‘তুমি ছেড়ে চলে গিয়ে ভালোই করেছ, আর্তুর র্যাঁ বো।
বন্ধু ও শত্রুদের প্রতি সমানভাবে তোমার আঠারো বছরের অবহেলা,
প্যারিসের কবিদের ন্যাকামির প্রতি, আর সেই বন্ধ্যা ঝিঝির একঘেয়ে সুর–
তোমার গ্রাম্য ও পাগলাটে পরিবার…
তুমি বেশ করেছ, ছেড়ে চলে গেছ অলসদের রাস্তা,
লিরিক-প্রস্রাবকারীদের সরাইখানা…’
–রেনে শার
যেহেতু প্যারিসের শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি আবার দেখার তেমন আগ্রহ নেই আমার, তাই এক একদিন দুপুরে স্বাতী ও অন্যরা বেরিয়ে যায়, আমি বাড়িতে শুয়ে থাকি। অসীম রায়ের সংগ্রহের বইগুলি নাড়াচাড়া করি। অসীম রায়ের নেশা ফটোগ্রাফি, নিজে ভালো ছবি তোলে তো বটেই, অনেক ফটোগ্রাফির ম্যাগাজিনও বাড়িতে রাখে। তা ছাড়া বাংলা ও ফরাসি ভাষায় কাব্য উপন্যাস আছে কিছু কিছু, ইংরিজি খুবই কম।
একলা থাকতে আমার ভালোই লাগে। কখনও বাগানে ঘুরি, কখনও টিভি দেখার চেষ্টা করি। সাধারণত টিভি দেখার জন্য মানুষকে কোনও চেষ্টা করতে হয় না, বোতাম টিপে যন্ত্রটা চালু করে দিয়ে সামনে বসে থাকলেই তো হল। কিন্তু অসীম রায়ের বাড়িতে টিভি দেখা অত সহজ নয়। তাঁর টিভির পেছনের পাল্লাটা একেবারে খোলা, ভেতরের হাজার হাজার যন্ত্রপাতি ও সূক্ষ্ম তারের খেলা সব পরিদৃশ্যমান। অর্থাৎ টিভির পেছন দিকটা সম্পূর্ণ দেখা যায় কিন্তু সামনের ছবি তেমন স্পষ্ট হয় না। অসীম রায় কোনও এক সময় টিভিটা সারাবেন বলে ঠিক করেছেন, আপাতত তিনি পেছনের ডালাটা এগিয়ে পিছিয়ে ছবি পরিস্ফুটনের পরীক্ষা করেন। অসীম রায় সেটা পেরে যান, কারণ তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং এ দক্ষতা আছে, আমি আবার এসব যন্ত্রে হাত দিতে ভয় পাই। সুতরাং একলা থাকলে টিভি দেখার সুবিধে হয় না। আমার ইচ্ছে ছিল, টিভি শুনে শুনে ফরাসি ভাষাটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া।
বৃষ্টি না পড়লে বাগানে বেশ ভালোই সময় কাটে। ইওরোপের বাড়িগুলোর এই বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে-পেছনে খানিকটা লন ও বাগান থাকবেই। এদেশে সব ভদ্রলোকই ঘেসুড়ে, সপ্তাহে একদিন বাগানের ঘাস ছাঁটা বাধ্যতামূলক। মালি রাখার প্রশ্নই নেই। কারুর বাগানের ঘাস বেশি বেড়ে গেলে অন্যরা অবজ্ঞার চোখে তাকায়। অসীম রায়কে সাহায্য করার জন্য আমিও দু-একবার লন মোয়ার দিয়ে ঘাস ঘেঁটেছি।
এসব বাড়িগুলিকে বলে সেমি ডিটাচড। অর্থাৎ দূর থেকে একটাই বাড়ি মনে হলেও আসলে মাঝখান থেকে দু-ভাগ করে দুটি বাড়ি হয়েছে। আলাদা বাগান, আলাদা প্রবেশ পথ, আলাদা সব কিছু, তবু বাড়ি দুটো পিঠোপিঠি ভাই-বোনের মতন। এইসব বাড়িতে আর সবরকম সুযোগ-সুবিধে থাকলেও বেশি রাত পর্যন্ত হইহুল্লোড় করা যায় না। তাতে প্রতিবেশীর ঘুমের অসুবিধে হয়।
অসীম রায়ের প্রতিবেশী এক জোড়া বুড়ো-বুড়ি, তাদের সঙ্গে অসীম রায়ের বেশ সৌহার্দ্য আছে। এক বাড়ির মালিক ছুটিতে কোথাও বেড়াতে গেলে অন্যজনকে চাবি দিয়ে যায়, অন্যজন দুটো বাগানের গাছেই জল দেয়, দৈবাৎ জলের কল বা গ্যাস লিক করলে চাবি খুলে মেরামত করে, চিঠিপত্র রেখে দেয়। তা বলে কিন্তু এরকম ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীরাও পরস্পরের বাড়িতে যখন তখন যাওয়া আসা করে না। কেউ কারুর ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি মারে না। ভদ্রতার সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করা পশ্চিমি সভ্যতার অঙ্গ। বাগানের বেড়ার দু’পাশ থেকে একবার সৌজন্য বিনিময় হয়, সেইটুকুই যথেষ্ট।
শহরতলির অধিকাংশ বাড়িই বৃদ্ধ দম্পতিতে ভরতি। ছেলেমেয়েরা কেউ সঙ্গে থাকে। ছেলেমেয়েরা হয়তো বছরে একবার দেখা করতে আসে কিংবা দূর থেকে ক্রিসমাস কার্ড পাঠান। বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতা এদের নিয়তি। আমাদের কাছে এটা নিষ্ঠুর ও করুণ মনে হলেও, এদের বোধহয় সহ্য হয়ে গেছে।
আপেল গাছ এদেশের সব বাগানেই আছে, মনে হয় যেন বিনা যত্নেই এ গাছ বেশ বাড়ে। আমাদের দেশের আম কাঁঠালের মতন। তা ছাড়া অসীমের বাগানে আছে ন্যাসপাতি ও চেরি গাছ, হাত বাড়িয়েই সেগুলির ফল ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাওয়া যায়। অসীম টমাটো আর কুর্জেং নামে এক ধরনের কুমড়ো লাগিয়েছেন। রান্নার সময় বাগান থেকে সেগুলো তুলে আনা হয়। কাঁচা লংকা নেই। ফরাসিরা কাঁচা লংকা খায় না, কিন্তু এখন ফ্রান্সে কিছু কিছু ভিয়েতনামিদের কলোনি হয়েছে, তাদের বাজারে কাঁচা লংকা, চালকুমড়ো, খলসে মাছ সবই পাওয়া যায়।
অনেকের বাগানেই একটি দোলনা থাকে। অতি সামান্য পোশাক পরে মেয়েরা সেই দোলনায় দুলতে-দুলতে রোদ পোহায়। কিংবা বই পড়ে। সৌভাগ্যের বিষয় অসীমের ডির দুপাশে সেরকম কোনও তরুণী থাকে না, তাহলে দুপুরবেলা আমার বাগানে ঘোরা অনুচিত হত। প্রতিবেশী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সঙ্গে চোখাচোখি হলে আমি একবার শুধু বঁ ঝুর বলে অনায়াসে বই পড়তে পারি। নির্মল ফরাসি আকাশের নীচে, চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ, ন্যাসপাতি গাছের ছায়ায় একটা সাদা রঙের চেয়ারে আমি একলা বসে আছি, হাতে বই, এরকম একটা দৃশ্য হিসেবে নিজেকে আমি উপভোগ করি সারা দুপুর ধরে।
অসীমের সংগ্রহের বাংলা বইগুলি আমার অধিকাংশই পড়া। ফরাসি বইগুলির পাতা ওলটাতে গিয়ে দেখি, কিছু কিছু শব্দের মানে বুঝলেও ক্রিয়াপদের ব্যবহার ভুলে গেছি। ইংরিজির সন্ধানে একদিন একটা আটলান্টিক ম্যাগাজিন পেয়ে গেলাম। তাতে রেনে শার বিষয়ে একটা রচনা রয়েছে।
রেনে শার মার্গারিটের প্রিয় কবি ছিলেন। মার্গারিট প্রায়ই ওঁর কথা বলত। শুধু কবি হিসেবেই নয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রেজিটান্স মুভমেন্টের বীর সেনানী হিসেবেও তাঁর দারুণ সম্মান।
