মস্কো বিমানবন্দরে পা দিলুম খুব ভোরবেলায়। সারা রাত প্রায় জেগেই কাটাতে হয়েছে। কলকাতা থেকে এরোফ্লোট বিমানে চেপেছিলুম বিকেলবেলা, তারপর বোম্বে, করাচি আর তাসকেন্টে বিমানটি মাটি ছুঁয়েছিল, আমাদেরও নামতে হয়েছিল দুবার। তার মধ্যে শেষ রাতে তাসকেন্টে নেমে আমি ঝোলা থেকে একটা সোয়েটার যার করে পরে নিয়েছিলুম। রাশিয়ার ঠান্ডা সম্পর্কে অনেকেই ভয় দেখিয়েছিল আগে থেকে, কিন্তু আমি খুব একটা শীত-কাতুরে নই, তা ছাড়া কিছুদিন আগেই ডিসেম্বর-জানুয়ারির ক্যানাডার তুষারের রাজ্য ঘুরে এসেছি, সুতরাং মে মাসের রাশিয়াকে ডরাব কেন? অবশ্য সঙ্গে একটা পাতলা ওভারকোটও এনেছি।
বিমানে রাত্তিরটা বেশ গল্প-গুজবেই কেটে গেছে। সহযাত্রী পেয়েছিলুম দুই বাঙালি তরুণকে। একজনের নাম সুবোধ রায়, সে মস্কোতে আছে প্রায় সাত-আট বছর, উচ্চশিক্ষার্থে। কিছুদিনের জন্য কলকাতায় ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার। সুবোধ খুব দিলদরিয়া ধরনের, উচ্ছ্বাসপ্রবণ এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। অন্যজনের নাম অসিতবরণ দে, সে প্রায় চোদ্দো বছর বাদে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে কলকাতা-দর্শনে এসেছিল। সে একটু চাপা ও লাজুক স্বভাবের। আমরা তিনজনে মিলে মস্কো-প্রাহা-কলকাতার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছিলুম। সন্ধে থেকে মাঝেমধ্যেই আমাদের খাদ্য-পানীয় পরিবেশন করা হচ্ছিল, বিমানযাত্রার একঘেয়েমি কাটাবার জন্যই বোধহয় ওরা অত ঘন ঘন খাবার দেয়, কিন্তু অত কি খাওয়া বায়? শেষবারের খাবার আমি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলুম।
মস্কোয় নামার পর অসিতবরণ দে চলে গেল ট্রানজিট লাউঞ্জের দিকে, আমি আর সুবোধ পাশপোর্ট হাতে করে এগোলুম নিষ্ক্রমণের পথে।
সুবোধ জিগ্যেস করল, আপনাকে কি কেউ নিতে আসবে?
আমি বললুম, সেই রকমই তো কথা আছে। কিন্তু এত ভোরে…
সুবোধ বলল, কেউ না এলেও ক্ষতি নেই, আমি তো আছি! আমি আপনাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেব।
মস্কো বিমানবন্দরটি বিশাল, কিন্তু প্রায় নিঝুম। এত সকালে একটিই মাত্র ফ্লাইট এসেছে। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস বেরিয়ার পার হওয়া মাত্রই একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছিপছিপে যুবক আমার কাছে এসে পরিষ্কার ইংরিজি উচ্চারণে আমার নাম বলে জিগ্যেস করল, আপনিই কি তিনি?
আমি হ্যাঁ বলতেই সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম সারগেই স্ট্রোকান, আমি আপনার জন্যই এসেছি।
এত লোকজনের মধ্যে সে প্রথমেই আমাকে চিনল কী করে? খুব সম্ভবত ছবি দেখে সে আমার চেহারাটা মুখস্থ করেছে। আমি তার সঙ্গে সুবোধ রায়ের আলাপ করিয়ে দিলুম।
সারগেই স্ট্রোকান একটা ঠেলাগাড়ি জোগাড় করে এনে তাতে আমাদের বাক্স প্যাঁটরাগুলো চাপাল। তারপর সেটা নিয়ে এগোবার চেষ্টা করতেই উলটে পড়ে গেল সবকিছু। সারগেই স্ট্রোকান লজ্জা পেয়ে সংকুচিতভাবে বলল, আমি খুব দুঃখিত, আমি কোনওরকম গাড়িই ঠিকঠাক চালাতে পারি না!
