তাহিতি দ্বীপের নাম শুনলেই পল গগ্যাঁর কথা মনে পড়ে। জীবনের শেষ কয়েকটি বছর গগ্যাঁ কাটিয়েছিলেন তাহিতি দ্বীপে। তাঁর অধিকাংশ বিখ্যাত ছবি এখানেই আঁকা। এবং এখানেই শেষ পর্যন্ত তাঁর মারাত্মক ব্যাধিজীর্ণ অভিশপ্ত, অবজ্ঞাত, অসহায় মৃত্যু। এখনও তাহিতির সমুদ্র পাড়ে একজন বৃদ্ধকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সে কতকগুলি ছেলেমানুষি ছবি এঁকে তলায় নাম সই করে গগ্যাঁ। সেই সব ছবি বহুমূল্যে বিক্রি হয় আমেরিকান বিবিদের কাছে। গগ্যাঁ নাম সই করার অধিকারও আছে সেই বৃদ্ধের–কারণ এক তাহিতি রমণীর গর্ভে সে পল গগ্যাঁরই সন্তান।
সেই তাহিতি এই সেদিন পর্যন্ত ছিল ভ্রমণকারীদের স্বর্গ। এবং ভ্রমণকারীদের ভাষায় ‘পৃথিবীর শেষ স্বর্গ’। এখনও এখানে ঝকঝকে সূর্যের আলো, টলটলে নীল জল, অজস্র ফল ফলের সম্ভার, এখানকার বাতাসে সুস্বাস্থ্যের সৌরভ। এখানকার জীবনযাপন শুরু আনন্দ ও রঙের সমারোহ, আর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এখানকার ওয়াহিন মেয়েরা। সেই সুন্দরীরা স্বর্গের অপ্সরীদের মতন, তারা বিবাহ বন্ধন মানে না, জানে না কোনও হিসেব নিকেশ। যে পুরুষকেই তার পছন্দ হয়, তারই বাহু বন্ধনে ধরা দেয়। পৃথিবীতে সম্ভবত এই শেষ জায়গা–যেখানে নারী-পুরুষের প্রেমের মাঝখানে কোনও আইন বা অর্থমূল্য নেই।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলির মধ্যে তাহিতির অধিবাসীরাও পলিনেশিয়ান গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং স্বভাবতই রূপবান। ১৯৬০ সালে তাহিতির পাপিতে শহরে জেট প্লেনের উপযোগী এরোড্রম খোলা হলে শুরু হয়, দলে দলে ধনী ভ্রমণ বিলাসীদের অভিযান। এদের মধ্যে আমেরিকানই বেশি। মিউটিনি অন দ্যা বাউনটি ছবির সুটিং এর সময় মারলন ব্র্যানডো এবং তাঁর দলবল গিয়েছিলেন ওখানে, তারপর আরও বহু সিনেমা কোম্পানি, উপভোগ-লোভী ব্যবসায়ীতে ভরে গিয়েছিল তাহিতি। ফলে এসেছে প্রচুর ডলার, খাদ্য ও আধুনিক উপকরণের ছড়াছড়ি, তাহিতির প্রত্যেকটি অধিবাসীই সুখ ও স্বাচ্ছন্দের মুখ দেখেছে। ছুটি আর খুশির হই-হল্লাই ছিল তাহিতির প্রাণ। পল গগ্যাঁ যেমন পেয়েছিলেন পাহুরা নামি সুন্দরী অধিবাসীনীকে, তেমনি অন্য পাহুরাদের খুঁজতে দলে দলে এসেছে গায়ে ফুলকাটা জামা পরা বিদেশিরা, পেয়েছেও অনেক।
তাহিতিতে আর বোধহয় পর্যটকরা তেমন আসবে না। বোধহয় তাহিতির স্বর্গেও ছড়িয়ে পড়বে বিষের ধোঁয়া। আণবিক পরীক্ষা বন্ধ চুক্তিতে সই করেনি যে দুই দেশ, সেই ফ্রান্স ও চিন এখন আণবিক বোমার বিস্ফোরণ চালিয়ে যাচ্ছে। এবং ফ্রান্সের বিস্ফোরণের জায়গা এই প্রশান্ত মহাসাগর। ফ্রান্স প্রথম বিস্ফোরণের পরীক্ষা চালিয়েছে সাহারা মরুভূমিতে, এখন তার পক্ষে সুবিধেজনক কেন্দ্র প্রতিবাদহীন প্রশান্ত মহাসাগর। ফ্রান্স অ্যাটম বোমা ফাটিয়েছে, অল্পদিনের মধ্যেই হাইড্রোজেন বোমা ফাটাবে। সেই ধোঁয়া এসে ছড়িয়ে যাবে তাহিতির আকাশে। অন্য দেশের ভ্রমণকারীরা এখন তাহিতি দ্বীপ বর্জন করতে শুরু করেছে। আবার স্বর্গ থেকে পতন।
