৩৩. সকালের চা

‘সব সময় তোমাকে অবশ্যই মাতাল হতে হবে।
সবকিছুই তো রয়েছে . : এটাই একমাত্র প্রশ্ন। সময়ের
বীভৎস বোঝা যাতে অনুভব করতে না হয়, যা
তোমার কাঁধ খুঁড়িয়ে দিচ্ছে, নুইয়ে দিচ্ছে মাটির
দিকে, তোমাকে মাতাল হতেই হবে, একটুও থামালে
চলবে না।
কীসে মাতাল হবে, সুরা কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা
তোমার পছন্দ। কিন্তু মাতাল হও।
এবং যদি কোনও সময়ে, কোনও প্রাসাদের সিঁড়িতে,
কোনও খানা-খন্দের সবুজ ঘাসের মধ্যে, অথবা
তোমার নিজেরই ঘরের নিরানন্দ নির্জতায় তুমি
জেগে ওঠো, তোমার নেশা যখন কমতে শুরু করেছে
অথবা কেটেই গেছে, জিগ্যেস করো বাতাসকে, ঢেউ,
নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি এমন সব কিছুকে, যারা ওড়ে,
গুঞ্জন করে, গড়ায়, গান গায়, কথা বলে, তাদের
জিগ্যেস করো, এখন কীসের সময়, তখন সেই
বাতাস, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি তোমাকে উত্তর
দেবে : ‘এখন মাতাল হওয়ার সময়! সময়ের
নিপীড়িত ক্রীতদাস হওয়ার বদলে মাতাল হও, একটুও
না থেমে! সুরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা তোমার
পছন্দ।’
–শার্ল বোদলেয়ার

এবারের যাত্রায় আমরা বাদলের ওপর একটা ব্যাপারে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। সকালের চা। বাদলের বুদ্ধিতে আমাদের সকালটা বেশ অলস বিলাসিতায় কাটে। এর আগের হোটেলগুলিতে চায়ের জন্য বেশ কষ্ট পেয়েছি। এইসব হোটেল রুম সার্ভিস থাকে না। আমাদের বাঙালি অভ্যেসে দাঁত মাজার আগে চা চাই।

বাদল প্রত্যেক বছর ফ্রাংকফুর্টের বিশ্ব বইমেলায় আসে। থাকে কোনও প্রাইভেট গেস্ট হাউসে। একা থাকতে হয় বলে ঘরে বসে নিজের চা বানিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে নেয়। সব জায়গাতেই সস্তায় ইমারসান হিটার পাওয়া যায়, প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে যেটা জলে ডুবিয়ে রাখলে তিনি চার মিনিটে জল গরম হয়ে যায়। এক রকম বিশেষ কাঁচের গেলাসও পাওয়া যায়, ফুটন্ত জলেও যেটা ফাটে না। এ সব দেশের বাথরুমে কল খুললেই গরম জল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা কখনও তেমন গরম হয় না, যাতে চা বানানো যায়। সুতরাং এই ব্যবস্থাই উত্তম। ঠিক মতন গরম জল পেলে, চা-চিনি-কন্ডন্সেড মিল্ক তো কিনে রাখাই যায়। এবং নানারকম বিস্কুট, মাখন, জ্যাম-জেলি।

যেহেতু হোটেলের ঘরের মধ্যেই নিজস্ব চা বানাবার পরিকল্পনা এবং জিনিসপত্রগুলো বাদলের, তাই পুরো দায়িত্বটাই বাদলের। আমরা শুয়ে শুয়ে আলস্য করি, বাদল গেলাসের পর গেলাস চা বানিয়ে যায়। এ যাত্রায় কুমকুম বা স্বাতী নেই। কুমকুম উপস্থিত থাকলে তার স্বামীর এই অদ্ভুত করিৎকর্মা রূপটি দেখলে নিশ্চয়ই স্তম্ভিত হয়ে যেত। অধিকাংশ বাঙালি পরিবারের কারা বাড়িতে এক গেলাস জলও গড়িয়ে খায় না। অসীম বহুদিন এ দেশে আছে, তাই তার মধ্যে সাহেবি গুণ অনেকটা বর্তেছে, সবাই কাজ ভাগাভাগি করে করছে না দেখে সে আমাদের ধমকায় এবং বাদলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ভাস্করও বিলেতে সিকি শতাব্দী কাটিয়ে দিল, কিন্তু তার অতিরিক্ত সেবাপরায়ণা স্ত্রী তার স্বভাবটি বাঙালি করেই রেখেছে। অসীমের ধমক খেয়ে ভাস্কর বিস্কুটে মাখন-জ্যাম মাখাবার কাজটা নেয়। আমার জন্য আর কোনওই কাজ বাকি রইল না, সুতরাং গেলাসের পর গেলাস চা পান করাটাই আমার একমাত্র কাজ। আমাদের কাপ নেই, সুতরাং হোটেলের গেলাসেই চা তৈরি হয়। একেবারে শেষে, চক্ষুলজ্জার খাতিরে আমি গেলাসগুলি ধুয়ে দি।

স্নান-টান করে ফিটফাট হয়ে আমরা বেরোলাম শামবর দুর্গ-প্রাসাদ দেখতে। ভেতরে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয় এবং টিকিটের দাম বেশ গায়ে লাগবার মতন। ধরা যাক, মাথা পিছু তিরিশ টাকা। আমাদের দেশের তুলনায় খুবই বেশি। কিন্তু টিকিটের দাম এত বেশি রাখার একটা যুক্তি আছে। সেই টাকায় রক্ষণাবেক্ষণ হয়। এত বড় একটা অট্টালিকার ভেতরটা একেবারে ঝকঝকে তকতকে। কেথাও একবিন্দু ময়লা নেই, কোনও দেওয়ালে দাগ নেই, কোনও জিনিসই ছেঁড়া ফাটা নয়। আমাদের দেশেও অনেক ভালো ভালো সৌধ বা সেতু তৈরি হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলোর যাচ্ছেতাই চেহারা হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণেশ্বরের কাছে বালি ব্রিজের কথা মনে পড়ছে। এক কালে এই সেতুটি ছিল অতি সুদর্শন, দূর দূর থেকে লোকে ওখানে বেড়াতে যেত, তখন ব্রিজের দু’ধারে টোল নেওয়া হত। এখন টোল বন্ধ হয়ে গেছে, ব্রিজটার দু’পাশের হাঁটাপথের অতি জরাজীর্ণ অবস্থা, বড় বড় গর্ত, যখন তখন মানুষের পা ভাঙতে পারে! টোল বন্ধ করতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল। হাওড়া ব্রিজের গর্ত দিয়ে একটা লোক গঙ্গায় পড়ে মরেই গেল। বালিগঞ্জ স্টেশানের কাছে বিজন সেতুটি তৈরি হল এই সেদিন। এখন দেখলে মনে হয় মহেঞ্জোদারোর আমলে। মুর্শিদাবাদের নবাববাড়ি হাজার দুয়ারির বয়েস মাত্র শ দেড়েক, কিন্তু এরই মধ্যে কী দৈন্য দশা! দর্শকদের কাছ থেকে বেশি করে দর্শনী নিয়ে কেন সেটাকে অবিকৃত রাখা যাবে না?

শামবর প্রাসাদপুরীর ভেতরের সবটা বর্ণনা দেওয়ার দরকার নেই। মোট চারশোটা ঘরের বর্ণনা লিখতে গেলে আমার তো বটেই, পাঠকদেরও মাথা খারাপ হয়ে যাবে। অতগুলো ঘর সব আমরা দেখিওনি। রক্ষীদের ঘর, অস্ত্রশস্ত্রের ঘর, সভাকক্ষ, পাঠাগার, জলখাবারের ঘর, দুপুরের খাবারের ঘর, বিকেলের হালকা খাবারের ঘর, রাত্তিরের ভোজশালা, এ ছাড়া অমুক রাজা আর অমুক রানির শয়ন কক্ষ, নানাভাবে সাজানো হলেও শেষ পর্যন্ত একঘেয়ে লাগে। এত বড় বাড়িতে রাজা-রানিদের খুব হাঁটতে হত বটে!

