‘রাত্রি তুমি পবিত্র, রাত্রি তুমি পরিব্যাপ্ত, রাত্রি তুমি সুন্দর
বিশাল আঙরাখায় ঢাকা রাত্রি
রাত্রি তোমায় ভালোবাসি,
তোমায় সাদর সম্ভাষণ জানাই,
তোমায় গৌরবোজ্জ্বল করি,
তুমিই আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা এবং আমার সৃষ্টি
হে রূপসী রাত, বিশাল আঙরাখায়
ঢাকা রাত
তারকা সজ্জিত আঙরাখায় ঢাকা আমার কন্যা
সেই উদার নিস্তব্ধতা, আমার
অকৃতজ্ঞতার বন্যাদ্বার
খুলে দেওয়ার আগে, যা এখানেই
ছিল ছড়িয়ে…’
–শার্ল পেগি
এক একটা রাতে জ্যোৎস্নাকে মনে হয় তরল, কিংবা সাবানের ফেনার মতন, গায়ে লেগে যায়। এক একটা রাত বাতাস হয়ে যায় মখমলের মতন। এক একটা রাতে আকাশের নীচে অনেকক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করে।
আমরা ফিরে এসে দেখি চাষি পরিবার তখন খেতে বলেছে। এইসব দেশে নৈশ ভোজ সন্ধে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এখানে দেখা যাচ্ছে তার ব্যতিক্রম। আমাদেরও তারা খাবর টেবিলে আমন্ত্রণ জানাল।
কর্তা ও গৃহিণী ছাড়া অন্য গ্রাম থেকে এসেছে তাদের মেয়ে-জামাই এবং একটি উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণী। এঁদের মধ্যে জামাইটিই একটু একটু ইংরিজি জানে, আমাদের দলের ফরাসি-ভাষী একমাত্র অসীম। তবু সকলে মিলে গল্প জমে গেল। ওরা আমাদের অনুরোধ করল নিজেদের বাড়ির তৈরি ওয়াইন পান করার জন্য, ভাস্করও নিজের স্টকের পানীয় দিল ওদের।
ওরা আগে কোনও হিন্দু (অর্থাৎ ভারতীয়) দেখিনি এত কাছ থেকে, ভারত সম্পর্কে ওদের জ্ঞানের বহর যৎসামান্য বললেও বেশি বলা হয়। আমাদের দলের দু’জন লন্ডন প্রবাসী শুনে ওরা বেশ মুগ্ধ, লন্ডন সম্পর্কে এদের বেশ একটা মোহ আছে মনে হল। এদের মধ্যে ওই জামাইটি ছাড়া আর কেউ লন্ডন দেখেনি।
বেশ সরল সাদা-সিধে মানুষগুলি, এরা প্রাণ খুলে হাসতে জানে। ভাস্কর এক বিন্দু ফরাসি না জেনেও জমিয়ে তুলল। আমরা অতদূরের ভারতবর্ষ থেকে স্কোর গুহাচিত্র দেখতে এসেছি শুনে বিস্ময় আর কাটে না। আমাদের অজন্তা কিংবা ভীম ভেটকার নামও ওরা শোনেনি।
পরিবারের কর্তাটি এক সময় উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা পাথর এনে বলল, এটা দ্যাখো, খুব মূল্যবান জিনিস।
সেটা তিন নম্বর ফুটবলের সাইজের একটা পাথরের টুকরো, তার একদিকে সামান্য একটা মুখের আদল।
জামাইটি বলল, এখানে অনেক জমি খুঁড়ে এখনও প্রাগৈতিহাসিক পাথরের অস্ত্রশস্ত্র ও মূর্তি পাওয়া যায়। এটা এ বাড়ির চাষের জমিতেই পাওয়া গেছে। এরকম গোটা তিনেক।
কর্তাটি বলল, তোমাদের যদি খুব আগ্রহ থাকে, তোমাদের দিতে পারি। এই মূর্তিটা চালকোলিথিক পিরিয়ডের।
ভাস্কর পাথরটা হাতে নিয়ে বলল, বাঃ, ভারী সুন্দর জিনিস তো। সত্যি আমাদের দেবে?
