প্যারিসে কবিতার আসর

প্যারিসে কবিতার আসর

পৃথিবীতে স্বদেশের বাইরে আমি সবচেয়ে বেশি গেছি ফরাসি দেশে। কতবার? তা আর গোনাগুনতি নেই। অন্তত কুড়িবার তো হবেই।

প্রথমবার গিয়েছিলাম, বহু বছর আগে, সেই উনিশশো চৌষট্টি সালে। তার আগের বছরেও অবশ্য প্যারিস বিমানবন্দরে কাটিয়েছিলাম কয়েক ঘণ্টা, শহরের মধ্যে ঢুকিনি। বিমানবন্দরে বসেই বহু কবিতা, গল্প-উপন্যাস ও শিল্পীদের জীবনীতে পড়া ফরাসি দেশকে জানলা দিয়ে দেখার মতন দেখেছিলাম মুগ্ধ বিস্ময়ে। যদিও পৃথিবীর সব এয়ারপোর্টই প্রায় একই রকম দেখতে, তা দেখে সে দেশের কিছুই বোঝা যায় না।

পরের বছরে আমেরিকা থেকে ফেরার পথে প্যারিসে ঘুরে ছিলাম আমার ফরাসি বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে। ফরাসি ভাষা না জেনে সে দেশে একা-একা ঘুরে বেড়ালে বাঁশবনে ডোম কানার মতন অবস্থা হয়, সেখানে কোনও বাঙালিবন্ধু থাকলে তবু খানিকটা স্বস্তি পাওয়া যায়। সেবারে ছিলাম প্রায় একমাস, একজনও বাঙালির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। একজন খাঁটি ফরাসি মেয়ে আমার সঙ্গিনী ও পথপ্রদর্শিকা ছিল বলে, সে দেশটি জানতে ও বুঝতে আমার অনেক সুবিধে হয়েছিল, খানিকটা উঁকি মারার সুযোগও হয়েছিল ফরাসি সমাজের অন্দরমহলে। [ এ বিষয়ে আমি আগে বিস্তারিতভাবে লিখেছি বলে এখন আর পুনরুল্লেখ করতে চাই না। এরপর মার্গারিট অকস্মাৎ আমার জীবন থেকে, এবং পৃথিবী থেকেও হারিয়ে যায়। আমি ভেবেছিলাম, ও দেশে আর কখনও আমার পা দেওয়ার সুযোগ হবে না। হয়তো আর বিদেশ যাওয়া হবে না।

অনেক বছর বাদে, উনিশশো একাশি সালে আনন্দবাজার অফিসে একজন লম্বা মতন অচেনা যুবক এসে দাঁড়াল আমার টেবিলের সামনে। তার নাম অসীমকুমার য়ায়, পরিচয় দিয়ে বলল, সে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, থাকে প্যারিসে। অনেকদিন প্রবাসী হলেও বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার টান আছে। সে শুধু আমার সঙ্গেই দেখা করতে আসেনি, এসেছে লেখকদের সঙ্গে আলাপ করতে, আনন্দবাজার তখন ছিল লেখকদের ডিপো।

অসীমের ভাষা কাঠ-কাঠ ধরনের, দুই ভুরুর মাঝখানটা কুঁচকে থাকে। কিন্তু তার বক্তব্য স্বার্থহীন। তার ধারণা, বাঙালি লেখকদের ঘরকুনো হয়ে বসে না থেকে, বাইরে বেরুনো উচিত। শুধু নিজের দেশ নয়, বিদেশেও চেনা দরকার। অন্যদেশের লেখকেরা কত ঘোরাঘুরি করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। আমাদের কোনও বন্ধুবান্ধব যদি ফরাসি দেশ দেখতে চায়, তা হলে প্যারিস শহরে ওর একটা বাড়ি আছে। সেখানে আতিথ্য দিতে পারে। এই আমন্ত্রণের কথা শুনে আমাদের বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে পূর্ণেন্দু পত্রী সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখিয়েছিলেন।

আমি কিন্তু তত উৎসাহ দেখাইনি। যদিও প্যারিসের মতন শহরে থাকার জায়গা পাওয়াই খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার, হোটেল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু প্লেন ভাড়ার টাকা কে দেবে? সে টাকা আমার নেই। তা ছাড়া প্যারিস আমার দেখা আছে ভালো করে।

