‘উঠে বসে, আমি আমার পর্দাগুলোর আড়াল থেকে
ধরলাম অলক্ষ্য প্রজাপতিটাকে, যেন জ্যোৎস্নালোক দিয়ে গড়া
অথবা এক বিন্দু শিশির
আমার আঙুলের বন্দিত্ব থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফটে
প্রজাপতিটা আমাকে দিয়ে গেল সুগন্ধের মুক্তিপণ!’
-–আললাইসিউস
বারত্রাঁ
প্যারিস থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথম লোয়ার নদীর দেখা পেলাম অরলিজঁ শহরের কাছে এসে। এই শহরটির নাম শুনলেই আমার মনে পড়ে সেই উনিশ বছরের মেয়েটির কথা, যাকে বহু লোকের সামনে একটি খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। সেই যুবতীটি মানব সভ্যতার একটি বিস্ময়।
বাংলায় তার নাম লেখা হয় জোয়ান অফ আক। কেন আমরা জোয়ান বলি কে জানে! ইংরিজিতে বলে জোন অব আর্ক, বার্নার্ড শ’ তাকে নিয়ে যে নাটকটি লিখেছেন, তার নাম সেন্ট জোন। ফরাসিতে বলে জান দা’র্ক! বাংলায় জোয়ান কোথা থেকে এল? সে যাই হোক, এতকাল বাংলায় জোয়ান চলে আসছে, আমি তা বদলাতে চাই না। শেকসপিয়রকে এক সময় বাংলায় লেখা হত শেক্ষপীয়ার, যেমন ম্যাক্সমুলারকে লেখা হত মোক্ষমুলর, শুনতে বেশ ভালোই লাগত।
যে-সময় ফ্রান্স ছিল টুকরো টুকরো অঞ্চলে বিভক্ত, ইংরেজরা এদেশের অনেকখানি ভেতরে ঢুকে পড়ে নানা জায়গা হস্তগত করে নিয়েছে, যুদ্ধ চলছে সর্বক্ষণ, ফরাসি সামন্তরা কে কার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আর কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে তার ঠিক নেই, দেশাত্মবোধ, স্বাধীনতা এইসব ধারণাগুলো ঠিক মতন পরিস্ফুট হয়নি, সেইরকম সময় এক গ্রাম্য বালিকা কী করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক অপদার্থ রাজাকে উজ্জীবিত করল, সেনা বাহিনীর মধ্যে তীব্র আবেগের সঞ্চার করে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইতে মাতিয়ে তুলল, তা শুধু দুর্বোধ্য নয়, আজও যেন ব্যাখ্যার অতীত মনে হয়। ডমরেমি গ্রাম থেকে যখন জান বা জোয়ান এসে ফরাসি সৈন্যবাহিনীর অধিনায়িকা হতে চাইল, তখন তার বয়েস ছিল আঠারো বছর। আগে কোনওদিন অস্ত্র ধরেনি, সে গ্রামে বসে শিখেছিল সুতো কাটা আর শেলাই-ফোঁড়াই। তবু যুদ্ধে যোগ দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার চিন্তা তার মাথায় এলো কী করে? পৃথিবীতে আর কোথায়, কবে একটি আঠারো বছরের মেয়ে স্বেচ্ছায় এত বড় গুরুদায়িত্ব নিয়েছে? বিচারের সময় জোয়ান বলেছিল, সে ঈশ্বর-আদিষ্ট। ঈশ্বর সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বটে, তবে ঈশ্বরের দূত, সন্ত মাইকেল, সন্ত ক্যাথরিন এবং সন্ত মার্গারিট তাকে প্রেরণা দিয়েছেন, তাঁরা এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছেন। জোয়ান তাঁদের সশরীরে দেখেছে, স্পর্শ করেছে।
এ যুগে আমরা দেবদূতদের এরকম আগমনের কথা যুক্তি দিয়ে ঠিক মেনে নিতে পারি না। তা ছাড়া, ঈশ্বরের দূতরা ভালোবাসা, সেবা ও শান্তির বাণী নিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু তাঁরা শুধু যুদ্ধের উত্তেজনা জোগাতে আসবেন কেন? রূপকথার কিংবা পৌরাণিক চরিত্র নয় জোয়ান, সে ইতিহাসের নায়িকা, মাত্র সাড়ে পাঁচশো বছর আগেকার ঘটনা, সমসাময়িক অনেক তথ্য এবং তার বিচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।
শেষ পর্যন্ত জোয়ান ধরা পড়েছিল বিশ্বাসঘাতক ফরাসিদেরই হাতে, বার্গান্ডির ডিউক তাকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে ইংরেজদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ধুরন্ধর ইংরেজরা তাকে তৎক্ষণাৎ খুন না করে একটি বিচারের প্রহসন করে, যাতে সাধারণ মানুষের মন থেকে তার মহিমার ধারণাটা মুছে যায়। এবং বিচারের ভার দেয় কিছু তাঁবেদার বিশপের হাতে। সেইসব শিক্ষিত ধর্মযাজকরা এই গ্রাম্য বালিকাকে অদ্ভুত সব অভিযোগ এনে জেরায় জেরায় অতিষ্ঠ করবার চেষ্টা করলেও নির্ভীক জোয়ানের উত্তরগুলো ছিল আত্মবিশ্বাসে ভরা। তবু প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে, জোয়ান মোটেই ঈশ্বর-প্রেরিতা নয়, সে মায়াবিনী, ডাকিনী, পিশাচসিদ্ধা। সে গির্জার কর্তৃত্ব মানে না, সে পুরুষের মতন পোশাক পরে। সে ব্যাভিচারিণী, অসতী।
কয়েকজন মহিলা, তাঁদের মধ্যে একজন অন্যতম বিচারকের স্ত্রী, জোয়ানের শরীর পরীক্ষা করে বলেছিলেন, সে সন্দেহাতীতভাবে কুমারী। যুদ্ধের সময় সে পুরুষদের মতন পোশাক পরেছে বটে, সে যুগে সেটাই ছিল চরম অপরাধ। আর কোনও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়নি, তবু তাকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছিল।
এই অরলিজঁ শহরেই জোয়ান তার সামরিক দক্ষতার প্রথম প্রমাণ দেয়। সঙ্গী সাথীদের নিয়ে জোয়ান নৌকোয় চেপে লোয়ার নদী পার হয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করে ইংরেজদের। ফরাসি বাহিনীর কয়েকজন সেনাপতি এই গেঁয়ো মেয়েটির নেতৃত্ব মানতে চাননি, কিন্তু জোয়ান উদ্বুদ্ধ করে সাধারণ সৈন্যদের। যুদ্ধের মাঝখানে জোয়ান একবার সাংঘাতিকভাবে আহত হয়, শত্রুরা ধরেই নিয়েছিল যে ওই যুদ্ধে অনভিজ্ঞ কুমারীটি মারাই গেছে। কিন্তু পরদিনই জোয়ান কাঁধের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে, পতাকা হাতে নিয়ে সেনাবাহিনীর সামনে এসে দাঁড়াল পূর্ণ উদ্যম নিয়ে। তখনই অনেকে মনে করল, এই মেয়েটির অলৌকিক ক্ষমতা আছে। জোয়ানের নেতৃত্বেই ফরাসিবাহিনী ইংরেজদের কবল থেকে শহরটি উদ্ধার করে। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
আমার খুব ইচ্ছে এই ঐতিহাসিক শহরটি ভালোভাবে ঘুরে দেখার। অরলিজঁ শহরটিকে ইংরেজরা বলে অরলিয়েন্স (orleans), তার থেকেই আমেরিকায় নিউ অরলিয়েন্স।
অসীম বলল, তুমি কল্পনায় যে শহরটির ছবি এঁকে রেখেছ, তাকে কিন্তু এখানে একদমই দেখতে পাবে না। জান দা’র্কের আমলের প্রায় কোনও চিহ্নই এখানে আর নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমার আঘাতে এই শহরটার অনেকখানিই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তারপর নতুন করে গড়া হয়েছে, এটা এখন আধুনিক শহর, ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। দেখবার বিশেষ কিছু নেই, থাকবার পক্ষেও ভালো নয়। আজ আমরা এর চেয়ে অনেক ভালো একটা জায়গায় রাত কাটাব ঠিক করেছি। তা ছাড়া, আমরা আবার এই পথ দিয়েই ফিরব। ফেরার সময় এখানে কিছুক্ষণ থেমে যাব না হয়!