এই কবি প্রথম জীবনে যোগ দিয়েছিলেন সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে; তারপর এক সময় সুররিয়ালিস্টরা কেউ কেউ সাম্যবাদের দিকে ঝোঁকে, রেনে শার হলেন জাতীয়তাবাদী। তিনি মনে করতেন, জীবনে ও বেঁচে থাকায় প্রত্যেক কবিই তাঁর দেশ ও সমাজের সঙ্গে জড়িত, দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বও তাঁকে নিতে হবে। কিন্তু কবিতা রচনা, তাঁর ব্যক্তিগত আরাধনার ব্যাপার। অর্থাৎ একজন কবি প্রতিবাদের মিছিলে যোগ দিতে পারে, কিন্তু তা বলে তাঁকে মিছিলের, চ্যাঁচামেচির কবিতা লিখতে হবে, তার কোনও মানে নেই। দেশের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করেছেন শার, কিন্তু উগ্র দেশাত্মবোধের কবিতা লেখেননি।
জাতীয় বীরের সম্মান পেলেও রেনে শার পরবর্তীকালে সরকার গঠনে অংশ নেননি, মন্ত্রী-টন্ত্রী হননি। বরং তিনি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর জন্মস্থান লিল-সুর-সরনেই-তে। ভাক্লজ অঞ্চলে সেটা একটা ছোট্ট জায়গা। শুধু কবিতা লিখেছেন আর তাঁর সমসাময়িক শিল্পী মিরো, ব্রাক-এর ওপর প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
শার-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আলবিয়ার কামু। কামর মতে শার এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফরাসি কবি। অবশ্য শার-এর সব কবিতার মর্ম বোঝা মোটেই সহজ নয়। তাঁর একটি ছোট্ট কবিতার নাম ‘ওরিওল পাখি’, সেটি এরকম :
ওরিওল পাখি ছুঁয়েছে ঊষার রাজধানী
তার সঙ্গীত তলোয়ার, এসে
বন্ধ করেছে দুঃখ শয্যা
সব কিছু আজ চির জীবনের শেষ।
এই কবিতাটি পড়ার সময় জানত হবে যে এর রচনাকাল ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৩৯, অর্থাৎ মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ইওরোপের কালো আকাশ পেরিয়ে উড়ে আসছে একটা ওরিয়ল। ওরিয়ল মানে সোনালি পাখি। আমাদের দেশে যে হলদে পাখিগুলো ‘গৃহস্থের খোক হোক’ বলে ডাকে, অনেকটা সেকরম, এদেশে খুব দেখা যায়। শার মনে করতেন, কবিতায় কোনও সম্পূর্ণ অর্থ থাকার দরকার নেই। কবির আবেগ বা বিশেষ অনভূতির শুধু প্রথম অংশটুকু নিয়েই হয় কবিতা, সেইটুকু অবলম্বন করে পাঠকদের মানস যাত্রা। অর্থাৎ এই কবি পাঠকদের ওপর অনেকখানি দায়িত্ব দিতে চান।
এই ছোট্ট কবিতাটি আমি মার্গারিটের মুখে বারবার আবৃত্তি শুনেছি। একবার তুষারপাতের সময় কয়েকটা মৃত পাখি দেখে…
