত্রি ঘষে সেই ভিজে পোষাকটাই কোনওরকমে শুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম গটফ্রিডের সঙ্গে। ব্রডওয়ে অঞ্চলের একটা থিয়েটার, আমার নাম ঠিক মনে নেই। অসংখ্য লোক এসেছিল। তার আগে আমি কোনও ভারতীয়কে দেখিনি। পথেঘাটে দেখেছি হয়তো–কিন্তু আলাদাভাবে চিনতুম না, সমস্ত এশিয়াবাসীদের আমার মনে হতো একরকম। দেখলুম মঞ্চের ওপর কবি একটি চেয়ারে বসে আছেন। অমন রুপবান মানুষ আমি আগে আর দেখিনি, ওরকম জ্যোতির্ময় পুরুষ। পুরুষ মানুষ যে এত সুন্দর হয় (স্বামীর দিকে তাকিয়ে ঈষৎ ভঙ্গি) আমি কল্পনাই করিনি। সাদা চুল, বুক পর্যন্ত সাদা দাড়ি, একটা লম্বা স্লিপিং গাউনের মতো পোশাক পরেছিলেন, সে রকম একজন মানুষকে দেখা এক জীবনের অভিজ্ঞতা। উনি প্রথমেই একটি বক্তৃতা দিলেন। তারপর অনেকগুলি কবিতা পড়লেন। দীর্ঘ সুরেলা গলা, যেন গির্জায় একক সঙ্গীতের মতো। কথাগুলি আমার মনে নেই। কিন্তু সেই উদাসীন মহাপুরুষের কণ্ঠস্বর আমার কানে আজও ভাসছে। সত্যি বড় দুঃখের কথা উনি কী কবিতা পড়েছিলেন আমার একেবারেই মনে নেই–কিন্তু একটা বিশাল ঘটনা আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতে শেষ পর্যন্ত বসেছিলুম। শেষ হবার পর বেরিয়ে এলুম, কী যেন এক অনির্বচনীয় দুঃখ বুকে নিয়ে। দুঃখ এবং আনন্দের মিশ্র অনুভূতি, আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। কবিতা শুনলে যে এরকম হয়, তা তো জানতাম না আগে। সেদিন থেকে আমি কবিতাকে সত্যিকারের ভালোবাসতে শিখি। তোমাদের কবির ছোঁয়ায় আমার রূপান্তর ঘটে গিয়েছিল।
উনি যখন থিয়েটার থেকে বেরুচ্ছেন–হঠাৎ একদল মানুষকে দেখলুম ওঁর দিকে ছুটে যেতে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম-হঠাৎ কী কোনও কারণে লোকে ওঁকে আক্রমণ করতে চাইছে? তক্ষুনি জানতে পারলুম, আসলে তা নয়। উপস্থিত ভারতীয়রা ছুটে যাচ্ছেন তাঁকে অভিনন্দন জানাতে। কী বিচিত্র প্রথা–সবাই তাঁর সামনে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আমি গটফ্রিডকে জিগ্যেস করলুম। গডফ্রিড বলল, এশিয়ার লোকেরা কারুকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য তাঁর পা ছুঁয়ে ধুলো নেয়। এরকম কথা আমি জীবনে কখনো শুনিনি, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হল ওরকম মানুষকে শ্রদ্ধা জানাবার এটাই তো শ্রেষ্ঠ উপায়।
মিসেস টেলার আমার দিকে তাকিয়ে লাজুকভাবে হেসে বললে, তখন আমিও ওঁর সামনে হাঁটুমুড়ে বসে পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালুম।