২২১. হরণাহরণ পৰ্বাধ্যায় – পার্থের সুভদ্রা-পাণিগ্রহণ

২২১. হরণাহরণ পৰ্বাধ্যায় – পার্থের সুভদ্রা-পাণিগ্রহণ, সুভদ্রাসহ অর্জুনের খাণ্ডবপ্রস্থে উপস্থিতি, সুভদ্রা-দ্রৌপদীর সকৌতুক মিলন, যাদবগণের খাণ্ডবপ্রস্থে আগমন, অভিমন্যু-জন্ম, পাঞ্চালীর পঞ্চপুত্র উৎপত্তি

একবিংশত্যধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, যাদবেরা এইরূপে স্ব স্ব বলবীর্য্য প্রকটনপূর্বক তর্জন গর্জন করিতে লাগিলেন। অনন্তর বাসুদেব অর্থভূয়িষ্ঠ বাক্যে কহিলেন, অর্জুন আমাদিগের কুলের অবমাননা করেন নাই; বরং সমধিক সম্মান রক্ষাই করিয়াছেন। তিনি তোমাদিগকে অর্থলুব্ধ মনে করেন না বলিয়াই অর্থদ্বারা সুভদ্রাকে গ্রহণ করিতে চেষ্টা করেন নাই। স্বয়ম্বরে কন্যা লাভ করা অতীব দুরূহ ব্যাপার, এই জন্য তাহাতেও সম্মত হন নাই এবং পিতামাতার অনুমতি গ্রহণপূর্বক প্রদত্ত কন্যার পাণিগ্রহণ করা তেজস্বী ক্ষত্রিয়ের প্রশংসনীয় নহে। অতএব আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, কুন্তীপুত্ৰ ধনঞ্জয় উক্ত দোষ সমস্ত পৰ্যালোচনা করিয়া বলপূর্বক সুভদ্রাকে হরণ করিয়াছেন। এই সম্বন্ধ আমাদিগের কুলোচিত হইয়াছে এবং কুল, শীল, বিদ্যা ও বুদ্ধিসম্পন্ন পার্থ বলপূর্বক হরণ করিয়াছেন বলিভদ্রাও যশস্বিনী হইবেন, সন্দেহ নাই। অর্জুনকে সামান্য জ্ঞান করিও না; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই মহাযশাঃ সুপ্রসিদ্ধ অর্জন কুন্তিভোজের দৌহিত্র। তদীয়জন্মে ভরতকুল অলঙ্কত হইয়াছে। মহাদেব ব্যতিরেকে তাহাকে যুদ্ধে পরাভব করিতে পারে, এমন ব্যক্তি দৃষ্টিগোচর হয় না। তাদৃশ রথ, মদীয় ঘোটক এবং লঘুহস্ত পার্থ যোদ্ধা, এই সমস্ত একত্র হইলে ত্রিভুবনমধ্যে এমন বীর কে আছে যে, তাঁহার সম্মুখীন হইতে পারে? অতএব আমার বিবেচনায় প্রফুল্লমনে শীঘ্র ধনঞ্জয় সন্নিধানে যাইয়া সত্ত্ববাদদ্বারা তাহাকে নিবৃত্ত করা সকলের কর্তব্য; কারণ, যদি পার্থ তোমাদিগকে বলে পরাভব করিয়া স্বনগরে গমন করেন, তাহা হইলে তোমাদিগের যশোরাশি সদ্যই বিনষ্ট হইবে, কিন্তু সান্ত্ববাদে পরাজয়ের সম্ভাবনা নাই। যাদবগণ কৃষ্ণের উপদেশানুসারে অর্জুনকে প্রতিনিবৃত্ত করিলে, তিনি যথাবিধি সুভদ্রার পাণিগ্রহণ করিলেন এবং যাদবগণ কর্তৃক পূজিত হইয়া যথেষ্ট বিহার করত দ্বারকাতে সম্বৎসর অতিবাহিত করিলেন। পরে পুষ্করতীর্থে গমন করিয়া একাদশ বৎসর অতিবাহিত করিলেন। এইরূপে দ্বাদশ বর্ষ পরিপূর্ণ হইলে পুনরায় খাণ্ডবপ্রস্থে প্রত্যাগমন করিলেন।