শহরটির পাশ দিয়ে যেতে-যেতে এটাকে এখন একটা কেজো, ব্যস্ত জায়গা বসেই মনে হল। এক চৌমাথায় লাল আলোতে আমাদের গাড়ি থেমেছে, আমাদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হল একদল যুবতী। তাদের মধ্যে অন্তত তিন-চার জন জিনসের প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা। আজ বেশ গরম পড়েছে, এই পোশাক অত্যন্ত স্বাভাবিক। অথচ এক সময় পুরুষদের মতন পোশাক পরেছিল বনে জোয়ান অফ আর্ককে মৃত্যুদণ্ড বরণ করত হয়েছিল।
এবার আমরা দলে চারজন। বাদল আর আমি একসঙ্গে এসেছি জার্মানি থেকে। খবর পেয়েই লন্ডন থেকে চলে এসেছে ভাস্কর। বছর তিনেক আগে ভাস্করের সেই যে হেঁচকির অসুখ হয়েছিল, তা আজও সারেনি। দিব্যি আমোদ-আহ্লাদ-মজায় আছে, হঠাৎ হেঁচকি আর ঢেকুঁরের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার শুরু হল, আর কিছুতেই থামে না, শেষের দিকে কথা বলাই দারুণ অসুবিধেজনক হয়ে ওঠে। লন্ডনে ভাস্কর সবরকম চিকিৎসা করিয়েছে। তারপর একবার কলকাতায় এসে দু-তিন মাস থেকে হোমিওপ্যাথি-কবিরাজি কিছুই বাদ রাখেনি, কিন্তু এ রোগ সমস্ত চিকিৎসার অতীত। হেঁচকি কিংবা সেঁকুর, শুনতে সামান্য মনে হলেও ঘন্টার পর ঘণ্টা যদি চলতে থাকে এবং দিনের পর দিন, তা হলে তা যে কত কষ্টকর তা নিশ্চয়ই অনুমান করা যেতে পারে। এই কারণে ভাস্করের শরীরও যথেষ্ট দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু ভাস্করের আচরণ দেখে সে রকম কিছুই বোঝা যাবে না। আগের মতনই সে উত্তেজনাপ্রবণ, যে-কোনও সামান্য ব্যাপার থেকে মজা খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতা আছে ভাস্করের। দা ফ্লেশ ইজ উইক বাট দা স্পিরিট ইজ হাই যাকে বলে।
চারজনে মিলে বেড়ানোই সবচেয়ে সুবিধাজনক। যুগ্ম সংখ্যায় খরচের সাশ্রয় হয়। হোটেলে দু’খানা ঘন নিলেই চলে, রেস্তোরাঁয় একটা টেবিল। অসীমের গাড়িটি চারজনের পক্ষেই আরামদায়ক। ভাস্কর আর বাদল পেছনে, আমি চালক মশাইয়ের সহকারী, আমার ওপর ম্যাপ দেখার ভার। চার-পাঁচখানা মানচিত্র নিয়ে আমি মাঝে মাঝে দিশাহারা হয়ে যাই। এই সব দেশে কত ধরনের ম্যাপ যে পাওয়া যায় তার ঠিক নেই, ছোট ছোট অঞ্চলেরও বড় বড় ম্যাপ। পেট্রোল পাম্প, মুদির দোকানে ম্যাপ বিক্রি হয়। অবশ্য এতরকম রাস্তার গোলকধাঁধায় ম্যাপ ছাড়া গতিও নেই।
আমরা এগোতে লাগলাম লোয়ার নদীর ধার দিয়ে দিয়ে। নদীটি নেহাত ছোট নয়। আবার বিশাল কিছুও নয়। অনেকটা বিহার কিংবা মধ্যপ্রদেশের নদীগুলোর মতন, পাথুরে তীর, নদীর মধ্যে মধ্যেও বড় বড় পাথরে চাই, কোথাও ছোটখাটো দ্বীপের মতন হয়ে গেছে, সেখানে নদীটি দ্বিধায়। এদিকে গভীর বন নেই, হালকা হালকা গাছ রয়েছে, পাইন ও উইলোজাতীয়। একটানা ফাঁকা নদীর ধার বেশিক্ষণ পাওয়া যায় না, দু-পাঁচ কিলোমিটার অন্তর অন্তর ছোট ছোট শহর। ইউরোপের এই সব ক্ষুদ্র শহরগুলি বড় নয়নাভিরাম, পরিষ্কার, ঝকঝকে, শান্ত অথচ আধুনিক সব সরঞ্জামই সুলভ।