আশ্চর্য ব্যাপার। পরের বছরই আমেরিকার আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি আমন্ত্রণ পেলাম। স্বাতীও সঙ্গে যেতে পারবে। স্বাতীর কিন্তু আমেরিকার চেয়েও ফরাসি দেশ দেখার আগ্রহ অনেক বেশি, ও ফরাসি ভাষা শিক্ষার ক্লাস করেছে কয়েক বছর, ফরাসি কালচারের ভক্ত। আমেরিকান যাওয়ার পথে ফরাসি দেশে ব্রেক জার্নি করে যাওয়া যায়, যেতে অতিরিক্ত খরচ লাগে না, আর থাকার জায়গার জন্য তো আমন্ত্রণ আছেই।

সেবারে প্যারিসে গিয়ে অসীম রায়ের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর তার সঙ্গে সারাজীবন বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারপর থেকে আমি যে-কোনও দেশেই যাই, মাঝে মাঝে বা ফেরার পথে টুপ করে একবার নেমে পড়ি প্যারিসে। মস্কো যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম, তার সঙ্গে ফ্রান্সের কোনও সম্পর্কই নেই, তবে চলে গেলাম প্যারিসের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। এসব কাহিনিও আমি ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’ বইতে লিখে ফেলেছি।

সে বইতে অবশ্য ফরাসি দেশে শেষ কবিসম্মেলনে কথা লিখিনি।

কয়েকবার প্যারিসে যাওয়ার পথেই সেখানকার বাঙালিদের কয়েকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। বাঙালিরা সংখ্যায় কম, কিন্তু ঘন নিবন্ধ একটি গোষ্ঠী আছে। যেমন অসীমের বিশেষ বন্ধু ভূপেশ দাশ, পেশায় বিজ্ঞানী, কিন্তু প্রচুর বাংলা কবিতা মুখস্থ, এখনকার বাংলা সাহিত্যও নিয়মিত পাঠ করে। প্রখ্যাত শিল্পী শক্তি বর্মন, তবু বাংলা সাহিত্যের পাঠক। ইউরোপের কর্তাব্যক্তি বিকাশ সান্যাল এবং তাঁর স্ত্রী প্রীতি সান্যাল, দু’জনেই বাঙালি লেখকদের খাতির-যত্ন করেন, প্রীতি সান্যাল তো এখন প্রতিষ্ঠিত লেখিকা। তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা ও ভ্রমণের বই প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম দশ-পনেরো বছর ফরাসি দেশে গেছি বারবার, কিন্তু কোনওযার ফরাসি সরকার বা কোনও সংস্থার আমন্ত্রণে নয়, গেছি বন্ধুদের জন্যে। সেইসঙ্গে পারিপার্শ্বিকের প্রতি মুগ্ধতা তো আছেই।

প্রথম একবার আমন্ত্রণ পেলাম, দক্ষিণ ফ্রান্সের এক শহরের মেয়রের কাছ থেকে। উপলক্ষ্যটি বিচিত্র। সেই শহরের মেয়র ও তাঁর পত্নী, বিশেষত মেয়র-গিন্নিই সত্যজিৎ রায়ের দারুণ ভক্ত। ওঁদের উদ্যোগে সেই শহরে সত্যজিৎ রায়ের একটি চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বিজয়া য়ায়, সস্ত্রীক সপুত্র সন্দীপ য়ায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, এবং যেহেতু সত্যজিতের অধিকাংশ চলচ্চিত্র বাংলা ভাষায়, তাই কয়েকজন বাঙালি লেখক ও কবিকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী ও আমাকে। এর মধ্যে আমার দাবি একটু বেশিই ছিল, কারণ সত্যজিৎ রায় আমারও দুটি উপন্যাসের চলচ্চিত্র-রূপ দিয়েছিলেন।

সেখানে খুব আদর-যত্ন, খাওয়া-দাওয়াই বেশি হয়েছে, এবং বেড়ানো। বক্তৃতা যৎসামান্য।

প্যারিস শহরে ফিরে আসার পর কয়েকদিনের জন্য আতিথ্য দিয়েছিলেন ফরাসি সরকার। সেই প্রথম স্বাতী ও আমি প্যারিসের হোটেলের ছিলাম, সরকারি পয়সায়। মোটেই ভালো লাগেনি। বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে পালিয়েছিলাম দু’দিন পরে।

ততদিনে আমি জেনে গেছি, এককালের কবিদের তীর্থস্থান ফরাসি দেশে এখন কবিতার কদর খুব কমে গেছে। তরুণ কবিদের কবিতার বই ছাপা খুব শক্ত ব্যাপার, আমাদের দেশের মতন। প্রকাশক হাসতে-হাসতে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তরুণ কবিদের বই পয়সা নিয়ে ছাপা হলেও কীভাবে তাদের ঠকানো হয়। সেভাবে ঠকে গিয়েও এখনও অনেকে কবিতা লেখে। কবিরা অদম্য!

