১৯১. কৃষ্ণাসহ কুন্তীসমীপে পাণ্ডবগমন

১৯১. কৃষ্ণাসহ কুন্তীসমীপে পাণ্ডবগমন

একনবত্যধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,-মহানুভব ভীমার্জুন ভার্গবকর্মশালায় উপস্থিত হইয়া পরম প্রীতমনে পৃথাকে নিবেদন করিলেন,-মাতঃ! অদ্য এক রমণীয় পদার্থ ভিক্ষালব্ধ হইয়াছে। পৃথা গৃহাভ্যন্তরে ছিলেন, সবিশেষ পৰ্যবেক্ষণ না করিয়াই পুদিগকে কহিলেন, বৎস! যাহা প্রাপ্ত হইয়াছ, সকলে সমবেত হইয়া ভোগ কর। অনুর কৃষ্ণাকে নয়নগোচর করিয়া কহিলেন, আমি কি কুকর্ম করিলাম। পরে ধভয়ে একান্ত চিন্তাকুলা হইয়া পরপ্রীত যাজ্ঞসেনীর হস্ত গ্রহণপূর্বক যুধিষ্ঠিরের নিকটে গমন করিয়া কহিলেন, পুত্র! ইনি রাজা দ্রুপদের নন্দিনী, তোমার অনুজদ্বয় ইহাকে আনিয়া ভিক্ষা বলিয়া আমার নিকট উপস্থিত করেন, আমিও অনবধানতাপ্রযুক্ত অজ্ঞ করিয়াছি, তোমরা সকলে সমবেত হইয়া ভোগ কর। অতএব, হে কুরুশ্রেষ্ঠ! এক্ষণে যাহাতে আমার বাক্য মিথ্যা না হয় এবং অধর্ম দ্রুপদকুমারীকে স্পর্শ না করে, এমন উপায় বিধান কর। মতিমান কুরুপ্রবীর জননীর এইরূপ উক্তি শ্রবণে ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কুন্তীকে আশ্বাস প্রদানপূর্বক অর্জুনকে কহিলেন, হে ফান! যাজ্ঞসেনী, তোমায় জয়লব্ধ বস্তু, তোমাতেই ইনি শোভা গাইবেন, তুমি অগ্নি সাক্ষী করিয়া যথাবিধানে ইহার পাণিগ্রহণ কর।

অৰ্জন কহিলেন, নরনাথ! আমাকে অধর্মে লিপ্ত করিবেন না, আমি সাধুবিগর্হিত ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইব না। আপনি জ্যেষ্ঠ, প্রথমতঃ আপনার। বিবাহ করা কর্তব্য, অনন্তর মহাবাহ ভীমের, তৎপরে আমার, তদনন্তর নকুলের, পরিশেষে তরী সহদেবের বিবাহ করা উচিত। বৃকোদর, আমি, নকুল, সহদেব এবং এই রাজকুমারী, আমরা সকলেই আপনার নিযোজ্য। অতএব যাহা যশস্কর ও ধৰ্মকর হয়, সবিশেষ পৰ্যালোচনা পূর্বক আপনি সেই কর্মের অনুষ্ঠান করুন এবং যাহাতে পাঞ্চালেশ্বরের হিতসাধন হইতে পারে, আমাদিগকে তদনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করুন। আপনি নিশ্চয় জানিবেন, আমরা সকলেই আপনার একান্ত বশম্বদ। ভক্তিস্নেহসহকৃত অর্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া পাতনয়ের দ্রৌপদীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। তাহারা যশস্বিনী কৃষ্ণাকে নয়নশোচর করিয়া পরম্পর বদন নিরীক্ষণ করিয়া উপবিষ্ট ও তদগতচিত্ত হইলেন। তাহারা দ্রৌপদীর রূপলাবণ্যে এরূপ মোহিত হইয়াছিলেন যে, তাহাদের ইন্দ্রিয়গ্রাম প্রমখিত করিয়া অনঙ্গবিকার প্রাদুর্ভূত হইল। বোধ হয়, বিধাতা সকল নারী অপেক্ষা উৎকষ্ট করিবার আশয়ে পাঞ্চালীর তাদৃশ কমনীয় রূপলাবণ্যের নির্মাণ করিয়াছিলেন, নতুবা তাহার দর্শনমাত্রেই কেন সকল প্রাণীর মনোহরণ হইবে।

যুধিষ্ঠির অনুজগণের আকার ও মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া দ্বৈপায়নের বাক্য সমুদায় স্মরণ করিলেন এবং ভেদভয়ে ভীত হইয়া অনুজদিগকে নির্জনে লইয়া কহিলেন, দ্রৌপদী আমাদিগের সকলেরই ভাৰ্য্যা হইবে। মহানুভব ভীমাদি জ্যেষ্ঠের বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে সেই বিষয়েরই আন্দোলন করিতে লাগিলেন। বৃষ্ণিপ্রবীর কৃষ্ণ, বলদেব সমভিব্যাহারে ভার্গবকর্মশালায় গমন করিলেন এবং দেখিলেন যে, অজাতশত্রু, অগ্নিতুল্য ভ্রাতৃগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তথায় উপবিষ্ট রহিয়াছেন।

অনন্তর বাসুদেব, পরম ধার্মিক যুধিষ্ঠিরের নিকট অভিগমন ও চরণ বনপূর্বক আপনার পরিচয় প্রদান করিলেন, মহাবল বলদেবও ঐরূপ আত্মপচিয় প্রদান করিলে পর, পাণ্ডবেরা আনন্দসাগরে নিমগ্ন হইলেন। তদমন্তর কৃষ্ণ ও বলদেব পিতৃসা কুন্তীর চরণে প্রণাম করিলেন। অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে সাদর সম্ভাষণ ও কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসাপূর্বক কহিলেন, হে বাসুদেব! আমরা গোপনে এস্থানে বাস করিতেছি, তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে? কৃষ্ণ হাস্য করিয়া কহিলেন, রাজন! অগ্নি প্রচ্ছন্ন হইলেও অনায়াসে পরিজ্ঞাত হয়, পাণ্ডব ব্যতীত মনুষ্যলোকে অন্য কোন ব্যক্তি ঐরূপ বিক্রম প্রদর্শন করিতে পারে? মহারাজ! ভাগ্যবলে আপনার সেই ভয়ঙ্কর পাবক হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছেন এবং আমাদিগেরই অদৃষ্টফলে দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয় ও তদীয় অমাত্যের দুরভিসন্ধি সিদ্ধ হইতে পারে নাই। এক্ষণে আপনাদিগের হতপ্রায় মঙ্গল পুনর্বার সমুদ্ভূত হউক, ইন্ধনযুক্ত হুতাশনের ন্যায় উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করুন, প্রার্থনা করি, পার্থিবগণ যেন আপনাদিগের অজ্ঞাতবাস জানিতে না পারেন। অনুমতি করুন, অধুনা শিবিরে গমন করি। অনন্তর পাণ্ডবকর্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া বাসুদেব বলদেব সমভিব্যাহারে স্কন্ধাবারে প্রস্থান করিলেন।