শার-এর একটি কবিতা আছে র্যাঁবোর ওপরে। কবিতাটির নাম, ‘তুমি ছেড়ে গিয়ে ভালোই করেছ, আর্তুর র্যাঁবো’। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে র্যাঁবো-র কবিতা হঠাৎ কলকাতায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। র্যাঁবোর অতি নাটকীয় জীবনের সঙ্গে তাঁর কবিতা মিলিয়ে বিশেষ একটি আকর্ষণ তৈরি হয়। মাত্র আঠারো বছরের এই বালকটি কবিতা লিখে হুলুস্থুলু ফেলে দেয় ফরাসি দেশে, তারপর হঠাৎই কবিতা লেখা একেবারে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় আফ্রিকায়। তারপর থেকেই র্যাঁবো একটি লিজেন্ড। একাধিক বাঙালি র্যাঁবোর কবিতা অনুবাদ করেছেন। আমারও একসময় ইচ্ছে ছিল র্যাঁবোর একটি জীবনী লেখার।
র্যাঁবো প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল। ফরাসি উচ্চারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বাংলার র্যাঁবো নামটি দেখে অনুমান করা দুঃসাধ্য ওই নামের মূল ফরাসি রূপ। ফরাসিরা র-অক্ষরটিকে অনেক সময় হ্র-র মতন উচ্চারণ করে, রেডিও হয়ে যায় দিও। Rimbaud-কে আমি মার্গারিটের কণ্ঠে হ্রাম্বো শুনেছি। একসময় আমি ‘অন্য দেশের কবিতা’ নামে একটি অনুবাদের সিরিজ প্রকাশ করছিলাম। তাতে ‘র্যাঁবো’র বদলে লিখেছিলাম ‘হ্রাম্বো’! আর যায় কোথায়, অনেকেই অবজ্ঞায় ওষ্ঠ ওলটাতে লাগল আমি ফরাসি শব্দের উচ্চারণ জানি না বলে, আবার ফরাসি ভাষায় পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলি দেশ পত্রিকার পাতায় ধমক দিয়ে লিখলেন, আজকাল হয়েছে এই এক ধরনের এঁচোড়ে পাকা, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী, র্যাঁবোর বদল লিখেছে হ্রাম্বো, এটা কোনও কবির নাম না ছাগলের ডাক তা বোঝাই যায় না!
আমি আলি সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বললাম, আপনি আমার ইয়ার্কিটা বুঝতে পারেননি? ফরাসি উচ্চারণ নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে, ওটা তাদের সম্পর্ক খানিকটা মজা করার জন্য। আমি তো কিছুই জানি না, আমাদের দেশে ক’জনই বা সঠিক ফরাসি জানে, বলুন? আমরা নেপোলিয়ান কিংবা প্যারিস দেখলে চিনতে পারি, তার বদলে নাপোলিয় কিংবা পারি লেখার দরকার আছে কি?
আলি সাহেব বললেন, না লিখলেও চলে। ইংরেজদের ধরনে ফরাসি উচ্চারণই লোকে বোঝে।
আমি বললাম, আমেরিকানরা বলে যাঁমবো। তবে কি এসব ঝামেলা এড়াবার জন্য বানান অনুযায়ী রিমবড লেখা উচিত?
উনি বললেন, না, না, এতদিন ধরে র্যাঁবো চলছে, সেটাই চলুক।
এই সূত্রে আমার প্রতি সৈয়দ মুজতবা আলির একটা স্নেহের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়। পরবর্তী কালে তিনি আমাকে অনেকগুলি চিঠি লিখেছিলেন।
যাই হোক, সেদিন দুপুরবেলা কেন যেন র্যাঁবোর চিন্তা আমায় পেয়ে বসেছিল। দেশপ্রেমিক রেনে শার দেশত্যাগী র্যাঁবো সম্পর্কে এতখানি সহানুভূতি দেখিয়েছেন কেন? রেনে শার সারা জীবন কবিতার সাধনা করেছেন, কিন্তু যা বো যে আঠারো বছর বয়সেই কবিতা লেখা ছেড়ে, একেবারে সাহিত্য জগৎ ছেড়েই চলে গেল, সেটাকে কেন তিনি বললেন, ‘তুমি ছেড়ে চলে গিয়ে ভালোই করেছ, আর্তুর যবো’?
