‘‘কুসুমের মাস রূপান্তরের মাস
মে মেঘহীন জুনের পৃষ্ঠে ছুরি
ভুলবো না আমি লিলির গুচ্ছ গোলাপের নিঃশ্বাস
বসন্তে আরও লুকানো যে মঞ্জরী…’
–লুই আরাগঁ
আমি যখন প্রথম বিদেশে যাই, তখনও জাহাজের যুগ পুরোপুরি শেষ হয়নি, বিমানের যুগ শুরু হয়ে গেছে। আগেকার দিয়ে আমরা কত ভ্রমণকাহিনিতে জাহাজযাত্রার বর্ণনা পড়েছি। সমুদ্রপৃষ্ঠে তৈরি হয়েছে কত রোমান্স, গল্প-উপন্যাস। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশযাত্রার সময় জাহাজের আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও অন্যান্যদের সঙ্গে বেশ কয়েক দিনের মেলামেশায় মনকে অনেকটা প্রস্তুত করে তোলে, হঠাৎ একটা কালচার শক হয় না। সেই তুলনায় বিমানভ্রমণের কয়েকটি ঘণ্টা নিতান্তই বর্ণহীন।
সেই সময় আমার পরিচিত নামকরা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই, যেমন অমর্ত্য সেন, নবনীতা দেবসেন, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত প্রমুখ, সমুদ্রপথেই প্রবাসে গিয়েছিলেন। আমারও বাল্যকাল থেকেই জাহাজভ্রমণের স্বপ্ন ছিল। বাচ্চা বয়েসে যখনই কেউ আমাকে জিগ্যেস করত, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও, আমি বিনা দ্বিধায় উত্তর দিতাম, নাবিক! অথচ প্রাপ্ত বয়েসে আমাকে প্রথম সমুদ্র ডিঙোতে হল, হনুমানের মতন, আকাশপথে।
এখন অনেক বাচ্চা ছেলেও জানে, ট্রানজিট লাউঞ্জ কাকে বলে, কিংবা নির্দিষ্ট দিয়ে বিমানে না চাপলেও আন্তর্জাতিক টিকিট নষ্ট হয় না। কিন্তু সেই সময়ে আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কারুরই বিদেশে বিমানযাত্রার অভিজ্ঞতা ছিল না। কেউ আমাকে কিছু বলে দেয়নি, টিকিটটি একেবারে শেষ মুহূর্তে পেয়েছিলাম বলে বিমান কোম্পানির লোকেরাও কোনও পরামর্শ দেয়নি আমাকে। সেইজন্যই, প্যারিসে আমার নির্দিষ্ট ফ্লাইট ধরতে না পেরে আমি যৎপরোনাস্তি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আমার আর আমেরিকায় যাওয়া হবে না, এখান থেকেই বা দেশে ফিরব কী করে। প্যারিসে আমায় পড়ে থাকতে হবে, এখানে একজনকেও চিনি না, পকেটে মাত্র আটটি ডলার। ক্লোশার নামে এক ধরনের ভিখিরির কথা পড়েছি ফরাসি উপন্যাসে, আমাকেও সেন নদীর ব্রিজের তলায় সেইরকম ভিখিরিজীবন কাটাতে হবে।
আমার ছটফটানি ও ব্যাকুলতা দেখে তিন-চারজন বিমানকর্মী ঘিরে ধরল আমাকে, হাত-পা নেড়ে বোঝাবার চেষ্টা করল যে ভয় নেই, ঘণ্টাচারেক বাদে অন্য এয়ার লাইনসের এক বিমানে আমাকে তুলে দেওয়া হবে, আমার সুটকেস নিউইয়র্কে অপেক্ষা করবে আমার জন্য। তাতেও খুব একটা ভরসা পেলাম না। নিউইয়র্কের বিশাল এয়ারপোর্টে কীভাবে একটা সুটকেস খুঁজে যার করতে হয়, তাই বা কে জানে!