তাতে আমি খুব আশ্বস্ত বোধ করলুম। যে-খুব তুখোড় ধরনের লোক সবকিছুই নিখুঁতভাবে করতে পারে, কখনও যাদের জীবনে নিজস্ব ভুলের জন্য লজ্জা পাওয়ার অবকাশ ঘটে না, সেই সব মানুষদের আমি বেশ ভয় পাই। এযারে আমরা তিনজনেই হাত লাগিয়ে গাড়িটিকে নিয়ে এলুম বিমানবন্দরের বাইরে। একটা ট্যাক্সি ডেকে মালপত্র তোলা হল।
এবারে আমি ওভারকোটটা গায়ে চাপিয়ে নিলুম। খুব যে শীত করছে তা নয়। জানলা দিয়ে আমি উৎসুকভাবে দেখতে লাগলুম বাইরের দৃশ্য।
যে-কোনও নতুন দেশে এলেই প্রথমটায় একটা রোমাঞ্চ হয়। সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে কৌতূহল, আগ্রহ পুষে রেখেছি কতদিন ধরে। আমরা একটা দেশকে সবচেয়ে ভালো করে চিনি তার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। এই সেই টলস্টয়, পুশকিন, ডস্টেয়ভস্কি, গোর্কি, মায়াকভস্কি-র দেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি দেশে প্রোলেতারিয়েতরা শোষণমুক্ত সমাজ-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে, এই দেশটি দেখবার জন্য আমি অনেকদিন থেকেই ব্যর্থ হয়েছিলুম, অকস্মাৎ আমন্ত্রণ পেয়ে খুবই পুলকিত বোধ করেছি।
আমি পূর্ব ইউরোপের কোনও দেশেই আগে আসিনি। এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের কতটা তফাত তাও দেখতে চাইছিলুম। এখন অবশ্য সেরকম কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বিমানবন্দর থেকে মস্কো শহর বেশ দূরে, এখন পথের দু-পাশে শুধুই উন্মুক্ত প্রান্তর, মাঝে-মাঝে গাছপালা। আজ এপ্রিল মাসের শেষ দিন, কিন্তু শীতের চিহ্ন এখনও মুছে যায়নি, এখানে সেখানে চোখে পড়ে বরফ-গলা জল।
রাস্তার পাশে একটি ভাস্কর্যের দিকে হাত দেখিয়ে সুবোধ বলল, এই পর্যন্ত হিটলারের বাহিনী এসে থেমে গিয়েছিল।
আমি চমকে উঠলুম। মস্কো নগরীর আশেপাশে কত ঐতিহাসিক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ১৯৪১-এর ডিসেম্বর মাসে এই অঞ্চলে কী সাংঘাতিক যুদ্ধ হয়েছিল, সারা পৃথিবী আতঙ্কে ভেবেছিল মস্কো বুঝি যায়-যায়, শেষ পর্যন্ত রেড আর্মির বীরত্বের কাছে দারুণভাবে হেরে যায় নাতসিরা। আজ তার আর কোনও চিহ্নই নেই। কয়েকটি বলিষ্ঠ পুরুষের মূর্তি আকাশের দিকে মুঠি তুলে আছে। তার পেছনেই বড়-বড় গাছ, নিঃশব্দ মস্কো শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে মস্কোভা নদী। এমন কিছু বড় নদী নয়। সেই নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলুম আমার জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে। এটির নাম হোটেল ইউক্রাইনিয়া। এর ভবনটি যেমন প্রকাণ্ড তেমনি জমকালো ধরনের। নীচের দিকটা অতি প্রশস্ত, তার পর ধাপে-ধাপে ছোট হতে-হতে ওপরের দিকে উঠেছে। একেবারে চূড়োর কাছটা গির্জাশীর্ষের মতন। অবিকল এই এক ডিজাইনের বাড়ি মস্কো শহরে চার-পাঁচটি আছে, অনেক দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
সুবোধ রায় এখান থেকে বিদায় নেবে, তাকে যেতে হবে আরও খানিকটা দূরে। সে সেরগেই স্ট্রোকান-কে জিগ্যেস করল, আপনাদের কী প্রোগ্রাম বলুন? আমরা এখানকার বাঙালিরা সুনীলদাকে নিয়ে কয়েকদিন বসতে চাই।
সেরগেই স্ট্রোকান বলল, তা তো সম্ভব হবে না। আমরা ওঁকে ডেকে এনেছি, আমাদের প্রত্যেকদিনের ঠাসা প্রোগ্রাম আছে। তার মধ্যে তো সময় করা যাবে না! আপনারা ইন্ডিয়াতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করবেন।
কিন্তু সুবোধ এত সহজে কিছু মেনে নেবার পাত্র নয়।
সে বলল, সন্ধের পর তো আপনাদের আর কিছু করবার থাকবে না। তখন আমরা এসে ওঁকে নিয়ে যাব, আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব। আজকের দিনটা থাক, কাল সন্ধেবেলা আমি এসে–
সেরগেই স্ট্রোকান বলল, কাল দুপুরেই আমরা লেনিনগ্রাড ঢলে যাচ্ছি।
যাই হোক, ঠিক হল যে নানা জায়গায় ঘুরে আমি আবার দিন দশেক বাদে ফিরে আসব মস্কোতে। তখন এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হবে। সুবোধ আমাদের দু’জনকেই তার কার্ড দিল, যাতে ফিরে এসেই আমরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।
হোটেলের ভেতরে এসে পাসপোর্ট জমা দিয়ে নামটাম লেখাতে খুব বেশি সময় লাগল না। আমার জন্য ঘর নির্ধারিত হল সতেরো তলায়। হোটেলের লাউঞ্জটি পুরোনো আমলের মতন বেশ জমকালোভাবে সাজানো। খুব উঁচু সিলিং, আলোগুলো ঝাড়-লণ্ঠনের মতন। লিফটটি দেখেও আমি চমকৃত হলুম, একেবারে আদিকালের ঢাউস লিফট, পেতলের কারুকার্য করা দরজা, ভেতরে অন্তত জনা কুড়ি লোক অনায়াসে এঁটে যায়। এ-রকম লিফট আমি আগে দেখেছিলুম রোমের ভ্যাটিকানে।
সুটকেস সমেত আমাকে আমার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সেরগেই স্ট্রোকান বলল, আপনি এখন একটু বিশ্রাম নিন। আমি আবার সাড়ে নটার সময় আসব।
ওভারকোট ও জুতো-মোজা খুলে ফেললুম তাড়াতাড়ি। বেশিক্ষণ মোজা পরে থাকলে আমার অস্বস্তি লাগে। সেই গতকাল দুপুর থেকে এসব পরে আছি। খালি পায়ে এসে দাঁড়ালুম জানলার ধারে। একটু দূরেই নদী। এই নদীর দু-পার আগাগোড়া পাথর দিয়ে বাঁধানো। জানলার কাঁচ খুলে বাইরে মুখ ঝুঁকিয়ে টাটকা হাওয়া বুকে টেনে নিলুম অনেকখানি। একটা গভীর বিস্ময়বোধ এখনও আমাকে আপ্লুত করে আছে। সত্যি আমি রাশিয়াতে এসেছি!
মাত্র সাতটা বাজে। কলকাতায় এ সময় ঘুম থেকেই উঠি না। দীর্ঘ বিমানযাত্রা ও রাত্রি জাগরণ সত্বেও শরীরে কোনও ক্লান্তি বোধ নেই। ইচ্ছে করলে এখন ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। ধপধপে সাদা চাদর পাতা নরম বিছানায় শুয়ে পড়লুম বটে, কিন্তু একটা নতুন দেশে এসেই কি ঘুমিয়ে পড়া সম্ভব?
ঘরখানি যে-কোনও দেশের দামি হোটেল ঘরের মতন। টিভি, টেলিফোন, রাইটিং টেবল, ড্রেসিং টেবল, এক পাশে ওয়ার্ডরোব ও সংলগ্ন বাথরুম। উঠে টিভি চালিয়ে দিলুম। রুশ ভাষা এক বর্ণ বুঝি না। মনে হল খবর পড়া হচ্ছে। তার মধ্যে এক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধির নাম শুনে চমকে উঠলুম। কী হয়েছে ইন্দিরা গান্ধির? তারপর শুরু হল বাচ্চাদের জন্য অনুষ্ঠান।
আধ ঘণ্টা শুয়ে থেকেও বুঝলুম ঘুম আসবার কোনও আশা নেই। তার চেয়ে বরং দাড়ি কামানো, স্নান ইত্যাদি সেরে ফেলা যাক। এইসব পর্ব চুকিয়ে, পোশাক পালটিয়ে আমি ফিটফাট হয়ে আবার দাঁড়ালুম জানলার ধারে। এত উঁচু থেকে রাস্তার মানুষজনকে ছোট-ঘোট দেখায়। নদীর ওপর দিয়ে স্টিম লঞ্চ যাচ্ছে। এখান থেকে যে দৃশ্য আমি দেখছি, তাতে অন্যান্য সাহেবি শহরের সঙ্গে মস্কোর কোনও তফাত নেই।
একটু পরেই সারগেই স্ট্রোকান এসে পড়ল। সে বেশ ব্যস্তভাবে বলল, আপনি তৈরি তো? চলুন, আগে ব্রেক ফাস্ট খেয়ে আসি।
আমি বললুম, আগে একটু বসুন। আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করে নিই।
সারগেই বলল, আপনি যে-ক’দিন আমাদের দেশে থাকবেন, আমিই সব জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাব। সুতরাং আলাপ তো হবেই।
আমি বললুম, তবু একটু বসুন।
যুবকটির চোখের মণি দুটো নীলচে, মুখটি বুদ্ধিদীপ্ত এবং সারল্য মাখানেনা। তার গায়ে একটা খয়েরি রঙের চামড়ার জ্যাকেট। আমি তাকে একটা সিগারেট দিতে চাইলে বলল যে কিছুদিন আগে সে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে, কারণ সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়। সেই সঙ্গে সে যোগ করল, অবশ্য সোভিয়েত দেশে এখনও অনেকেই সিগারেট খায়।
আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি আমার সম্পর্কে কী কী জানেন?
সে গড়গড় করে অনেক কিছু বলে গেল। বুঝলুম যে কলকাতার কনসুলেট থেকে পাঠানো আমার বায়োডাটা সে ভালো ছাত্রের মতন মুখস্থ করে নিয়েছে।
আমি হেসে বললুম, বাঃ সবই তো জেনে ফেলেছেন দেখছি। এবারে আপনার সম্বন্ধে কিছু বলুন!
সারগেই স্ট্রোকানের জন্ম ইউক্রাইনে, উচ্চশিক্ষার জন্য সে মস্কো চলে আসে। পড়াশুনা শেষ করার পর সে কিছুদিন সামরিক বাহিনীতে ট্রেইনিং নিয়েছে, এখন নভোস্তি প্রেস এজেন্সিতে ইন্ডিয়া ডেস্কে সে অনুবাদকের কাজ নিয়েছে। তার বয়েস বাইশ এবং সে বিবাহিত।
একটু হেসে সে যোগ করল, আমিও কবিতা লিখি। তবে আমার কবিতা বিশেষ কোনও জায়গায় ছাপা হয়নি।
তারপর সে জিগ্যেস করল, আমি আপনাকে কি মিস্টার গঙ্গোপাধ্যায় বলব? কিংবা যদি সুনীলজি বলি? ইন্ডিয়াতে তো অনেকেই এইভাবে ডাকে!
-তুমি জানলে কী করে?
–আমি ইন্ডিয়াতে গেছি। প্রায় এক বছর ছিলাম!
সারগেই স্ট্রোকান ভারত ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হতে চায় বলে সে তামিল ভাষা শিখেছে। এবং সেই ভাষাজ্ঞান ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য সে ভারতবর্ষ ঘুরে এসেছে। সে তামিলনাড়, কেরালা, বোম্বাই, দিল্লি দেখেছে, কলকাতার দিকে যায়নি।
আমি মনে-মনে একবার ভাবলুম, ওদের ইন্ডিয়া ডেস্কে নিশ্চয়ই বাংলা জানা ছেলেও আছে। সেরকম একজনকে কেন পাঠাল না আমার সঙ্গী হওয়ার জন্য? পরক্ষণে সেই ভাবনাটা বাতিল করে দিলুম। এই যুবকটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। বাংলা জানা বা না জানায় কী আসে যায়!
ঠিক হল, সে আমাক সুনীলজি বলবে, আমি তাকে শুধু সারগেই বলে ডাকব। এর পর নীচে নেমে এলুম ব্রেক ফাস্ট খেতে।
এ হোটেলের ডাইনিং হলটাও বিশাল। ব্রেক ফাস্ট খাওয়ার দু-রকম পদ্ধতি। টেবিলে বসে মেনিউ কার্ড দেখে ইচ্ছে মতন অর্ডার দেওয়া যায়। আর একদিকে আছে সেলফ সার্ভিস। আমরা দ্বিতীয় দিকেই গেলুম। এখানে পনেরো-কুড়ি রকম খাবার সাজানো রয়েছে, তিন রুবল দিয়ে টিকিট কাটলে ইচ্ছে মতন যা খুশি নেওয়া যায়।
আমি একটা ডিম সেদ্ধ, একজোড়া সসেজ ও এক পিস টোস্ট নিয়ে টেবিলে বসতেই সারগেই বলল, এ কী সুনীলজি, এত কম নিলেন? আরও কত কী রয়েছে, স্যালামি, বেকন, হ্যাম, মিট বল, ম্যাসড পোটাটো, চিজ, আমাদের অনেকরকম চিজ আছে, ট্রাই করুন।
আমি খুব একটা ভোজনরসিক নই, বিশেষত সকালের দিকে মোটেই বেশি খেতে ইচ্ছে করে না। তবু সারগেই আরও কিছু খাদ্য জোর করে এনে দিল আমার প্লেটে। কাছাকাছি টেবলগুলোতে যারা বসে আছে, তারা অধিকাংশই বিদেশি; ইংরিজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষা শুনতে পাচ্ছি। এই হোটেলটি প্রধানত বিদেশিদেরই জন্য।
দশটার সময় বেরিয়ে এলুম হোটেল থেকে। এবারে আর ট্যাক্সি নয়, সারগেই-র অফিস থেকে গাড়ি এসেছে। এই গাড়ি সারাদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে।
সারগেই বলল, চলুন, সুনীলজি, আগে রেড স্কোয়ার দেখে আসি। রেড স্কোয়ার না দেখলে মস্কো শহর অনুভবই করা যায় না।
আমি তাতে সম্মতি জানালুম।
মস্কো শহরে আধুনিক কায়দায় বিরাট বিরাট বহুতল বাড়ি যেমন উঠেছে, তেমনি পুরোনো আমলের প্রাসাদ রয়ে গেছে অনেক। রাস্তার দুপাশে বাতিস্তম্ভগুলোতে লোকেরা এক জোড়া করে লাল পতাকা লাগাচ্ছে, দু-দিন মে-ডের উৎসব, সেজন্য। ঝকঝক করছে রোদ। চওড়া চওড়া রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা অতি সুশৃঙ্খল, কোথাও জ্যামে পড়তে হল না। তবে, পশ্চিমি কোনও বড় শহরের তুলনায় মস্কোতে গাড়ির সংখ্যা যেন কিছু কম। বাস স্টপগুলিতে রয়েছে অপেক্ষমাণ মানুষ, অনেক লোক পায়ে হেঁটেও যাচ্ছে, এটা দেখলে স্বস্তি লাগে। আমেরিকার অনেক শহরে গাড়ি ছাড়া একজনও পথচারী দেখা যায় না, কেন যেন ভূতুড়ে-ভূতুড়ে মনে হয়।
মস্কো শহরটি তেমন ঘিঞ্জি নয়। মাঝে মাঝেই পার্ক রয়েছে, তাতে নানারকম ভাস্কর্য। ব্রোঞ্জ ও পাথরের মূর্তিগুলি দৃষ্টি টেনে নেয়। খুবই বলিষ্ঠ কাজ। লেনিনের মূর্তি ছাড়াও বিখ্যাত সব সাহিত্যিক ও কবিদের মূর্তিও আছে। একটি অতি জীবন্ত মূর্তির নাম, সর্বহারার অস্ত্র ও খোয়া পাথর।
যেতে-যেতে বলশয় থিয়েটার দেখে আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠল। এই সেই বিখ্যাত নাট্যশালা! আমি সারগেইকে বললুম, এখানে একটা ব্যালে কিংবা অপেরা দেখার সুযোগ পাব কী?