তাহিতির সরল অধিবাসীরা এখনও তেমনভাবে এর প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারেনি। আমেরিকান ভ্রমণকারীরা আসা বন্ধ করায় ডলারের মিষ্টি ঝনঝন শব্দ বন্ধ হলেও ফ্রান্সের, ফ্রাংকের নোট এখনও সেখানে বাতাসে উড়ছে। আণবিক পরীক্ষার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ফরাসি সরকার তাহিতিতে গড়ে তুলেছেন বিরাট সামরিক শিবির। ১৯৬২ সালের পর থেকে এখানে সামরিক বিভাগের হাজার লোক আস্তানা গেড়েছে এবং সৈনিকদের ব্যবহার, যদিও অনেক সময় বর্বরোচিত, নিরেট এবং কটু, কিন্তু পর্যটকদের তুলনায় টাকা খরচে তারা আরও উদার। সৈন্যবাহিনীর খরচ করা টাকার স্রোতে তাহিতির অধিকাংশ অধিবাসীরই আয় এখন দ্বিগুণ।
অ্যাটম বোমার বিস্ফোরণের জন্য সরল তাহিতিবাসীরা এখনও প্রতিবাদ জানাতে শেখেনি। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী অন্য দেশগুলি যথেষ্ট প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু সরকার তীব্র সমালোচনা করেছেন। চিলি থেকে উঠছে অসহিষ্ণু গুঞ্জরণ এবং জাপান সরকারিভাবে বিধিবদ্ধ প্রতিবাদ জানাবে ঠিক করেছে। ফ্রান্স সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। ফরাসি দেশকে কে না ভালোবাসে এমনকি তার পরম শত্রুরাও, কিন্তু সে ফরাসি দেশ মারণাস্ত্র প্রস্তুতকারক ফরাসি দেশ নয়, চিরকালের ফ্রান্স, যে ফ্রান্স সারা বিশ্বের সংস্কৃতির কেন্দ্র। কিন্তু ফরাসি সংস্কৃতিকে ভালোবাসলেও ফরাসী দেশের জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে কেউ সুনজরে দেখছে না।
তাহিতির অনেক সরল মানুষ এখনও ভাবে, বিস্ফোরণ হচ্ছে আটশো মাইল দূরে, সে তো অনেক দূর, একদিন প্রবল ঝড়ো বাতাস উঠবে। উড়িয়ে নিয়ে যাবে বিষের ধোঁয়ার মেঘ। তা আর এ পর্যন্ত পৌঁছবে না, তাহিতি স্বৰ্গই থেকে যাবে। ভয় কী? তবু বহিরাগতদের মুখে আশঙ্কা আর উদ্বেগের চিহ্ন দেখে এখন সর্বক্ষণ অ্যাটম বোমার আলোচনা, তাহিতির লোকেরা কী যেন এক অশুভ ছায়া দেখতে পেয়েছে। সমুদ্রে মাছ ধরার ছোট্ট ডিঙা একা বাইতে-বাইতে তাহিতির কোনও জেলে বিষণ্ণভাবে গান ধরে। সেই দিনগুলো ছিল ভালো, যেদিন এখানে বিদেশের সাদা মানুষেরা আসেনি, যন্ত্র আসেনি, সোনার টাকা আসেনি। তখন ছিল শুধু সমুদ্রের গান, ফুলের রং আর নারীর প্রেম। সেদিনই তাহিতি ছিল সত্যিকারের স্বর্গ।