বড়দিন এবং নববর্ষের সপ্তাহান্ত মিলিয়ে আমেরিকায় পথদুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৪০০। পথদুর্ঘটনা বলতে মোটর গাড়ির দুর্ঘটনাই বোঝায়–রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মরে না কেউ ওদেশে, কারণ শহরের বাইরের রাস্তা দিয়ে পায়ে হাঁটেই না কেউ। যে ১৪০০ জন লোক মরেছে, হিসেব করলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ১৬ থেকে ৪৫ বছরের নারী পুরুষের সংখ্যাই বেশি। বুড়ো বুড়িরা মরে না। তারা ঠিকঠাক সিটবেল্ট বেঁধে সাবধানে গাড়ি চালায়। সুতরাং প্রায় দেড় হাজার যুবক-যুবতী উৎসবের আনন্দ করতে-করতে মারা গেল। আমেরিকা হয়তো সকলের আগেই একদিন ক্যানসার রোগের ওষুধ আবিষ্কার করবে, কিন্তু মোটর-দুর্ঘটনা রোগের কোনও ওষুধ কোনদিন আবিষ্কার করতে পারবে না বোধ হয়। কারণ এই রোগের মূল ওই জাতির মর্মে। আমেরিকার এই বিশাল উন্নতিরও যা কারণ, মোটর-দুর্ঘটনার সেই একই কারণ।
সাধারণত আমেরিকানরা ভালো মোটর চালক হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা বেশ কঠিন। মোটর গাড়ির কলকজা সম্বন্ধে যথেষ্ট জানতে হয় ও লিখিত পরীক্ষা আছে। এ ছাড়া আস্তে গাড়ি চালানোর পরীক্ষা। ও দেশের বহু রাস্তাতেই ৭০ মাইল গতি বাঁধা–কিন্তু শহরের জনাকীর্ণ রাস্তায় ১৫ মাইলের বেশি গতি নিলে ফাইন হয়। সুতরাং আস্তে চালানো একটি পরীক্ষা। বহু বুদ্ধিমান ব্যক্তিকেও দেখছি ড্রাইভিং লাইসেনসের পরীক্ষায় বার দুয়েক ফেল করতে।
এবং ট্রাফিক আলোর প্রতি আমেরিকানদের আনুগত্য অতি দর্শনীয়। রাত্তির দুটো, চকচকে রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা–দূরে, কাছে কোথাও কোনও পুলিশ নেই, ট্রাফিকের আলো জ্বলছে। ক্লান্ত মোটর চালক হয়তো সারাদিন ড্রাইভ করে আসছে, কিন্তু সেই নির্জন মধ্যরাত্রেও লাল আলোর সামনে দাঁড়াবে। এরকম আমি বহুবার দেখেছি।
যেখানে যাওয়া-আসার অনেকগুলো আলাদা লেন-সেখানে তো দুর্ঘটনার সম্ভাবনা না থাকার কথা। এ ছাড়া অন্য সব রাস্তায় আগাগোড়া মাঝখানে হলদে দাগ কাটা–দুদিক আলাদা করে বোঝানোর জন্য। কোথাও রাস্তায় খানা-খন্দ নেই, বৃষ্টির জল জমে নেই। যখন শহরের রাস্তা তিন চার ফুট বরফে ঢেকে গেছে–তখনও প্রত্যেকটি হাইওয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার। প্রতি আধঘণ্টা অন্তর বরফ পরিষ্কার করে দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেক বাঁকে সাবধান বাণী। দেখলে মনে হয় দুর্ঘটনার কোনও কারণ নেই।
তবু দুর্ঘটনা এত হয় কেন? অনেকের ধারণা, মদ খেয়ে গাড়ি চালাবার জন্য। কিন্তু মাতাল দুর্ঘটনাকারীর সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে নগণ্য। মাতালরা যেমন কদাচিৎ গাড়ি চাপা পড়ে, তেমনি কদাচিৎ দুর্ঘটনা করে। একটা সাময়িক সতর্কতা প্রত্যেক মাতালকে ভর করে শুনেছি। সঙ্গিনীকে নিয়ে বিহ্বল অবস্থায় দুর্ঘটনা খুব কম। দূর পাল্লার চালকের বরং প্রায়ই ঘুম আসার সম্ভাবনা, সঙ্গিনী থাকলে তা জাগিয়ে রাখতে পারে। ১৬ বছর বয়স না হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না। ছেলে-মেয়েরা ততদিন ছটফট করে। তার আগে লুকিয়ে চুরিয়ে এক আধদিন যে না-চালায় তা না, কিন্তু ১৬ বছর বয়স হলেই লাইসেনস ও গাড়ির চাবি, তখন বান্ধবীকে নিয়ে সন্ধেবেলা হুস করে বেরিয়ে যাওয়া।
সব দেশেরই বড় বড় রাস্তায় আধিপত্য করে ট্রাকগুলো। বিশাল বিশাল দৈত্যের মতো ট্রাক ঝাঁঝাঁ আওয়াজে ছোটে। কিন্তু অমন ভারী ভারী ট্রাকের গতি কখনও ঘণ্টায় ৭০৮০ মাইল হতে পারেন। একটু আস্তে যায়, তার পিছনে কোনও মোটরগাড়ি পড়লে এক বিরক্তিকর অবস্থা। তাকেও পিছনে-পিছনে আসতে হয়। চলতি কথাই আছে স্ট্রাক বাহাইনড আ ট্রাক। অর্থাৎ যে-লোক জীবনে দমে গেছে, এগিয়ে যেতে পারছে না, সে-ই ট্রাক বাহাইন্ড আ ট্রাক। জীবন মানে এগিয়ে যাওয়া, অপরকে অতিক্রম করা, ক্রমশ গতি বাড়ানো। জোরে যাও, আরো জোরে, নীতি-আইন সব ঠিক থাক। কিন্তু যেতে হবে আরও জোরে, পাল্লা দিয়ে আর সবাইকে ছাড়িয়ে, জোরে জোরে, আরও জোরে। সামনের লোককে হারিয়ে দিয়ে, অতিক্রম না করে গেলে আর জীবনের কী মানে? আর ওইরকম অতিক্রম করতে গিয়েই কোনও কোনও সময়ে মৃত্যু দেওয়ালের মতো এসে দাঁড়ায়। মৃত্যুকেও পাশ কাটাবার চেষ্টা সফল হয় না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনায় তিনটে গাড়ি জড়িয়ে পড়ে। ট্রাকগুলোকে পাশ কাটাবার প্রথম প্রয়াস থেকেই আসে সামনের অন্য গাড়িকেও অতিক্রম করার নেশা। একটা খুন করা এবং দশটা খুন করা যেমন পাপের হিসেবে সমান, তেমনি একটা গাড়িকে অতিক্রম না করার কোনও মানে হয় না। প্রত্যেকটি আমেরিকানের চরিত্রে আছে প্রতিযোগিতার স্পৃহা, অন্যকে ছাড়িয়ে যাওরার দুর্দমনীয় চেষ্টা–এর ফলেই ওই জাতটার যাবতীয় উন্নতি এবং আকস্মিক মৃত্যুও।
মসৃণ নিখুঁত পথ, নিপুণ চালক–দুর্ঘটনার কোনও কারণই দিগন্তে নেই। কিন্তু সামনের ওই যে গাড়িটা সমান গতিতে ছুটছে-ওইটাই তো সব গন্ডগোলের মূল। হয়তো কয়েকশো মাইল ধরেই ওই গাড়িটা সামনে ছুটছে। সুতরাং প্রথমে দেখতে ইচ্ছে ওই চালক বা চালিকার মুখ। সুতরাং অ্যাকসিল্যারেটারে চাপ। কাছাকাছি। ও গাড়িতে একটা কঠিন মুখ। পিছনের গাড়ি একটু আগে একটা ট্রাককে পাশ কাটিয়ে এসেছে, সুতরাং পাশ কাটাবার নেশা এখনও তার রক্তে। জীবনে সে কত লোককে পাশ কাটিয়েছে। সুতরাং হুস করে আওয়াজ, হলদে দাগ পেরিয়ে ৮০।৯০ মাইল গতিতে পাশ কাটাবার পাল্লা। সে ডিও গতি কমাবে না, এবার পাশাপাশি-কে আগে যাবে, হলদে দাগ পেরুনো গাড়ি আরও জোরে। দিগন্তে ক্ষীণতম বিপদের আভাস ছিল না। কিন্তু সামনের রাস্তাটা ঢালু, পুরো দেখা যায়নি, বিপরীত দিক থেকে আর একটা কালো বিন্দু ৭০ মাইল গতিতে নিরীহভাবে ছুটে আসছিল। ব্রেক করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না সে-সময়ে। একসঙ্গে তিনটে গাড়িতে ধাক্কা লাগল আগুন জ্বলে উঠলো, হতাহতের সংখ্যা কম পক্ষে পাঁচজন।
গত উৎসবে ১৪০০ মৃত্যুর অধিকাংশই এই রকম। একজনকে পাশ কাটাতে গিয়ে সামনে থেকে মৃত্যু।
আমি এরকম একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। বলা বাহুল্য, সেবার আমি মরিনি। এ রচনা ভূতের লেখা নয়।