বিকেল শেষ হয়ে যাওয়ার মুখে আমরা লোয়ার নদীর ধার ছেড়ে অন্য একটা রাস্তা নিলাম। এদিকটায় গাছপালা বেশি, ছায়া ছায়া পথ। সেই পথ যেখানে শেষ হল, সেখানে সামনের দৃশ্যটা দেখে মুখ দিয়ে একটিই শব্দ বেরিয়ে আসে, বাঃ!
লোয়ার নদীর দুই পারে অনেকগুলি শাতো রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাতটির নাম শামবর (Chambord)। শাতো কথাটার ঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নেই, ইংরিজিতে অনেক সময় কাসল বলা হলেও শাতো আসলে প্রাসাদ ও দুর্গের মাঝামাঝি, মূলত রাজা-রাজড়াদের বিলাস-ভবন, কিছুটা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থাও থাকে। বাংলা প্রতিশব্দের অভাবে একে শাতো (chateaux) বলাই ভালো।
অনেক সুন্দর জিনিসকেই একটা বিশেষ সময়ে, একটা বিশেষ মেজাজে দেখলে আরও সুন্দর দেখায়। সন্ধে হয়ে এসেছে, আলো এখন নরম। আকাশের একপ্রান্ত এখনও লাল। ঠিক এই রকম সময়েই শামবর আসা উচিত। একটা বাড়ি, যতই বিশাল হোক, মানুষের তৈরি বাড়িই তো বটে, তাও যে কত ছন্দোময়, কত সসমঞ্জস হতে পারে পাথর-কাঠ-লোহার অস্তিত্ব মুছে গিয়ে সব মিলিয়ে একটা শিল্প সৃষ্টির মতো মনে হয়, তা ঠিক সন্ধের আগে শামবর এলে বোঝা যায়।
বেশ কিছু বছর আগে ভাস্কর ও আমি এখানে এসেছিলাম অসীম ও ভূপেশ দাশের সঙ্গে। সেটি ছিল দুপুর বেলা, খুব গনগনে রোদ, প্রচুর লোকজনের ভিড়, তখন এই প্রাসাদটিকেই এমন কিছু আহামরি মনে হয়নি। ভাস্কর সেবার বলেছিল, আমাকে বেশি সিঁড়ি ভেঙে এই সব দুর্গ-ফুর্গ দেখতে বলবে না কেউ! গাদাগুচ্ছের হিস্ট্রিও শুনতে চাই না। ক্লাস এইট-নাইনে পড়ার সময় প্রচুর হিস্ট্রি মুখস্থ করেছি, আর এই সব ফ্রেঞ্চদের হিস্ট্রি জানার কোনও দরকার নেই। আয়, সুনীল!
কাছেই ছিল একটা খুব প্রাচীন চেহারার ট্যাভার্ন। ভেতরটা অন্ধকার মতন, চেয়ার টেবিলের বদলে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বেঞ্চ করা, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কাঠের পিপেতে ওয়াইন। ভাস্কর আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে, তারপর প্রচুর রেড ওয়াইন পান করা হয়েছিল।
এবারে ভাস্করেরও সেই ট্যাভার্নের কথা মনে পড়ল না, সে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে বলল, সেই একই বাড়িটাকে এখন বড় সুন্দর লাগছে তো রে?