সেই অপেক্ষার সময়টা নানারকম উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটছিল, হঠাৎ একসময় মনে হল, দুর ছাই! যা হওয়ার তা হবে! আমি বসে আছি প্যারিসের বুকে, আর শুধু শুধু সুটকেস, টিকিট, টাকা-পয়সার মতন বাজে ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করছি! এই চার ঘণ্টায় শহরটা খানিকটা ঘুরে দেখা যেতে পারত, কিন্তু এখান থেকে বেরুতে দেবে না, আমি বিমানবন্দরেরই চতুর্দিকে টহল মারতে লাগলাম, যদি কোনও দিকের কাঁচের দেওয়াল দিয়ে এই কবি-শিল্পীদের স্বর্গস্থানটি দেখা যায়। যা দেখা যায়, তা যৎসামান্য, আশ মেটে না। সোফাগুলিতে গা এলিয়ে যে-সব যাত্রী-যাত্রিণীরা বসে আছে, তাদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ কেউ ফরাসিদেশের বড় শিল্পী কিংবা খ্যাতিমান কবি। একজন দাড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক সাহেব নোটবই খুলে কী যেন লিখছেন। বার্নার্ড শ চলন্ত বাসে নোট বইতে নাটকের সংলাপ লিখে রাখতেন। এখানেও বোধহয় কোনও কবি মহাকাব্য রচনা করেছেন। লোভ হয় পাশে গিয়ে উঁকি মারতে, আবার দুর্মর সঙ্কোচে যেতেও পারি না।
পরে আমার এই ধরনের চিন্তার কথা শুনে মার্গারিট হেসে কুটিকুটি হয়েছিল। সে বলেছিল, দূর বোকা, ট্রানজিট লাউঞ্জে ফরাসি কবি-শিল্পীরা বসে থাকতে যাবে কেন? ওখানে তো আটকে থাকে শুধু বিদেশিরা। যে-লোকটা খাতা খুলে কিছু লিখছিল, সে নিশ্চয়ই ব্যাবসার হিসেবপত্র টুকে রাখছিল!
সেই চার ঘণ্টা কোনও একজন ব্যক্তির সঙ্গেও আমার আলাপ হয়নি। ফরাসি বলতে হবে এই ভয়ে মুখ খুলিনি।
আমি ফরাসি ভাষা জানি না। কিন্তু এই চমৎকার ভাষাটি শেখার একাধিক সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারিয়েছি।
তখন কলকাতায় আমার পরিচিতদের মধ্যে দুজন ছিলেন ফরাসি ভাষাবিদ। প্রখ্যাত লেখক কমলকুমার মজুমদার এবং তৎকালীন বাংলা প্রকাশনা জগতের সবচেয়ে সাড়া জাগানো প্রতিষ্ঠান সিগনেট প্রেসের অন্যতম অংশীদার সুনন্দ গুহঠাকুরতা। বুঢ়ঢ়া এই ডাকনামেই যে পরিচিত ছিল, সে আমাদের সমবয়েসি বন্ধু। বুঢ়টা পরবর্তীকালে হয়েছিল বহুভাষাবিদ, অন্তত পনেরো-ষোলোটি ভাষা, গ্রিকসমেত, সে লিখতে ও বলতে পারে। তার মতন স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন মানুষ আমি দ্বিতীয় দেখিনি। এ দেশের দুর্ভাগ্য যে এরকম সুরসিক ও জ্ঞানী ব্যক্তিটি বহুকাল দেশছাড়া।
কমলকুমার আমাদের প্রথম যৌবনের অ্যারিস্টটল। তিনি বহু বিষয়ে আমাদের দীক্ষাগুরু। অ্যারিস্টটলের মতনই কমলকুমারকে আমরা বসে থাকতে দেখেছি কদাচিৎ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা চলন্ত অবস্থায় তিনি কথা বলতেন, অর্থাৎ তিনি ছিলেন পেরিপাটেটিক দার্শনিক। কলেজ স্ট্রিট কিংবা ওয়েলিংটনের মোড়ই ছিল আমাদের আথেনসের লাইসিয়াম।
কমলকুমারের গল্প-উপন্যাসের ভাষা অনেকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হলেও তাঁর মুখের ভাষা ছিল খাঁটি কলকাতার চলতি ভাষা, কলকাতার ককনিও বলা যেতে পারে। তার সঙ্গে মিশে থাকত ফরাসি শব্দ। ওয়েলিংটনের মোড়ে ভেজাল তেলে ভাজা হাঁসের ডিমের ওমলেট খেতে খেতে তিনি বলতেন, বঁ, সে বা বেড়ে কাঁচালঙ্কার ঝালটি দিয়েছে, কী বলো? কিংবা, কোনও তরুণ কবিকে সস্নেহ ভর্ৎসনা করার সময় তিনি বলতেন, কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া যায় না, বুঝলে! পভর পোয়েত ত্রাভাইয়োঁ!