কর্তাটি বলল, হ্যাঁ, নাও না। মাত্র পাঁচ হাজার ফ্ল্যাংক পেলেই আমি সন্তুষ্ট হব।
চাষি বউটি তার মেয়ের সঙ্গে চোখাচোখি করল। তারপর আমাকে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
এরকম অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। কায়রো থেকে উটের পিঠে চেপে মরুভূমির মধ্যে পিরামিড দেখতে গিয়েছিলাম। একটা পিরামিডের ভগ্নস্তূপ থেকে একজন সান গ্লাস পরা লোক বেরিয়ে এসে ফিসফিস করে আমাকে বলেছিল, তোমাকে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এক ফারাও-এর একটা মূর্তি দিতে পারি। খুব গোপনে নিয়ে যেতে হবে। এ দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারলেই এর অনেক দাম।
আমি হাতে নিয়ে দেখলাম। একটা এক বিঘৎ লম্বা পাথরের মূর্তি। সেটার বয়েস পাঁচ হাজার বছর নয়, খুব বেশি হলে পাঁচ মাস। কোনও পুতুল কারখানায় তৈরি। তৈরির পর খুব করে মাটি ঘষা হয়েছে।
লোকটি বলেছিল, তোমায় খুব সস্তায় দেব। মাত্র পঞ্চাশ ডলার।
আমি চাই না বলাতেও সে কিছুতেই ছাড়বে না, মূর্তিটা আমার হাত থেকে নেবে না। তার খুব ক্যাশ টাকা দরকার, একজনকে ধার শোধ করতে হবে, সেই জন্য সে এত সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে, ঠিক আছে, সে চল্লিশ ডলারেই বিক্রি করতে রাজি!
দর নামতে নামতে শেষ পর্যন্ত সে দু-প্যাকেটে সিগারেটের বিনিময়ে সেটা দিতে রাজি হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, কারখানায় তৈরি হলেও এটা মিশরীয় পুতুল তো, দু-প্যাকেট সিগারেটের বদলে নিলে ঠকা হবে না।
এখানে এই চাষিটির সাহস তো কম নয়। প্রথমেই চেয়ে বসল পাঁচ হাজার ফ্ল্যাংক?
অসীম বাংলায় বলল, ভাস্কর, ওটা রেখে দাও। আমাদের বোকা ভেবে গালে চড় মারতে চাইছে।
ভাস্কর কিন্তু দাম শুনে একটুও চমকালো না। যদিও প্রথমে আমাদের সকলেরই মনে হয়েছিল, লোকটি ওটা আমাদের বিনা পয়সায় উপহার দিতে চায়।
ভাস্কর বলল, পাঁচ হাজার ফ্রাঁ? এমন একটা ঐতিহাসিক জিনিসের আরও অনেক বেশি দাম হওয়া উচিত।
লোকটি উৎসাহিত হয়ে বলল, হ্যাঁ, একজন বিশেষজ্ঞ দেখে বলেছিল, এর দাম অনায়াসে দশ হাজার হতে পারে।
ভাস্কর বলল, দশ কেন, চোদ্দো-পনেরো হাজার ফ্রাঁ-ও হতে পারে। দাম কমিও না
একদম। কাঁধে দুটো ক্যামেরা ঝোলানো টাক-মাথা কোনও আমেরিকায় টুরিস্ট পেলেই বেচে দিও। সঙ্গে যদি তার একটা কবি বউ থাকে, তা হলে শিওর তুমি ভালো দাম পাবে! আমাদের মতন ফেকলু পার্টিকে খবরদার যেন এ জিনিস আর কক্ষনো দেখিও না!