একটা ঘরের নাম দেখা গেল, ভারত কক্ষ! কেন যে ভারতের নাম সে ঘরের সঙ্গে যুক্ত তা বোঝা গেল না। তবে দেওয়ালের কারুকার্যের সঙ্গে ভারতীয় কল্কার কাজের মিল আছে খানিকটা। ভারত সম্পর্কে ফরাসি দেশে নানা রকম ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল। যে কালো কালিকে আমরা বলি চাইনিজ ইংক, তাকে ওরা বলে ভারতীয় কালি। এক ধরনের লণ্ঠনকে ওরা বলে ‘বাংলা-আলো’, সেরকম লণ্ঠন বাংলাদেশে কোথাও নেই। মালার্মের কবিতায় ‘বেঙ্গলি’ নামে যে পাখির উল্লেখ আছে, সে পাখিটা কী পাখি কে জানে! ভারতের সমস্ত অধিবাসীদের তারা আজও বলে হিন্দু, তারা কি মুসলমানের অস্তিত্ব জানে না?

এই অট্টালিকার বিশেষ উল্লেখযোগ্য এর এক জোড়া সিঁড়ি। এত বড় বাড়িতে মোট সতেরোটা সিঁড়ি আছে, তার মধ্যে দু’খানা সিঁড়ি অতি অভিনব। মুখোমুখি এই সিঁড়ি। কিন্তু এমনই অপূর্ব কৌশলে তৈরি যে, একটা দিয়ে উঠতে শুরু করলে বোঝাই যায় না যে পাশ দিয়ে আর একটা সিঁড়ি উঠেছে, এবং অন্য সিঁড়ির লোকদেরও দেখা যাবে না। কোনও এক সময় এই প্রাসাদের মালিক হয়েছিল অরলিয়েন্সের সামন্ত গাসতোঁ। লোকটা সুবিধের ছিল না, অনেক ষড়যন্ত্র-টন্ত্র করেছে জীবনে, কিন্তু পিতা হিসেবে সে ছিল খুব স্নেহপ্রবণ। সেই গাসতোঁ এই যুগ্ম সিঁড়িতে তার ছোট মেয়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলত।

সেই ছোট মেয়েটির পরে নাম হয়েছিল ‘লা গ্রাঁদ মাদমোয়াজেল’। এই প্রাসাদের সঙ্গে তার প্রণয়কাহিনিও জড়িত। লোজুন-এর ডিউক যখন এখানে বেড়াতে আসে, তাকে দেখে সেই যুবতী মুগ্ধ হয়। কিন্তু তাকে সে নিজের মনের কথা জানাতে পারেনি। এক দিন সে সেই রূপবান তরুণ ডিউককে এই সিঁড়ি দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে একটা বড় আয়নার ওপর নিঃশ্বাস ফেলে-ফেলে যে বাষ্পচ্ছায়া হয়, তার ওপর আঙুল দিয়ে সে ডিউকের নাম লিখে দেয়।

এই প্রাসাদটি ছিল রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া’র স্বপ্ন। ফরাসি দেশে তাঁর অনেক কীর্তি এখনও জাজ্বল্যমান হয়ে আছে। কিন্তু কিছু একটা গভীর দুঃখ ছিল তাঁর মনে। এই বিশাল ব্যয়বহুল হটির অনেকখানিই নির্মিত হয়েছিল তাঁর সময়ে, তবু তিনি থাকতেন একটি সাধারণ ঘরে। সেই ঘরের একটা জানলার কাছে তিনি এক দিন আপনমনে লিখেছিলেন, ‘নারী যখন তখন বদলায়। যে ব্যক্তি কোনও নারীকে বিশ্বাস করে, সে নির্বোধ!