কোনও রেস্তোরাঁ বা পানশালায় দাম দেওয়ার সময় তিনি টাকা বার করতেন কোনও বইয়ের পাতার ভাঁজ থেকে। সবসময়েই তাঁর হাতে থাকত এক একখানা ফরাসি বই, পুরোনো ক্লাসিক, ট্রামে-বাসে পড়তেন, আবার সেই বই-ই তাঁর মানিব্যাগ। সাদা ধপধপে পাঞ্জাবি ও ধুতি পরিহিত এই বলিষ্ঠকায় মানুষটি একদিকে অত্যন্ত ভারতীয় আর্য, আবার ফরাসি সংস্কৃতিতে খুব বেশি আপ্লুত। ইংরেজদের তিনি পছন্দ করতেন না, এদেশের ইংরেজ-মনস্ক বাঙালিরা ছিল তাঁর উপহাসের পাত্র। এমনও তিনি বলেছিলেন যে, বঙ্কিমের আমল থেকেই বাংলা গদ্য লেখা হচ্ছে ইংরিজি সিনট্যাক্স-এ, এর বদলে ফরাসি গদ্যকে আদর্শ হিসেবে ধরলে আমাদের গদ্য অনেক উন্নত হত। সম্ভবত তিনি ফরাসি সিনট্যাক্স এ বাংলা গদ্য লেখার চেষ্টা করেছেন। ফরাসি ভাষায় বিশেষণ বিশেষ্যের পরে, যেমন লাল গোলাপের বদলে গোলাপ লাল, এরকম নিদর্শন আছে তাঁর রচনায়।
দেশের বাইরে কখনও পা দেননি কমলকুমার, এককালে সে সুযোগ তাঁর যথেষ্টই ছিল, তাঁর ছোটভাই শিল্পী নীরোদ মজুমদার বহুকাল কাটিয়ে এসেছেন ফরাসিদেশে, কিন্তু কমলকুমার ইচ্ছে করেই যাননি। কোনও বিলেতফেরত ব্যক্তিকে অতি সাহেবিপনা করতে দেখলে তিনি হেসে বলতেন, আমার বাবার বাবার বাবার বাবা হাফ পেন্টুল পরে বিলেত গেসল, বুঝলে! ফরাসিদেশ থেকে অনেক জ্ঞানী-গুণী, লেখক-শিল্পী সমালোচক কলকাতায় এলে কমলকুমারের খোঁজ করতেন, কমলকুমার তাঁদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতেন। খালাসিটোলায় দিশি মদের দোকানে। চতুর্দিকে নোংরা ছড়ানো সেই আধো অন্ধকার স্থানটিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন হালকা সুরে।
কলকাতার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি কমলকুমারের কাছে ফরাসি ভাষার ছাত্র ছিলেন। আমরাও একসময় বায়না ধরেছিলেন, কমলদা, আমাদের ফরাসি শেখান! তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি, তবে দুটি শর্তে। বিনা পয়সায় শেখা চলবে না, তাঁকে মাইনে দিতে হবে মাসে এক টাকা। আর দ্বিতীয় শর্ত হল, তাঁর অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই আমরা প্রকাশ্যে অন্যদের কাছে একটাও ফরাসি বাক্য উচ্চারণ করতে পারব না। শুনেছি, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ-র নির্দেশ ছিল, টানা সাত বছর স-র-গ-ম না সাধলে তাঁর শিষ্যরা এক লাইনও গান গাইতে পারত না।
উত্তর কলকাতায় গ্রে স্ট্রিটে আমার বন্ধু আশুতোষ ঘোষের বাড়িতে সপ্তাহে দুদিন ধরে দুপুরে তিনি পড়াতে আসতেন আমাদের। ওঃ, কী ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতা! এমন সুরসিক, আড্ডাবাজ কমলকুমার শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর, কোনওরকম হাস্য-পরিহাস নয়, আমাদের শুধু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ফরাসি শব্দরূপ ধাতুরূপ মুখস্থ করতে হবে। আজকালকার ডাইরেকট মেথডে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না, বাক্য গঠন দিয়ে শিক্ষা শুরুর মজা আমরা পেলাম না, শুধু নীরস