একটা বড় রকমের পরিবর্তনের দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে নেওয়ার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গরবাচেভ বিশ্রাম নিতে গিয়েছিলেন তাঁর বাগানবাড়িতে। কৃষ্ণ সাগরের নিকটবর্তী ক্রিমিয়ার এই ডাচা-তে তাঁর পরিবারের সকলেই উপস্থিত। দু দিন বাদেই মস্কোতে ফিরে কাজাকাস্তানের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর নতুন এক চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলিকে অনেকখানি স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিয়ে দেওয়া হবে। রবিবার, ১৮ অগাস্ট, ১৯৯১, বিকেলবেলা গরবাচেভ বসে বসে সেই চুক্তি সম্পাদনের সময় কী বক্তৃতা দেবেন তার খসড়া তৈরি করছেন। কাছাকাছি আর একটি ছুটি ভবনে রয়েছেন জর্জি শাখলাঝারভ নামে একজন পরামর্শদাতা ও বন্ধু, গরবাচেভ তাঁকে টেলিফোন করে গল্প করলেন কিছুক্ষণ। মনোরম পরিবেশে এক শান্ত অপরাহ্ন। কোথাও কোনওরকম অস্বাভাবিকতার ছায়া নেই।
ঘণ্টাখানেক বাদে সেই বাড়ির বাইরে শোনা গেল গাড়ি থামার শব্দ, জুতোর আওয়াজ করে একদল লোক ঢুকে এল ভেতরে। গরবাচেভ-এর নিরাপত্তারক্ষীদের প্রধান হন্তদন্ত হয়ে প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে এসে জানাল যে কয়েকটি ব্যক্তি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চায়। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এমনভাবে যখন তখন দেখা করা যায় না, নিরাপত্তা রক্ষীরা থাকতেও তারা ভেতরে ঢুকল কী করে? ওরা কারা? রক্ষীদের প্রধান জানালো যে ওই দলটিতে রয়েছে ইউরি প্লেখানভ, সমস্ত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষীদের সে প্রধান, তাকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। হঠাৎ সাংঘাতিক কিছু না ঘটলে এরকম বেয়াদপি দেখানো অসম্ভব, তাই প্রকৃত ব্যাপার জানবার জন্য গরবাচেভ মস্কোতে টেলিফোন করতে গেলেন। প্রথম ফোনটি বিকল। বাড়িতে মোট পাঁচটি টেলিফোন, একে একে তুলে দেখা গেল, সব ক’টিই নিঃশব্দ। অর্থাৎ লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে।
বাইরের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার একটাই অর্থ হয়। তিনি আর প্রেসিডেন্ট নেই। এক সময় প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভের হাত থেকে টেলিফোন কেড়ে নেওয়ার ঘটনা সকলেরই জানা। গরবাচেভ অন্দর মহলে গিয়ে স্ত্রী ও মেয়েজামাইদের ডেকে বললেন, তোমরা মন শক্ত করো, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এরা আমাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করবে কিংবা অজানা কোনও জায়গায় সরিয়ে ফেলবে।
এরপর তিনি এলেন অফিস ঘরে। অনাহূত অতিথিরা সেখানে আগেই চেয়ার দখল করে বসে আছে। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্টের নিজস্ব বাহিনীর প্রধান ভালেরি বলডিন, এবং আরও কয়েকজন সরকার ও পার্টির হোমরা-চোমরা। এরা অনেকেই গরবাচেভ-এর বিশ্বস্ত বলে পরিচিত ছিল। ভালেরি বলডিনকে গরবাচেভ নিজে বেছে নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়েছেন। এই আগন্তুক দলটি দাবি জানালো যে, গরবাচেভকে জরুরি অবস্থা ঘোষণাপত্রে সই করতে হবে এবং উপরাষ্ট্রপতি গেন্নাদি ইয়ানাইয়েভ-এর হাতে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে।
গরবাচেভ বললেন, তোমরা পোল্লায় যাও!