এরপর আর আড্ডা জমল না, সভা ভঙ্গ হল।
মেয়ে-জামাইরা বিদায় নিল, কর্তা-গিন্নি শুতে চলে গেল। আমাদের কিন্তু এর মধ্যেই ঘুমোতে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই, ঘরের মধ্যেও বসে থাকার কোনও মানে হয় না, বাইরের আকাশে চাঁদ হাতছানি দিচ্ছে।
বাড়ির সামনেই একটা চাতাল, আমরা চারজন গিয়ে বসলাম সেখানে। বাগানে অনেক বড় বড় গাছপালা, এখন বাগানটিকে গভীর জঙ্গল বলে মনে হয়। এই অঞ্চলে পনেরো কুড়ি হাজার বছর আগেও মানুষের বসতি ছিল। সেইসব মানুষেরা বৃষ্টি কিংবা তুষারপাতের সময় গুহার মধ্যে বসে সময় কাটাবার জন্য ছবি এঁকেছে।
কিছু একটা গল্পে আমরা খুব হাসছিলাম, হঠাৎ পেছনের দরজাটা খুলে গেল। চাষি গিন্নি রাত-পোশাক পরে সেখানে দাঁড়িয়ে গড়গড় করে কী যেন বলল, অসীম তার সঙ্গে বাক্যালাপ চালাল। তারপর সেই রমণী আবার দরজা বন্ধ করে চলে যেতেই অসীম আমাদের জানাল যে গৃহকত্রী আমাদের আড্ডা ভাঙতে বলেছে। এ বাড়িতে আরও দুটি ঘরে অতিথি আছে, আমাদের হাসি-গল্পের আওয়াজে অসুবিধে হচ্ছে তাদের।
এখন বেশ শীত শীত ভাব, আমরা চাদর জড়িয়ে বসেছি। এদের দেশে কেউ শীতের মধ্যে জানলা খুলে শোয় না। সব দরজা-জানালা বন্ধ, তবু আমাদের কথাবার্তায় অন্যদের এমন কী ব্যাঘাত হতে পারে? আমরা বেড়াতে বেরিয়েছি, আমরা যখন ইচ্ছে ঘুমোব!
আমরা ভেতরে যেতে রাজি হলাম না। তবে গলার আওয়াজ কমিয়ে দিলাম। কিন্তু ভাস্কর এমন সব মজার গল্প শুরু করেছে যে হাসি চাপা দায়। আর ফিসফিস করে তো কেউ হাসতে পারে না। দু-একবার হো-হো হা-হা হবেই।
আরও কিছুক্ষণ বাদে গৃহকর্তা এসে কড়া গলায় কী যেন বলল। এবার অসীম দু তিনবার দা কর, উই উই বলল। এবং অসীমের তাড়নাতে আমাদের উঠে পড়তেই হল। ভেতরে কাঠের সিঁড়ি। উঠতে গেলে মচমচ শব্দ হয়, অসীম বলল, এই, আস্তে আস্তে। কিন্তু রাত্তিরবেলা সামান্য আওয়াজও বেশি শোনায়, কাঠের সিঁড়িতে একটু শব্দ হবেই। আমাদের শয়নকক্ষ দোতলায়, বাথরুম একতলায়, সুতরাং ওঠা-নামাও করতে হল দু একবার। তারপর এক সময় আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন বেলা আটটায় অসীম আমাদের ঘরে এসে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, এই তোমরা কাল রাত্তিরে যা কাণ করেছ, এরা ভয়ংকর চটে গেছে।
আমরা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, কী করেছি কাল রাত্তিরে!
অসীম বলল, কাল অত রাত পর্যন্ত বাইরে আড্ডা দিয়েছে, হই চই করেছ, এদের ঘুমের খুব ব্যাঘাত হয়েছে।
ভাস্কর বলল, অ্যাই অসীম, তুমি বুঝি আড্ডা দাওনি? তুমি বুঝি হাসোনি?
অসীম বলল, আমি তোমাদের মতন অত জোরে হাসিনি। সে যাই হোক, ওরা বলছে, এক্ষুনি আমাদের ঘর ছেড়ে দিতে হবে।
ভাস্কর বলল, সে কী! ব্রেকফাস্ট দেবে না?