ব্যাকরণ! এ যেন তেঁতুলগাছ তলায় বুনো রামনাথের টোলে মাথায় টিকিওয়ালা ছাত্রদের মতন দুলে দুলে এতর, আভোয়ার-এর নানারূপ আউড়ে যাওয়া। দুমাসের মধ্যেই আমাদের ধৈর্য চলে গেল! আমাদের সময়ে স্কুলে সংস্কৃত অবশ্যপাঠ্য ছিল, শব্দরূপ-ধাতুরূপ মুখস্থ করার ভীতিতে সে ভাষাও ভালো করে শিখিনি, ফরাসি ভাষায় বিদ্বান হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের অচিরেই বিলীন হয়ে গেল।
মূল ভাষায় ফরাসি কবিতা পাঠ করার বাসনা আমার একেবারে যায়নি। এর পরে, বন্ধুদের না জানিয়ে, গোপনে আমি আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজেও ছাত্র হিসেবে ভরতি হয়েছিলাম একবার। সেখানেও বেশিদিন লেগে থাকতে পারিনি নিজেরই দোষে। সেই সময়ে অন্তত, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই প্রধানত পড়তে যেত আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে, চমৎকার তাদের চেহারা, আর জামা-কাপড়ের কত বাহার। এক একজন জন্মদিনে ক্লাসের মধ্যে দামি চকোলেট বিলি করে, একগাদা সহপাঠী-সহপাঠিনীদের নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের কোনও দামি রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। সেই তুলনায় আমার চেহারা ও পোশাক অতি মলিন, পকেটে হাত দিয়ে প্রায় সময়ই খুচরো পয়সা গুনি। কারুর সঙ্গে মিশতে পারতাম না, পেছনের দিকে চুপ করে থাকতাম। জানি, এটা বোকামির পর্যায়ে পড়ে, অন্যদের চালিয়াতি তুচ্ছ করাই উচিত। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে থাকলে আমি বাঘ, একা হয়ে পড়লেই মুখচোরা। এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারতাম না কিছুতেই। তা ছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের কাছেও ধরা পড়ে গেলাম অবিলম্বে। ফরাসি কনসুলেটে যাতায়াত করছি শুনে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের আড্ডাধারীরা অনেকে বলতে লাগল, খুব আঁতেল হতে চাস বুঝি। আঁতেল শব্দটি গালাগালের পর্যায়ে পড়ে। আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে পড়াবার ধরন খুবই আকর্ষণীয় ছিল, সুন্দরী তরুণী মেমরা পড়াত, কিন্তু তা আমার ভাগ্যে সইল না।
পরবর্তীকালে, অনেক বছর পরে, ওই আলিয়াঁজ ফ্রাঁসেজ-এর সামনের রাস্তায় আমি এক একদিন বিকেলে দাঁড়িয়ে থাকতাম অন্য কারণে। ওখানকার এক ছাত্রীকে মাঝপথে ধরে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমার সঙ্গে ময়দানে টোটো করে ঘুরে বেড়াবার কুপ্ররোচনা দিতাম। এইভাবে আমি আমার পূর্বতন ব্যর্থতার শোধ নিয়েছি বলা যেতে পারে।
ফরাসি ভাষা শেখা হয়নি বটে, কিন্তু ফরাসি বাক্য মুখস্থ করেছিলাম বেশ কিছু। আমার বন্ধু বুঢ়ঢ়া শিখিয়েছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ভুলে ভু কুশে আভেক মোয়া? এর অর্থ আমি বলে দেব না। পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, ভুলেও যেন কখনও এই বাক্যটি কোনও সদ্য-পরিচিত বিদেশিনীর সামনে উচ্চারণ করবেন না!
প্যারিসের প্রথম দিন সেই চার ঘণ্টার অপেক্ষায় আমি কিছুই দেখিনি। পৃথিবীর সব বড় বড় শহরের বিমানবন্দরই একরকম, চরিত্রহীন। জাহাজ কিংবা ট্রেনযাত্রা নিয়ে কত অসংখ্য কাহিনি রচিত হয়েছে, সেই তুলনায় বিমানযাত্রা নিয়ে কিছুই না।
নিউইয়র্ক পৌঁছে আমার সুটকেসটা খুঁজে পেয়েছিলাম ঠিকই। নিউইয়র্কে আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসেনি, চিনতামই না কারুকে। বস্তুত, সারা আমেরিকায় অ্যালেন গিনসবার্গ ও পল এঙ্গেল ব্যতীত আমার পরিচিত কেউ ছিলই না। তখনও, সেই তেষট্টি সালে, এত রাশি রাশি বাঙালি ছেলেমেয়ে মার্কিনদেশে গিয়ে থিতু হয়নি।
নিউইয়র্ক থেকে একটু পরেই বিমান বদলে শিকাগো, সেখানে এক হোটেলে রাত্রিবাস। সে-ও এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। এখন কলকাতা থেকে কেউ বিদেশে গেলে আর পাঁচজন তাকে অনেক কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়। কিন্তু তখন আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি। মাঝপথে কোথাও রাত কাটাতে হলে তার জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করা যে বিমান কোম্পানির দায়িত্ব, তা কি জানতাম তখন! শেষ দিন হাতে টিকিট পেয়েছি, তার মধ্যে হোটেল ভাউচার নেই।
এর মধ্যে দুটি পিকচার পোস্টকার্ড কিনে পঞ্চাশ সেন্ট খরচ করে ফেলেছি, আমার আর সম্বল মাত্র সাড়ে সাত ডলার। সে আমলেও শিকাগোতে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি কোনও হোটেলের ঘর দশ ডলারের কমে পাওয়া যেত না। শুধু থাকা, খাওয়া নয়। একটা হোটেলে পৌঁছে অতি দীনভাবে আমাকে স্বীকার করতে হয়েছিল যে আমার কাছে পয়লা কম আছে। কাউন্টারের তরুণ ম্যানেজারটি দয়া করেছিল আমাকে।
এইসব প্রসঙ্গ আমি আগে অন্যত্র লিখেছি। প্রথম দিকে কিছু কিছু পুনরাবৃত্তি মার্জনীয়।
পরের দিন ভোরবেলা আমি যখন আয়ওয়ার উদ্দেশে ছোট্ট একটি প্লেনে চাপলাম, তখন আমি কপর্দকশূন্য। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় আমি পৌঁছব নিঃস্ব অবস্থায়। কোনও কারণে যদি পল এঙ্গেল খবর না পেয়ে থাকেন, কিংবা এয়ারপোর্টে কারুকে পাঠাতে ভুলে যান, তা হলে আমি কী করব জানি না।
বাগডোগরা কিংবা তেজপুরের মতন ছোট্ট এয়ারপোর্ট আয়ওয়া সিটি। রানওয়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন পল এঙ্গেল। আমি নামতেই তিনি দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই উষ্ণতায় বুক ভরে গিয়েছিল।
তারপর ম্যাজিকের মতন ব্যাপার ঘটতে লাগল। আমাকে কিছু জিগ্যেস না করেই পল এঙ্গেল কী করে যেন বুঝে গেলেন যে আমি খুবই ক্ষুধার্ত, প্রথমেই তিনি আমাকে এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। আমার জন্য তিনি আগেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে রেখেছিলেন, সেখানে যাওয়ার আগে ইউনিভার্সিটিতে নাম রেজিস্ট্রেশান, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা, টেলিফোন ও গ্যাসের কানেকশান নেওয়া ইত্যাদি সারা হল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। তারপর তিনি একটি নির্জন রাস্তায় এক দোতলা বাড়ির সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্টে আমায় পৌঁছে দিয়ে বললেন, এবার তুমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও, আমি আবার সন্ধেবেলা আসব।