হাত বদল হতে-হতে এই অট্টালিকাটি এক সময় রাজা চতুর্দশ লুই-এর অধিকারে আসে। প্যারিস ছেড়ে রাজা চতুর্দশ লুই প্রায়ই এই শামবর-এ থাকতে আসতেন। তিনি ছিলেন সঙ্গীত ও নাট্যপ্রেমী। এখানে তিনি নাট্য দল ডাকতেন। একবার এসেছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার মলিয়ের তাঁর দল নিয়ে।

মলিয়ের-এর নাম শুনলেই অধিকাংশ পাঠকের মনে পড়ে একটিই ছবি, এই সেই নাট্যকার ও অভিনেতা, যিনি নিজের লেখা নাটকে একটি অসুস্থ ব্যক্তির ভূমিকায় অভিনয় করতে-করতে হঠাৎ সত্যিকারের অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং সে রাত্রেই মারা যান। কিন্তু এটাই মলিয়ের-এর প্রতিভা সম্পর্কে শেষ কথা নয়। বরং বলা যায়, এটা একটা অতিরঞ্জিত গুজব। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মলিয়ের-এর স্বাস্থ্য আগেই ভেঙে পড়েছিল, তবু তিনি মঞ্চে নেমেছিলেন। হঠাৎ মঞ্চের মধ্যে পড়ে যেতে দেখে দর্শকরা মনে করে তিনি বুঝি অভিনয়ের ঘোরের মধ্যে মঞ্চের মায়াকে বাস্তব করে ফেলেছেন। বস্তুত মলিয়ের-এর প্রতিভা ছিল এর চেয়ে অনেক বড়। তিনি আধুনিক ট্র্যাজি-কমেডির জনক। চার্লি চ্যাপলিনের পূর্বপুরুষ।

সঠিক অর্থে মলিয়ের নাট্যকার ছিলেন না। অর্থাৎ সাহিত্যের একটি অঙ্গ যে নাটক, সে রকম নাটক রচনার দিকে তাঁর কখনও মন ছিল না। তিনি ছিলেন এক থিয়েটার কোম্পানির ম্যানেজার। নিজের দলের প্রয়োজনে তিনি অন্যদের নাটক যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি নিজেও তাড়াহুড়ো করে অনেক প্রহসন, ব্যঙ্গ-নাটক, রচনা করেছেন। আমাদের দেশে গিরিশ ঘোষ যেমন নাটক লিখেছেন। চার্লি চ্যাপলিন যেমন নিজের ফিল্মের গল্পগুলি তৈরি করেছেন। জীবদ্দশায় মলিয়ের তার কিছু কিছু নাটক যে ছাপিয়েছিলেন, তাও সাহিত্য সৃষ্টির জন্য নয়। তাঁর নাটক অন্য দল বিনা অনুমতিতে অভিনয় করত, তাঁকে স্বীকৃতিও দিত না। তাই মলিয়ের নাটক ছাপিয়ে নিজের নামটা দেগে দিতেন।

এক সার্থক আসবাবপত্র ব্যবসায়ীর ছেলে মলিয়ের অল্প বয়েস থেকেই ঝুঁকেছিলেন মঞ্চে অভিনয়ের দিকে। বাবার ব্যবসায়ে গেলেন না, লেখাপড়া শেষ করার পর বাড়ি ছেড়ে চলে এসে যোগ দিলেন এক থিয়েটারের দলে। মাদলেইন বেজার নামে এক অভিনেত্রীর সহযোগিতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে চালাতে লাগলেন নিয়মিত নাটকের অভিনয়। কিন্তু প্যারিস শহরে তখন আরও দুটি থিয়েটার বেশ চালু (১৬৪৪ সাল, কলকাতা শহরের তখনও জন্ম হয়নি), মলিয়ের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারলেন না, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লেন, সে জন্য তাঁকে জেল খাটতেও হল।

জেল থেকে বেরিয়ে আবার নাটুকে দল গড়লেন মলিয়ের, এবার গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিনয় করতে লাগলেন, তাতে খরচ উঠে যেত, অনেকটা আমাদের যাত্রা দলের মতন। মোট ১৩ বছর এইভাবে মফস্বলে কাটিয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন মলিয়ের, তিনি এখন একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা ও দক্ষ ম্যানেজার। আবার ফিরে এলেন প্যারিসে। বুদ্ধিজীবী ও উচ্চবিত্ত মহলে মলিয়ের প্রথম পরিচিত হলেন রাজার নেকনজরে আসার পর। লুভর প্রাসাদের রক্ষীদের হলঘরটিতে একটা অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে মলিয়ের রাজা ও সভাসদদের সমক্ষে দুটি নাটক দেখালেন। দ্বিতীয়টি তাঁর নিজের রচনা, সেটির নাম ‘প্রেমিক ডাক্তার’। এই নাটকটি গ্রাম্য দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, শহুরে সমাজও বেশ পছন্দ করল।