অসীম বলল, না, দেবে না। চটপট তৈরি হয়ে নাও। দশটার মধ্যে ঘর ছেড়ে দিতে হবে বলেছে।
ভাস্কর বলল, আমরা একদিনের পুরো ভাড়া দিচ্ছি। সব জায়গায় বারোটা পর্যন্ত থাকা যায়।
অসীম বলল, সে তো হোটেলের নিয়ম। এটা চাষির বাড়ি। এদের সঙ্গে তর্ক করে তো লাভ নেই। চলে যেতে বলেছে, তারপরেও কি জোর করে থাকবে?
না, তা থাকা যায় না বটে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সকালবেলায় চা কিংবা কফি না পেয়ে বাথরুম-টাথরুম যাওয়া যায় না যে! সেগুলো সেরে তো বেরুতে হবে অসীম আর মৃণালের সে সমস্যা নেই, কিন্তু ভাস্কর আর আমার বেড টি খাওয়ার অভ্যেস। অসীম জানিয়ে দিল, সে ওদের কাছে কিছু চাইতে পারবে না।
তখন আমাকেই উঠতে হল। বাড়িটা মনে হল জনশূন্য। এ বাড়ির অন্য অতিথিরা কোথায় কে জানে, হয়তো অনেক সকালেই বেরিয়ে গেছে। খাওয়ার ঘরে কেউ নেই। চাষিটিও বোধহয় কাজে গেছে। বাইরে মুরগির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন চাষি গিন্নি।
আমি দূর থেকে বললাম, বঁ ঝুর, মাদাম! তিনি এই সম্ভাষণের কোনও উত্তর দিলেন না। আমি আরও কাছে গিয়ে বললাম, বঁ ঝুর, বঁ ঝুর, সিল ভু প্লে, পারলোঁ, সিল ডু প্লে…। এবার তিনি মুখ ফিরিয়ে বেশ রাগত স্বরে উত্তর দিলেন, বঁ ঝুর!
আমি বিনীতভাবে বললাম পারদোঁ, ভু প্লেনে দোনে মায়া দে কাফে ও লে। সেই সুন্দরী মহিলা মুখখানা খুব কঠোর করে ঝরঝর করে এক সঙ্গে অনেক কথা বলে গেলেন। অতি কষ্টে আমি তার মর্ম বুঝলাম। আমরা রাত্তিরে গোলমাল করেছি বলে আমাদের মতন অতিথি তিনি আর রাখতে চান না। তিনি আমাদের চা-কফি কিছু দিতে পারবেন না, তাঁর এখন অনেক কাজ আছে। এখান থেকে তিন মাইল দূরে একটা কাফে আছে, সেখানে গিয়ে আমরা জলখাবার খেতে পারি। দশটার সময় তাঁর বাড়িতে অন্য লোক আসবে, তার মধ্যে আমাদের ঘর ছেড়ে দিতে হবে!
সুন্দরী মহিলাদের রাগ দেখলে আমার মজাই লাগে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, এই মহিলার সঙ্গে খানিকটা ইয়ার্কি-ঠাট্টা করার। ওঁর ওই বাক্যবাণের অনেক মজা করে উত্তর দিতে পারতাম, শেষ পর্যন্ত ওঁকে হাসিয়ে ছাড়তাম ঠিকই। কিন্তু আমি অসহায়। সেই ভাষার জোর যে আমার নেই। আমাদের গ্রামের কোনও চাষির কাছে গিয়ে শহুরে বাবুরা ইংরিজিতে বুকনি ঝাড়লে যে অবস্থাটা হয়, এখানে হল তার ঠিক উলটো। এক চাষির বউ আমার ওপর ফরাসি ঝাড়ছে, আমি শহুরে বাবু হয়েও উত্তর দিতে পারছি না।
আমাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে দেখে ভাস্কর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, চল, তা হলে এক্ষুনি চলে যাব!
খুব দ্রুত আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। জুতো মোজা পরে নেমে এলাম নীচে। অসীম গম্ভীরভাবে চাষি গৃহিণীকে জিগ্যেস করল, আমাদের কত দিতে হবে?