মাত্র একদিন আগেও আমি ছিলাম কলকাতার এক কনিষ্ঠ কেরানি, দমদমে এক রিফিউজি পল্লির ফ্ল্যাটবাড়ির দু-খানা ঘরে সবাই মিলে গাদাগাদি করে থাকতাম, মাসের মাঝখান থেকেই ধারের চিন্তা করতে হত, পুরো এক প্যাকেট সিগারেটের বদলে কিনতাম দুটো দুটো করে, সেই আমারই এখন একটা নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট, টেবিলের ওপর টেলিফোন, রান্নাঘরে গ্যাস স্টোভ আর ফ্রিজ, বাথরুমে বাথটাব। কলকাতায় আমার নিজস্ব কোনও ব্যাংক অ্যাকাউন্টই ছিল না। ফ্রিজ-টেলিফোন-বাথটাব এসব তো স্বপ্নের জিনিসপত্র। এখানকার ব্যাংকে আমার নামে জমা পড়েছে চারশো ডলার, ঘ্যাঁচ করে যখন ইচ্ছে চেক কেটে ফেলতে পারি। হঠাৎ এতখানি পরিবর্তন ঠিক স্পর্শসহ মনে হয় না, কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে।
এ পর্যায়ে আমি আমেরিকা-প্রবাস বিষয়ে কিছু লিখব না। শুধু পটভূমিকা বোঝাবার জন্য এতখানি অবতরণিকা।
মাস দু-একের মধ্যেই টেলিফোন-ফ্রিজ-বাথটাব ইত্যাদি আর গ্রাহ্যের মধ্যেই আসে না। ও দেশের জীবনযাত্রায় ওসব সাধারণতম সামগ্রী। এমনকী টিভি, যা কলকাতায় তখন তো ছিলই না, ভারতের কোথাও এসেছে কি না সন্দেহ, ওদেশে গিয়েই প্রথম দেখি, তারও আকর্ষণ কিছুদিনের মধ্যেই চলে যায়। আমার সর্বক্ষণ কলকাতায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, অথচ ওদেশে থেকে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি অনেক।
আমার মতন ছেলের পক্ষে সেই সময়ে কলকাতায় একটা ভদ্রগোছের চাকরি জোগাড় করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে, আমেরিকায় আমার অবস্থা বেশ সচ্ছল। বাড়িতে প্রতি মাসে মা-ভাই বোনদের জন্য টাকা পাঠাতেও কোনও অসুবিধে নেই। বিয়ে করিনি, পিছুটানও নেই অন্য কোনও। পল এঙ্গেলের দেওয়া স্কলারশিপের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও অন্য কোনও চাকরি পাওয়ার অনেক সুযোগ হয়েছিল। আমার ভিসা ছিল পাঁচ বছরের, টানা পাঁচ বছর থাকার কোন অসুবিধেই নেই। তখন অনেক ভারতীয় এইরকম পাঁচ বছরের ভিসা নিয়ে আমেরিকা পৌঁছে কিছু না কিছু চাকরি জুটিয়ে নিত, তারপর ভিসার মেয়াদ শেষ হলে চলে যেত পাশের কানাডায়, সেখানে ভিসা লাগে না, সেখানে কোনওক্রমে মাস ছয়েক কাটিয়ে আবার আমেরিকায় ঢুকলেই আবার পাঁচ বছরের ভিসা। তার মধ্যেই পাওয়া যায় স্থায়ী পারমিট। কয়েকজন ভারতীয় এই পন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছিল আমাকে।
যদি তা মেনে নিতাম, তা হলে এতদিনে অমেরিকায় আমার নিজস্ব একটা বাড়ি হত, গোটা দুয়েক অন্তত গাড়ি, মেম বউ, কিংবা একফাঁকে টুক করে দেশে এসে বিয়ে করে নিয়ে যেতাম কনভেন্টে-পড়া কোনও রূপসীকে, আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা না শিখে শুধু ইংরিজি বলত, আমার আবলুস কাঠের মতন গায়ের রংটাও বোধহয় ফরসা হয়ে যেত। দু-তিন বছর অন্তর দেশে ফিরতাম একগাদা অল্পদামের ক্যামেরা, ঘড়ি, টেপ রেকর্ডার, পারফিউম, গেঞ্জি-সোয়েটার নিয়ে, উদারভাবে সেগুলো বিলোতম আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে। আর নাক সিঁটকে বলতাম, কলকাতা শহরটা এত নোংরা কেন, রাস্তাগুলোর কেন এমন বদখত অবস্থা। এদেশের মানুষ কোনও কাজকর্ম করে না, দিল্লি-বোষে যাওয়ার প্লেনগুলো সময়ের ঠিক রাখে না, ছি ছি ছি!
