এক সময় রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা একটা ফ্যাশান ছিল। কল্লোল যুগ থেকে শুরু, চলেছিল পঞ্চাশ দশকের শেষ পর্যন্ত। তিন জোড়া লাথির ঘায়ে, রবীন্দ্র রচনাবলি লুটোয় পাপোষে–এরকম লাইন লিখেছিল পঞ্চাশের দশকের কোনও ছোঁকরা কবি। এই রকম মনোভাবের শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকীর বছরে। প্রচুর ধূমধাড়াক্কা, সভা-সমিতি, অসংখ্য পত্র-পত্রিকা, গান-বাজনা ইত্যাদি হল। উৎসবের শেষে বোঝা গেল রবীন্দ্রনাথ এতদিন পরে পুরোপুরি ছবি হলেন। তাঁর রচনাবলি লোকে সযত্নে আলমারিতে সাজিয়ে রাখবে, আর কেউ পড়বে না। তাঁর নৃত্যনাট্য গীতিনাট্যগুলোও ক্রমে জনপ্রিয়তা হারাতে লাগল। কবিতা তো আগে থেকেই ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। বাকি রইল গান। তাঁর গান কিন্তু আশ্চর্যভাবে জনপ্রিয় হতে লাগল। চল্লিশ পঞ্চাশ দশক পর্যন্তও তার গান ছিল এলিটদের ড্রইংরুমে সীমাবদ্ধ। পঙ্কজ মল্লিকের ক্লান্ত চেষ্টা বা কিছু কিছু বাংলা সিনেমাতে রবীন্দ্রসংগীত প্রয়োগেও এই গান খুব বেশি জনসমাদর পায়নি। কিন্তু শতবার্ষিকীর বছরের পর থেকেই যেন রবীন্দ্রসংগীতই হয়ে উঠল বাঙালির একমাত্র গান এবং এই রবীন্দ্রসংগীত রুচির প্রভাবেই অতুলপ্রসাদের গান ও দ্বিজেন্দ্রগীতিকে টেনে তোলা হল অনেকখানি বিস্তৃতির গহ্বর থেকে। এর প্রধান কারণ অবশ্য আধুনিক বাংলা গানের নিম্নগতি, নামতে-নামতে তা তলিয়ে গেল কদর্যতার পাকে, শচীন দেব বর্মন বা সলিল চৌধুরীর মতন প্রতিভাবানেরা ওই সময়ে পুরোপুরি চলে গেলেন হিন্দি গানের জগতে। আচ্ছা, গানের কথা পরে হবে।
আপামর পাঠকেরা একজনের রচনাকে মাথায় তুলে নিয়ে নাচল কিংবা ডুয়ে রেখে দিয়ে আর ছুঁল না, তা দিয়ে তো আর সাহিত্য বিচার হয় না। এ কথা ঠিক, হঠাৎ কোনও লেখক জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গেলে তার প্রতি অন্য লেখকদের ঈর্ষা, বিরাগ বা অবহেলার ভাব আসে। সমালোচকেরা সে রকম লেখককে লঘু দৃষ্টিতে দেখেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন ওঠে না। সমালোচকেরা এখনও পর্যন্ত তাঁর মহিমায় আচ্ছন্ন। লেখক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এতই বড় যে তাঁকে অন্য লেখক ঈর্ষা করলে সেই লেখক নিজেই ছোট হয়ে যাবেন, যেমন সাময়িকভাবে হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কল্লোল যুগের রবীন্দ্র বিরোধিতা মোটেই ঈর্ষাপ্রসূত নয়। তাঁরা রবীন্দ্রপ্রভাব অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন এবং সেটা ঠিক কাজই করেছিলেন।
যদিও নানা সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে তিরিশের দশকের সেই সব বিদ্রোহী যুবকেরা প্রকাশ্য রবীন্দ্র বিরোধিতা করলেও নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রবীন্দ্রনাথের কবিতা আউড়েছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্র বিরোধিতা ছিল তাদের স্ট্রাটেজি, কিন্তু মনের দিক থেকে তাঁরা অনেকখানিই ছিলেন রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে, পরবর্তীকালে সেই সব যুবকেরা যখন প্রবীণ হলেন তখন তাঁদের মধ্যে থেকে বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ অনেকেই আবার প্রকাশ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি পূজা নিবেদন করেছেন। কবিতায় ও গদ্যে আধুনিকতার যথার্থ প্রতিনিধি যে দু’জন, সেই জীবনানন্দ দাশ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সঠিক মনোভাব ঠিক জানা যায় না। এঁরা দু’জনেই রবীন্দ্র মানসিকতা থেকে অনেকখানি দূরের মানুষ এবং খুব সম্ভবত এঁরা আর পেছন দিকে ফিরে তাকাননি।