মহিলাটি একটি কাগজে লিখে দিল টাকার অঙ্কটা। পুরো যা ভাড়া দেওয়ার কথা তাই ই, যদিও এর মধ্যে ব্রেকফাস্ট পাওয়ার কথা ছিল। মহিলার মুখ দেখে মনে হল, উনি ধরে নিয়েছেন যে আমরা কিছু টাকা কমাবার চেষ্টা করব। উনি সেজন্য তর্কাতর্কি করার জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু অসীম সে দিক দিয়েই গেল না। অত্যন্ত রাশভারী ভঙ্গিতে পকেট থেকে চেক বই বার করে খচখচ করে লিখে দিল সম্পূর্ণ অঙ্কটা। তারপর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, মের্সি মাদাম!
প্রায় বিতাড়িত হয়েই আমরা সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠলাম গাড়িতে।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ। তারপর আবহাওয়া হালকা করার জন্য অসীম ভাস্করের পেছনে লাগল। হাসতে-হাসতে বলল, কী ভাস্কর, একেবারে চুপসে গেল যে! খুব যে কাল সন্ধেবেলা মহিলার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলে, ওর স্বামীকে আর জামাইকে তোমার দামি স্কচ খাওয়ালে, কত গল্প শোনালে, আজ সকালবেলা আশা করেছিলে ওরা তোমাকে নিজেদের ফার্মের মুরগির ডিম খাওয়াবে! সব ফস্কে গেল?
ভাস্কর দপ করে জ্বলে উঠে বলল, শালা, আমি এই সব চাষি-ফাঁসিদের বাড়িতে আর কক্ষনও থাকছি না। এর চেয়ে হোটেল অনেক ভালো খাবার টেবিলে বসে জোরে হাসা যাবে না, বারান্দায় বসে হাসা যাবে না, এ রকম অদ্ভুত নিয়ম বাপের জন্মে দেখিনি! সকালে এক কাপ চা পর্যন্ত দিল না?
অসীম বলল, যেমন তোমরা গোলমাল করেছ। এরা আওয়াজ একেবারে সহ্য করতে পারে না। প্যারিসে কী হয় জানো, কোনও বাড়িতে রাত্রির পার্টিতে বেশি চ্যাঁচামেচি হলে পাশের বাড়ির লোক থানায় ফোন করে।
আমি বললাম, দ্যাখো অসীম, আমার তবু খটকা লাগছে। কাল অত ভালো ব্যবহার করল ওরা, সেধে কফি খাওয়াল, নিজেদের ওয়াইন খাওয়াল, কত গল্প করল, তারপর হঠাৎ এত বদলে গেল কী করে? শহরে পাশাপাশি বাড়িতে অসুবিধে হতে পারে, কিন্তু এখানে কাছাকাছি কোনও লোকজনই ছিল না, আমরাও এমন কিছু হইহল্লা করিনি; গল্প করেছি আর হেসেছি। হাসিটা এমন কী দোষের? তার জন্য সকালবেলা এতটা খারাপ ব্যবহার করার কোনও যুক্তি নেই।
অসীম বলল, তোমরা সিঁড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ করেছিলে? ভাস্কর বলল, আমরা কি পাখি যে উড়ে উড়ে দোতলায় যাব? অসীম, তোমার বাড়ির কাঠের সিঁড়িতেও রাত্তিরে আওয়াজ হয়।
অসীম বলল, এটা তো গ্রাম! এরা ঘুমোতে খুব ভালোবাসে। মৃণাল এমনিতে চুপচাপ থাকে। সে বলল, আপনারা কেউ পাথরের মূর্তিটা কিনতে চাইলেন না, তাই বোধহয় চটে গেছে।
ভাস্কর আবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, একটা ঝুটো পাথর, সেটার ওপর উকো দিয়ে ঘষে একটা মুখ ফুটিয়েছে, সেটাকে বলে কি না প্রি-হিস্টোরিকাল! গ্যাঁজা দেওয়ার আর জায়গা পায়নি। আবার পাঁচ হাজার ফ্রাঁ দাম চায়, সাধ কত! আর একটু হলে আমি লোকটাকে গাঁট্টা মারতাম!