এরপর বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনও একজনের একটা রিভলবার যার করে রাষ্ট্রপতির বুকে পরপর ছ’টা গুলি দেগে দেওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিংবা তাঁর চোখ-মুখ বেঁধে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া উচিত ছিল কোনও গুপ্ত স্থানে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কে জি বি-র একটি বাহিনী ঘিরে রইল সেই বাড়ি, নিকটবর্তী বিমানবন্দরটির রানওয়ে খুঁড়ে দেওয়া হল, যাতে গরবাচেভ কোনওক্রমে প্লেনে না পালাতে পারেন।
পরদিন সকালে সোভিয়েত দেশের প্রধান সংবাদ সংস্থা তাস জানাল যে প্রেসিডেন্ট গরবাচেভ অসুস্থ, তাই তিনি তাঁর সমস্ত ক্ষমতা ইয়ানাইয়েভ-এর ওপর হস্তান্তর করেছেন এবং আট সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটির নেতৃত্বে সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সমস্ত মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ। গরবাচেভ-এর অসুস্থতার কথা কেউ বিশ্বাস করল না, অনেকেই ধরে নিল, গরবাচেভ এর মধ্যেই নিকেশ হয়ে গেছেন। মস্কোর রাস্তায় তখন শোনা যাচ্ছে ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ। রেড স্কোয়ার-এর সেই বেসিলস ক্যাথিড্রাল-এর পাশে, বলশয় থিয়েটারের সামনে স্থাপিত হয়েছে রায়ট পুলিশ ভরতি বহু ট্রাক। স্পষ্টই এক অভ্যুত্থান। গরবাচেভ গেছেন, এবার ইয়েলেৎসিনের পালা। হয় হত্যা, অথবা নির্বাসন। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটবার আগেই ইয়েলেৎসিন বাড়ি ছেড়ে দ্রুত চলে এলেন রুশ পার্লামেন্ট ভবনে। সেখানে ততক্ষণে তার কিছু সমর্থকও জমায়েত হয়েছে। এ এমনই এক অভ্যুত্থান যে, যারা এর পক্ষে এবং যারা এক বিপক্ষে, দু-দলেরই বিমূঢ় অবস্থা। যারা পক্ষে তারা ভাবছে যে কোনওরকম বাধা না পেয়েও অভ্যুত্থানের নায়করা সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব নিতে পারছে না কেন? যারা বিপক্ষে, তারা ভাবছে, এ ধরনের অভ্যুত্থানের পর যেসব
সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটবার কথা, তা কেন ঘটছে না? যারা সংবিধান ও আইনসঙ্গত উপায় বর্জন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে, তাদের খানিকটা বিবেকহীন নিষ্ঠুরতা দেখাতেই হয়। কিন্তু ইয়েনাইয়েভ ও তার সহচররা এখনও এত দুর্বলতা দেখাচ্ছে কেন? সোভিয়েত ইউনিয়ানের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র রাশিয়া, তার প্রেসিডেন্ট ইয়েলেৎসিন এককালের কমিউনিস্ট নেতা হয়েও এখন ঘোর কমিউনিস্ট বিরোধী, সেই লোকটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দর্পিত, বিলাসী, স্পষ্টত পশ্চিম-ঘেঁষা। কিন্তু ইয়েলেৎসিন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, বিপুল জনসমর্থন পেয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, রুশ প্রজাতন্ত্রের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁর হাতে। একে না সরিয়ে ফেললে কোনও অভ্যুত্থান সার্থক হতে পারে না।
মস্কোভা নদীর তীরে ট্যাংক বাহিনী এসে উপস্থিত, কিন্তু ইয়েলেৎসিনের ওপর কোনও আঘাত হানার চেষ্টা হল না। ইয়েলেৎসিন নিজেও যেন এটা বিশ্বাস করতে পারেননি। সকাল সাতটার মধ্যে তিনি রাশিয়ান পার্লামেন্ট ভবনে পৌঁছে গিয়েছিলেন কিন্তু কীভাবে পাল্টা আক্রমণ করবেন, তা বুঝে উঠতে পারেননি দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। ইয়েলেৎসিন-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, পালাবদল ঘটছে সোভিয়েত নেতৃত্বে, কিন্তু রুশ প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে, রাশিয়ান ভূমিতে অধিষ্ঠিত সেনা বাহিনী ও কে জি বি-র আইনসঙ্গত সর্বাধিনায়ক তিনি, এই অধিকারের কথা ঘোষণা করলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত হবে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে ইয়েলেৎসিন দ্বিধা ও সংশয়ের মধ্যে ছিলেন। রুশ বাহিনী ও সোভিয়েত বাহিনীর মধ্যে ভাগাভাগির প্রশ্ন এনে ফেললে যে-কোনও মুহূর্তে গৃহযুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা। যুগোশ্লাভিয়ায় যেমন ঘটছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে এই গৃহযুদ্ধ অনেক বেশি রক্তাক্ত হবে।
