১৫৩. পাণ্ডববধার্থ হিড়িম্ব রাক্ষসের আগমন, ভীম-হিড়ম্বের পরস্পর স্পর্দ্ধা

১৫৩. পাণ্ডববধার্থ হিড়িম্ব রাক্ষসের আগমন, ভীম-হিড়ম্বের পরস্পর স্পর্দ্ধা

ত্রিপঞ্চাশদধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,-হে রাজন্! এদিকে উর্দ্ধকেশ, মহাবাহু, নিবিড় কাদম্বিনীতুল্য কলেবর, লোহিতনয়ন, বিকটদশন, ভয়ঙ্করবৃদন দুরাত্মা হিড়িম্ব স্বীয় ভগিনী হিড়িম্বার বিলম্ব দেখিয়া বৃক্ষ হইতে অবতরণপূর্বক স্বয়ং পাণ্ডবশণ সমীপে গমন করিতে লাগিল। হিড়িম্বা তদ্দর্শনে সাতিশয় ভীত হই। ভীমসেনকে কহিল, হে মহাত্মন! ঐ দেখুন, নরমাংসলোলুপ মদীয় সহোদর দুরাত্মা। হিড়িম্ব ক্রুদ্ধ হইয়া আসিতেছে, আর নিস্তার নাই; এক্ষণে বিনয় করিয়া কহিতেছি, দাসীর বাক্য গ্রহণ করুন; সকলকে জাগরিত করিয়া ইরায় আমার নিতদেশে আ রূঢ় হউন, আমি আপনাদিগকে লইয়া আকাশমার্গে উড্ডীন হই। ভীমসেন কহিলেন, হে পৃথুশ্রোণি! কিছুমাত্র ভয় করিও না, স্থির হও, দেখ, তোমার সমক্ষেই দুরাত্মাকে এখনই বধ করিব; এই একাকী রাক্ষসাধমের কথা দূরে থাকুক, সমস্ত রাক্ষসকুল একত্র হইয়া আসিলেও আমি পরাজিত করিতে পারিব; আমার করিশুসন্নিভ এই ভূজযুগল, পরিঘতুল্য এই ঊরুদ্বয় ও বিশাল এই বক্ষঃস্থল দর্শন কর; আর ইন্দ্রসদৃশ মদীয় অতুল পরাক্রমও অচিরে দেখিতে পাইবে; হে পৃথুনিতম্বিনি! মনুষ্য বলিয়া আমাকে অবজ্ঞা করিও না। হিড়িম্বা কহিল, হে দেবরূপ নরশ্রেষ্ঠ। আমি তোমাকে অবজ্ঞা করিতেছি না; এই দুরাত্মা সর্বদাই মানবদিগকে অনায়াসে পরাজয় করে; এই নিমিত্ত ভীত হইয়া তোমাদিগকে লইয়া পলায়নে উদ্যত হইয়াছিলাম।

রাক্ষস দূর হইতে ভীমসেনের কথসমস্ত শুনিতে পাইয়া ক্রোকম্পিত-কলেবরে অগ্রসর হইয়া দেখিল যে, হিড়িম্বা মানুষীর বেশ ধারণ করিয়াছে; তাহার বদন পূর্ণশশিসম, কবরী পুস্পমালায় পরিবেষ্টিত, ভ্রূ, চক্ষুঃ ও কেশান্ত একান্ত মনোহর, সৰ্বাঙ্গ বিচিত্রাভরণ-ভূষিত ও পরিধান সূক্ষম বস্ত্র ও হিড়ি তাহাকে, তাদৃশভাবাপন্ন দেখিয়া কামুকী বলিয়া নিশ্চয় বুঝিতে পারিল। তখন সে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রোধান্বিত হইয়া বিপুল নেত্ৰদ্বয় বিষ্ফারণপূর্বক ভগিনীকে ভৎসনা করিয়া কহিতে লাগিল, অরে বিপ্রিয়কারিণি হিড়িম্বে! তুই আমার ভোজনে বিঘ্ন উৎপাদন করিতে উদ্যত হইয়াছিস্? আমার ক্রোধ কি একবারে বিস্মৃত হইলি? রে রাক্ষসকুলকলঙ্কিনি পরপুরুষাভিলাষিণি অসতি! তোকে ধিক্‌! তুই যাহার আশ্রয়বলে আমার এই মহৎ অপ্রিয়ানুষ্ঠান করিলি, আমি তাহাকে তোর সমক্ষে এখনই বধ করিতেছি। হিড়িম্ব, ভগিনীর উপর এই প্রকার তর্জ্জনগর্জ্জন করিয়া রোষকষায়িতলোচনে দৃঢ়তররূপে দশনে দশন নিপীড়নপূর্বক পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিতে চলিল।