এরপর থেকে বড় বড় জমিদারদের বাড়িতে মলিয়ের ডাক পেতে লাগলেন। প্যারিসে হল ভাড়া করে নিয়ে নিয়মিত নাটকও চলল। নিছক রঙ্গ কৌতুকের নাটক লিখতে লিখতে মলিয়ের হঠাৎ একটা নাটকে রক্ষণশীলদের বেশ একটা ধাক্কা দিয়ে বসলেন। এই নাটকের নাম ‘লে’ কল দে ফাম’ (বউদের ইস্কুল), সমাজের শিরোমণিরা এই নাটক দেখে গেল গেল রব তুলে দিল। অনেকে স্বীকার করল, এই নাট্যকার একটি ‘কমিক জিনিয়াস’ বটে, কিন্তু কোনও সামাজিক প্রথাকেই এই লোকটা শ্রদ্ধেয় বলে মনে করে না।

মলিয়ের দমলেন না, নতুন নতুন নাটকে দর্শকদের কাঁপাতে লাগলেন। চোদ্দ বছরে মলিয়ের পঁচানব্বইটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন, তার মধ্যে একত্রিশটা তাঁর নিজের রচনা। একটা সিজনেই তিনি নাটক লিখেছিলেন ছ’খানা।

তাড়াহুড়ো করে, দর্শকদের মেজাজ-মর্জি বুঝে নাটক লিখতেন মলিয়ের, সে জন্য অনেকগুলি ঠিক জমেনি, মঞ্চসফল হয়নি। কোনওটা একবার মঞ্চস্থ করার পর দর্শকরা ঠিক নিচ্ছে না দেখে আবার খোল নলচে বদলে ফেলতেন। তিনি তো শুধু নাট্যকার ও অভিনেতা নন, তিনি দলের ম্যানেজার, খরচ চালাবার চিন্তা তাঁকে করতে হত সব সময়। তবু এরই মধ্যে মলিয়ের-এর কয়েকটি নাটক কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে। মলিয়ের ঠিক বাস্তবকে অনুকরণ করতেন না, শুধু সমসাময়িক জীবনকে ফুটিয়ে তুলতেন না, নিছক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও তাঁর উপজীব্য ছিল না, এইসব কিছুকে মেলাবার পরেও তিনি পরাবাস্তবতার দিকে চলে যেতেন। মঞ্চে মৃত্যুদৃশ্যে অভিনয় করতে-করতে তাঁর সত্যিকারের মৃত্যু যেন একটা রূপক।

মলিয়ের-এর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটকের নাম ‘তারতুফ’। এই নাটকের জন্যও তাঁকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। মলিয়ের সমালোচকদের উত্তর দিতেন নাটক লিখে। ‘বউদের ইস্কুল’ নাটকটি নিয়ে যখন আপত্তির ঝড় ওঠে, তখন তিনি মঞ্চে নামিয়েছিলেন ‘বউদের ইস্কুল সম্পর্কে সমালোচনা’। এই নাটকে তিনি একাই অভিনেতা, একা তিনি তাঁর সমালোচকদর উদ্দেশ্যে তর্জনী দেখিয়েছেন।

