২৯তম অধ্যায়
ভগদত্ত-শরে অর্জ্জুনের কীরিট স্খলন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয়! মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রোধান্বিত হইয়া ভগদত্তের কি করিলেন, আর ভগদত্তই বা তাঁহার কি করিয়াছিলেন? যথার্থ কীৰ্ত্তন কর।
সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেব ভগদত্তের সমীপে গমন করিলে তত্ৰত্য সমুদায় লোকই তাহা দিগকে যমের দশন সন্নিহিত বলিয়া বোধ করিলেন। মহাবীর ভগদত্ত গজস্কন্ধ হইতে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের উপর অনবরত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন এবং স্বীয় কাৰ্ম্মুক আকর্ণ আকর্ষণ করিয়া হেমপুঙ্খ শিলানিশিত কৃষ্ণায়স বিনির্ম্মিত শরনিকরে দেবকীনন্দনকে বিদ্ধ করিলেন। ভগদত্তনিক্ষিপ্ত অগ্নিস্পর্শ শরনিকর দেবকীতনয়কে বিদ্ধ করিয়া ভূতলে প্রবেশ করিল। তখন মহাবীর অর্জ্জুন ভগদত্তের শরাসন ছেদন ও রথ রক্ষককে বিনাশ করিয়া তাঁহার সহিত ক্রীড়া করতই যেন সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। রণবিশারদ ভগদত্ত অর্জ্জুনের প্রতি চতুর্দ্দশ সুতীক্ষ্ণ তোমর নিক্ষেপ করিলে লঘুহস্ত সব্যসাচী ভগদত্ত নিক্ষিপ্ত প্রত্যেক তোমর তিন তিন খণ্ডে ছেদন করিয়া সুতীক্ষ্ণ শরনিকর দ্বারা তাঁহার হস্তীর বৰ্ম্ম ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সেই মহাগজ অর্জ্জুনের সায়ক জালে ছিন্নবর্ম্মা ও একান্ত ব্যথিত হইয়া বারিধারাসিক্ত মেঘবিহীন পর্ব্বতরাজের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তখন মহাবীর প্রাগেজ্যোতিষেশ্বর কৃষ্ণের উপর লৌহময় হেমদণ্ড মণ্ডিত শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। সমরবিশারদ অর্জ্জুন তৎক্ষণাৎ উহা দুই খণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং তৎপরে ভগদত্তের ছত্র ও ধ্বজ ছেদন করিয়া তাঁহাকে দশ শরে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর ভগদত্ত অর্জ্জুনের কঙ্কপত্ৰযুক্ত নিশিত শরনিকরে দৃঢ় বিদ্ধ হইয়া একান্ত ক্রুদ্ধ চিত্তে তাঁহার মস্তকে অসংখ্য তোমর নিক্ষেপ করত উচ্চস্বরে চীৎকার করিতে লাগিলেন। ভগদত্ত নিক্ষিপ্ত শরনিকরে অর্জ্জুনের কিরীট পরিবর্ত্তিত হইল। মহাবীর অর্জ্জুন সেই পরিবর্ত্তিত কিরীট যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়া ভগদত্তকে কহিলেন, প্রাগেজ্যাতিষেশ্বর! এই সময় সকলকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া লও।
কৃষ্ণ কর্ত্তৃক ভগদত্তনিক্ষিপ্ত বৈষ্ণবাস্ত্র সংবরণ
মহাবীর ভগদত্ত অর্জ্জুনের বাক্যে যৎপরোনান্তি ক্রুদ্ধ হইয়া অতি ভীষণ শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার ও কৃষ্ণের উপর অনবরত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন সমরবিশারদ ধনঞ্জয় সত্বরে ভগদত্তের শরাসন ও তূণীর ছেদন করিয়া দ্বিসপ্ততি শরে তাঁহার সমুদায় মৰ্ম্ম স্থানে আঘাত করিলেন। মহাবীর ভগদত্ত অর্জ্জুনের শরনিকরে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া ক্রোধভরে বৈষ্ণব অঙ্কুশ অস্ত্র অভিমন্ত্রণ পূর্ব্বক অর্জ্জুনের বক্ষস্থলে নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাত্মা মধুসূদন পার্থকে আচ্ছাদন করিয়া স্বয়ং সেই ভগদত্ত নিক্ষিপ্ত সর্ব্বঘাতী বৈষ্ণবাস্ত্ৰ বক্ষস্থলে গ্রহণ করিলেন অস্ত্র কৃষ্ণের বক্ষস্থলে বৈজয়ন্তী মালা হইয়া অবস্থান করিতে লাগিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় নিতান্ত ক্লিষ্ট চিত্তে কৃষ্ণকে কহিলেন, হে মধুসূদন! তুমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে যুদ্ধ করিবে না; কেবল আমার অশ্ব সংযমন করিবে; এক্ষণে সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিলে না। যদি আমি ব্যসনাপন্ন বা অরাতি নিবারণে অশক্ত হই, তাহা হইলে যুদ্ধ করা তোমার কর্ত্তব্য। আমি বর্ত্তমান থাকিতে সমর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা তোমার কদাপি কর্ত্তব্য নয়। আমি যে ধনুর্ব্বাণ ধারণ করিয়া সুর, অসুর ও মানবগণ সমবেত সমুদায় লোক পরাজয় করিতে পারি, তাহা তোমার অবিদিত নাই।