সাহিত্য একটা তীব্র নেশা, রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, যাকে একবার এই নেশা ধরে, তার আর অন্য কোনও গতি থাকে না। আবার এ কথাও হয়তো ঠিক, অনেক লেখকই এক এক সময় এই নেশা থেকে মুক্তি পেতে চায়! সাহিত্য সৃষ্টিতে খ্যাতি-কীর্তি-অর্থের সম্ভাবনা আছে বটে, কিন্তু তার জন্য লেখককে ভেতরে-ভেতরে কত কষ্ট যে সহ্য করতে হয়! এক একসময় রক্তক্ষরণের মধ্যে মিশে যায় শব্দের বিষ, তা অন্যদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রত্যেক লেখকেরই বোধহয় জীবনে কোনও না কোনও সময় মনে হয়, দূর ছাই, আর জীবনে এক লাইনও লিখব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারা যায় না। যে দু-একজন পারে, তাদের প্রতি অন্য লেখকদের শ্রদ্ধা ও ঈর্ষাবোধ হয়। খুব সার্থক কোনও লেখক সম্পর্কে যেমন অন্য লেখকদের ঈর্ষা থাকে, তেমনি কোনও ক্ষমতাসম্পন্ন লেখক অবহেলায় সাহিত্যজগৎ ছেড়ে গেলে তাঁর প্রতিও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ঈর্ষা থাকতে পারে। র্যাঁবো সম্পর্কে রেনে শার-এর এত উচ্ছ্বাস কি সেইজন্য?
র্যাঁবোর জীবনের নানা ঘটনা আমার মনে পড়ে যায়। আঠেরো বছর, মাত্র আঠারো বছরের একটি ছেলে নুরকে এক ঋতু’র মতন অবিস্মরণীয় কাব্য লিখে ফেলেছিল? আমরা আঠেরো বছর বয়েসে কী করেছি। কতটুকু জেনেছি সাহিত্য সম্পর্কে? আর কীভাবে র্যাঁবো রচনা করেছিল সেই কাব্য? সেই সময়ে তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ভেরলেইন-এর সঙ্গে ঝগড়া, ভেরলেইন রাগের মাথায় যাবোকে গুলি করেছিল, এ ঘটনা তো অনেকেরই জানা। ভেরলেইনকে গ্রেফতার করে পুলিশ জেলে ভরে দিল, আহত অবস্থাতেও র্যাঁবো পুলিশকে জানাল যে বন্ধুর বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই, পুলিশ তা মানল না। র্যাঁবোর তখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, কোনও বন্ধু নেই, কপর্দকশূন্য অবস্থা, খাবার জোটাবার সঙ্গতিও নেই। গৃহত্যাগী এই ছেলেকে তার পরিবারের লোকরাও পছন্দ করে না, সকলের ধারণা কুসঙ্গে মিশে সে উচ্ছন্নে গেছে। (ভেরলেইনের সঙ্গে তখন র্যাঁবোর সমকামিতার সম্পর্কের গুজব বহুল প্রচারিত) নিরুপায় র্যাঁবো গ্রামের বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হল, পায়ে হেঁটে, এক হাতে তখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা, শীর্ণ শরীর। বাড়িতে সবাই তখন খাবার টেবিলে বসেছে, মা, দুই বোন, এক ভাই। সেখানে এসে দাঁড়াল সেই অভিশপ্ত পুত্র র্যাঁবো। প্রথমে সবাই নিশ্চুপ, র্যাঁবো বুঝতে পারছিল না যে তাকে এ বাড়িতে গ্রহণ করা হবে, না তাড়িয়ে দেওয়া হবে! তারপর মা ছেলেকে বললেন, আয়, বোস। সেই সামান্য স্নেহের ডাক শুনেই র্যাঁবো টেবিলে মাথা গুঁজে হু হু করে কাঁদতে লাগল।