শেষ পর্যন্ত মনঃস্থির করে, সোমবার দুপুর সাড়ে বারোটার সময় ইয়েলেৎসিন বেরিয়ে এলেন রুশ পার্লামেন্ট ভবন থেকে। একটা সাঁজোয়া গাড়ির ওপর উঠে দাঁড়িয়ে ইয়েলেৎসিন ঘোষণা করলেন যে এই অভ্যুত্থান অবৈধ। ইয়েনাইয়েভ-এর রাষ্ট্রপতিত্বে কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। রুশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জরুরি অবস্থা জারির নির্দেশ মানছেন না। প্রতিবাদ হিসেবে তিনি দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিচ্ছেন।
ইয়েলেৎসিনের সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাতটি দশকের ইতিহাস রূপান্তরিত হয়ে গেল।
এইসব ঘটনার বিবরণ আমরা সংবাদপত্রে পাঠ করেছি, দূরদর্শনে জ্যান্ত দেখেছি। তবু আমি সুবোধ রায়ের মুখে আবার শুনছিলাম। হোটেল ইউক্রানিয়ার পাশেই মস্কোভা নদী। তার ওপাশেই রুশ পার্লামেন্ট ভবন, সাদা রঙের ওই প্রাসাদটির ডাক নাম হোয়াইট হাউজ। ওই বাড়িটির সিঁড়ি, নদীর ওপরে ব্রিজ, তার নীচের এবং পাশের রাস্তা, এই এলাকাটুকুই এখানকার পানিপথ। হোটেলের জানলা দিয়েই সব দেখা যায়।
ইয়েলেৎসিন যখন তাঁর প্রথম বক্তৃতাটি দেন, তখন সুবোধ সেখানে যায়নি। মস্কোর অগণ্য নাগরিকরাও সেখানে গিয়ে ভিড় জমায়নি। ইয়েলিৎসিন প্রথম থেকেই যে বিরাট জনসমর্থন পেয়েছিলেন, তা ঠিক নয়। সোভিয়েত দেশের মানুষ অনেককাল ধরেই সরকারের সবরকম ডিক্রি মানতে অভ্যস্ত, কে জি বি-র ভয় পদে পদে। ইদানীং গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রাইকার খানিকটা খোলামেলা হাওয়া বইলেও তা দিয়ে কামান-বন্দুকের গোলাগুলি যে আটকানো যাবে, সে ভরসা কোথায়! অভ্যুত্থান ঘটিয়ে যারা সরকারি ক্ষমতা নিয়েছে, কামান-বন্দুক সবই তো তাদের দখলে।
সেইজন্যই ইয়েলেৎসিনের প্রথম বক্তৃতার সময় সেখানে সর্ব সাকুল্যে দুশোর বেশি শ্রোতা ছিল না। কয়েকটা গোলা ছুঁড়েই ভয় দেখিয়ে এই জনতা ছত্রভঙ্গ করা যেতে পারত, ইয়েলেৎসিনকে বন্দি করা সহজ ছিল। কিন্তু কেন অভ্যুত্থানের নেতারা দ্বিধা করতে লাগলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। দেশের অভ্যন্তরে কোনও বড় রকম প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি, নিদেশেও কোনও তীব্র প্রতিক্রিয়া ছিল না। ব্রিটেন, আমেরিকা সমেত পশ্চিমি দেশগুলি দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় কিছু মন্তব্য করলেও সরাসরি বিরুদ্ধাচরণের কোনও হুমকি আসেনি। অভ্যুত্থান, রাষ্ট্রপতি বদল এ সব প্রত্যেক দেশেরই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, তাতে অন্য দেশের মাথা গলানোর নজির নেই। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনও রাষ্ট্রনায়ককে খুন করে কোনও সামরিক শাসক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও কিছুদিনের মধ্যেই সে দেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়। পরে জানা গেছে, পশ্চিমি দেশগুলি ইয়ানাইয়েভ-এর নেতৃত্বকে মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। অভ্যুত্থানকারীরা এসব সুববাগ নিতে পারল না।
সোমবার বিকেল পাঁচটায় অভ্যুত্থানকারীরা ডাকল প্রেস কনফারেন্স। সেখানেও তাদের বক্তব্য অত্যন্ত অস্পষ্ট। তারা জানাল যে, গরবাচেভ অত্যন্ত অসস্থ বলে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নিতে অক্ষম, তাই সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইয়ানাইয়েভ-কে। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্বল হতে দেবে না, সংস্কারের কাজগুলোও চালিয়ে যাবে। তাদের এই ক্ষমতাগ্রহণ সংবিধানসম্মত ইত্যাদি।
দেশের মানুষ এতে কী বুঝবে? রাষ্ট্রপতি গরবাচেভ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে উপরাষ্ট্রপতির কাজ চালিয়ে যাবেন, এ তো স্বাভাবিক। তার জন্য অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে কেন, জরুরি অবস্থাই বা জারি করতে হবে কেন? গরবাচেভকে বাদ দিয়ে যদি নতুন সরকার গড়া হয়, তা হলে ইয়ানাইয়েভের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন হল কখন সুপ্রিম সোভিয়েতে? কী করে এই পালাবদল সংবিধানসম্মত হয়?