আমি তো গেছি গরিব দেশ থেকে, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, এমনকী ইংল্যান্ড থেকেও যেসব কবি লেখকরা গিয়েছিলেন, তাঁদেরও আমেরিকার এমন সুলভ জিনিসপত্র এবং চাকরি পাওয়ার সুবিধে দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেল, বেশ কয়েকজন এখানে পাকাঁপাকি থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন, দু-চারজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়ে ডিগ্রি বাড়াবার চেষ্টায় মাতলেন, একজন বিয়ে করে ফেললেন দুম করে, যাতে আর ফেরার প্রশ্নই না ওঠে। কিন্তু দু-তিন মাসের মধ্যেই আমার মনের মধ্যে যাই যাই রব। কিছুই ভালো লাগে না। যেন আমি বন্দি, যদিও আমেরিকার মতন সর্বত্র ঘোরাফেরার স্বাধীনতা পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই। কয়েকজন নবলব্ধ ভারতীয় বন্ধু আমার ছটফটানি দেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, কোনওরকমে একটা বছর কাটিয়ে দাও। প্রথম এক বছরই খুব হোম সিকনেস থাকে, তারপর একদম কেটে যায়। আমি তা শুনে শিউরে উঠে ভাবতাম, তবে তো কোনওক্রমেই এক বছর পার হতে দেওয়া চলবে না।
কলকাতায় সবসময় বন্ধু-বান্ধব কিংবা ছুটোছুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, ফাঁকা সময় প্রায় ছিলই না। আয়ওয়াতে গিয়েই পুরোপুরি নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছি অনেক সময়। এমনও দিন গেছে, চব্বিশ ঘণ্টা নিজের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে পা দিইনি, নিজের সঙ্গে ছাড়া অন্য কারুর সঙ্গে কথা বলিনি। সেই নির্জন ঘরে, আয়নার সামনে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আমি নানারকম প্রশ্ন করতাম। এখানে থেকে যাওয়া কিংবা ফিরে যাওয়া, এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো সাজাতাম বারবার। জাগতিক নিয়মে ওদেশে থেকে যাওয়ার পক্ষেই যুক্তি প্রচুর, তবু একটা প্রশ্ন থাকে, এ জগতের কাছে আমি কী চাই? নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার আনন্দ! তা হলে কীসে আমার সর্বাধিক আনন্দ?
এতদিন পর্যন্ত জীবনের কোনও ব্যাপারেই কোনও গুরুত্ব দিইনি। লেখালিখিও চলছিল খেলাচ্ছলে। কিছু কবিতা লেখা ও ছোট কবিতার পত্রিকা চালানো নিয়ে মেতে ছিলাম, কিন্তু তা নিয়েই সারাজীবন কাটবে কি না ভেবে দেখিনি। আয়ওয়াতে ফাঁকা ঘরে দিনের পর দিন নিজেকে প্রশ্ন করে আমার একটা উপলব্ধি হল। টাকাপয়সা রোজগার, নিশ্চিন্ত জীবিকা, আরামের উপকরণ, ভালো ভালো খাদ্য পানীয়–এই সব কিছুর চেয়েও বেশি আনন্দ পাই যখন মাথায় ঘাম ছুটিয়ে কিছু লেখালিখি করি। তা যতই অকিঞ্চিৎকর হোক, আমার কাছে তার মূল্য অনেক। দু-চার লাইন লেখার সময় যে রোমাঞ্চ হয়, নারীসঙ্গের চেয়েও তা কম রোমহর্ষক নয়!
আমার ইংরিজি ভাষায় দক্ষতা নেই, লিখি শুধু বাংলায়। আর বাংলায় লিখে যেতে হলে এই পরবাসভূমি ছেড়ে আমাকে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে। জানি, দেশে ফিরলে সহজে জীবিকা জুটবে না। কবিতা লিখলে পেটের খিদে থেমে থাকবে না, তবু একটাই যখন জীবন, তখন ঝুঁকি নিয়েও তো আনন্দের সন্ধানই করা উচিত। লাইব্রেরি অ্যাসিস্টেন্টের চাকরি কিংবা একটা মাস্টারি জুটিয়ে এদেশে বাড়ি-গাড়ি বানালেও তো আমি সে আনন্দ পাব না। আমাকে ফিরতেই হবে। একজন বড় বিজ্ঞানী কিংবা চিকিৎসক দেশে ফিরে গেলে দেশের অনেক উপকার করতে পারবেন, আমার দ্বারা সেরকম কিছুই হবে না, আমার সঙ্কল্প আমার একান্তই ব্যক্তিগত।
তবু ফেরার ব্যাপারে আমার একটা দ্বিধা এসে গেল অন্য দিক দিয়ে।
