০৪৮. অশ্বকেতুপ্রমুখ মাগধগণের বধসাধন

৪৮তম অধ্যায়

অশ্বকেতুপ্রমুখ মাগধগণের বধসাধন

সঞ্জয় বললেন, “হে মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুনতনয় কর্ণের কর্ণ দেশে সুশাণিত কণিক নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার গাত্রে পঞ্চাশত শর নিক্ষেপ করিলেন মহাবাহু কর্ণ অভিমন্যুর শরাঘাতে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার গাত্রে শর নিক্ষেপ কিরতে লাগিলেন। সুভদ্রানন্দন কর্ণের শরে বিদ্ধ হইয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিলেন এবং ক্রোধভরে কর্ণের উপর অসংখ্য শর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। অভিমন্যুর বিষম শরনিকরে কর্ণের ক্ষত বিক্ষত গাত্র হইতে রুধিরধারা বিনির্গত হওয়াতে তাঁহারও অপূর্ব্ব শোভা হইল। ঐ দুই মহাবীরই পরস্পরের শরে বিদ্ধ ও রুধিরাক্ত কলেবর হইয়া পুষ্পিত কিংশুক তরুর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।

মহাবীর অভিমন্যু কর্ণের ছয় জন মহাবল পরাক্রান্ত সচিবের অশ্ব, সারথি, ধ্বজ ও রথ ছেদন পূর্ব্বক তাহাদিগকে সংহার করিলেন এবং অন্যান্য মহারথগণকে দশ দশ বাণে বিদ্ধ করিলেন। উহা অদ্ভুতের ন্যায় প্রতীয়মান হইয়া উঠিল। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুনতনয় ছয় বাণে মাগধের পুত্রকে সংহার করিয়া যুবা অশ্বকেতুকে অশ্বগণ ও সারথির সহিত শমন সদনে প্রেরণ করিলেন এবং ক্ষুর দ্বারা কুঞ্জরকেতু মাত্তিকাবতদেশীয় ভোজকে সংহার করিয়া শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবাহু দুঃশাসনতনয় চারি বাণে অভিমন্যুর চারি অশ্ব ও এক বাণে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহাকে দশ বাণে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুনতনয় দুঃশাসনতনয়ের শরাঘাতে ক্ষুব্ধ হইয়া তাঁহাকে দশ বাণে বিদ্ধ করিয়া রোষাক্ত নয়নে উচ্চস্বরে কহিতে লাগিলেন, হে দুঃশাসনতনয়! তোমার পিতা নিতান্ত কাপুরুষ; তিনি সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছেন। তুমি এই যুদ্ধে আমার হস্তে কদাপি পরিত্রাণ পাইবে না।

অভিমন্যু কর্ত্তৃক চন্দ্রকেতুপ্রমুখ বীরগণ বধ

মহাবীর অর্জ্জুনতনয় দুঃশাসন পুত্রকে এই কথা বলিয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া কর্ম্মকার-পরিমার্জিত নারাচ নিক্ষেপ করিলে মহাবাহু অশ্বত্থামা সত্বরে তিন তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ পূর্ব্বক অভিমন্যু নিক্ষিপ্ত নারাচ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর অর্জ্জুনতনয় অশ্বত্থামাকে প্রহার না করিয়া শল্যের উপর তিন শর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর মদ্ররাজ সত্বরে অভিমন্যুর বক্ষস্থলে গৃধ্রপক্ষযুক্ত নয় বাণ বিদ্ধ করিলেন। উহা অদ্ভুতবৎ প্রতীয়মান হইল। তখন সমর বিশারদ অর্জ্জুন নন্দন সত্বরে শল্যের শরাসন ছেদন এবং উভয় পার্ঞ্চি সারথিকে সংহার করিয়া তাঁহাকে ছয় অয়োময় শরে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর শল্য অভিমন্যুর শরে জর্জ্জরিত হইয়া সেই হতাশ্ব রথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্য রথে আরূঢ় হইলেন। সমর নিপুণ অর্জ্জুনতনয় শত্রুঞ্জয়, চন্দ্রকেতু, মহামেঘ, সুবর্চ্চা ও সুর্য্যভাম এই পাঁচ বীরকে সংহার করিয়া শকুনিকে শরবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। সুবলনন্দন অভিমন্যুকে তিন বাণে বিদ্ধ করিয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, মহারাজ! এক্ষণে সকলে একত্র হইয়াই অর্জ্জুনতনয়কে সংহার করা কর্ত্তব্য; নচেৎ অভিমন্যু এক এক করিয়া আমাদিগকে বিনাশ করিবে; অতএব দ্রোণ ও কৃপ প্রভৃতির সহিত উহার বধোপায় চিন্তা কর।