এই সমালোচকদের প্রসঙ্গেই মলিয়ের সম্পর্কে এতখানি ভূমিকা করতে হল।

শামবর প্রাসাদে রাজা চতুর্দশ লুই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মলিয়ের-এর দলকে। নতুন নাটক দেখাতে হবে। এখানে এসে কয়েকদিনের মধ্যে মলিয়ের একটা নাটক লিখে ফেললেন। দ্রুত রিহার্সাল দিয়ে সেটা মঞ্চস্থ করা হল। রাজা, রানি ও পারিষদরা সবাই উপস্থিত। নাটকের প্রথম দু-অঙ্ক হয়ে গেল, কিন্তু দর্শকদের মধ্যে হাসির হিল্লোল উঠছে না। রাজা হাসছেন না, তাই অন্য কেউও হাসবে না। মহা মুশকিল। মলিয়ের-এর দলের সঙ্গীত পরিচালকের নাম লালি। সে হঠাৎ একটা কাণ্ড করল। নাটক চলছে, এর মধ্যে সে এক লাফ দিয়ে পড়ল গান-বাজনার যন্ত্রগুলোর ওপরে, সবগুলো ঝন ঝনাৎ করে উঠল এক সঙ্গে। তার-ফার ছিঁড়ে লালি চিৎপটাং। রাজা হো-হো করে হেসে উঠলেন, তারপর থেকেই জমে গেল নাটক।

কয়েকদিন সেই নাটকটি চলার পর রাজা হুকুম দিলেন আর একটা নতুন নাটক লিখতে। এটার নাম ‘বুর্জোয়া ভদ্রলোক’। এক দল সুযোগন্ধানী লোক নানারকম কায়দা কানুন ও তোষামোদ করে সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে কীভাবে ওপর মহলে ওঠে, তাই নিয়ে কাহিনি। এ কাহিনি চিরকালীন, আজকের দিয়েও সত্য। কিন্তু প্রথম দিন অভিনয়ের বিরাট ব্যর্থতা। রাজা চতুর্দশ লুই আগাগোড়া ঠোঁটে কুলুপ এঁটে বসে রইলেন, তাঁর মুখে কোনও ভাব-বৈকল্য দেখা গেল না, সুতরাং অন্য কেউ হাসল না। হাসির নাটকে শ্মশানের স্তব্ধতা। চতুর্দশ লুইয়ের মেজাজ মর্জির এমনিতেই ঠিক-ঠিকানা ছিল না। তিনি কখন হাসবেন, কখন মুখখানা গোমড়া করে থাকবেন, তা কেউ জানে না। মলিয়ের অন্যত্র বলেছিলেন, ফ্রান্সের বড়লোকদের মুখে কৌতুকের হাসি ফোঁটানো অতি শক্ত কাজ।

নাটকের শেষে উপস্থিত সমালোচকরা ছি ছি করতে লাগল। কেউ কেউ বলতে লাগল, মলিয়ের-এর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, নাটক দানা বাঁধছে না, সংলাপে ধার নেই, অভিনয়ও বাজে।

মলিয়ের তবু আর একদিন অভিনয়ের অনুমতি চাইলেন।

দ্বিতীয় দিয়ে প্রায় শুরু থেকেই রাজা বেশ ফুরফুরে মেজাজে, মাঝে মাঝে হেসে উঠছেন, বাঃ বাঃ করছেন। আর বাকি দর্শকরাও হাসিতে ফেটে পড়ছে, মুহুর্মুহু হাততালি দিচ্ছে। যবনিকা পতনের পর আগের দিনের সমালোচকরাই মলিয়েরকে ঘিরে ধরে উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, অহো, কী অপূর্ব নাটক! কী চমৎকার সংলাপ কী দুর্দান্ত অভিনয়!

এখনকার দিয়েও সমালোচনার এই ধারা বিশেষ পালটেছে কি? এখন আর রাজতন্ত্র নেই, তবু অধিকাংশ সমালোচকের সামনেই একজন অনুপস্থিত রাজা বসে আছে, এমন মনে হয় না?

যে-হলঘরটিতে মলিয়ের তাঁর নাটক দুটির অভিনয় করেছিলেন, সেখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম। যে-সময়ে মলিয়ের এখানে চতুর্দশ লুইয়ের সামনে অভিনয় করেছিলেন সেই সময়ে আমাদের দিল্লিতেও লালকেল্লা গমগম করছে, শাজাহান ঔরঙ্গজেবের আমল, মোগল-সাম্রাজ্য গৌরবের চূড়ায়। কিন্তু দিল্লির বাদশাহদের নাট্যপ্রীতির কোনও খবর পাওয়া যায় না। দিল্লিতে পেশাদারি নাটকের নিয়মিত অভিনয়ও হত না, মলিয়ের-এর মতো নাট্যকারও জন্মায়নি।