অর্জুন যথানিয়মে নৃপসন্নিধানে গমনপূর্বক ব্রাহ্মণদিগকে অর্চনা করিয়া দ্রৌপদীর নিকট উপনীত হইলেন। দ্রৌপদী রমণীস্বভাবসুলভ ঈষৎ প্রণয়কোপ প্রকাশ করিয়া কহিলেন, হে কৌন্তেয়! যে স্থানে সাত্বতকুমারী আছে, তথায় গমন কর। অথবা তোমারও নিতান্ত দোষ নাই, গুরুভার বস্তু দৃঢ়রূপে বদ্ধ থাকিলেও কালক্রমে তাহার পূর্ব বন্ধ শিথিল হইয়া যায়। কৃষ্ণা এবম্বিধ নানাপ্রকার পরিহাস করিতে আরম্ভ করিলে, ধনঞ্জয় তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ সান্ত্বনা এবং তাহার নিকট বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। পরে অর্জুন রক্তবস্ত্রপরিধানা সুভদ্রাকে গোপালিকার বেশ ধারণপূর্বক শীঘ্র অন্তঃপুরে প্রস্থান করিতে আজ্ঞা দিলেন। বরাঙ্গনা সুভদ্রা সেইরূপ বেশভূষায় অধিকতর শোভমানা হইয়া গৃহ প্রবেশপূর্বক পৃথার চরণবন্দনা করিলেন। কুন্তী প্রীতমনে সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরীর মস্তক আঘ্রাণ করিয়া ভূরি ভূরি আশীৰ্বাদুকরিতে লাগিলেন। সুভদ্রা তথা হইতে দ্রৌপদীসন্নিধানে গমন করিয়া আঁকে অভিবাদনপূর্বক কহিলেন, আমি অদ্যাবধি আপনার অনুচরী হইলাম কৃষ্ণা গাত্রোত্থানপূর্বক কৃষ্ণভগিনীকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, তোমার পতি নিঃসপত্ন হউন। অধিবভগিনী তাহাই হউক বলিয়া দ্রৌপদীকে প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন। পাণ্ডবগণ এবং কুন্তীর আর আহাদের পরিসীমা রহিল না। পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুন নির্বিঘ্নে ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিয়াছেন শুনিয়া বাসুদেব, বলদেব ও যদুবংশীয় অন্যান্য বীরপুরুষেরা ভ্রাতৃবর্গ, কুমারগণ এবং অসংখ্য সেনাগণ সমভিব্যাহারে তথায় যাত্রা করিলেন। অসাধারণ-ধীশক্তিসম্পন্ন যাদবচমুপতি অকুর, মহাতেজাঃ অনাবৃষ্টি, মহানুভব উদ্ধব, সত্যক, সাত্যকি, কৃতবর্মা, সাত্বত, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, নিশঠ, শঙ্কু, চারুদেষ্ণ, ঝিল্লী, বিপৃথু, সারণ, গদ এবং অন্যান্য যাদব, ভোজ ও অন্ধকবংশীয়ের বহুল যৌতুক গ্রহণপূর্বক খাণ্ডবপ্রস্থে আগমন করিলেন।

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ সমাগত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া, তাঁহার অভ্যর্থনার নিমিত্ত নকুল ও সহদেবকে প্রেরণ করিলেন। কৃষ্ণ সাদরে পরিগৃহিত হইয়া ধ্বজপতাকা-পরিশোভিত খাণ্ডবপ্রস্থে প্রবেশ করিলেন। তত্রত্য রাজপথসকল নির্ধূলীকৃত এবং শীতল সুগন্ধি চন্দনরসে অভিষিক্ত হইয়াছিল। কোন কোন প্রদেশ দহমান অগুরুধূমে সুরভিত, কোন স্থান কুসুমমালায় সুশোভিত এবং কোন স্থান বণিকগণের কোলাহলে পরিপূর্ণ হইয়াছে; কোথাও বা নগরবাসী লোকের প্রফুল্লমনে ভ্রমণ করিতেছে। শ্রীকৃষ্ণ বৃষ্ণিবংশীয় ভূপতিগণ ও বলদেব সমভিব্যাহারে নগরে প্রবেশপূর্বক পৌরজন ও ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক পূজিত হইয়া ইন্দ্রালয়সদৃশ রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির বলরামের যথোচিত সৎকার করিয়া কৃষ্ণের মস্তকাঘ্রাণ এবং বাহুযুগলদ্বারা তাহাকে আলিঙ্গন করিলেন। কৃষ্ণ বিনীতভাবে ধর্মরাজ ও ভীমসেনকে অভিবাদন করিলেন। যুধিষ্ঠির সেই সমস্তু যাদবগণ ও প্রধান প্রধান অন্ধকদিগকে যথাবিধি সৎকার করিলেন। তিনি কাহাকেও গুরুবৎ পূজা করিলেন, কাহাকেও বয়স্যের ন্যায় প্রিয়সম্ভাষণ করিলেন এবং কাহারও নিকটে বা স্বয়ং অভিবাদিত হইলেন। কৃষ্ণ ধনঞ্জয়কে জ্ঞাতিদেয় রত্নসমূহ যৌতুক প্রদান করিয়া বাহনচতুষ্টয়-সংযুক্ত, কিঙ্কিণীজালজড়িত সহস্র সংক সুবৰ্ণরথ, সুশিক্ষিত সারথি, মাধুরদেশীয় অযুত গো, শ্বেতবর্ণ বড়বাসমূহ দ্রুতগামী অশ্বতরসহ, সুবর্ণালঙ্কারবিভূষিত সেবাকুশষ কিঞ্চিৎ অধিক বয়স্ক সহস্র দাসী, বালিকদেশীয় ঘোটকসমূহ, উৎকৃষ্ট বর্ণ রাশি, মদাবী অত্যুমত রণপরিচিত হস্তীপক-বিশিষ্ট গজযুথ প্রভৃতি কন্যাধন সকল সুভদ্রাকে প্রদান করিলেন। বলরাম সেই সম্বন্ধের বহুমানপূর্বক অমূল্য রত্নসমূহ, মহার্হ বস্ত্র, বহুল নাগেন্দ্র এবং শত পতাকা প্রভৃতি বস্তুজাত যৌতুক দান করিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির উক্ত সমস্ত দ্রব্য প্রতিগ্ৰহ করিয়া সমাগত যাদব ও অন্ধকগণের যথোচিত সৎকার করিলেন। যেমন পুণ্যাত্মা লোকেরা পরম সুখে কর্ম ভোগ করেন, তজপ সেই সকল মহাত্মারা তথায় গীতবাদ্যদ্বারা যথেষ্ট বিহার করিতে লাগিলেন।