মায়ের কাছে র্যাঁবো আবেদন জানাল যে এখন থেকে বাড়িতে থেকে সে তার বইটি শেষ করতে চায়। এই বইটি ছাপিয়ে সে দেখতে চায়, তার সাহিত্য প্রচেষ্টার সত্যিকারের কোনও মূল্য আছে কি না। মা সাহায্য করতে রাজি হলেন, এমনকি বই ছাপাবার খরচও দেবেন বললেন। ওদের নিজস্ব ফার্মে অন্য ভাই-বোনেরা ও মা রোজ সকাল থেকে চাষ ও হাঁস-মুরগি পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, শুধু এই একটি ভাই কিছু করে না, সে লেখে। তার এক বোন ভিতালি ডায়েরিতে লিখেছিল, আমরা যখন কাজ করতে যাই, আর্তুর আমাদের সঙ্গে আসে না, সে তার কলম নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু আমি এক একদিন শুনেছি, সে একা একা যন্ত্রণায় চ্যাঁচায়, গালাগালি দেয় দরজায়, যেন সে কোনও শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
বইটি শেষ হওয়ার পর মা পাণ্ডুলিপিটা পড়লেন। কিছুই বুঝতে না পেরে, ভ্যাবাচ্যাকা, বিমূঢ় অবস্থায় ছেলেকে জিগ্যেস করলেন, এ সবের মানে কী? শান্তভাবে ছেলে উত্তর fucsibat ‘‘It means exactly what I’ve said, literally and completely, in all respects.’
পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেওয়া হল প্যারিসে, ছাপাও হল, কিন্তু কেউ উচ্চবাচ্য করল না, প্রকাশকের কাছে গাদা হয়ে পড়ে রইল সব বই। ওদের অসামাজিক জীবনযাপন, বিশেষত গুলি ছোঁড়ার ঘটনা ও ভেরলেইনের জেল খাটার জন্য, এই দুজনকে ফরাসি লেখক-সাহিত্যিকরা বিষবৎ পরিত্যাগ করেছিল।
কিছুদিন বাদে র্যাঁবো প্যারিসে এল তার এই সাহিত্যকীর্তিটি সম্পর্কে লেখককুলের প্রতিক্রিয়া জানতে। কাফে তাবুরি ছিল সাহিত্যকদের আড্ডা স্থল, সেখানে যাবো আর ভেরলেইনও একসময় প্রচুর সময় কাটিয়েছে। সেটা একটা ছুটির দিন, র্যাঁবো এসে বসল একটা টেবিলে, অন্য টেবিলগুলোতে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ও তাদের বান্ধবীরা তুমুল হল্লা করছে, তাদের অনেকেই র্যাঁবোকে চেনে, কিন্তু কেউ ডাকল না, কেউ তার সঙ্গে কথা বলল না। এই আঠারো বছরের যুবকটি যেন শয়তান, তার দিকে তাকাতেও নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা র্যাঁবো বসে রইল একা। কঠিন মুখে, মাথা নীচু করে। তার অহংকার কম নয়, সেও নিজে থেকে কারুর সঙ্গে কথা বলবে না।
সম্ভবত এই দৃশ্যটি সম্পর্কেই রেনে শার লিখেছেন তাঁর কবিতাটি। ‘প্যারিসের কবিদের ন্যাকামি…লিরিক-প্রস্রাবকারীদের সরাইখানা’…।
সে য়াতে বাড়ি ফিরে এসে র্যাঁবো তার সব লেখার পাণ্ডুলিপি ও বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দিল। তার এক বোন সেই বহূৎসব দেখেও থামাতে পারেনি। সাহিত্যের প্রতি সেই আগুনই ছিল র্যাঁবোর শেষ উপহার।
র্যাঁবো সম্পর্কে পড়তে-পড়তে ও ভাবতে-ভাবতে আমি একটু একটু রেড ওয়াইন খাচ্ছিলাম। অসীম রায়ের সেলারে অনেক বোতল ওয়াইন জমা করা ছিল, তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়নি, কিন্তু প্যারিসে এসে ইচ্ছে মতন ওয়াইন খাব না, তা কখনও হয়?