ভীমপরাক্রম ভীমসেন, রাক্ষসকে ভগিনীর প্রতি ক্ষুদ্ধ ও ধাবমান দেখিয়া, “রে দুরাত্মন্! তিষ্ঠ তিষ্ঠ” বলিয়া তাহাকে ভৎসনা করিতে লাগিলেন এবং উপহাস করিয়া কহিলেন, অরে হিড়িম্ব! তুই কি নিমিত্ত বৃথা গৰ্জন করিয়া এই সুখপ্রমুপ্ত জনগণের নিদ্রা ভঙ্গ করিতেছিস্? আর কি নিমিত্তই বা স্বীয় ভগিনীকে বধ করিতে উদ্যত হইতেছিস্? ক্ষমতা থাকে আয়, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর। তোর ভগিনীর অপরাধ কি? শরীরান্তশ্চারী অনঙ্গই অপরাধী, তাহারই দুর্জয় কুসুম-শরে জর্জরিত হইয়া হিড়িম্বা আমাকে অভিলাষ করিয়াছে। ইহার কিছুমাত্র অপরাধ নাই; জানি না, তুই স্বয়ং ইহাকে আমার নিকটে পাঠাইয়াছি, এ এখানে আগমন করিয়াই আমার রূপলাবণ্য দর্শনে কন্দর্পণে মোহিত হইয়া যখন আমাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছে, তখন ও অবশ্যই আমার রক্ষণীয়া। রে রাক্ষসকুলকলঙ্ক দুরাত্মন্! তুই কি সাহসে আমি জীবিত থাকিতে আমার স্ত্রীর প্রাণনাশে উদ্যত হইয়াছিস্? যোগ্যতা থাকে আসিয়া আমার সঙ্গে সংগ্রাম কর; আমি এইক্ষণেই তোকে শমনসদনে প্রেরণ করিব। রে নরমাংসলোলুপ দুৰ্ব্বত রাক্ষস! আমি আজি তোর মস্তক চূর্ণ করিব; শ্যেন, কঙ্ক, গোমায়ু প্রভৃতি জন্তুগণ পরমাহাদপূর্বক তোর ধরণীলুণ্ঠিত মৃত দেহ আকর্ষণ করিবে। রে রাক্ষসাধম! তুই নিত্য নিত্য নরহত্যা করাতে এই বন পাপে পরিপূর্ণ হইয়াছে; আমি অদ্য মুহর্ভকাল মধ্যে ইহা রাক্ষসশূন্য করিব। যেমন সিংহ মহাগজকে আকর্ষণ করে, সেইরূপ অদ্য তোর ভগিনীর সমক্ষে তোকে আকর্ষণ করিব। রে রাক্ষসকুলাঙ্গার! অদ্য আমার হস্তে তোর মৃত্যু হইলে অরণ্যচারী পুরুষগণ নিঃশঙ্কচিত্তে এই বনে বিচরণ করিবে। হিড়িম্ব কহিল, রে নরাপসদ! তুই কেন অকারণ গৰ্জন করিতেছিস্? অগ্রে স্বীয় প্রতিজ্ঞানুরূপ কাৰ্যানুষ্ঠান কর, পরে আত্মশ্লাঘা করিস্। আম। অপেক্ষা বলবান্ বলিয়া মনে মনে যে তোর অহঙ্কার হইয়াছে, অবিলম্বে তাহা চূর্ণ করিব। আমি এই নিদ্রিত ব্যক্তিদিকে এখন কিছুই বলিব না। ইহারা স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাউক; অগ্রে তোকে বধ করিয়া তোর রক্ত পান করি, পরে এই নিদ্রিতদিগকে, তৎপরে এই অপ্রিয়কারিণী পাপীয়সী ভগিনীকে সংহার করিব।

রাক্ষস এইরূপ তর্জন গর্জন করিয়া বাহুপ্রসারণপূর্বক ক্রোধভরে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইল। মহাবলপরাক্রান্ত ভীম রাক্ষসকে সম্মুখাগত। দেখিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁহার বাহুযুগল ধারণ করিলেন এবং যেমন সিংহ ক্ষুদ্র মৃগকে অনায়াসে টানিয়া লইয়া যায়, সেইরূপ তাহাকে সে স্থান হইতে অষ্ট ধনু অন্তরে লইয়া গেলেন। রাক্ষস ভীমসেনের পরাক্রম দর্শনে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া ভীমকে ধারণ করিয়া গর্জ্জন করিতে লাগিল। তখন বৃকোদর জননীসমূবেত নিদ্রিত ভ্রাতৃগণের নিদ্রাভঙ্গভয়ে পুনর্বার তাহাকে বলপূর্বক আকর্ষণ করিয়া অপেক্ষাকৃত দূরে লইয়া গেলেন। তদনন্তর তাহারা দুইজনে পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ ও স্ব স্ব বিক্ৰম প্ৰকাশ করিতে লাগিলেন এবং যষ্টিবর্ষবয়স্ক ক্রোধান্বিত মত্ত মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষভঞ্জন ও লতাকৰ্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহাদের ভীষণ গর্জনে মাতৃসমবেত পাণ্ডবচতুষ্টয় জাগরিত হইয়া সম্মুখস্থতা হিড়িম্বাকে দেখিতে পাইলেন।