আমি বললাম, কোনও জায়গায় এসে ঘর ভাড়া নিলেই যে সে বাড়ির পাথর কিনতে হবে, এ রকম নিশ্চয়ই শর্ত থাকতে পারে না!
ফরাসি চাষিদের পক্ষ সমর্থন করার আর কোনও যুক্তি খুঁজে না পেয়ে অসীম বলল, ঠিক আছে, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে, এবার ওসব বাদ দাও তো!
সেই সকালটাই আমাদের খারাপ কাটল। তখনও রাস্তার ধারের কাফে-রেস্তোরাঁগুলো খোলেনি বলে অনেকক্ষণ আমাদের সহ্য করতে হল চা-কফির তেষ্টা। তারপর অনেকখানি পথ উজিয়ে গিয়েও লাস্কোর বিশ্ববিখ্যাত গুহাচিত্রও আমাদের দেখা হল না।
সেখানে পৌঁছে দেখা গেল একটা লম্বা নোটিশ ঝুলছে। তার মর্ম এই যে, লাস্কোর প্রাগৈতিহাসিক গুহার দরজা সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাটির তলায় ওই সব মহা মূল্যবান ছবি বহু মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা। সেইজন্যই একমাত্র ইতিহাস, নৃতত্ব কিংবা শিল্পকলার গবেষক ছাড়া আর কারুকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। সেইসব গবেষকদেরও প্যারিস থেকে চিঠি আনতে হবে। তবে, একটু দূরেই একটা কৃত্রিম গুহা তৈরি করা হয়েছে, হুবহু ওই রকম, সেখানে একজন জাপানি মহিলা শিল্পী অবিকল সব গুহাচিত্র এঁকে রেখেছেন। টিকিট কেটে সেটা দেখা যেতে পারে!
অসীম সেটাই দেখতে চায়, কিন্তু ভাস্কর হাত-পা ছুঁড়ে বলল, অ্যাঁ? আসলেরও নকল? এখানে ভূমিমাল গছাবার চেষ্টা, তার জন্য আবার পয়সা দিতে হবে? হি হি হি, ফরাসি দেশটার হল কি! এত পয়সার খাঁই? ইংল্যন্ডে যাও, বড় বড় মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি সব ফ্রি! এসব দেখতে হবে না, চল!
অসীম বলল, তবু একবার দেখে যাই। খানিকটা আন্দাজ তো পাওয়া যাবে! ভাস্কর বলল, পয়সা খরচ করে আমি নকল জিনিস দেখব? কিছুতেই না। এর চেয়ে তো বইতে ছাপা ছবি দেখলেই হয়! আসল ব্যাপার তো গুহার ভেতরটার অ্যাটমোসফিয়ার!
আবার গাড়ির কাছে ফেরার সময় আমি চুপিচুপি অসীমকে জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার বলো তো, অসীম। তুমি ভাস্করের কাছে এত সহজে হার স্বীকার করলে? দ্বিতীয় গুহাটা না দেখেই চলে এলে?
