সপ্তচত্বারিংশ অধ্যায়
জরৎকারুর পত্নীপরিত্যাগ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, নাগরাজ বাসুকি জরৎকারুকে কহিলেন, “হে তপোধন! আমার এই ভগিনী আপনার সনাম্নী এবং ইনি তপঃপরায়ণা! আপনি ইঁহার পাণিগ্রহণ করুন। আমি ইঁহাকে আপনার সহধর্ম্মীণী করিয়া দিন বলিয়াই এতাবৎকাল পর্য্যন্ত অভিলাষ করিয়া আছি। আর অঙ্গীকার করিতেছি, আমি সাধ্যানুসারে ইঁহার ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করিব।” ঋষি কহিলেন, “তবে এই নিশ্চয় হইল যে, আমি কদাচ ইঁহার ভরণপোষণ করিব না এবং ইনিও আমার কোন অপ্রিয় আচরণ করিবেন না, যদি করেন, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ পরিত্যাগ করিব।”
বাসুকি ভগিনীর ভরণপোষণের ভারগ্রহণ করিলে মহাতপা জরৎকারু তাঁহার বাসভবনে গমন করিয়া যথাবিধানে তদীয় ভগিনীর পাণিপীড়ন [পাণিগ্রহণ-বিবাহ] করিলেন। বিবাহকালে মহর্ষিগণ তাঁহাকে স্তব করিতে লাগিলেন। অনন্তর জরৎকারু ভার্য্যা সমভিব্যাহারে ভুজঙ্গরাজের রমণীয় অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্ব্বক সুচারু আস্তরণ-পটে আচ্ছাদিত [প্রচ্ছদ-বাস-ওয়াড় দ্বারা আবৃত] বিচিত্র শয্যায় শয়ন করিলেন। পরে ভার্য্যার সহিত এইরূপ নিয়ম করিলেন যে, “তুমি কদাচ আমার অপ্রিয় আচরণ করিবে না, অপ্রিয় কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে আমি তদ্দণ্ডেই তোমাকে পরিত্যাগ করিব ও ত্বদীয় বাসগৃহে আর ক্ষণমাত্রও অবস্থিতি করিব না। দেখিও, যাহা কহিলাম, যেন কদাপি ইহার অন্যথা না হয়।” পিতৃকুলহিতৈষিণী নাগরাজভগিনী অতিমাত্র দুঃখিত ও উদ্বিগ্নচিত্তে অগত্যা ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বামিবাক্যে অঙ্গীকার করিলেন এবং অতি সতর্কমনে ভর্ত্তৃশুশ্রূষা করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎকাল পরে ভুজঙ্গরাজভগিনী ঋতুস্নাতা হইয়া যথাবিধি স্বামিসেবায় নিযুক্ত হইলেন। মহর্ষির সহযোগে তাঁহার গর্ভসঞ্চার হইল। ঐ গর্ভ শুক্লপক্ষীয় শশিকলার ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। একদা মহাযশা জরৎকারু একান্ত ক্লান্ত হইয়া প্রিয়তমার অঙ্কশয্যায় শিরোনিবেশ [ক্রোড়ে-কপলে মাথা রাখিয়া] পূর্ব্বক শায়িত ও নিদ্রিত হইলেন। দ্বিজেন্দ্র নিদ্রাক্রান্ত হইলে দিনমণি অস্তাচলে গমন করিলেন। মনর্স্বিনী নাগভগিনী সায়ংকাল উপস্থিত দেখিয়া স্বামীর তৎকালোচিত সন্ধ্যা-বন্দনাদি ক্রিয়ালোপের আশঙ্কায় চিন্তা করিলেন, “সম্প্রতি আমার কি কর্ত্তব্য, ভর্ত্তার নিদ্রাভঙ্গ করি কি না? ইনি অতি কোপনস্বভাব, নিদ্রাভঙ্গ করিলে নিশ্চয়ই কোপ করিবেন; কিন্তু জাগরিত না করিলেও নিত্যক্রিয়ার ব্যতিক্রম ঘটে; অতএব এক্ষণে কি করা উচিত? ফলতঃ কোপ ও ধর্ম্মশীল ব্যক্তির ধর্ম্মলোপ এই দুইয়ের মধ্যে ধর্ম্মলোপই নিতান্ত দূষণাবহ; অতএব যাহাতে ব্রাহ্মণের ধর্ম্মরক্ষা হয়, তাহাই করা কর্ত্তব্য।”এইরূপ নিশ্চয় করিয়া মধুরভাষিণী বাসুকি-ভগিনী জ্বলন্ত-হুতাশনসন্নিভ তেজঃপুঞ্জাকৃতি সুখপ্রসুপ্ত মহাতপা জরৎকারুকে সম্বোধন করিয়া অতি বিনীত-বচনে কহিলেন, “মহাভাগ! সূর্য্যদেব অস্তাচল শিখরদেশে আরোহণ করিয়াছেন। সন্ধ্যাতিমির [সন্ধ্যার অন্ধকার] পশ্চিমদি্ক অল্প অল্প আচ্ছন্ন করিতেছে। গাত্রোত্থান করিয়া সন্ধ্যোপাসনা করুন, অগ্নিহোত্রের সময় উপস্থিত।” ভগবান্ জরৎকারু জাগরিত হইয়া ওষ্ঠাধর পরিস্ফুরণপূর্ব্বক রোষভরে কহিলেন, “হে ভুজঙ্গমে! তুমি আমার অবমাননা করিলে, অতএব আমি আর তোমার নিকট অবস্থিতি করিব না, যথাস্থানে গমন করিব। হে বামোরু! আমার এরূপ দৃঢ়-নিশ্চয় আছে, আমি নিদ্রিতাবস্থায় থাকিলে সূর্য্যের সাধ্য কি যে, তিনি যথাকালে অস্তগত হন? অপমানিত হইলে সামান্য লোকেও তথায় বাস করে না, আমার বা মাদৃশ ধর্ম্মশীল ব্যক্তির কথা কি বলিব?”