একটু তাড়াহুড়ো করেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হল, কারণ হোটেলের ঘর ছাড়তে হবে। এমন সুন্দর পরিবেশের হোটেলটি ছাড়তে আমাদের কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু উপায় নেই। লোয়ার উপত্যকায় প্রায় বারোমাসই দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। সুতরাং এর পরে কোনও ভালো হোটেলে জায়গা পাওয়া যাবে না কি না তার ঠিক নেই। আমরা তো দামি হোটেলে থাকতে পারব না, আমাদের সস্তাও চাই, পরিবেশটাও মনোরম হওয়া দরকার।

এই হোটলের রিসেপশনিস্ট মহিলাটি আমাদের প্রতি সদয় হয়ে দূর-দূরান্তের অনেকগুলি হোটেলে ফোন করে খবর নিল, অনেক জায়গাতেই ঘর ঘালি নেই। শেভার্নি নামের একটা জায়গায় একটি মাঝারি হোটেলে দুটি ঘর পাওয়া যেতে পারে। চলো শেভার্নি!

অনেক ঘুরে ঘুরে, দু-একবার রাস্তা হারিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত শেভার্নির সেই হোটেলে পৌঁছে বেশ নিরাশ হলাম। কাছাকাছি নদী নেই, জঙ্গল নেই, শহরের ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে একটা পুরোনো আমলের হোটেল। ঘর ভাড়া বেশ বেশি, অথচ ঘরগুলো স্যাঁতসেঁতে, দিনের বেলাতেও রোদ আসে না,। যে ঘরে দিনের বেলা আলো জ্বালতে হয়, সে ঘর আমার কিছুতেই পছন্দ হয় না! কিন্তু উপায় নেই, রাতটা তো কাটাতে হবে।

বিকেলের চা বানাতে গিয়ে দেখা গেল ইমারশান হিটারের প্লাগটা প্লাগ-পয়েন্টে ঢুকছে। এ কী অদ্ভুত ব্যাপার। প্লাগ পয়েন্টগুলো পৃথিবীর সব দেশে একই মাপের, শুধু এখানে আলাদা! শেষ পর্যন্ত অসীম তার-টার বার করে কিছু একটা কায়দায় বাদলের ডিপার্টমেন্ট চালু করে দিল।

এই হোটেল থেকেই হাঁটা পথের দূরত্বে একটা শাতো রয়েছে। পুরো জায়গাটা উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। চা খাবার পর অসীম বলল, চলো বেড়াতে-বেড়াতে গিয়ে শাতোটা দেখে আসি!

আমি সঙ্গে সঙ্গে জোর দিয়ে বললাম, না, ওটা দেখব না!

অসীম হাসতে-হাসতে বলল, কী ব্যাপার, তোমার এই জায়গাটা এমনই অপছন্দ হয়েছে যে এখানকার কোনও কিছুই দেখবে না?

আমি বললাম, শুধু সেজন্য নয়। আজ শামবর-এর মতন অসাধারণ শাতো দেখে এসেছি, আজ আর কিছু দেখব না। এক দিয়ে দুটো সহ্য হবে না। কোনও ভালো জিনিস যেমন এক সঙ্গে বেশি খেতে নেই, তেমনি ভালো ভালো জিনিসও খুব বেশিক্ষণ দেখা ঠিক নয়। কোনও কবিতার বই আমি প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত এক টানা পড়ি না, কয়েকটা কবিতা পড়ে রেখে দিই, তাতে মর্মে ঠিক মতন ঢোকে। এক সঙ্গে দু’জন কবির দু-খানা আলাদা বই পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। লুভর মিউজিয়ামে গিয়ে এক দিয়ে সব কিছু দেখার চেষ্টা করলে আসলে কিছুই দেখা হয় না। আমি শুধু একটা অংশ দেখে বেরিয়ে আসি।

ভাস্কর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সমর্থন করে বলল না, না, আজ আর কোথাও যাওয়া হবে না। রাজা-ফাজাদের বাড়ি তো সব প্রায় এক রকমই থাকে। আজ আসল ভালোটা দেখে এসেছি, তাতেই পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে!