প্যারিসে একটি কবিতা-ভবন আছে। তার নাম মেইজো দ্য পোয়েজি। তার পরিচালক ফিলিপ ল্যামবেয়ারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তার ডাকে একদিন গিয়েছিলাম সেখানে। দেখলাম, কবিতা-ভবনটির বেশ দুর্দশা। কোনওক্রমে টিমটিম করে চলেছে। কবিতা পাঠের আসরে পঞ্চাশ-ষাটজনের বেশি শ্রোতা পাওয়া যায় না। এরকমভাবে চললে কবিতা ভবনটির দ্বার শিগগিরই রুদ্ধ হয়ে যাবে। সেই টিমটিমে অবস্থার কোনও উন্নতি হয়েছে কি না জানি না।

ইউনেস্কোর বিকাশ সান্যাল একসময় ভারত ভবনের (মেইজে দ লা’ন্ড) পরিচালক হলেন। তিনি ইউনেস্কোরও উপদেষ্টা রইলেন, আবার ভারত ভবনেরও দেখাশুনো করতে হয়। ভারত ভবনে বিশিষ্ট গবেষক ও অতিথিদের থাকার জন্য অনেকগুলি ঘর আছে, এবং আছে একটি মাঝারি আকারের সভাঘর। এই সভাঘরে মাঝে-মাঝে গানবাজনা, বক্তৃতা, কবিতা পাঠের আয়োজন হয়। বলাই বাহুল্য, এই কবিতা পাঠের ব্যবস্থা শ্ৰীমতী প্রীতি সান্যালের আগ্রহাতিশয্যে। বিকাশের আদি নিবাস ময়মনসিংহ-এ, কিছুদিন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজে অধ্যক্ষ করেছেন, তারপর বহুকাল প্যারিসবাসী। আর প্রীতি সান্যাল বহরমপুরের মেয়ে, স্বদেশে পড়েছেন কিছুদিন, এখন ফরাসি দেশে স্থায়ী হয়ে সেখানকার ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ রেখেছেন নিবিড়ভাবে। এই দম্পতিকে ওখানকার বাঙালিরা, অবাঙালি ও অনেক ফরাসিও রাজযোটক হিসেবে গণ্য করে। প্রীতি ওদেশে চাকরি নেননি, কিন্তু নিছক গৃহবধূ হয়েও বসে থাকেননি। স্বামীর সঙ্গে প্রীতি এই পৃথিবীর কত যে দেশভ্রমণ করেছেন তাঁর ইয়ত্তা নেই। আমি মাঝে-মাঝে নিজেকে বিশ্বভ্রমণকারী হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসি। কিন্তু প্রীতি আমার চেয়েও অনেক বেশি দেশ ঘুরেছেন। এমন এমন সব ছোটখাট দেশও, যেসব জায়গায় আমার পদার্পণ করার কোনও সম্ভাবনাই নেই। প্রীতি শুধু দেশ দেখেন না, সেসব দেশের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করারও সহজাত ক্ষমতা আছে তাঁর। তার পরিচয় আছে প্রীতির বিভিন্ন কবিতা ও ভ্রমণ রচনায়।

প্রীতি-বিকাশের আমন্ত্রণে আমি প্যারিসের ভারত ভবনের কবিতা পাঠের আসরে অংশ নিয়েছি দুবার। প্রথমবার উপস্থিত ছিলাম শামসুর রাহমান আর আমি। শামসুর রাহমান অন্যান্য দেশ ঘুরে দেখলেও প্যারিসে আগে কখনও আসেননি, স্বভাবতই প্যারিস দেখার খুব শখ ছিল। তাঁকে আনিয়েছিল বাংলাদেশিরা, তিনি এসে উঠেছিলেন আহরামের বাড়িতে। আমরা যেমন পূর্ববঙ্গ থেকে চলে এসে পশ্চিমবঙ্গে বসতি নিয়েছি, আহরামও তেমনি পশ্চিমবাংলায় লেখাপড়া করে তারপর চলে যায় বাংলাদেশ। সুতরাং আমাদের দুজনের বেশ মিল আছে। আহরাম চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। বাংলাদেশের তথ্যচিত্র তৈরি করেছে। আহরাম ও তার স্ত্রী দুজনেই খুব অতিথিবৎসল।