এইরূপে বহুদিবস অতিবাহিত হইলে বলদেবপুরঃসর সেই সকল মহাত্মারা কৌরবগণ কর্তৃক রত্নসমুহ ও সম্মানদ্বারা পূজিত হইয়া হারবতীনগর প্রত্যাগমন করিলেন। কৃষ্ণ পার্থের সহিত পরম রমণীয় ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহারা দুইজনে মৃগয়াসক্ত হইয়া মৃগ বরাহ বিদ্ধ করত যমুনাতীরে ক্রীড়া করিতেন। অনন্তর শচী যেমন জয়ন্তকে প্রসব করিয়াছিলেন, তদ্রূপ কৃষ্ণের প্রিয়তমা ভগিনী সুভদ্রা সুবিখ্যাত ও সৰ্বলক্ষণাক্রান্ত এক পুত্র প্রসব করিলেন। তিনি স্বভাবতঃ অভী ও মদ্যুমা অর্থাৎ নির্ভয় ক্রোধান্বিত ছিলেন বলিয়া তাহার নাম অভিমন্যু হইল। লোকে তাহাকে আর্জুনি বলিয়াও সম্বোধন করিত। যেমন সংঘর্ষণদ্বারা শমীবৃক্ষ হইতে অগ্নি সমুদ্ভূত হয়, তদ্রূপ ধনঞ্জয় হইতে অভিমন্যু উৎপন্ন হইয়াছিলেন। অভিমন্যুর জন্ম হইলে ধর্মরাজ অযুত গো ও সুবর্ণরাশি বিপ্রসাৎ করিলেন। তিনি জন্মিয়া অবধি কৃষ্ণের সাতিশয় প্রিয়পাত্র ছিলেন। শারদ শরীনাথ সন্দর্শনে লোকের যাদৃশ প্রীতি হয়, তাহাকে দেখিয়া পিতৃগণ ও প্রজাগণের সেইরূপ আহ্লাদ হইত। তাঁহার জাতকাৰ্য্য প্রভৃতি সমুদায় শুভকর্ম বাসুদেব স্বয়ং সম্পন্ন করেন। তিনি শুক্লপক্ষীয় চন্দ্রকলার ন্যায় দিন দিন পরিবর্ধিত হইতে লাগিলেন। পরে অর্জুনের নিকট নিখিল ধনুর্বেদ শিক্ষা করেন এবং বিজ্ঞান প্রভৃতি প্রধান প্রধান শাস্ত্র ও বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকলাপে সুশিক্ষিত হইয়াছিলেন। ধনঞ্জয় আগম ও শস্ত্র প্রয়োগবিষমে আত্মজকে আত্মতুল্য এবং সাৰ্বাংশে কৃষ্ণসদৃশ দেখিয়া আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন।

এই সময়ে শুভলক্ষণ দ্রেীপদীও পঞ্চপতি হইতে ভূধরতুল্য দৃঢ়কায় মহাবল পরাক্রান্ত পঞ্চ পুত্র লাভ করিলেন। আদিত্যজননী অদিতির ন্যায় পাঞ্চালী যুধিষ্ঠির হইতে প্রতিবিন্ধ্য, বৃকোদর হইতে সুতসোম, অর্জুন হইতে শ্রুতকর্মা, নকুল হইতে শতানীক এবং সহদেব হইতে শ্রুতসেন, এই পঞ্চবীর প্রসব করিলেন। দ্রৌপদীর্তনয়েরা প্রত্যেকে এক এক বৎসরান্তরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহারা পরস্পর পরস্পরের হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মহর্ষি ধৌম্য আনুপূর্বিক তাঁহাদিগের জাতকর্ম, চুড়া ও উপনয়নাদি সম্পন্ন করেন। তাহারা বেদাধ্যয়ন সমাপনপূর্বক অর্জুনের নিকট নিখিল অস্ত্র ও ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করিলেন। হে ভরতভ! এইরূপে পাণ্ডবেরা দেবকুমার সদৃশ আত্মজগণের সহিত পরমসুখে খাণ্ডবপ্রস্থে কালযাপন করিতে লাগিলেন।

হরণাহরণ পর্বাধ্যায় সমাপ্ত।