অসীম বাদলের দিকে তাকাতেই বাদল বলল, আমাকে যদি এখন যেতে বলেন, রাজি আছি। আর যদি না যাওয়া হয়, তাতেও আপত্তি নেই। মোজা-টোজা খুলে ফেলেছি, বেরুতে গেলে আবার পরতে হবে।

অর্থাৎ অসীম আধখানা ভোটে হেরে গেল। বিদ্রুপের সুরে বলল, যত সব কুঁড়ের দল!

লোয়ার নদী এবং তার শাখাপ্রশাখার তীরে তীরে কত যে সুরম্য হৰ্ম রয়েছে তার ঠিক নেই। পৃথিবীর আর কোনও নদীর অববাহিকায় এমনটি নেই। উল্লেখযোগ্য শাতো’র সংখ্যাই ষাট-বাষট্টি। এ ছাড়া ছোট ছোট আরও অনেক। আমরা বেছে বেছে সাত আটটির বেশি দেখব না ঠিক করে ফেলেছি। যেহেতু এখানেও প্রচুর টুরিস্ট আসে, তাই কেউ কেউ এখানে শালতা নিয়ে ব্যাবসাও শুরু করেছে। পুরোনো আমলের একটা জমিদার বাড়ি কিনে সারিয়ে-টারিয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে দর্শনীয় করে তোলে। বাড়ির একটা অংশে নিজেরা থাকে, অন্য অংশটায় টিকিট কেটে দর্শকরা আসে। সঙ্গে রেস্তোরাঁ ও স্যুভেনিরের দোকান। মন্দ লাভ হয় না।

মাঝারি আকারের শাতো’র সঙ্গে তুলনা দেওয়ার মতন একটা বাড়ি আমি কলকাতার কাছেই দেখেছি। বারাসাত থেকে বসিরহাটের দিতে যেতে যেতে দেগঙ্গা, স্বরূপনগর ছাড়াবার পর রাস্তার বাঁ দিকে একটা প্রাসাদ দেখে চমকে উঠেছিলাম। ঠিক যেন একটা ফরাসি শাতো সেখানে বসানো। সেটা কোন জমিদারের বাড়ি ছিল আমি জানি না, নিশ্চিত কোনও বিদেশি নক্সায় তৈরি। সামনে দুই গম্বুজওয়ালা সিংহদ্বার, ভেতরে উদ্যান ও দীঘি, তারপর একটি সুসমঞ্জস অট্টালিকা। শুনেছি, সেখানে এখন একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনাথ আশ্রমের প্রয়োজনীয়তা আছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য এমন একটা সুন্দর বাড়ি ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল কি? এই প্রাসাদটিকে মেরামত ও পরিষ্কার করে, কিছু ছবি ও মূর্তি দিয়ে সাজালে পর্যটকদের একটা আকর্ষণীয় কেন্দ্র হতে পারত। আমাদের পর্যটন দফতরের এই সব দিকে নজর পড়ে না কেন?

কুচবিহারের রাজবাড়িটা তো আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেল। অল্প বয়েসে কুচবিহারে বেড়াতে গিয়ে দূর থেকে রূপকথার রাজবাড়ির মতন ওই অট্টালিকাটিকে দেখে মুগ্ধ হতাম। এখন সেখানকার ঝাড়লণ্ঠন, ছবি, চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত লুঠপাট হয়ে গেছে, জানলা-দরজাগুলোও খুলে নিয়ে গেছে চোরেরা। সেটা একটা ভুতুড়ে বাড়ির মতন দেখায়। পাশের চত্বরটিতে বাস ডিপো।

আমাদের পশ্চিম বাংলায় ঐতিহাসিক দুর্গ কিংবা প্রাসাদ বা স্মৃতিস্তম্ভ প্রায় বিশেষ কিছুই নেই। অনতি অতীতের চিহ্নগুলিও যদি আমরা নষ্ট হতে দিই, তা হলে ভবিষ্যতের জন্য আমরা কী রেখে যাব?