অসীম মুচকি হেসে বলল, দ্বিতীয়টার কাছে গেলে দেখা যেত সেটাও বন্ধ। হঠাৎ আমার মনে পড়ল আজ সোমবার। এ দেশে প্রত্যেক সসামবার সমস্ত মিউজিয়াম কিংবা এই ধরনের ব্যাপার বন্ধ থাকে।
চাষি পরিবারের কাহিনি কিন্তু এখনও শেষ হয়নি।
এবারে আমরা যাব এক্স অঁ প্রভাঁস-এর দিকে। দক্ষিণ ফ্রান্সের এক্স শহরটির নাম শুনলেই আমার মনে পড়ে সাহিত্য ও শিল্প-জগতের দুই বিরাট ব্যক্তিত্বের কথা। এমিল জোলা এবং পল সেজান। এই দুজন ছিল স্কুলের বন্ধু এবং সারাজীবন বন্ধু থাকার অঙ্গীকার করেছিল। তখন কেউই জানত না, একজন হবে সাহিত্য জগতের মহারথী আর অন্যজন হবে শিল্পের এক বিস্ময়।
দু’জনকেই কৈশোর-যৌবনে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। জোলাকে দারিদ্র্য তাড়া করে ফিরেছে অনেকদিন, প্যারিসে এসে খবরের কাগজে ফিচার লিখে কোনওক্রমে গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ করতে হত। আর পল সেজান অবস্থাপন্ন বাড়ির সন্তান হলেও তাঁর বাবা ছিলেন স্বৈরাচারী, শক্ত হাতে ছেলের রাশ ধরে রেখেছিলেন। পিতার ইচ্ছে ছিল ছেলে হোক আইনজীবী, পারিবারিক ব্যাবসা দেখাশুনো করুক। আইন পড়া ছেড়ে সেজান যখন ছবি আঁকতে এক্স শহর ছেড়ে গেলেন প্যারিসে, তখন তাঁর বাবা অতি কম টাকা দিতেন। বাবার ভয়ে সেজান নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারেনি, তাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং প্রথম সন্তানের জন্মের পরও সে-খবর জানাননি বাড়িতে।
এই দুই প্রতিভার মধ্যে জোলা ছিলেন পরোপকারী ও বন্ধু-বৎসল, আর সেজান পাগলাটে, অতিশয় দুমুখ। ক্রমে ক্রমে জোলা ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান হলেন, আর্থিক অবস্থাও ফিরল, সমাজে প্রতিষ্ঠা হল। আর সেজানকে তখনও কেউ বড় শিল্পী হিসেবে গণ্য করে না, কামিল পিসাররা ছাড়া অন্য শিল্পীরা তাঁকে সহ্য করতেও পারে না। অথচ নিয়তির কৌতুক এই যে, পরবর্তীকালের সেজান এই দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য হয়েছেন। ইমপ্রেশানিস্টদের আন্দোলনের সময় তিনি কিছুদিন ছিলেন ইমপ্রেশনিস্ট, অথচ তখনই তাঁর মধ্যে পোস্ট-ইমপ্রেশানিজম-এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তিনি এক্সপ্রেশানিস্টদেরও পুরোধা এবং কিউবিস্টদেরও পূর্বপুরুষ।
আমি আর অসীম এই দুই লেখক ও শিল্পীর জীবন ও শিল্প নিয়ে টুকরো টুকরো কথা বলছিলাম। অসীম এক সময় জিগ্যেস করল, এদের এত গভীর বন্ধুত্বও কী করে নষ্ট হয়ে গেল, তা তুমি জানো সুনীল?
আমি বললাম, এমিল জোলার ‘দা মাস্টারপিস’ উপন্যাসটা উপলক্ষ করে তো?
এটা একটা ট্রাজেডি। উপন্যাসের বিষয়বস্তু খুঁজতে-খুঁজতে এমিল জোলা শেষ পর্যন্ত তাঁর বন্ধদের জীবনকাহিনি অবলম্বন করলেন শুধ না, বন্ধুদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেও ছাড়লেন না। উপন্যাসটিও তেমন কিছু উচ্চাঙ্গের হয়নি। ‘দা মাস্টারপিস’ উপন্যাসে জোলা তাঁর সমসাময়িক শিল্পীগোষ্ঠীর কথা লিখলেন, যে ইমপ্রেশানিস্টদের একসময় প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি, এখন দেখা গেল এঁদের শিল্পীরীতি সম্পর্কে তাঁর তেমন উচ্চ ধারণা নেই। প্রধান চরিত্রটি, যে শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করল, সেটি তাঁর প্রাণের বন্ধু পল সেজান-এর আদলে গড়া।
এমিল জোলার এই উপন্যাসটি তাঁর শিল্পী বন্ধুরা কেউই পছন্দ করেনি। এক কপি উপহার পাওয়ার পর পল সেজান অত্যন্ত নীরস ভদ্রভাষায় এবং ভাববাচ্যে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি লেখককে ধন্যবাদ জানাই। পুরোনো দিনের স্মৃতিতে আমি তাঁর করমর্দনের অনুমতি প্রার্থনা করি।’
এরপর সেজান বাকি জীবনে আর কখনও জোলাকে কোনও চিঠি লেখেননি। কোনও যোগাযোগও রাখেননি!