কৃষ্ণের গুপ্ত আত্ম-পরিচয়
তখন মহাত্মা মধুসূদন ধনঞ্জয়কে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, হে পার্থ! আমি অতি গুহ্য পুরাবৃত্ত কহিতেছি, শ্রবণ কর। আমি লোকের হিতসাধন ও পরিত্রাণের নিমিত্ত আপনার মূর্ত্তি চারি অংশে বিভক্ত করিয়াছি। আমার এক মূর্ত্তি ভূমণ্ডলে তপশ্চরণ, দ্বিতীয় মূর্ত্তি জগতের সাধু ও অসাধু কর্ম্ম অবলোকন, তৃতীয় মূর্ত্তি মৰ্ত্তলোক আশ্রয় পূর্ব্বক মানুষ কর্ম্ম সাধন ও চতুর্থ মূর্ত্তি শয়ন করিয়া সহস্র বর্ষব্যাপী নিদ্রা সুখ অনুভব করিতেছে। ঐ চতুর্থ মূর্ত্তি সহস্র বৎসরের পর সমুত্থিত হইয়া বরার্হ ব্যক্তিগণকে অত্যুৎকৃষ্ট বর প্রদান করে। ঐ সময় পৃথিবী আমার বর প্রদান কাল জানিয়া স্বীয় পুত্র নরকের নিমিত্ত আমার নিকট যে বর প্রার্থনা করিয়াছিল, শ্রবণ কর; পৃথিবী কহিল, হে নারায়ণ! তোমার বরে আমার পুত্র বৈষ্ণবাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়া দেব ও অসুরগণের অবধ্য হউক। আমি কহিলাম, হে বসুন্ধরে! এই বৈষ্ণবাস্তু নরকের রক্ষার্থ অমোঘ হউক; ইহার প্রভাবে নরককে কেহই বিনাশ করিতে সমর্থ হইবে না। তোমার পুত্র এই অস্ত্র কর্ত্তৃক সংরক্ষিত হইয়া সর্ব্বলোকের দুধর্ষ ও পরবল মর্দ্দনক্ষম হইবে। পৃথিবী এইরূপে আমার নিকট কৃতকার্য্য হইয়া তথাস্তু বলিয়া গমন করিলেন। নরকারও তদবধি দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠিল। মহাবীর প্রাগেজ্যাতিষেশ্বর নরকের নিকট হইতে সেই অস্ত্র প্রাপ্ত হন। ত্রিলোকমধ্যে ইন্দ্র রুদ্র প্রভৃতি কেহই ঐ অস্ত্রের অবধ্য নন। এই নিমিত্ত আমি স্বীয় প্রতিজ্ঞার অন্যথা করিয়া স্বয়ং অস্ত্র বেগ ধারণ করিলাম। দেবদ্বেষী মহাসুর ভগদত্ত এক্ষণে সেই পরমাস্ত্র বিহীন হইয়াছে; অতএব যেমন আমি লোক হিতার্থ নরকাসুরকে বিনষ্ট করিয়াছিলাম, তদ্রূপ তুমি ঐ দুর্দ্ধর্ষ বৈরীরে বিনষ্ট কর।
হস্তিবাহনসহ ভগদত্ত বধ
মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেব কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সহসা ভগদত্তের উপর নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। অনন্তর অসম্ভ্রান্ত চিত্তে ভগদত্তের হস্তীর কুম্ভান্তরে নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। সর্প যেমন বল্মীকের মধ্যে গমন করে, তদ্রূপ অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত বজ্রসম সেই নারাচ করিকুম্ভ মধ্যে প্রবেশ করিল। ভগদত্ত বারংবার হস্তীকে চালন করিতে লাগিলেন, কিন্তু দরিদ্রের ভাৰ্য্যা যেমন স্বামীর বাক্যে কর্ণ পাত করে না, তদ্রূপ গজরাজ প্রাগজ্যোতিষেশ্বরের বাক্য শ্রবণ করিল না। কিয়ৎক্ষণ মধ্যেই করিবর স্তব্ধগাত্র ও দন্ত দ্বারা অবনিতলগত হইয়া আর্ত্তস্বরে চীৎকার করত প্রাণ পরিত্যাগ করিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় অর্দ্ধচন্দ্র বাণে ভগদত্তের হৃদয় ভেদ করিলেন। মহাবীর ভগদত্ত অর্জ্জুন শরে ভিন্নহৃদয় হইয়া শর ও শরাসন পরিত্যাগ পূর্ব্বক পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। যেমন সন্তাড়িত পদ্মনাল হইতে পত্র নিপতিত হয়, তদ্রূপ ভগদত্তের মস্তক হইতে মহার্ঘ বস্ত্র ধরাতলে নিপতিত হইল। যেমন সুপুষ্পিত কণিকার বৃক্ষ বায়ুবেগে ভগ্ন হইয়া পর্ব্বতাগ্র হইতে নিপতিত হয়, তদ্রূপ হেমমালা ভূষিত ভগদত্ত স্বর্ণ ভূষণ ভূষিত হস্তী হইতে ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ইন্দ্র তুল্য পরাক্রম ইন্দ্রের সখা মহাবাহু ভগদত্তকে নিহত করিয়া, বলবান্ বায়ু যেমন বৃক্ষ সমুদায় ভগ্ন করে, তদ্রূপ কৌরব পক্ষীয় বীরগণকে নিহত করিতে লাগিলেন।”