তদীয় এতাদৃশ নির্দ্দয়-বাক্য শ্রবণে বাসুকি-ভগিনী কহিলেন, “ভগবান্! ধর্ম্মলোপের আশঙ্কায় আমি আপনার নিদ্রাভঙ্গ করিয়াছি, অপমানের উদ্দেশ্যে করি নাই।” তখন জরৎকারু ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভার্য্যা-পরিত্যাগ-বাসনায় বলিলেন, “হে ভুজঙ্গমে! আমার কথা মিথ্যা হইবার নহে, আমি অদ্যই এ স্থান হইতে প্রস্থান কবির। আমি ত’ পূর্ব্বেই তোমার সহিত এইরূপ নিয়ম করিয়া-ছিলাম ; অতএব হে ভদ্রে! এতদিন তোমার নিকট পরমসুখে ছিলাম, এক্ষণে চলিলাম। আমি গমন করিলে তোমার ভ্রাতাকে বলিও, সেই মুনি গমন করিয়াছেন এবং তুমিও মদীয় অদর্শনে শোকাভিভূত হইও না।”
তাঁহার এই দারুণ কথা শুনিয়া নাগ-স্বসা [সর্পভগিনী] জরৎকারুর মুখ শুষ্ক হইল ও হৃদয় কম্পিত হইতে লাগিল। পরিশেষে তিনি ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক বাষ্পাকুললোচনে ও গদগদ বচনে কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, “হে ধর্ম্মজ্ঞ! বিনা অপরাধে আমাকে পরিত্যাগ করিও না, আমি কখন অধর্ম্মাচরণ করি নাই এবং প্রাণপণে আপনার প্রিয়কার্য্য ও হিতানুষ্ঠান করিয়া থাকি। ভ্রাতা যে অভিসন্ধি করিয়া আপনার হস্তে আমাকে সম্প্রদান করিয়াছেন, দুরদৃষ্টক্রমে আমি অদ্যাপিও তাহা প্রাপ্ত হইলাম না। তিনিই বা আমাকে কি বলিবেন? আমার জ্ঞাতিবর্গ মাতৃশাপে অভিভূত আছেন; আপনার ঔরসে আমার গর্ভে একটি পুৎত্র জন্মিবে এবং ঐ পুৎত্র হইতে তাঁহাদিগের শাপমোচন হইবে, এই তাঁহাদিগের অভিপ্রেত। কৈ, তাহারও ত’ কোন বিশেষ চিহ্ন দেখিতে পাইতেছি না; অতএব এক্ষণে যাহাতে তাঁহাদিগের ঐ মনোরথ নিষ্ফল না হয়, তাহা সম্পাদন করুন। হে ভগবান্! আমি জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছি, আমার প্রতি প্রসন্ন হউন, এই অপরিস্ফুট গর্ভাধান [যে গর্ভ প্রকাশ পাব নাই এইরূপ] পূর্ব্বক বিনা-অপরাধে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গমন করিবেন?” মহর্ষি জরৎকারু সহধর্ম্মিণীর এইরূপ বাক্য শুনিয়া তৎকালোপযুক্ত অনুরূপ বচনে কহিলেন, “হে সুভগে! তোমার গর্ভে পরম-ধার্ম্মিক, বেদ-বেদাঙ্গপারগ, অগ্নিকল্প এক ঋষি জন্মিবেন।” এই বলিয়া অতি কঠোর তপশ্চরণে কৃতনিশ্চয় হইয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।