অভিমন্যু-বধমন্ত্রণা

অনন্তর মহাপ্রতাপশালী কর্ণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে কহিলেন, ব্রহ্মন্‌! অবিলম্বে অভিমন্যুর বধোপায় বলুন; নচেৎ অর্জ্জুনতনয় আমাদের সকলকেই সংহার করিবে। মহারথ দ্রোণাচার্য্য কর্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর সমুদায় কৌরব পক্ষ বীরগণকে কহিতে লাগিলেন, হে বীরগণ! তোমরা কি এপর্য্যন্ত অর্জ্জুনতনয়ের অণুমাত্র অবকাশ দেখিয়াছ? অর্জ্জুনতনয়ের লঘুচারিত্ব অবলোকন কর; অর্জ্জুনতনয় অভিমন্যু চারি দিক্‌ ভ্রমণ করিতেছে, তথাপি উহার কিছু মাত্র অবকাশ লক্ষিত হইতেছে না। ঐ মহাবীর এত শীঘ্র শর সন্ধান ও পরিত্যাগ করিতেছে যে, রথোপরি কেবল উহার চাপ মণ্ডল লক্ষিত হইতেছে। অরাতি নিপাতন মহাবীর সুভদ্ৰাতনয় শরজালে আমাকে একান্ত ব্যথিত ও মোহিত করিয়াও সন্তুষ্ট করিতেছে। কৌরব পক্ষ মহারথগণ ক্রোধ পরবশ হইয়াও উহার যে অণুমাত্র অবকাশ প্রাপ্ত হইতেছেন না, তাহাতে আমার আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। মহাবীর অর্জ্জুনতনয় ক্ষিপ্রহস্তে শর দ্বারা দশ দিক্‌ সমাবৃত করাতে গাণ্ডীবধারী মহাবীর অর্জ্জুন হইতে উহার কিছু মাত্র বিভিন্নতা দৃষ্ট হইতেছে না।

তখন মহাবাহু কর্ণ অর্জ্জুনতনয়ের শরে আহত হইয়া পুনরায় দ্রোণকে কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন! বীরগণের সমর পরিত্যাগ করা উচিত নয় বলিয়া আমি অভিমন্যুর শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াও এ স্থানে অবস্থান করিতেছি। ঐ মহাতেজা অর্জ্জুনকুমারের পাবক সদৃশ পরম দারুণ শরনিকরে আমার হৃদয় বিদলিত হইতেছে।

মহাবীর দ্রোণাচার্য্য কর্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর হাসিতে হাসিতে কহিলেন, হে রাধেয়! মহাবীর অভিমন্যুর কবচ অভেদ্য। আমি উহার পিতাকে কবচ ধারণে সুশিক্ষিত করিয়াছি; ঐ বীরও তাঁহার নিকট তদ্বিষয়ে সুশিক্ষিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু সাতিশয় যত্ন সহকারে সুতীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া উহার ধনু, জ্যা, অশ্ব, সারথি ও উভয় পার্ঞ্চিসারথিকে অনায়াসে ছেদন করা যাইতে পারে; অতএব 
যদি সমর্থ হও, তবে উহার শরাসন প্রভৃতি ছেদন করিয়া উহাকে সমরবিমুখ কর; পশ্চাৎ সংগ্রাম করিও। যতক্ষণ উহার করে শরাসন থাকিবে, ততক্ষণ উহাকে পরাজয় করা সমুদায় দেব ও অসুরগণেরও সাধ্য নহে। অতএব যদি উহাকে পরাজয় করিবার বাসনা থাকে, তাহা হইলে অবিলম্বে উহাকে বিরথ ও শরাসনশূন্য কর।

ছয় মহারথী কর্ত্তৃক অভিমন্যু আক্রমণ

মহাবীর কর্ণ দ্রোণের বাক্য শ্রবণানন্তর সত্বরে শর নিক্ষেপ পূর্ব্বক অভিমন্যুর শরাসন ছেদন করিলে ভোজ তাঁহার অশ্ব সমুদায় ও কৃপ তাঁহার পার্ষ্ণিসারথিদ্বয়কে সংহার করিলেন। অন্যান্য বীরগণ তাঁহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সেই করুণরসশূন্য ছয় মহা রথ সত্বরে এক কালে একাকী বালক অভিমন্যুকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ছিন্নশরাসন রথবিহীন অর্জ্জুন তনয় স্বীয় বীর ধর্ম্ম প্রতিপালন করত খড়্গ চৰ্ম্ম ধারণ পূর্ব্বক আকাশ মার্গে সমুত্থিত হইয়া মহাবেগে কৌশিকাদি গতি দ্বারা গরুড়ের ন্যায় আকাশে বিচরণ করিতে লাগিলেন। রন্ধ্রদর্শনতৎপর মহাধনুর্দ্ধরগণ এই অভিমন্যু অসিহস্তে আমার উপর নিপতিত হইবে মনে করিয়া উৰ্দ্ধদৃষ্টি হইয়া তাঁহাকে বাণ বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন; অরাতি নিপাতন মহাবীর দ্রোণ সত্বরে তাঁহার খড়্গের মণিময় মুষ্টিদেশে সুতীক্ষ্ণ নারাচ নিক্ষেপ পূর্ব্বক ছেদন করিলেন এবং কর্ণ শাণিত শরনিকরে তাঁহার চর্ম্ম ছেদন করিলেন। এইরূপে অসি, চর্ম্ম ও বাণ সমুদায় ছিন্ন হইলে মহাবীর অর্জ্জুনতনয় চক্র গ্রহণ পূর্ব্বক পুনরায় ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া ক্রোধভরে দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। ঐ সময় চক্ররেণু সমুজ্জ্বল কলেবর মহাবীর অভিমন্যু চক্র ধারণ পূর্ব্বক সমরে বাসুদেবের অনুকরণ করত সাতিশয় ভয়ানক হইয়া উঠিলেন। তৎকালে অমিততেজা, সিংহনাদকারী, বীরগণ মধ্যস্থিত মহাবীর অভিমন্যুর দেহ হইতে শোণিত বিনির্গত হইয়া বস্ত্র রক্তবর্ণ ও ভ্রুকুটি দ্বারা ললাট ফলক কুটিল হওয়াতে অপূর্ব্ব শোভা হইল।”