ততক্ষণে ইয়েলেৎসিনের প্রতিবাদী ঘোষণার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। রুশ পার্লামেন্ট ভবন ঘিরে অনেক ট্যাংক জমায়েত হয়েছে বটে কিন্তু গুলি গোলার শব্দ নেই। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে লাগল, ক্রমে সহস্র থেকে তা পরিণত হল লক্ষে লক্ষে। একবার ভয় ভেঙে গেলে আর কোনও বাধাকেই বাধা বলে মনে হয় না। যে-কোনও মূল্যে
শপথের গর্জন শোনা গেল, অনেকে ট্যাংকের ওপর উঠে নাচানাচি শুরু করল। এতকালের পরিচিত কাস্তে-হাতুড়ি লাঞ্ছিত রক্ত পতাকার বদলে এসে গেল রুশ প্রজাতন্ত্রের পুরোনো আমলের ত্রিবর্ণ পতাকা।
লেনিনগ্রাডেও একই অবস্থা। সেখানকার নির্বাচিত মেয়র আনাতোলি সোবচাক প্রথম থেকেই অভ্যুত্থানের ক্ষমতা দখলকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সমবেত হল অসংখ্য মানুষ। যে সেনাবাহিনী সিটি কাউন্সিল দখল করতে আসছিল, তারা জনতার প্রতিরোধে লেনিনগ্রাড শহরে ঢুকতেই পারল না। লেনিনগ্রাডের বিখ্যাত উইন্টার প্যালেস, বার সামনে ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে প্রথম বিপ্লব শুরু হয়েছিল, এখন সেখানেই অজস্র মানুষ অস্বীকার করল লেনিনবাদ। ইতিহাসের কী বিচিত্র নিয়তি!
এর মধ্যে বালটিক রাষ্ট্রগুলি তো বটেই, তা ছাড়াও ইউক্রাইন, মালডাভিয়া, বেলোরাশিয়া, উজবেকিস্তান ইত্যাদি অন্যান্য রাষ্ট্রও এই অভ্যুত্থানকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করল, তাদের কোনও নির্দেশই মানতে সম্মত হল না। সাইবেরিয়ার খনি শ্রমিকরা ধর্মঘটের হুমকি দিল।
মস্কোয় যখন জনসাধারণ সমস্ত ভয় ঝেড়ে ফেলে সেনাবাহিনীকেও তুচ্ছ করে দিয়েছে, প্রতিবাদ নিয়েছে এক উৎসবের রূপ, তখন সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে সুবোধ রায়, ইতিহাসের এক বিরাট সন্ধিক্ষণের সে সাক্ষী। তার হোটেলের সামনেই রয়েছে কয়েকটা ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্কগুলি চালিয়ে এনেছে তরুণ সৈনিকেরা। তাদের মুখগুলি উদভ্রান্তের মতন। তাদের একজনকে সুবোধ জিগ্যেস করেছিল, তুমি কি নিজের দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাবে? সে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলেছিল, না। তারপর তাকে জিগ্যেস করা হল, তবে তুমি এখানে এসেছ কেন? সে বলেছিল, তা তো জানি না। আমাকে আসতে বলা হয়েছে…।
চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেলেও সেই ট্যাংক চালকরা কোনও খাবার পায়নি। এমনই অব্যবস্থা যে, রুশ পার্লামেন্ট ঘিরে রাখার জন্য সেনা পাঠানো হল, কিন্তু তারা কী খাবে তা নিয়ে চিন্তা করেনি কেউ। শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদকারী জনতাই তাদের হাতে রুটি তুলে দিয়েছে।
এত বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নে, তথা পৃথিবীতে, বিনা রক্তপাতে। কালিনিস্কি ব্রিজের কাছে যে তিনজন মানুষ নিহত হল, তা নিছক দুর্ঘটনা। তারা ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ ট্যাংকের মুখ ঘোরাতেই তাদের আঘাত লাগে।
পৌনে তিনদিনের এই অভ্যুত্থান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল কেন? এ রকম একটা দুর্বল, অপটু অভ্যুত্থানেরও কারণ বোঝা যায় না। ক্ষমতা যারা দখল করতে চায়, তারা দখলের প্রক্রিয়াগুলো পালন করবে না! ভয় ও সন্ত্রাস সৃষ্টিই তো প্রধান অস্ত্র। কিছু রক্তস্রোত গড়াবেই, সোভিয়েত ইউনিয়নে মানুষ মারা তো নতুন কথা নয়! যারা দেশটাকে আবার স্তালিন জমানায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল, তারা ভয় পেয়েছিল জনসাধারণ নামে এক বস্তুপিণ্ডকে? কিংবা সেনাবাহিনী তাদের বশ্যতা স্বীকার করবে কিনা, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিল না? বিমানবাহিত বাহিনী তুলস্কায়া এবং ট্যাংকবাহিনীর কিছু অংশ তো ইয়েলেৎসিনের দিকেই চলে গিয়েছিল। সৈন্যবাহিনীকে গুলি চালাতে বললে তারা অস্বীকার করত? চিনে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে দু বছর আগের ছাত্র বিপ্লবের সময় বেশ কয়েক ঘণ্টা চিনা শাসকদের ভাগ্য অনিশ্চিত ছিল। সেনাবাহিনী নিজেদের পুত্র ও ভাইয়ের মতন ছাত্রদের হত্যা করতে রাজি হবে কি না। সেবার ট্যাংকের কামানের নলগুলি মুখ ঘোরালেই চিন সরকারের পতন ঘটত। শেষ পর্যন্ত সৈন্যবাহিনী অবাধ্য হয়নি, তারা কর্তব্যের খাতিরে তিন হাজার ছাত্রকে গুলি করে ও ট্যাংকের তলায় পিষে মেরেছে। কিন্তু প্রাচ্য দেশগুলিতে প্রাণ দেওয়া ও নেওয়া এখনও যত সহজ, ইউরোপে
আর তেমন পরিবেশ নেই। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জনসাধারণ যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন সেনাবাহিনী তাদের ওপর গুলি চালাতে প্রত্যাখ্যান করেছে। সাধারণ মানুষ কোনও কোনও দেশে ট্যাংকের কামানোর ডগায় পরিয়ে দিয়েছে ফুলের মালা।
সোভিয়েত সৈন্যরাও তাদের স্বদেশবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করতে এখনও রাজি কি না, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।
এত সহজে অভ্যুত্থানের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেল বলে অনেকের সন্দেহ জেগেছে যে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো নয় তো? স্বয়ং গরবাচেভই কলকাঠি নেড়েছেন পেছন থেকে? এই সন্দেহের কথা অনেকে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন, আমি গিয়েও শুনেছি। ক্রিমিয়ার বিশ্রাম-ভবনে সত্যি কী ঘটেছিল, তা সকলে জেনেছে গরবাচেভের মুখ থেকেই। কেন তাঁকে বন্দি করা হল না? তা হলে কি তিনি নিজেই এই নকল অভ্যুত্থানের উস্কানি দিয়ে আবার তার পতন ঘটালেন। এতে সুকৌশলে পার্জিং হল, জনসাধারণের প্রকৃত মনোভাবও জেনে নেওয়া হল। পুরোটাই যেন একটা নাটক, এর শেষে নায়ক হিসেবে ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করে নিলেন গরবাচেভ।
এই সন্দেহও সত্যি না মিথ্যে, তা জানতে হয়তো আরও ঢের দিন লেগে যাবে। আমরা অনেকেই নাটক পছন্দ করি, কিন্তু এই নাটকটিও তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। গরবাচেভ একা সবাইকে বোকা বানালেন, তিনি এত বুদ্ধিমান আর বাকিরা সবাই নির্বোধ? অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীরা পরে দু-একজন আত্মহত্যা করেছে, বাকিরা ধরা পড়েছে। তারা গরবাচেভ-এর চক্রান্ত কেন ফাঁস করে দিচ্ছে না? এদেশে সংবাদপত্র এখন স্বাধীন, তারা খুঁজে বার করতে পারছে না প্রমাণ? তা ছাড়া, নাটকের শেষে ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হল এবং ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেল ইয়েলেৎসিনের, গরবাচেভের তো নয়! তিনি যেন অনেকটাই করুণার পাত্র।