গল্প করতে-করতে আমরা প্রায় দেড়শো কিলোমিটার চলে এসেছি, ভাস্কর একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছিল, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, এই রে, আমার শাল! অসীম গাড়ি থামাও!
অসীম ব্রেকে পা দিয়ে বলল, শাল মানে?
ভাস্কর বলল, আমার কাশ্মীরী শাল! দেশ থেকে আনা।
আমার সঙ্গে একবার বেলজিয়ামে বেড়াবার সময় ভাস্কর ওর দামি ক্যামেরা হারিয়েছিল। আর একবার লন্ডনে আমার সামনেই ওর পার্স পকেটমার হয়। ক্যামেরা, পার্স ইত্যাদি ও যেখানে-সেখানে ফেলে রাখে, জিনিসপত্র হারাবার দিকে ভাস্করের বেশ ঝোঁক আছে। চাষির বাড়িতে হুড়োহুড়ি করে ব্যাগ গোছাবার সময় ও কাশ্মীরি শালটা ভরে নিতে ভুলে গেছে। তা ছাড়া তখন মেজাজও বেশ খারাপ ছিল!
গাড়ি থামিয়ে সব ব্যাগ খুঁজে দেখা গেল সত্যিই শালটা আনা হয়নি। অথচ গতকাল রাতে ভাস্কর শালটা জড়িয়ে বসেছিল, আমরা সবাই দেখেছি। শালটার দাম যতই হোক, তার চেয়ে বড় কথা, শালটা ভাস্করকে ওর মা দিয়েছেন, সেটা হারাবার কোনও মানে হয় না!
আবার অতখানি রাস্তা ফিরে যেতে হলে আজকের সারাদিনটাই নষ্ট হবে। অথচ কীই বা করা যায়, যেতে তো হবেই। ভাস্কর নিজে অবশ্য বলল, আবার ওই গোমড়ামুখো মেয়েছেলেটির কাছে ফিরে যেত হবে? দূর ছাই, দরকার নেই, চলো চলো! ও ব্যাটারাই শালটা গায়ে দিক!
অসীম বলল, একটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। চাষিদের বাড়িতে চিঠি লিখব, ওরা যেন শালটা ডাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
ভাস্কর বলল, ওদের ঠিকানা তো আনিনি? আন্দাজে কোথায় চিঠি লিখব?
অসীম বলল, মহিলাটি আমাকে একটা রিসিট দিয়েছে। তাতে নাম-ঠিকানা সব আছে।
আমি জিগ্যেস করলাম, চিঠি পেলেই ওরা ফেরত পাঠাবে? নিজেরা ডাক খরচ করে?
অসীম বলল, ডাক খরচ পরে পাঠিয়ে দেব। কিংবা ওরা ভি পি করে পাঠাতে পারে, আমরা ছাড়িয়ে নেব। হ্যাঁ, সেই ভালো, ভি পি-তে পাঠাবার জন্যই অনুরোধ জানাব।
এরপরেই রাস্তায় যে পোস্ট-অফিসটি পড়ল, সেখান থেকে লেখা হল চিঠি।
সেই চাষি পরিবারটিকে আজও আমরা মনে রেখেছি, তাদের প্রতি একটুও বিরূপ ভাব নেই, বরং পুরো ঘটনাটাই একটা মজার স্মৃতি হয়ে আছে এই জন্য যে, যথা সময়ে সেই শালটিকে কেচে, ভালোভাবে প্যাক করে তারা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল।