০১৩. দুর্য্যোধন দুরভিসন্ধি প্রকাশে অর্জ্জুন সতর্কতা

১৩শ অধ্যায়

দুর্য্যোধন দুরভিসন্ধি প্রকাশে অর্জ্জুন সতর্কতা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! দ্রোণাচার্য্য যুধিষ্ঠিরের নিগ্রহ বিষয়ে সীমাবদ্ধ প্রতিজ্ঞা করিলে পর আপনার সৈনিকগণ সেই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া বাণধ্বনি ও শঙ্খশব্দের সহিত সিংহনাদ করিতে লাগিল।

এ দিকে রাজা যুধিষ্ঠির আপ্ত লোক দ্বারা ন্যায়ানুসারে দ্রোণাচাৰ্য্য চিকীর্ষিত সমুদায় বৃতান্ত শীঘ্র অবগত হইয়া অন্যান্য লোক ও ভাতৃগণকে আনয়ন পূর্ব্বক ধনঞ্জয়কে কহিলেন, হে পুরুষোত্তম! অদ্য দ্রোণাচার্য্যের চিকীর্ষিত সকল তোমার শ্রবণগোচর হইয়াছে, এক্ষণে যাহাতে তাহা সফল না হয়, এরূপ নীতি বিধান কর। হে মহাধনুর্দ্ধর! শত্রুনিপাতন দ্রোণ সীমাবদ্ধ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন এবং সেই সীমা তোমাতেই নিহিত হইয়াছে; অতএব তুমি আজি আমার নিকটে থাকিয়া দ্রোণের সহিত যুদ্ধ কর; দুর্য্যোধন যেন দ্রোণের সাহায্যে পূর্ণকাম না হয়।

অর্জ্জুন কহিলেন, হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! যেমন কোন কালেই আচার্য্যের প্রাণসংহার আমার কর্ত্তব্য নয়, সেইরূপ আপনাকে পরিত্যাগ করাও আমার অভিলষিত নয়; যদি আমাকে যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করিতে হয়, তথাপি কোন ক্রমেই আচার্য্যের বিপক্ষ হইব না; কিন্তু দুৰ্য্যোধন যে আপনাকে গ্রহণ করিয়া রাজ্য কামনা করিতেছে, তাহা এই জীবলোকে কখনই পরিপূর্ণ হইবে না। যদি বজ্রধর স্বয়ং বা দেবগণ সমবেত বিষ্ণু সমরে তাহার সাহায্য করেন, তথাপি সে আপনাকে গ্রহণ করিতে পারিবে না। হে রাজেন্দ্র দ্রোণাচাৰ্য্য নিখিল অস্ত্র শস্ত্রধরের শ্রেষ্ঠ হইলেও আমি জীবিত থাকিতে আপনি তাঁহাকে ভয় করিবেন না। আমি আপনাকে আরও কহিতেছি যে, আমার প্রতিজ্ঞা কদাচ ভঙ্গ হয় না; আমি কখন মিথ্যা বাক্য কহিয়াছি কি পরাজিত হইয়াছি অথবা প্রতিশ্রুত হইয়া কিঞ্চিত্মাত্রও অন্যথা করিয়াছি, ইহা আমার স্মরণ হয় না।

একাদশ দিবসীয় যুদ্ধ – দ্রোণ-পাণ্ডব সমর

অনন্তর মহাত্মা পাণ্ডবগণের নিবেশনে শঙ্খ, ভেরী, মৃদঙ্গ ও আনক সকল বাদিত হইতে লাগিল; গগনস্পর্শী, অতি ভীষণ সিংহনাদ এবং ধনু, জ্যা ও তলধ্বনি সমুত্থিত হইল। মহা বীর পাণ্ডবদিগের শঙ্খধ্বনি শ্রবণ করিয়া আপনার সৈন্য মধ্যেও বাদিসকল বাদিত হইতে লাগিল। অনন্তর আপনার ও পাণ্ডবগণের সংব্যূহিত যুদ্ধাভিলাষী সৈন্যগণ যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত ক্রমশ পরস্পর নিকটবর্তী হইলে পাণ্ডব ও কৌরবগণের এবং দ্ৰোণ ও পাঞ্চালদিগের লোমহর্ষণ তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সৃঞ্জয়গণ দ্রোণপালিত সৈন্য বিনাশে প্রযত্ন সহকারে প্রবৃত্ত হইয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারিল না। দুৰ্য্যোধনের মহারথ যোদ্ধাগণও অর্জ্জুন পালিত পাণ্ডব সেনাগণের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইল না। সুতরাং দ্রোণার্জ্জুন পালিত উভয় সেনাই রাত্রিকালীন দুই কুসুমিত বনরাজির ন্যায় নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। অনন্তর দীপ্যমান দিবাকর সদৃশ, সুবৰ্ণরথ দ্রোণ পাণ্ডব সেনাগণকে নিষ্পেষণ করিয়া তাহার অভ্যন্তরে বিচরণ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ সেই রথারোহী ক্ষিপ্রকারী একমাত্র দ্রোণাচাৰ্য্যকে বহুবিধ বিভীষিকা স্বরূপ বলিয়া বোধ করিলেন। দ্রোণবিমুক্ত ভীষণ শরনিকর পাণ্ডব সৈন্যগণকে ত্রাসিত করিয়া ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। আচার্য্য দ্রোণ মধ্যাহ্নকালীন, কিরণশত সংবৃত দিবাকরের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিলেন। দানবগণ যেমন সমরক্রুদ্ধ দেবরাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে সমর্থ হয় নাই, সেই রূপ পাণ্ডবগণের মধ্যে কেহই তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে পারিল না। অনন্তর প্রতাপবান্ দ্রোণাচার্য্য সৈন্যগণকে বিমোহিত করিয়া শীঘ্র শরজালে ধৃষ্টদ্যুম্নের সেনাগণকে তাড়না করিতে আরম্ভ করিলেন এবং যে স্থানে ধৃষ্টদ্যুম্ন অবস্থান করিতে ছিলেন, সমস্ত দিক্ ও আকাশমণ্ডল শরনিকরে আবৃত করিয়া সেই স্থানেই পাণ্ডব সেনাগণকে বিমর্দ্দিত করিতে লাগিলেন।