ষড়যন্ত্রকারীরা যে স্বার্থান্বেষী ও দুর্বল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে এদের অনেকেরই চাকরি যাবে কিংবা পদমর্যাদা অকিঞ্চিৎকর হয়ে যাবে, এই আশঙ্কাতেই তারা যে-কোনও উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। সে যোগ্যতা তাদের আছে কি না বুঝে দেখেনি। গরবাচেভ-ইয়েলেৎসিনকে বন্দি করার বদলে তারা নিজেরাই বিপনের ভয়ে কাঁপছিল। সবাই দেখেছে যে প্রেস কনফারেন্সের সময় ইয়ানাইয়েভের মুখ ছিল পাণ্ডুর বর্ণ এবং হাত কাঁপছিল সত্যিই। পরে গরবাচেভ বলেছেন, ওরা প্রচার করেছিল যে, আমি অসুস্থ, কিন্তু আসলে অসুস্থ ছিল তো ওয়াই।
এই এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ফলে সত্যিই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। নিষিদ্ধ হল কমিউনিস্ট পার্টি। বিশ্বের প্রথম ও সর্ববৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দেশে সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা অসফল বলে গণ্য হল। ফাঁস হয়ে গেল যে দেশের মানুষকে না খাইয়ে রাখা এবং নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে সমাজতন্ত্রের নামে।
সোভিয়েত পার্লামেন্টের সাদা ধপধপে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমি বেশ বিষণ্ণ বোধ করলাম। মাত্র কিছুদিন আগে এখানে এক বিপ্লব ঘটে গেছে, এখন তার কোনও চিহ্নমাত্র নেই। কোনও পাহারা নেই, কোথাও মিলিটারি বা পুলিশ চোখে পড়ে না, অনেকে ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে, আমরাও যদৃচ্ছ ঘুরছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় একজন ভারতীয় হিসেবে আমার খুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই। এ দেশের অভ্যন্তরে কতরকম অনাচার ঘটেছে তা আমাদের অজানা ছিল বটে, কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই ভারতবন্ধ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ান যে কোনো সঙ্কটের সময় ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর প্রশ্নে আমরা সব সময় সোভিয়েত দেশের সমর্থন পেয়েছি। আমি আগের যার এসে যখন এ দেশে ঘুরেছি, তখন সর্বত্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছি। রাস্তার লোক এসে ভারতীয় বলে চিনতে পেরে খাতির করেছে, এমনটি আর কোনও দেশে ঘটে না। সেই দেশের রূপ বদলে গেল, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেল? ভারত কি এর হারাবে তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধুকে!
আর একটি প্রশ্নও অনবরত ঘুরতে থাকে মাথার মধ্যে। এত সহজে কী করে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল এ দেশে? সি পি এস ইউ, দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি, দারুণ তার প্রতিপত্তি, একটি মাত্র নিষেধাজ্ঞায় সেই পার্টি একেবারে স্তব্ধ? কোনও প্রতিবাদ হল না? এখানকার মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, মিছিল-সমাবেশে কোনও যারণ নেই। কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে হাজার হাজার ক্যাডাররা রাস্তায় নেমে এল না কেন? এই পার্টির ক্যাডাররা সব দেশেই লড়াকু হয়, তারা ভয় পাবে কেন, বিশেষত যখন লাঠি-গুলির আশঙ্কাও নেই? কমিউনিস্ট পার্টির ওপর মহলের নেতারা না হয় অভ্যুত্থান সমর্থন করার লজ্জায় কিংবা নিজেদের নানারকম দুষ্কর্ম গোপন করার জন্য আড়ালে রয়ে গেছে, কিন্তু ক্যাডারা কেন পার্টির সমর্থনে প্রকাশ্যে দেখা দিল না?
তা হলে কি এত বড় সি পি এস ইউ নিছক একটা মাথা ভারী পার্টি হয়ে গিয়েছিল, যার শুধু এক গুচ্ছ নেতা আছে ক্যাডার নেই?