আমি কোনারকের মন্দির দেখেছি বেশ কয়েকবার। তার মধ্যে একবার গিয়েছিলাম গাড়িতে চেপে, পৌঁছেছিলাম এরকম সন্ধের সময়। তখন রেলওয়ে স্ট্রাইক চলছিল, তাই টুরিস্টের ভিড় ছিল না একেবারেই, সব মিলিয়ে পাঁচ-সাত জন মানুষ, কোনারকের সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য এবং শিল্প-শৈলী সেবারই সবচেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলাম। রাত্রে থেকে গিয়েছিলাম পান্থনিবাসে, তাই সন্ধ্যায়, মাঝরাতে, ভোরবেলা করবার দেখেছি।
এখানেও একটি হোটেল রয়েছে। শামবর-এর ভেতরে ঢুকে দেখার কোনও ব্যস্ততা নেই আমাদের, আমরা এখানে গেলাম থাকার জায়গা ঠিক করতে। এই দায়িত্ব অসীম ও ভাস্করের। ওরা হোটেলের ভেতরে চলে গেল, আমি আর বাদল বাতাসে নিশ্বাস নিতে নিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কাছেই একটা ছোট্ট নদী, তার ওপারে জঙ্গল, এককালে রাজারা এই জঙ্গলে শিকার করতে আসতেন। এখনও প্রচুর হরিণ আছে, মাঝে মাঝে কিছু হরিণ হোটেলের কাছেও এসে পড়ে।
এক সময় ভাস্কর ফিরে এল উত্তেজিতভাবে। আমাকে বলল, একটা চুরুট দে তো!
আমি বললাম, কী হল? এত দেরি হচ্ছে কেন?
ভাস্কর বলল, ব্যাটারা পাত্তা দিচ্ছে না। বলছে ঘর খালি নেই। এমন চমৎকার জায়গাটা ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনও মানে হয়? এখানেই দু-তিনদিন থেকে গেলে ভালো হয় না?
বাদল বলল, ভাস্করদা, ম্যানেজ করুন। জায়গাটা দারুণ!
আমারও তাই মত। যদিও এর চেয়েও ভালো জায়গা যে নেই তাই-ই বা কে বলতে পারে? অবশ্য রাত হয়ে গেছে, এখন আবার গাড়ি চালিয়ে হোটেল খুঁজতে যাওয়া এক বিড়ম্বনা।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসে যে চারজন যুবকের কথা আছে, ভাস্কর তাদের অন্যতম। এমনিতে ও ধূমপান করে না, কিন্তু ওর ব্যক্তিত্ব ফোঁটাবার জন্য হাতে একটা চুরুট দরকার হয়। অরণ্যের দিনরাত্রির সময় আমাদের ফরেস্ট ডাকবাংলোতে কোনও রিজার্ভেশন ছিল না। চৌকিদারকে ম্যানেজ করে থাকা হয়েছিল, হঠাৎ সদলবলে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন ডি এফ ও। সেবারে একটা আধপোড়া চুরুট মুখে দিয়ে ভাস্কর সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডি এফ ও সাহেবকে কাবু করে দিয়েছিল।
এবারেও ভাস্কর কিছুক্ষণ পর গর্ব-মেশানো হাসি নিয়ে ফিরে এল। একটা ব্যবস্থা হয়েছে। কী একটা কনফারেন্সের জন্য এই হোটেলের সব কটি ঘরই বুকড, সব অতিথিরা এখনও এসে পৌঁছয়নি, কাল থেকে কনফারেন্স শুরু। সন্ধে হয়ে গেছে, আজ আর কেউ আসবে না, বাকি অতিথিরা আসবে কাল সকালে, এটা ধরে নিয়ে আমাদের দু খানা ঘর দেওয়া হচ্ছে আজ রাত্তিরের মতন। তবে হঠাৎ কোনও অতিথি এর পরেও এসে গেলে আমাদের ঘর ছেড়ে দিতে হবে, যদিও যে সম্ভাবনা খুবই কম।
অসীম অবশ্য বলল যে, সে-ই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ম্যানেজারকে রাজি করিয়েছে, ভাস্করের বেশি-বেশি কথায় সব গুবলেট হয়ে যাচ্ছিল, এবং ভাস্কর যথারীতি এর প্রবল প্রতি করল, আমি আর বাদল এই কৃতিত্বটা ওদের দুজনকেই ভাগ করে দিলাম। খরচ বেশি না, হোটেলের ঘরগুলো খুবই আরামদায়ক এবং পরিবেশের তো তুলনাই হয় না। আমাদের ঘরের একদিকের জানলা দিয়ে দেখা যায় জ্যোৎস্নধৌত শামবর শাতো, অন্য একটা জানলা দিয়ে দেখা যায় কসোঁ নদী।
একটুখানি ইতিহাস না বললে শামবর-এর মাহাত্ম্য ঠিক বোঝা যাবে না। এই শাতো’র সঙ্গে জড়িত আছে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির নাম!