সেবারে প্যারিসে পৌঁছেই শামসুর রাহমান খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিকেলে আহরামের বাড়িতে গিয়ে দেখি, তিনি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। কবিতাপাঠের দিনও সবাই শামসুর-এর স্বাস্থ্যবিষয়ে খুব উদবিগ্ন ছিল। পরে অবশ্য শামসুর অনেকটা সামলে নিয়ে নিরাপদেই ফিরেছিলেন।

এবারে (২০০৫) আমাদের বিদেশযাত্রার আগেই প্রীতি সান্যাল ফোন করে জানিয়েছিল যে প্যারিসে একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছে। তবে শুধু বাংলা কবিতা নয়, ফরাসি কবিও থাকবেন দুজন। তাঁদের কবিতা অনুবাদ করা হবে বাংলায়। আর বাংলা কবিতা ফরাসিতে।

আমি আগে কখনও অস্ট্রিয়া যাইনি। স্বাতী বলেছিল, একবার অন্তত ভিয়েনা শহর না দেখলে এবং সেখানে গিয়ে কনসার্ট না শুনলে ওর জীবনটাই বৃথা। সুতরাং শিকাগো ও ভ্যাঙ্কুবারে দুটি আমন্ত্রণ রক্ষা করার আগে প্যারিসে নেমে ভিয়েনা যেতেই হবে। প্যারিসে আর কোনও সঙ্গী পাওয়া গেল না। সুতরাং আমরা দুজনেই উড়ে চলে গেলাম। ভিয়েনায় গিয়ে স্বাতীর অনেকটাই আশা মিটল, বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহের বাড়িতে একটি দিন কাটিয়ে যাওয়া অতিরিক্ত পাওনা।

ফেরার পরের দিনই প্যারিসে ভারত ভবনে সেই কবিতা পাঠের আসর। বিকাশের ব্যবস্থাপনা নিখুঁত। আর প্রীতি খানিকটা ছটফটে স্বভাবের হলেও তাকে খাটতে হয়েছে অনেক। নির্বাচিত শ্রোতাদের ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানানো থেকে শুরু করে ফরাসি কবিতার বাংলা অনুবাদ প্রস্তুত রাখা পর্যন্ত। মঞ্চসজ্জা ও জলখাবারের ব্যবস্থা এবং আসরের শেষ কবি ও ঘনিষ্ঠজনদের পানাহারের বন্দোবস্ত নিজেদের কোয়ার্টারে। এইসব কাজে প্রীতিকে সহায়তা করেছে দুই তরুণ-তরুণী। ছেলেটির নাম ধৃতব্রত ভট্টাচার্য। তার ডাকনাম তাতো। সে নামেই সে বেশি পরিচিত। সে এখনও পড়াশোনা করছে, ফরাসি ও ইংরেজি সাহিত্য তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও তার প্রবল উৎসাহ। মেয়েটির নাম সুমনা সিনহা, তাকে কলকাতাতেই আগে আলিয়ঁস ফ্রাসেজের ছাত্রী হিসাবে দেখেছি। বাচ্চা বয়স থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ফরাসি দেশে যাবেই যাবে। সেই তীব্র আকাক্ষার সঙ্গে যোগ্যতা অর্জন করে সে পৌঁছে গেছে প্যারিসে। শুধু তাই নয়, এখন সে ফরাসি ভাষার অন্যতম প্রধান কবি লিওনেল রে-র স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান প্রায় চল্লিশ বছর, তা একটুও বিসদৃশ মনে হয় না।

এই কবিতা পাঠের আসরে কবি মাত্র চারজন। আমাদের কলকাতায় কিংবা বাংলাদেশে যেমন এক সন্ধ্যায় তিরিশ-চল্লিশ জন কবির কবিতা পাঠের ব্যবস্থা থাকে, অন্য কোনও দেশে সে প্রথা নেই। একসঙ্গে অতজন কবির নানা ধরনের কবিতা শুনলে অনেক কিছুই মর্ম স্পর্শ করে না। অন্যান্য দেশে এক আসরে বড়োজোর পাঁচ-ছ’জনের কবিতা পাঠ হয়।

এখানে চারজনের মধ্যে দুজন ফরাসি। লিওনেল রে এবং জিনো বিয়ানু। দ্বিতীয়জনও সুখ্যাত। আর বাংলা কবিতার হয়ে পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং আমি। বিপ্লবী বাঘাযতীনের নাতি পৃথ্বীন্দ্র বহুকাল ফ্রান্সবাসী, প্রচুর বাংলা কবিতার অনুবাদ ও সংকলন প্রকাশ করেছেন, নিজেও দু’ভাষাতে কবিতা রচনা করেন।