আয়াওয়া সিটি একটা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছোট শহর। এখানে লোকজনদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য বিশেষ কোনও উদ্যোগ নিতে হয় না। ইউরোপীয়দের মতন, আমেরিকানরা ফর্মাল নয়, একেবারে কেউ পাশে বসলে নিজে থেকে কথা বলতে শুরু করে। ওদের সামাজিকতার আর একটা সুন্দর দিক আছে। পথে-ঘাটে যে-কোনও লোকের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয় না, সেটা অভদ্রতা, বরং হাসি মুখে বলে, হাই! অর্থাৎ এই যে! প্রথম প্রথম হকচকিয়ে গেলেও পরে আমার এটা বেশ ভালোই লাগত।
কলকাতার আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ-এর উচ্চবিত্ত সহপাঠী-সহপাঠিনীরা কেউ আমার সঙ্গে যেচে কথা না বললেও, ওখানকার রাইটার্স ওয়ার্কশপের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা নিজের থেকেই আলাপ করল, এবং কয়েকজনের সঙ্গে অল্পদিনের মধ্যেই আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। লন্ডনে যেমন পাব, আমেরিকার ছোট শহরে তেমনি ট্যাভার্ন, সেখানে বসে প্রতি বিকেলে আড্ডা। কোনও একজনের বাড়িতে দল বেঁধে হানা দেওয়া হয় যখন তখন।
আমার বাড়িতেও একদিন চার-পাঁচজন যুবক-যুবতী আড্ডা দিতে এল। সবাই লেখক লেখিকা নয়, তাদের বন্ধু-বান্ধবী, ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক-অধ্যাপিকাও দু-একজন। সন্ধের পর তারা চলে যাওয়ার পর দেখি, একখানা বই কেউ ফেলে গেছে। সেখানা লাইব্রেরির বই, সুতরাং কে রেখে গেছে, তা বোঝার উপায় নেই। সেখানা মূল ফরাসিতে মলিয়ের এর নাট্যসংগ্রহ। উলটে-পালটে দেখি, দাঁত ফোঁটাতে পারি না।
দু-দিন বাদে সকালবেলা একটি নারীকণ্ঠের টেলিফোন। তার নামটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সে বলল, গত পরশু আমার বন্ধু ডোরি-র সঙ্গে তোমার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম, তোমার মনে আছে কি? আমি কি তোমার বাড়ি গিয়ে বইটা নিয়ে আসতে পারি?
আমি তিনবার বললাম, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!
ইংরিজি ভাষা ও উচ্চারণ শুনে বোঝা যায় মেয়েটি আমেরিকান নয়। সেদিনের চার পাঁচজনের মধ্যে এ মেয়েটি কোন জন?
একটু পরেই যে এল, সে বেশ দীর্ঘাঙ্গিনী তরুণী, মাথাভরতি অলোকলতার মতন এলোমেলো সোনালি চুল, গায়ে একটা ভোরের সূর্যের মতন লাল রঙের সোয়েটার, সারা মুখে সুস্বাস্থ্যের ঝলমলানি। তার হাতে একগুচ্ছ শিশিরভেজা সাদা লিলি ফুল।
এই মেয়েটি আগের দিন এক কোণে বসেছিল, বেশি কথা বলেনি, তাই তার নাম আমার মনে নেই।
আমি দরজা খোলার পর সে বলল, হাই, সুনীল! আমার নাম মার্গারিট ম্যাতিউ। সেদিন তোমার ঘরে কোনও ফুল দেখিনি, তাই তোমার জন্য এই লিলির গুচ্ছ এনেছি। না, না, না, কিনিনি, আর্ট ডিপার্টমেন্টের বাগান থেকে চুরি করে এনেছি। তুমি বুঝি এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলে? তোমার ঘরে সুন্দর কফির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বইটা দাও!
আমি বইটা এনে জিগ্যেস করলাম, একটু বসে যাবে না? মাগারিট বলল, আমাকে এক্ষুনি ক্লাসে ছুটতে হবে। এমন দারুণ রোদ উঠেছে, এরকম সকালে ক্লাস করার কোনও মানেই হয় না। কিন্তু ছেলে-মেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর একদিন এসে ভারতীয় চা খেয়ে যাব। মের্সি বকু।
বইটা হাতে নিয়ে সে ঝড়ের মতন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েও আবার উঠে এল কয়েক ধাপ। সারল্যমাখা মুখখানি উঁচু করে বলল, তুমি আমাকে শকুন্তলার কথা একটু বলবে একদিন?
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, শকুন্তলা? কে শকুন্তলা? আমি তো কোনও শকুন্তলাকে চিনি না!
মার্গারিট বলল, গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ারের কবিতায় যে শকুন্তলার উল্লেখ আছে।
তৎক্ষণাৎ আমি বুঝতে পারলাম, এ নিশ্চয়ই দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রসঙ্গে। অ্যাপোলিনেয়ারের সে কবিতা তো আমি পড়িনি। মার্গারিট আবার বলল, তুমি যদি আমাকে একদিন শকুন্তলার উপাখ্যানটা বুঝিয়ে দাও, তা হলে তোমাকে আমি অনেক ফরাসি কবিতা পড়ে শোনাতে পারি।