ফরাসিরা স্থাপত্যবিদ্যায় বেশ কাঁচা ছিল। মধ্য যুগে বিশাল, সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণের খ্যাতি ছিল ইটালিয়ানদের। ফরাসিদেশের রাজা ও ভূম্যধিকারীরা ইটালিতে লড়াই করতে গিয়ে হেরেছে বটে, কিন্তু সেখানকার বিশাল মনোহর অট্টালিকাগুলি দেখে মুগ্ধ হয়ে ফিরেছে। তারপর নিজেদের জায়গায় তারা ইটালিয়ানদের অনুকরণে অট্টালিকা বানাতে চেয়েছে।
আগে এখানে ছিল একটা ছোটখাটো দুর্গ। রাজারা শিকার করতে এসে সেখানে দু এক রাত কাটাতেন। রাজা ফ্রাঁসোয়া প্রমিয়ে, অর্থাৎ প্রথম ফ্রাঁসোয়া নিয়মিত শিকার করতেন এখানে। তিনি পুরোনো দুর্গটা ভেঙে ফেলে এখানে একটা দর্শনীয় প্রাসাদ বানাবার পরিকল্পনা করলেন। আঁকা হল নানারকম নক্সা। ইতালিয়ান শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তখন ফরাসি সরকারের অতিথি, থাকেন কিছুটা দূরে। নক্সাগুলো তাঁকে দেখিয়ে তাঁর মতামত নেওয়া হয়েছিল। লিওনার্দো তো শুধু শিল্পী বা ভাস্কর বা কবি নন, তিনি আবিষ্কারক, স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ার, নদী বিশেষজ্ঞ এবং আরও অনেক কিছু। রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া এই প্রাসাদ নির্মাণের ব্যাপারে এমনই উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন যে এর জন্য তিনি দু’হাতে অর্থ ব্যয় করেছেন তো বটেই, এমনকি রাজকোষ যখন শূন্য, তখন যে-কোনও উপায়ে টাকা সংগ্রহ করতেন, গির্জাগুলোর অর্থসম্পদের ওপর হানা দিতেন, প্রজাদের কাছ থেকে রুপো কেড়ে নিয়ে গলিয়ে ফেলতেন। একবার তাঁর দুই ছেলে বন্দি হয় স্পেনে, তাদের মুক্তিমূল্যস্বরূপ প্রচুর টাকা দিতে হয়, তবু তিনি এই প্রাসাদের খরচের ব্যাপারে কার্পণ্য করেননি।
এই বিশেষ জায়গাটিই প্রথম ফ্রাঁসোয়ার পছন্দ, অথচ তাঁর শখ ছিল প্রাসাদটি হবে লোয়ার নদীর তীরে। তা কী করে সম্ভব? অসম্ভবই বা হবে কেন? নদীটাকে ঘুরিয়ে এনে এই প্রাসাদের পাশ দিয়ে বইয়ে দিলেই হয়। রাজা সেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে। লিওনার্দোর পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়, এরকম নদীর প্রবাহ বদলাবার কাজ তিনি ইটালিতে করেছেন। কিন্তু অত বড় লোয়ার নদীকে এতখানি দূরে ঘুরিয়ে নেওয়ার বিপুল ব্যয়ের ঝুঁকি নিতে রাজা আর সাহস পেলেন না। সেই স্বপ্নটি পরিত্যক্ত হলেও নদীর জেদ ছাড়লেন না রাজা। কাছাকাছি আর একটি ছোট নদী, কসোঁ কে টেনে আনা হল এই পর্যন্ত।
