একদা প্যারিস ছিল বিশ্বের সমস্ত শিল্পীদের তীর্থ। একদা এবং অতীত ক্রিয়াপদ ব্যবহার। করলুম খানিকটা ভেবেচিন্তেই। পৃথিবীর প্রায় সবদেশেরই শিল্পীদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল একবার প্যারিসে ঘুরে আসা। আমাদের বাংলাদেশের কোনও অখ্যাত শিল্পীও প্যারিসের রাস্তায় বসে পদ্মাপাড়ের ছবি আঁকছেন এমন কাহিনী আমরা শুনেছি। প্যারিসে নাম করেছেন এমন বন্ধু শিল্পীই অফরাসি। প্যারিসের ম’মার্ত্র-এর কাফে রেস্তোরাঁয় বিখ্যাত সব শিল্পীরা এসে গুলজার করেছেন, একটি কাফের মধ্যে বদ্যাঁর সঙ্গে দেগার ঝগড়া হয়ে গেল, পল গগ্যাঁ মত্ত অবস্থায় ঢুকে বললেন, আমি তিনদিন কিছু খাইনি, কে আমাকে খেতে দেবে দাও।–এসব আমরা কাহিনীতে পড়েছি।
রঙিন ছাতাওয়ালা খোলা হাওয়ার রেস্তোরাঁ। ম’মার্ত্রে আমি বসে আছি। এখানে ওয়াইন বা কফি বা যে-কোনও খাবারের দাম একটু বেশি। কারণ এখানে ভ্রমণকারীদের ভিড় লেগেই আছে। ভ্রমণকারীরা এখানে শিল্পীদের দেখতে আসেন। তা ছাড়া মাত্র পাঁচ ফাঁ খরচ করলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছবি এঁকে দেবে–এমন শিল্পীরা ঘোরাঘুরি করছে প্রচুর। সে-সব ছবি দেখলে নিজেকে চেনা যাবে নিশ্চিত। আমাকে এসে একজন শিল্পী অনুরোধ করলেন। আমি হাত নেড়ে প্রত্যাখ্যান করতে যেতেই আমার ফরাসিভাষী সঙ্গিনী পাঁচ কথায় ধমকে শিল্পীকে বিদায় করলেন। আমার ক্ষীণ সন্দেহ বা আশা হল যে, সবকটি রূঢ় বাক্য শিল্পীটির বোধগম্য হয়নি। কারণ খুব সম্ভব সে ফরাসি নয়, আমেরিকান। সে পাশের এক আমেরিকান দম্পতির কাছে গিয়ে আবার অনুনয় করতে লাগল এবং দু’খানা ছবি আঁকার কাজও পেয়ে গেল। পৃথিবীর সব দেশেই, সবচেয়ে জাঁকজমকের পোশাকে দেখা যাবে আমেরিকান পর্যটকদের। এবং সবচেয়ে ছেঁড়াখোঁড়া মলিন পোশাকে দেখা যাবে যাদের তারাও আমেরিকায়। একজন ভারত কিংবা বাংলাদেশি বিদেশে গিয়ে ভিখারি সাজে না কিন্তু বহু আমেরিকান বিদেশে গিয়ে ভিক্ষে করতে পারে।
ফরাসি উচ্চারণের নানা ধরন দেখেই আমার সঙ্গিনী বলে দিচ্ছিলেন কে কোন জাতের এবং দেখা গেল ওইসব ছুটকো শিল্পীদের মধ্যে আমেরিকানই বেশি।
এরকম অনেক শিল্পী আছেন প্যারিসে। কিন্তু না, প্যারিস আর শিল্পীদের তীর্থস্থান নেই। শিল্পীদের কেন্দ্র এখন বেশিরভাগ উচ্চাভিলাষী শিল্পীদেরই এখন স্বপ্ন, একবার নিউ ইয়র্কে যাওয়া।
কারণ ফরাসিরা ছবি তারিফ করার ব্যাপারে ঝিমিয়ে এসেছে। অনেক প্রাচীনপন্থী হয়েছে এখন। বাজে শৌখিন শিল্পীতে ভরে যাওয়ার জন্যই হয়তো, নতুন শিল্পীদের ছবির ক্রেতা নেই ফরাসি দেশে। শিল্পের দৃষ্টিতে ছবি দেখার বদলে, ছবি এখন অর্থ বিনিয়োগের উপায় হিসেবে দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ কোনও রকমে মডিসের একটা স্কেচও যদি এখন কিনে রাখা যায়, তবে পরে তা উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা যাবে। কিন্তু নতুন অচেনা কোনো ছোঁকরার ছবি কিনে, পরে সে খ্যাতিমান হলে, সেই ছবিকে কাজে লাগানোর ঝুঁকি এখন ফরাসি দেশে চট করে কেউ নিতে চায় না। আর, নবীন শিল্পীদের একমাত্র ভরসা ছবি বিক্রি। ছবি আঁকা এক হিসেবে ২৪ ঘণ্টার কাজ। যিনি সত্যিকারের ছবি আঁকতে চান, তাঁর পক্ষে কোনও চাকরি করে ছবি আঁকা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং আঁকা ছবি যদি বিক্রি করা না যায়, তবে পাঁচ মিনিটে মুখের ছবি আঁকার অধঃপতনে জীবিকা উপার্জন করা স্বীকার করে নিতে পারে?
নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট একদল আমেরিকান শিল্পীকে ইউরোপ পাঠান। তাদের মধ্যে ছিলেন পোলোক, ডি কুনিং, ক্লাইন প্রভৃতি শিল্পী এবং কিছু কিছু অমূর্তভাবের শিল্পের উদাহরণও ছিল, এই সব শিল্পীরা ইউরোপে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এবং জানা গিয়েছিল, আমেরিকায় তারা সুপ্রতিষ্ঠিত। নিউইয়র্কের উঁচু সমাজে হঠাৎ ছবি কেনার খুব রেওয়াজ শুরু হয়েছে। তা ছাড়া, আমেরিকানরা যেহেতু ঠিক কেউই বনেদি-বংশ নয়, সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রে বড় বড় মাস্টারদের আঁকা ছবি পারিবারিক সংগ্রহে পায়নি। সুতরাং একদিকে যেমন যতই উচ্চমূল্য হোক, পিকাসো, ম্যাতিস, রেনোয়া, রুসো কেনার জন্য আমেরিকানরা উদগ্রীব, তেমনি ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধির জন্য আধুনিক তরুণ শিল্পীদের ছবি কিনতে পরন্মুখ নয়। এই সন্ধান নগরে-নগরে রটে যাওয়ার পর, তরুণ শিল্পীরা এখন ছুটছেন নিউইয়র্কে।
অত্যধিক আর্থিক প্রাচুর্য এবং সেই জনিত অস্বস্তি দুটোই ছবি আঁকার পক্ষে অনুকূল। প্রথমটি ছবি বিক্রির পক্ষে দ্বিতীয়টি ছবি আঁকার পক্ষে। প্যারিসের নিয়মিত প্রদর্শনীগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় সম্মিলিত প্রদর্শনী। একক প্রদর্শনী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতি বিখ্যাত বা মৃত শিল্পীদের। অন্যদিকে নিউইয়র্কে নিয়মিত আর্ট গ্যালারির সংখ্যা একশোর কাছাকাছি এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পীদেরও প্রদর্শনীর সুযোগ পাওয়া অনেক সহজ। তা ছাড়া পপ আরট বা বিজ্ঞানের কাগজপত্র ছিঁড়ে কোলাজ ব্যবহার করে আমেরিকানরা যে চিত্রধারা তৈরি করেছে তার জনপ্রিয়তা প্রায় পপ সঙের কাছাকাছি।
ছবির নিলামের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে, উল্লেখযোগ্য স্থান লন্ডনে। লন্ডনের নিলামে গিয়ে ছবি কেনা একটি শখে দাঁড়িয়ে গেছে! লন্ডনের বাজারে এ পর্যন্ত ছবির সর্বোচ্চ দাম ৫৬ লক্ষ ডলার পর্যন্ত উঠে একটা রেকর্ড হয়ে আছে।
প্যারিসে একজন তরুণ শিল্পীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ফরাসিদের অতি আদরের লম্বা রুটি যা গরম গরম না খেলে শেষ পর্যন্ত ঠোঁট কেটে যায়, সে সম্পর্কে সে অভিযোগ করছিল। ঘর ভাড়া পাওয়া যায় না সহজে, সব খাবারেরই দাম বেশি। নিউইয়র্কে অনেক সস্তায় সুন্দরী মডেল পাওয়া যায়। রঙের দামও আমেরিকায় সস্তা। তবে, তুমি এখানে পড়ে আছো কেন?
ছেলেটা হাসল। এক মুহূর্ত থেমে বলল মায়া বলতে পারো। জানি আমেরিকায় অনেক সুববাগ বেশি। কিন্তু যখনই ভাবি এই প্যারিসের রাস্তা দিয়ে এক সময় কত মহা মহা শিল্পী হেঁটেছে এখানেই কাটিয়েছে তাদের যৌবনের দুঃখের দিনগুলি তখনই আমেরিকাকে আমার নোংরা মনে হয়। প্যারিসকে মনে হয় পবিত্র।