সারগেই বলল, এখন তো টুরিস্ট সিজন, টিকিট পাওয়া খুব শক্ত, তবু আমি চেষ্টা করব!
রেড স্কোয়ারে যাওয়ার আগে আমরা পুরো ক্রেমলিন এলাকাটায় একটা চক্কর দিলুম। এই অঞ্চলে আধুনিক বাড়ি বেশি চোখে পড়ে না, প্রাচীন ভাবটি অক্ষুণ্ণ আছে। ক্রেমলিন প্রাসাদের পেছন দিকে একটি পার্ক, সেখানে নামলুম আগে। এই পার্কের মধ্যেই একটি ঘেরা জায়গায় জ্বলছে অমর-জ্যোতি। যুদ্ধের সময় দেশকে রক্ষা করার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের স্মরণে জ্বলে এই অনির্বাণ আলোর শিখা। আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালুম আমার শ্রদ্ধা জানাতে। অনেকেই এই আলোর শিখা দেখতে এসেছে, তার মধ্যে দেখলুম দু-জোড়া নব-বিবাহিত দম্পতিকে। যুবতী দুটির সাদা পোশাক ও দীর্ঘ ওড়না দেখলেই বোঝা যায় তারা সদ্য বিবাহের অনুষ্ঠান সেরেই এখানে এসেছে। সারগেইকে জিগ্যেস করে জানলুম, অনেক নব-দম্পতিই এখানে আসে। বিবাহের আনন্দ উৎসবের মাঝখানে শহিদ বেদিতে মাল্যদান আমাদের কাছে একুট আশ্চর্য মনে হতে পারে, কিন্তু সোভিয়েত নাগরিকদের কাছে এর বিশেষ তাৎপর্য আছে। গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রায় দু-কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছে, যখন এখানে জনসংখ্যাই ছিল কুড়ি কোটি। অর্থাৎ প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার থেকেই একজন দুজন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিংবা পঙ্গু হয়েছে।
আমি সারগেইকে মৃদু গলায় জিগ্যেস করলুম, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় তো তুমি জন্মাওনি। তোমাদের পরিবারের কেউ কি…
সে সংক্ষিপ্তভাবে বলল, হ্যাঁ।
গাড়িতে ফিরে এসে আবার খানিকটা চক্কর দিলুম। চার দিকেই অসংখ্য ফুল। এর মধ্যে বেশি করে চোখে পড়ে টিউলিপ। এত বৈচিত্র্যময় টিউলিপ আমি আগে কখনও দেখিনি। গাঢ় লাল রঙের টিউলিপের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় ছিল, এখানে দেখলুম হলুদ এবং তুষার-শুভ্র টিউলিপের ঝাড়ও রয়েছে। বাগানগুলি খুব যত্ন করে সাজানো। ফরাসি দেশের মতন বেশি বেশি যত্নের চিহ্ন প্রকট নয়, বরং বেশ স্বাভাবিক।
সারগেই বলল, আপনি ভাগ্যবান, আপনি খুব ভালো সময়ে এসেছেন। কয়েকদিন আগেও এখানে যখন-তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। দুদিন ধরে আকাশ পরিষ্কার। সেজন্য টিউলিপও এত বেশি ফুটেছে।
রেড স্কোয়ারে যাওয়ার জন্য গাড়িটা বাইরে রেখে খানিকটা হেঁটে যেতে হয়। ঢালু রাস্তা ধরে আমরা ওপরের দিকে উঠে এলুম।
তারপর রেড স্কোয়ারে পা দিয়েই মনে হল, এ জায়গাটা তো আমার খুব চেনা!