রাত্তিরের দিকে আমরা শাতো-টি একবার দেখতে গেলাম। পুরো টুরিস্ট সিজনে এখানে সন-এ-লুমিয়ে দেখানো হয়, শীতের ভয়ে অক্টোবর থেকে তা বন্ধ। এখন মধ্য অক্টোবর, কিন্তু এবারে একটুও শীত নেই। এদেশের ঋতুগুলির মতিগতি বোঝা দায়। একবার অক্টোবর মাসে আমি তেমন গরম জামাকাপড় সঙ্গে না এনে ফ্রান্সে এসেছিলাম, শীতে হি হি করে কেঁপেছি। এবারে সঙ্গে রেইন কোট, ওভারকোট সব এনেছি, শীতের নামগন্ধ নেই, ভারী সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া।
সুরকি বিছানো রাস্তা দিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে-গাইতে আমরা শাতো-র ধার দিয়ে ঘুরলাম খানিকক্ষণ। অন্ধকার শাততাটির একটি মাত্র ঘরে আলো জ্বলছে।
ভাস্কর এক সময় জিগ্যেস করল, এটা কি ভার্সাই প্রাসাদের চেয়ে বড় নাকি রে।
অসীম বলল, বোধহয় বড়। দেখতে বেশি সুন্দর তো বটেই। এখানে ঘরের সংখ্যা চারশো চল্লিশ।
ভাস্কর বলল, অত ঘর, তার জন্য কত বাথরুম বানাতে হয়েছিল বলো তো!
অসীম এবার হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, এত বড় বাড়িতে কটা বাথরুম থাকতে পারে, বলো তো ভাস্কর?
আমি বললাম, এটা ভাস্কর আন্দাজ করতে পারবে না। অসীম বলল, একখানা! এখানকার কেয়ারটেকারের জন্য। ফরাসিরা আবার বাথরুম ব্যবহার করতে জানত নাকি?
আমি ফরাসিদের স্নানের অভ্যেস বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। মধ্যযুগের ফরাসিদের অত সাজ-পোশাকের বাহার, অত সৌন্দর্যচর্চার আড়ম্বর, অথচ তাদের শরীর যে কী পরিমাণ নোংরা থাকত, তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। বহু মেয়ে সারাজীবনে একবারও স্নান করত না, অর্থাৎ সর্বাঙ্গে জলস্পর্শ বিনাই সেই সব সুন্দরী স্বর্গে চলে যেত। অনেক পুরুষ জীবনে একবার অন্তত স্নান করতে বাধ্য হত, কারণ সেনাবাহিনীতে ভরতি হওয়ার সময় তাদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে জলে চুবিয়ে শরীরটা পরীক্ষা করে দেখা হত। অভিজাত ফরাসিরাও সকালবেলার ছোট বাথরুম-বড় বাথরুম সেরে নিত ঘরের মধ্যেই বড় গামলাতে, আর সাধারণ লোক মাঠে-ঘাটে যেত।
সারা বছরই তো শীত থাকে না, কখনও কখনও বেশ গরম পড়ে এ দেশে। রীতিমতো ঘাম হয়। সারা বছরে একবারও স্নান না করলে সেই ঘামের গন্ধ তো শরীরেই থেকে যাওয়ার কথা। সেইজন্যই ফরাসিদেশে এতরকম পারফিউমের কদর। সুগন্ধ মেখে কি ঘামের গন্ধ চাপা দেওয়া যায়? আঁদ্রে জিদ এই বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘যৌন আবেদনে ঘামের গন্ধ’। ফরাসি মেয়েরা ঘামের গন্ধে উত্তেজিত হয়। কিছুকাল আগে পুরুষদের জন্য একটা পারফিউম বেরিয়েছিল, যেটা শুধু তীব্র ঘামের গন্ধ। এখন আর পুরুষদের শরীর ঘামাবার মতন সময় নেই, তাই পয়সা দিয়ে ঘামের গন্ধ কেনা!