কিছুক্ষণ পরে একসঙ্গে দুটো নেশা আমায় পেয়ে বসল। রেড ওয়াইনের নেশায় মাথাটা হালকা হয়ে গেল, আর আঠারো বছরের সেই দুরন্ত কিশোরটি যেন শতাব্দী পেরিয়ে এসে হাতছানি দিয়ে আমায় বলতে লাগল, এসো, এসো, চলে এসো, লেখাটেখা ছেড়ে দাও, কী হবে লিখে? কে তোমায় মাথার দিব্যি দিয়েছে যে লিখতেই হবে? না লিখলে বিশ্বসংসারের কোনও ক্ষতি হয় না। আরও অনেক ভালো ভালো লেখক আছেন, তোমার কিছু না লিখলেও চলবে!
সত্যি সত্যি কাল থেকে যদি ঘোষণা করে দিই, আর কক্ষনো এক লাইনও লিখব না, তা হলে কেমন হয়? পাঠক-পাঠিকারা অবশ্য মাথাও ঘামাবে না, কিন্তু চেনাশুনো, বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হবে নিশ্চয়ই। তাদের অবিশ্বাসের ওপর বিচ্ছুরিত হবে আমার অহংকার। না-লেখার অহংকার।
আগেও আমার একবার এরকম হয়েছিল। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েসে। কিছু একটা অভিমানে আমি ঠিক করেছিলাম, জীবনে আর এক লাইনও কবিতা লিখব না। আমার সংগ্রহের সমস্ত কবিতার বই ও পত্র-পত্রিকা আমি বিলিয়ে দিয়েছিলাম, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কখনও কবিতা জিনিসটার মুখদর্শনও করব না। সেবারে সে প্রতিজ্ঞা সাতাশ দিনের বেশি রাখতে পারিনি।
এবারে, একাকী প্যারিসের প্রান্তে এক বাড়ির বাগানে বসে রোদ পোহাতে-পোহাতে র্যাঁবোর প্রভাব আমাকে আবার অনুপ্রাণিত করে। যেন আমি মাথার টুপি তুলে বলছি, সাহিত্য জগৎ, বিদায়। র্যাঁবো সাইপ্রাসে চলে গিয়ে বাড়িঘর বানানোর মিস্তিরির কাজ নিয়েছিলেন, আমি সাঁওতাল পরগনায় কোনও কাঠ গুদামে কাজ নিতে পারি। আমাকে বিয়ে করার সময় স্বাতী বলেছিল, দরকার হলে ও আমার সঙ্গে বনে-জঙ্গলে গিয়ে থাকতেও রাজি আছে। তা হলে তো আর কোনও অসুবিধে নেই।
একাধিক রেড ওয়াইনের বোতল শেষ হয়ে গেল। স্বাতীরা ফিরল ঘোর সন্ধেবেলা। তখনই ওদের কাছে কিছু ভাঙলাম না। নৈশাহারের সময় আরও ওয়াইন পান হল। তারপর হল এক কাণ্ড। মাঝরাত্তিরে আগুনের আঁচে ঘুম ভেঙে আমি লাফিয়ে উঠলাম। বিছানায় আগুন লেগে গেছে, কম্বল জ্বলছে, তোশক জ্বলছে।
শুয়ে-শুয়ে বই পড়ার সময় হঠাৎ আমার ঘুম এসে গিয়েছিল। হাতে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট। রাত্তিরে শুয়ে সিগারেট টানা যে বিপজ্জনক, তা কি আমি জানি না? অন্য দিন তো এরকম করিও না! বেশি ওয়াইন খেলে এরকম করা তো একদমই উচিত না, তবু কি আমার মাথায় র্যাঁবোর ভূত পেয়েছিল?
কম্বল ফুটো হয়ে তোশকের ভেতরটা জ্বলছে। তুলোর আগুন নেভানো সহজ নয়। অন্যদের ঘুম না ভাঙিয়ে স্বাতী জল এনে-এনে অনেকক্ষণ ধরে সেই আগুন নেভাল। সারারাত আমাদের শুয়ে থাকতে হল সেই ভেজা বিছানায়। আর আমার ঘুম আসে না। নেশা-ফেশা সব ঘুচে গেছে, অপরাধবোধে আমি মরমে মরে যাচ্ছি। এদিকে সবই কাঠের বাড়ি। ছ্যাঁকা লেগে জেগে না উঠলে যদি দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠত, তা হলে সারা পাড়া জুড়ে একটা অগ্নিকাণ্ড হত। অসীম রায়ের সঙ্গে সদ্য পরিচয়, তিনি তাঁর বাড়িতে অনুগ্রহ করে আমাদের থাকতে দিয়েছেন, এই কি তার প্রতিদান? তিনি রাগী ধরনের মানুষ, এই সব দেখে কী ব্যবহার করবেন কে জানে!
সকালবেলা অসীম রায়কে সব কিছু জানাতেই হল। তাঁর অফিস যাওয়ার তাড়া ছিল, তিনি দগ্ধ বিছানা নিরীক্ষণ করে বিনা মন্তব্যে চলে গেলেন। আমার মাথা থেকে র্যাঁবোর ভূত চলে গেছে, অসীম রায় বকুনি দিলে আমি কীভাবে ক্ষমা চাইব, তার সাতরকম ভাষ্য তৈরি করেছিলাম মনে-মনে, কিন্তু অফিস থেকে ফিরেও অসীম সে প্রসঙ্গই তুললেন না।
স্বাতী দু-তিনবার বলল, কাল কী কাণ্ড হতে যাচ্ছিল বলুন তো!
অসীম বললেন, শেষ পর্যন্ত বিশেষ কিছু হয়নি তো! বলুন, আজ কোথায় বেড়াতে যাবেন?
অসীম যে এত বড় ব্যাপারটায় কোনও গুরুত্বই দিলেন না, তাতেই অস্বস্তি কাটছে না। আমিও আমার সাতরকম ভাষ্য শোনাবার সুযোগ পাচ্ছি না। একবার আমি জানালাম যে কাল তাঁর সেলার থেকে আমি দু-বোতল রেড ওয়াইন শেষ করেছি। তার উত্তরেও অসীম বললেন, আমি তো আপনাদের এখানে নেমন্তন্ন করে এনেছি। এমনি এমনি তো আসেননি। আমার বাড়িতে এসে আমার ওয়াইন খাবেন না?
কিন্তু নিমন্ত্রিত হয়ে এসে বিছানা পুড়িয়ে দেওয়াও কোনও কাজের কথা নয়। অসীম রায়ের কাছ থেকে কিছু ধমক আমাদের প্রাপ্য তো বটেই!
শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে আমি একবার বললাম, দেখুন, আপনার বাড়ির জন্য একটা তোশক আর কম্বল আমরা কিনে দিতে পারি কি? ও দুটো ফুটো হয়ে গেছে!
এর অসীম রায় আমার দিকে ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনার বাড়িতে গিয়ে কেউ যদি একটা কাঁচের গেলাস ভাঙে, আপনি বুঝি তার দাম চান? ঠিক আছে, কমপেনসেশান হিসেবে আপনি আমাকে আপনার লেখা একটা কবিতার বই দেবেন!
প্রকৃতপক্ষে সেই দিন থেকে অসীম রায়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সূত্রপাত।