পঞ্চাশের দশকে আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, তখনও কিন্তু সাহিত্যের আবহাওয়া রবীন্দ্রনাথের কিরণচ্ছটাতেই অনেকখানি আচ্ছন্ন। পত্র-পত্রিকায় অধিকাংশ প্রবন্ধই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। অধ্যাপকেরা রবীন্দ্রনাথে আপ্লুত। রাজনৈতিক নেতারাও তাঁদের ভাষণে যখন-তখন, অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে, রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দেন। ‘দেশ’, মাসিক বসুমতী’, ‘শনিবারের চিঠি’ প্রভৃতি প্রভাবশালী পত্রিকায় রবীন্দ্র অনুসারী কাঁচা কবিতারই প্রাবল্য, নিছক ছন্দমিল দেওয়া সে সব অদ্ভুত জিনিস। ‘আধুনিক কবিতা’, তখনও, শিক্ষিত মহলেও হাসিঠাট্টার বিষয়। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন অল্পজ্ঞাত কবি, অনেকদিন তাঁর কোনও কবিতার বই ছাপাই হয়নি। মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় ইংরেজি দৈনিকের ছোট খবরে তাঁর নাম ভুল ছাপা হয়েছিল। একটি বাংলা সংবাদপত্রে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছিল শুধু অধ্যাপক হিসেবে, কোনও কোনও সংবাদপত্রে কোনও খবরই ছাপা হয়নি।
আমার কৈশোর কাটে রাবীন্দ্রিক পরিমন্ডলে। তখনকার কবিতা পিপাসু কিশোর ও তরুণেরা পাগলের মতন রবীন্দ্রনাথের কবিতাই পড়ত। নিজে কবিতা রচনা শুরু করার আগে আমি ছিলুম একজন খুদে আবৃত্তিকার। একজন মাস্টার মশাই-এর উৎসাহের আতিশয্যে আমি বিভিন্ন জলসায় নির্মলেন্দু লাহিড়ীর স্টাইলে গলা কাঁপিয়ে-কাঁপিয়ে আবেগে প্রায় চোখে জল এনে ফেলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে হাততালি পেতুম। (এখনকার অনেকেই বোধহয় জানেন না যে এক সময় বাংলা রঙ্গমঞ্চে নির্মলেন্দু লাহিড়ী ছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর চেয়েও জনপ্রিয়। তখনও শম্ভু মিত্র ঠিক মতন আসেননি। নির্মলেন্দু লাহিড়ীর ‘দেবতার গ্রাস’ আবৃত্তির রেকর্ড গ্রামে-গঞ্জেও বাজাতে শোনা যেত)। তখনকার কোনও জলসায় নজরুল-পরবর্তী কোনও কবির কবিতাপাঠ ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। সদ্যমৃত সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ছোট-ঘোট গোষ্ঠীতে পরিচিতি পাচ্ছে মাত্র। রবীন্দ্রনাথের কবিতা যথার্থই ছিল আমার প্রিয়। রাত্রিরবেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আমি উঠে অনেকগুলি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে নিতুম। সেইসব কবিতা ছিল আমার নির্জনতার সঙ্গী, বিশেষ ভালো লাগা কোনও কোনও লাইন অপরকে জানাবার জন্য, আমি বিনা কারণেই একে ওকে তাকে চিঠি লিখতুম তখন, এমনকি রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের গদ্য কবিতাগুলিও অধিকাংশই ছিল আমার মুখস্থ।
অন্য কারুর প্ররোচনায় নয়, কোনও সাহিত্যিক গোষ্ঠীর প্রভাবেও নয়, নিজে থেকেই আস্তে-আস্তে আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে সরে আসি। ক্রমশ, তার কবিতাগুলি পানসে লাগতে থাকে। মনে হয় যেন অতি সরলীকরণ। রহস্যময়তা বড় কম। একটি স্তবকে যা বলা হয়ে গেছে, সেটাকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরও পাঁচটি স্তবকে লেখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গদ্য তখনও আমাকে আকর্ষণ করে। তার অল্পায়াসে লেখা সব পুস্তক সমালোচনা, প্রাচীন-সাহিত্য, লোক-সাহিত্য সম্বন্ধে প্রবন্ধ, ছোটগল্প সবগুলি, কয়েকটি উপন্যাস, কয়েকটি নাটকে যে গদ্যশিল্পীকে পাই, যে পরিশীলিত রুচি, যে বিশাল মানুষটির অন্তঃকরণ ফুটে ওঠে, তাঁর প্রতি বিস্ময়ের অবধি থাকে না।
গত দশ বছরে রবীন্দ্রনাথের কোনও লেখা শখ করে আবার পড়বার ইচ্ছে হয়েছে, এমন তো মনে পড়ে না। দৈবাৎ তাঁর রচনাবলি হাতে এলে চতুরঙ্গ যোগাযোগ বা চার অধ্যায় আবার পড়ে যেতে ভালো লাগে, আবার অনেক লেখা পড়তে-পড়তে বই বন্ধ করে দিতেও ইচ্ছা হয়। একটা বিশেষ কারণে সম্প্রতি তাঁর মুক্তধারা নাটকটি আমায় অনেকবার পড়তে হয়েছে। ফাঁপা গাল-ভরা মহত্বের প্রতি ঝোঁকের দোষে তাঁর এই ধরনের অনেক রচনা দুষ্ট বলে মনে হয়। কিন্তু তাঁর গান এখনও পুরোন হয়নি। শুধু সুরের আনন্দের জন্যই নয়, শুধু বাণীর বৈচিত্র্যের জন্যও নয়, আরও কিছু আছে, একটা কোন জাদু, বার নাম শিল্প, তার জন্যই এই সব গান এখনও আমাদের মন ভরিয়ে রাখে। এই সব গানগুলির কাব্যরসের আবেদন এখনও অক্ষুণ্ণ আছে, হয়ত তার কারণ এগুলি সংক্ষিপ্ত। বহুবার শোনা গানের একটা দুটো লাইন হঠাৎ মনটা আলোকিত করে দেয়। মাঝে মাঝেই তাঁর এইসব গানে আশ্চর্য ভাষা ব্যবহারের সৌন্দর্য নতুন করে খুঁজে পাই। একা-একা তাঁর গান শুনতে-শুনতে অকস্মাৎ চোখে জল এসে যায়। এই অশ্রু মন ভালো করে দেয়। আজও রবীন্দ্রনাথ এতখানি আনন্দের ভান্ডার, এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে থাকি।