বাদল বলল, ওরে বাবা, দিনের পর দিন এরা চান না করে থাকত কী করে? আমার তো মনে হয়, একটা দিনও চান না করলে আমি বাড়ি থেকে বেরুতেই পারব না।
ভাস্কর বলল, সেইজন্যই তো তুমি ফরাসি দেশে জন্মাওনি। জন্মেছ মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামে, বাড়ির পাশেই পুকুর, যখন ইচ্ছে ঝুপঝুপ করে ডুব দিয়ে আসতে পারতে।
বাদল বলল, এই সব ফরাসি সাহেব-মেমদের কথা যা শুনেছি, তাতে মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস এ দেশে জন্মাইনি। আমাদের মেদিনীপুর অনেক ভালো।
ভাস্কর বলল, নিঃসন্দেহে ভালো। আমিও চান না করে একদম থাকতে পারি না। সুনীলটাকে দেখেছি, মাঝে মাঝে দু-একদিন চানটা কাট মারে।
আমি বললাম, তার সঙ্গে অবশ্য ফরাসি অভ্যেসের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি বর্ষার দিয়ে স্নান বাদ দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি, কিংবা কোনও শীতের দিয়ে দুপুরবেলা জলস্পর্শ না করে রাত্তিরে বেশ গরম জলে স্নান করি। এতে বেশি আরাম। প্রত্যেক দিন এক ধারাবাঁধা সময়ে স্নান করে স্নানের ব্যাপারটাকে আমি নিছক একটা অভ্যেসে পরিণত করতে চাই না।
একটু থেমে আমি আবার বললাম, মেরি আঁতোয়ানেৎ-এর মতন সুন্দরী জীবনে একবারও স্নান করেননি, এটা কি ভাবা যায়? কিন্তু অসীম, অনেক শিল্পী যে স্নানার্থিনী মহিলা এঁকেছেন? যুবতী মেয়েরা নগ্ন হয়ে নদী কিংবা ঝরনায় স্নান করছে, যেমন রেনোয়া’র ছবি আছে, কিংবা অ্যাগ্রে’র সেই বিখ্যাত ছবি, মাথায় তোয়ালে জড়ানো, পেছন ফিরে বসা নারীটি…
অসীম বলল, ওগুলো অনেকটা নতুনত্ব, তাই ছবিতে এসেছে। তা ছাড়া তুমি যাদের কথা বললে, তাঁরা নাইনটিনথ সেঞ্চুরির শিল্পী, তখন একটু-একটু করে স্নানের ব্যাপারটা চালু হয়েছিল নিশ্চয়ই। এখন সবাই চান করে। রোজ না হলেও মাঝে-মাঝে। আগে অনেক বাড়িতে শুধু টয়লেট থাকত, এখন স্নানের জায়গাও তৈরি হয়। পাড়ায় পাড়ায় কত সুইমিং পুল।
আড্ডা মারতে মারতে আমরা ছোট্ট নদীটার ধারে গিয়ে বসলাম। দূরে কোথাও ডেকে উঠল একটা রাতচরা পাখি। শামবর-এর কাছাকাছি কোনও জনবসতি নেই, বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে পরিবেশের বিশেষ বদল হয়নি, তাই অতীত এখানে পটভূমিকা হিসেবে রয়ে গেছে। এখানে রাজা-রানিরা ঘুরে বেড়াত, এখানে যুদ্ধ হয়েছে, রাজতন্ত্রের বিদ্রোহীরা এসে লুটপাট করে গেছে, অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষও থেকে গেছেন এখানে। এই নিস্তব্ধ য়াতে একটুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলে তা অনুভব করা যায়। পিঠের দিকে কয়েকটা শতাব্দীর সেই পরিস্থিতির অনুভবটাই তো মূল্যবান।