০০৯. দ্রোণবধবৃত্তান্ত শ্রবণেচ্ছু ধৃতরাষ্ট্রের সখদোক্তি

৯ম অধ্যায়

দ্রোণবধবৃত্তান্ত শ্রবণেচ্ছু ধৃতরাষ্ট্রের সখদোক্তি

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয়! পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ তাদৃশ অস্ত্রনিপুণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে কি প্রকারে সংহার করিলেন, তাঁহার কি রথ ভগ্ন বা শাসন বিশীর্ণ হইয়াছিল? অথবা তিনি অনবধান হইয়াছিলেন যে, সেই নিমিত্ত মৃত্যু প্রাপ্ত হইলেন? যিনি ভূরি ভূরি স্বর্ণপুঙ্খ শরজাল বিকীর্ণ করিতেছিলেন, যিনি অবহিত হইয়া দুষ্কর কর্ম্মকলাপ সম্পাদন করিতে ছিলেন, যিনি অতি দূরে শরক্ষেপ করিতে পারিতেন, যিনি শস্ত্রযুদ্ধে পারীণ হইয়াছিলেন, যিনি দিব্যাস্ত্রধারণ করিতেন, যিনি শত্রুগণের দুরভিভবনীয়, ক্ষিপ্রহস্ত, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, কৃতী, চিত্রযোধী, দান্ত, ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই অক্ষয় দ্রোণাচাৰ্য্যকে কি প্রকারে সংহার করিল? পৌরুষ অপেক্ষা দৈবের বলই অধিক, এই নিমিত্ত দ্রোণাচার্য্য মহাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে নিহত হইলেন। যাঁহাতে চতুর্বিধ অস্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই দ্রোণাচার্য্য নিহত হইয়াছেন কহিতেছ! যিনি ব্যাঘ্ৰ চৰ্ম্ম পরিবৃত স্বর্ণময় রথে আরোহণ করিতেন, সেই দ্রোণাচার্য্য নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া আজি আর শোকের শান্তি হইতেছে না। ইহা যথার্থ যে, পরের দুঃখে কাহার প্রাণ বহির্গত হয় না, এই মন্দভাগ্য ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণের মৃত্যু শ্রবণ করিয়াও জীবিত আছে। এক্ষণে দৈবই প্রধান; পুরুষকার নিরধক বলিয়া বোধ হইতেছে। আমার হৃদয় প্রস্তরের সারাংশ দ্বারা নির্মিত হইয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই; এই নিমিত্ত দ্রোণাচার্যের মৃত্যু শ্রবণে শতধা বিদীর্ণ হইতেছে না। গুণার্থীব্রাহ্মণ এবং রাজপুত্রগণ ব্রাহ্ম ও দৈবশাস্ত্রের নিমিত্ত যাহার উপাসনা করিতেন, মৃত্যু তাঁহাকে কি প্রকারে বিনাশ করিল? আমি সাগরের শোষণ, মেরুর উৎসারণ ও দিবাকরের নিপাতনের ন্যায় দ্রোণাচার্যের মৃত্যু আমার সহ্য হইতেছে না।

যিনি দুষ্টগণকে নিবারণ ও ধাৰ্মিকগণকে রক্ষা করিতেন, যিনি দীন দুর্য্যোধনের নিমিত্ত প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছেন মূঢ়মতি আমার পুত্রগণের জয়াশা যাঁহার বিক্রমের উপর নির্ভর করিত, যিনি বুদ্ধিতে বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য্যের সদৃশ ছিলেন, তিনি কি প্রকারে নিহত হইলেন? যাঁহার অশ্বগণ হিরন্ময় জালে আচ্ছন্ন থাকিত, সর্ব্বপ্রকার শস্ত্রপাত অতিক্রম করিত, সংগ্রামকালে দৃঢ় হইয়া অবস্থান করিত, শঙ্খ দুন্ধুভি শ্রবণজনিত করিবৃংহিত, জ্যাক্ষেপ, শর ও শস্ত্র সহ্য করিত, পরিশ্রম করিলেও ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করিত না, কদাচ ব্যথিত হইত না এবং শত্রুগণের পরাজয় কীৰ্তন করিত, দ্রোণের সেই শোণবর্ণ, বৃহৎ কলেবর, বায়ুসম বেগশীল, বলবান, শান্ত, অবিহ্বল সিন্ধুদেশীয় অশ্বগণ অতি শীঘ্র কি পরাজিত হইয়াছিল? দ্রোণাচার্য্য সেই সমস্ত অশ্বকে সুবর্ণভূষিত রথে যোজিত করিয়া তাহাতে আরোহণ পূর্ব্বক কি নিমিত্ত পাণ্ডবগণের সেনা হইতে উত্তীর্ণ হন নাই?

যে সত্যসন্ধ শূরশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্য্যের বিদ্যা সকল ধনুর্দ্ধরের উপজীবিকা, তিনি কিরূপ যুদ্ধ করিয়াছিলেন? কোন্ সকল রথী ইন্দ্রসদৃশ, ধনুর্দ্ধরগণের শ্রেষ্ঠ, উগ্ৰকৰ্ম্মা দ্রোণাচাৰ্য্যকে প্ৰত্যুদগমন করিয়াছিল? পাণ্ডবগণ সেই মহাবলকে অবলোকন করিয়া কি পলায়ন করিয়াছিল, কিম্বা সমুদায় সৈন্য ও ধৃষ্টদ্যুম্ন সমভিব্যাহারে তাঁহাকে নিবারণ করিয়াছিল? অথবা ধনঞ্জয় শরনিকরে অন্যান্য পার্থিবগণকে নিবারণ করিলে পাপকৰ্ম্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াছিল, সন্দেহ নাই। অর্জ্জুন কর্ত্তৃক পরিরক্ষিত ভীষণ ধৃষ্টদ্যুম্ন ভিন্ন আর কেহ দ্রোণকে বধ করিয়াছে, এমন বোধ হয়না। বোধ হয়, যেমন পিপীলিকাগণ বিষধরকে আকুলিত করে, সেইরূপ কৈকেয়, চেদি ও কারূষগণ এবং অন্যান্য ভূমিপাল সকল অসুকর কর্মে ব্যাপৃত দোণাচাৰ্য্যকে আকুলিত করিলে পাঞ্চালাধম ধৃষ্টদ্যুম্ন শূরগণে পরিবৃত হইয়া তাঁহাকে বধ করিয়াছিল। যেমন সাগর সমুদায় তরঙ্গিণীর আধার, সেইরূপ যিনি ষড়ঙ্গ সমবেত চারি বেদ ও আখ্যান অধ্যয়ন করিয়া ব্রাহ্মণগণের আশ্রয় হইয়াছিলেন এবং ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ উভয়রূপ ধারণ করিয়াছিলেন, সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কি প্রকারে শস্ত্রাঘাতে নিহত হইলেন? ক্রোধনস্বভাব দ্রোণাচাৰ্য্য আমার নিমিত্ত সর্ব্বদা ক্লেশ প্রাপ্ত হইয়া পার্থকে যে শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার সমুচিত ফল লাভ করিয়াছেন। যাহার কর্ম্ম ধনুর্দ্ধরগণের উপজীবিকা, যিনি সত্যসন্ধ ও পুণ্যবান্, সম্পত্তি-লোলুপেরা তাঁহাকে কি প্রকারে সংহার করিল? পাণ্ডবগণ পুরন্দরের ন্যায় শ্রেষ্ঠ, মহাসত্ত্ব, ক্ষিপ্রহস্ত, দৃঢ়ধন্বা মহাবল দ্রোণাচাৰ্য্যকে কি প্রকারে বধ করিল? ক্ষুদ্র মৎস্যেরা কি তিমি সংহার করিতে পারে? জয়ার্থী ব্যক্তি যাঁহার গোচরে উপস্থিত হইলে জীবিত থাকিতে পারিত না, বেদার্থিগণের বেদশব্দ ও ধনুর্দ্ধরগণের জ্যানির্ঘোষ যাঁহাকে কখন পরিত্যাগ করে নাই, যিনি অদীন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, শ্ৰীমান্‌, অপরাজিত এবং সিংহ ও দ্বিরদের ন্যায় বিক্রমশালী, সেই দ্রোণাচার্য্যের মৃত্যু আমার সহ্য হইতেছে না।

যাঁহার যশ বল কেহই পরাভব করিতে পারে না, ধৃষ্টদ্যুম্ন পুরুষেগণের সমক্ষে সেই দুর্দ্ধর্ষ দ্রোণাচাৰ্য্যকে কি প্রকারে সংহার করিল? কাহারা দ্রোণাচার্যের অগ্রে অবস্থান করিয়া তাঁহাকে রক্ষা করত নিকট হইতে যুদ্ধ করিয়াছিল? কাহারা দুর্লভ গতি লাভ করিয়া পশ্চাৎ ভাগে অবস্থান করিয়াছিল? কাহারা দক্ষিণ চক্র ও কাহারাই বা বাম চক্র রক্ষা করিয়াছিল? দ্রোণাচার্য্যের যুদ্ধ সময়ে কাহারা তাঁহার সম্মুখে অবস্থান করিয়াছিল এবং কাহারাই বা সেই যুদ্ধে প্রতিকুল মৃত্যু ও কাহারাই বা পরম গতি প্রাপ্ত হইয়াছে? দ্রোণের রক্ষক মন্দমতি ক্ষত্রিয়গণ কি ভয়ে তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল? শত্রুগণ কি তাঁহাকে নির্জ্জনে বধ করিয়াছে? তিনি ত নিতান্ত বিপন্ন হইলেও ভয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতেন না, তবে শত্রুগণ তাঁহাকে কি প্রকারে বধ করিল? আর্য্য ব্যক্তির কর্ত্তব্য যে, ঘোরতর আপদ উপস্থিত হইলে যথাশক্তি পরাক্ৰম প্ৰকাশ করিবেন, তিনি তাহাও করিয়াছেন! হে সঞ্জয়! আমার মন মোহাবিষ্ট হইতেছে, এক্ষণে কথা নিবৰ্তিত কর; পুনরায় সংজ্ঞা লাভ করিয়া তোমাকে জিজ্ঞাসা করিব।