শ্রোতারা সুনির্বাচিত। শিক্ষিত-সংস্কৃতিমনা এইসব মানুষ শুধু কবিতা শুনতেই এসেছেন। তাঁদের মধ্যে কিছ ফরাসিও আছেন। এইরকম সংবেদনশীল শ্রোতাদের সামনে কবিতা পাঠ করার সময় গলার আওয়াজটা ভালো হয়। অনুষ্ঠানের শেষে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী আমার সঙ্গে আলাপ করতে এল, তারা সবাই বাংলাদেশি, কবিতার টানে এসেছে অনেক দূরদূরান্ত থেকে।

একবার বাংলা কবিতা, তারপর তার ফরাসি অনুবাদ, আর ফরাসি কবিতার পর বাংলা অনুবাদ পাঠ করা হল বেশ সুষ্ঠুভাবে। অনুবাদগুলি পাঠ করলেন প্রীতি সান্যাল, ধৃতব্রত, সুমনা এবং আরও দু-একজন। আমার পক্ষে খুব শ্লাঘার বিষয় এই যে জিনো বিয়ানু (Zeno Bianu) তাঁর নিজের কবিতার পর আমার একটি কবিতার ফরাসি অনুবাদও পড়ে শোনালেন। কোনও একজন সুপ্রতিষ্ঠিত কবি কি অন্য কারুর কবিতা পাঠ করতে চান? এই মানুষটি অতি ভদ্র। আর পৃথীন্দ্রও আমার একটি নারী-বিষয়ক কবিতা অনুবাদ করেছেন। সেটা তিনি নিজেই পাঠ করলেন। আর কোনও কারণে নয়, ওই চারজনের মধ্যে আমিই একমাত্র বহিরাগত বলে বোধহয় খাতির পেলাম একটু বেশি। তাই অনুষ্ঠানের শেষ দিকে কয়েকজনের অনুরোধে আমাকে কয়েকটা বেশি বাংলা কবিতা পড়তে হল।

লিওনেল রে (Lionel Ray) ‘কুর পুরস্কার ও আরও বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রবীণ কবি, তিনি গত বইমেলায় কলকাতাতেও এসেছিলেন আমন্ত্রিত হয়ে। তাঁর একটি কবিতার সামান্য নিদর্শন সুমনার অনুবাদে :

এই আমি আমি নই
নামগোত্রহীন রাতে এই মুখোস
এই স্বর যা বেড়ে ওঠে নদীর মতো
এই পা ফেলাও আমার নয়।
ন্যুন পাথর বাতাসের এই
দেশে আমরা একা
কথোপকথনের এই বিশাল ভস্মস্তূপে
এই ঘূর্ণি আয়নায়।
তুমি কে তুমি যে-ই হও
আমার রাস্তা জুড়ে এই মৃতদেহ
রক্ত আর ছায়ায় কী এই জিনিস
যা স্পন্দ্যমান যা স্থির,
তুমি বেঁচে আছ তোমার থেকে দূরে
কী এই মুখাবয়ব, অনুপস্থিত
এই অপরিচিত যাকে তুমি বয়ে চলো
আর যে দাঁড় টানে প্রতিকূল স্রোতে…

জিনো বিয়ানু বয়েসে অপেক্ষাকৃত তরুণ। লিওনেল রে যেমন এ একেবারেই ইংরেজি বলতে পারেন না। আগের প্রজন্মের ফরাসিরা ইংরেজি জানলেও ইচ্ছে করে বলতে চাইতেন না, তেমন হতে পারে, সেই তুলনায় জিনো বিয়ানু ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ। তাঁর একটি অংশ, প্রীতি ও ধৃতের যুগ্ম অনুবাদে :

হ্যাঁ
সে বলেছিল
হয়তো হতাশা নেই
অথবা
মৃত্যু শুধু অনুপ্রভা
শূন্য স্থান
অন্য নিঃশ্বাসে

বলছিল
ক্ষিপ্র গতিতে ছোটো
পৃথিবীর ভস্মতলে
মুহূর্তের আলপথ ধরে
যেখানে শব্দ উৎসারিত

পালাও
এক অনুপলে
কেন্দ্র পরিধিতে
আরও বলেছিল
সবই ঝুলন্ত
জন্ম আর পতনের মধ্যে
নৈঃশব্দ্য আঁকো
জাদুমন্ত্রের কুঠুরিতে
খোঁজো
খুঁজে ফেরো
কেন না ঈশ্বর
আর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন না…

অনেক দেশের বড়-বড় কাব্যসভার তুলনায় প্যারিসের এই কবিতা পাঠের আসর অনেক বেশি আন্তরিক ও স্মরণীয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *