৪৩. কর্ণের ধৈর্য্যগুণগৌরব-পরশুরামশাপ

৪৩তম অধ্যায়

কর্ণের ধৈর্য্যগুণগৌরব-পরশুরামশাপ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ মদ্ররাজের সেই কঠোর বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! আমি অর্জ্জুন ও বাসুদেবকে সম্যক অবগত হইয়াছি। আমি বাসুদেবের রথচালন ও অর্জ্জুনের অস্ত্রবল যেরূপ জ্ঞাত আছি, তুমি তদ্রূপ নও; অতএব আমি নির্ভীক্‌চিত্তে সেই অস্ত্রবিদ্‌গণের অগ্রগণ্য মহাত্মা বীরদ্বয়ের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইব; কিন্তু দ্বিজোত্তম পরশুরামের শাপের নিমিত্ত আমার অতিশয় সন্তাপ হইতেছে। পূর্ব্বে আমি দিব্যাস্ত্রশিক্ষার নিমিত্ত ব্রাহ্মণবেশে পরশুরামের সমীপে অবস্থান করিয়াছিলাম। একদা গুরু আমার ঊরুদেশে মস্তক অর্পণ করিয়া নিদ্রিত হইলে, দেবরাজ ইন্দ্র অর্জ্জুনের হিতাভিলাষে আমার বিঘ্নবিধানার্থ কীটরূপ ধারণ করিয়া আমার ঊরুদেশ বিদীর্ণ করিলেন। ঊরুদেশ বিদারিত হইলে তাহা হইতে অতিমাত্র শোণিত বিনির্গত হইতে লাগিল, তথাপি আমি আমার গুরুর নিদ্রাভঙ্গভয়ে স্থির হইয়া রহিলাম। ক্ষণকাল পরে মহাত্মা জমদগ্নিতনয় বিনিদ্র হইয়া সেই শোণিতদর্শনে আমার দৃঢ়তর ধৈৰ্য্যগুণ পৰ্য্যালোচনা করিয়া কহিলেন, —বৎস! তুমি ব্রাহ্মণ নহ; অতএব যথার্থরূপে আত্ম-পরিচয় প্রদান কর। তখন আমি সূতপুত্র বলিয়া আত্মপরিচয় প্রদান করিলাম। মহাতপাঃ ভার্গব আমার বাক্যশ্রবণে রোষাবিষ্ট হইয়া আমাকে এই অভিশাপ প্রদান করিলেন যে,—রে দুরাত্মম্‌! তুমি শঠতাচরণপূর্ব্বক আমার নিকট হইতে যে ব্রহ্মাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছ, তোমার মৃত্যুকাল উপস্থিত হইলে তাহা আর স্মৃতিপথারূঢ় হইবে না; রে মূঢ়! অব্রাহ্মণ কি কখন ব্রাহ্মণ হইতে পারে?

নির্ভীক কর্ণের অর্জ্জুনসহ যুদ্ধে দৃঢ়তা

“হে মদ্ররাজ! আজ এই ভীষণ তুমুল সংগ্রামে আমি সেই অস্ত্র বিস্মৃত হইলে ভরতকুলতিলক ভীমপরাক্রম অর্জ্জুন সমস্ত ক্ষত্রিয়গণকে সন্তপ্ত করিবে, এই নিমিত্তই আমি যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়াছি। যাহা হউক, আমার সময় শর আছে, তদ্বারা আমি শত্রুগণকে সংহার করিয়া অসহ্যপরাক্রম সত্যপ্রতিজ্ঞ, ক্ররকর্ম্মা, মহাবলপরাক্রান্ত, মহাধনুর্দ্ধর ধনঞ্জয়কে বিনাশ করিব। মহাসমুদ্র অসংখ্য জনগণকে জলনিমগ্ন করিবার মানসে ভীষণ বেগে প্রবাহিত হইলে তীরভূমি যেমন তাহাকে নিবারণ করে, তদ্রূপ মহাস্ত্রবলসম্পন্ন মহাবীর অর্জ্জুন মর্ম্মভেদী অরাতিঘাতন শরনিকরে নরপালগণকে উন্মূলিত করিতে উদ্যত হইলে আমি বাণপাতে তাহাকে নিবারণ করিব। হে শল্য! যে মহাবীর অদ্বিতীয় ধনুর্দ্ধর এবং যে সমরাঙ্গনে সুরাসুরগণকেও পরাজিত করিতে সমর্থ, আজি সেই বীরের সহিত আমার ঘোরতর সংগ্রাম সন্দর্শন কর। প্রদীপ্ত মাৰ্ত্তণ্ড [উগ্রতেজোযূক্ত সূর্য্য]সদৃশ মহাবীর অর্জ্জুন অলৌকিক মহাস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক যুদ্ধার্থ সমাগত হইলে আমি মেঘের ন্যায় শরজালে তাহাকে সমাচ্ছন্ন করিয়া স্বীয় উত্তমাস্ত্রে তাহার অস্ত্রসকল ছেদনপূর্ব্বক তাহাকে ভূতলে নিপাতিত করিব। জলধর যেমন বারিবর্ষণে সর্ব্বলোকদহননান্মুখ প্রজ্বলিত হুতাশনকে প্রশমিত করে, তদ্রূপ আজ শরনিকরনিপাতে তাহাকে প্রশমিত করিব। সুতীক্ষ্ণদংষ্ট্র আশীবিষসদৃশ ক্রোধপ্রদীপ্ত কুন্তীনন্দন আজ আমার নিশিতভল্লপ্রহারে সমরে নিরস্ত হইবে। হিমাচল যেমন অনায়াসে অত্যুগ্ম বায়ুবেগ সহ্য করে, দ্রুপ আমি রথমার্গ বিশারদ সমরনিপুণ ধনঞ্জয়ের পরাক্রম সহ্য করিব। যে মহাবীর স্বীয় বাহুবলে সমুদয় পৃথিবী পরাজিত করিয়াছিল, যাহার তুল্য যোদ্ধা আর কেহই নাই, অদ্য আমি তাহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইব। যে বীরপুরুষ খাণ্ডবদাহকালে দেবগণের সহিত অসংখ্য জীবজন্তু পরাজিত করিয়াছিলেন, আমি ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া সেই সব্যসাচীর সহিত সংগ্রামে সমুদ্যত হইতে সমর্থ হয়? হে শল্য! আজ আমি নিশিতশরনিকরদ্বারা সেই অভিমানসম্পন্ন, শিক্ষিতাস্ত্র, দিব্যাস্ত্রবেত্তা, ক্ষিপ্রহস্ত, মহাবীর ধনঞ্জয়ের শিরচ্ছেদন করিব। অন্য কোন মনুষ্যই অসহায় হইয়া যাহার সহিত যুদ্ধ করিতে সাহসী হয় না, আমার মৃত্যুই হউক বা জয়লাভই হউক, অদ্য সেই ধনঞ্জয়ের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইব, সন্দেহ নাই। রে মূর্খ! তুমি কি নিমিত্ত আমার নিকট অর্জ্জুনের পৌরুষ প্রকাশ করিতেছ? আমি স্বয়ংই হৃষ্টমনে ভূপালগণসমক্ষে তাহার পুরুষকার কীৰ্ত্তন করিব।

কর্ণের শল্যভৎসনা

‘হে শল্য! তুমি অপ্রিয়কারী, নিষ্ঠুর, ক্ষুদ্রাশয় ও একান্ত অসহিষ্ণু; আমি তোমার সদৃশ শত ব্যক্তিকে বিনাশ করিতে পারি; কিন্তু এক্ষণে অসময় বলিয়া ক্ষমা প্রদর্শন করিলাম। তুমি নিতান্ত মূর্খের ন্যায় আমার অবমাননা করিয়া অর্জ্জুনের প্রতি প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিতেছ। দেখ, আমার সহিত সরল ব্যবহার করাই তোমার কর্ত্তব্য; কিন্তু তুমি তাহা না করিয়া আমার প্রতি কুটিলতা প্রদর্শন করিতেছ, সুতরাং তুমি অতি মিত্রদ্রোহী ও পাষণ্ড। রে মূঢ়! এক্ষণে রাজা দুৰ্য্যোধন স্বয়ং যুদ্ধে আগমন করিয়াছেন, ইহা অতি ভয়ঙ্কর কাল। আমি মহারাজ দুৰ্য্যোধনের প্রিয়কাৰ্য্যসংসাধনার্থ যত্ন করিতেছি, কিন্তু তুমি যাহাদের সহিত কিছুমাত্র মিত্ৰতা নাই, তাহাদেরই হিতানুষ্ঠানের অভিলাষ করিতেছ। হে শল্য! যিনি স্নেহ প্রদর্শন, হর্ষবর্দ্ধন, প্রীতিসম্পাদন, রক্ষাবিধান ও হিতাভিলাষ করেন, তিনিই মিত্র। আমার এই সমস্ত গুণ বিদ্যমান রহিয়াছে; তাহা রাজা দুৰ্য্যোধনেরও অবিদিত নাই। আর যে ব্যক্তি বিনাশসাধন, হিংসা, শাসনহীনতা ও অবসাদ সম্পাদন এবং বলপ্রকাশ করে, সেই শত্রু। তোমাতে এই উক্ত দোষসমুদয়ের প্রায় সকলই বিদ্যমান রহিয়াছে এবং তুমি তৎসমুদয় আমার প্রতি প্রদর্শন করিতেছ। যাহা হউক, হে শল্য! অদ্য আমি রাজা দুর্য্যোধনের হিতসাধন, তোমার প্রীতিসম্পাদন এবং আপনার জয়লাভ, যশোলাভ ও ধৰ্মলাভের নিমিত্ত পরমযত্নসহকারে অর্জ্জুন ও বাসুদেবের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব। তুমি এক্ষণে, আমার অদ্ভুত কাৰ্য্য, ব্রাহ্ম-অস্ত্র, ঐন্দ্র, বারুণ প্রভৃতি দিব্য-অস্ত্র ও মানুষ-অস্ত্রসমুদয় নিরীক্ষণ কর। যদি অদ্য আমার রথচক্র বিষম প্রদেশে নিপতিত না হয়, তাহা হইলে আমি মত্তমাতঙ্গ যেমন মত্তমাতঙ্গের সহিত সংগ্রাম আরম্ভ করে, তদ্রূপ মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া জয়লাভার্থ তাহার প্রতি দুর্নিবার ব্রাহ্ম-অস্ত্র নিক্ষেপ করিব। ঐ অস্ত্র হইতে কেহ পরিত্রাণ প্রাপ্ত হইতে সমর্থ নহে। হে শল্য! তুমি নিশ্চয় জানিবে যে, আমি দণ্ডধারী যম, পাশহস্ত বরুণ, গদাধারী ধনপতি কুবের ও সবজ্র বাসবপ্রমুখ কোন আততায়ী শত্রু হইতেই ভীত হই না। এই নিমিত্ত জনার্দ্দন ও ধনঞ্জয় হইতে আমার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র ভয়সঞ্চার হইতেছে না। অতএব অদ্য আমি অবশ্যই তাহাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব।

বিপ্রশাপবিড়ম্বিত কর্ণের দৈন্য

‘হে মদ্ররাজ! একদা আমি অস্ত্রাভ্যাসের নিমিত্ত প্রমত্তের ন্যায় অনবরত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক অটবীতে [পক্ষিসমাকুল বহু বৃক্ষসমাকীর্ণ বনে] পর্যটন করিয়া অজ্ঞানতানিবন্ধন কোন এক ব্রাহ্মণের হোমধেনুসম্ভূত[যজ্ঞনির্ব্বাহক গাভী হইতে জাত] বৎসকে সংহার করিয়াছিলাম। ব্রাহ্মণ তদ্দর্শনে আমাকে কহিলেন, তুমি প্রমত্ত হইয়া আমার এই মহাধেনুর বৎসকে বিনাশ করিয়াছ; অতএব তুমি যুদ্ধ করিতে যে সময় একান্ত ভীত হইবে, তৎকালে তোমার রথচক্র বিলমধ্যে নিপতিত হইবে সন্দেহ নাই। হে শল্য! আমি কেবল সেই ব্রাহ্মণের অভিশাপভয়ে ভীত হইতেছি। তিনি এইরূপে অভিশাপ প্রদান করিলে এই সময় সুখদুঃখের ঈশ্বর সোমবংশীয় ভূপালেরা তাহাকে সহস্ৰ ধেনু ও ছয়শত বলিবর্দী প্রদান করিলেন; কিন্তু ব্রাহ্মণ কিছুতেই প্রসন্ন হইলেন না। পরে আমিও সাতশত দীর্ঘদন্ত হস্তী ও অসংখ্য দাসদাসী প্রদান করিয়া তাহাকে প্রসন্ন করিতে সমর্থ হইলাম না। তৎপরে আমি তাহাকে শ্বেতবর্ণ বৎসসম্পন্ন কৃষ্ণকায় চতুর্দ্দশসহস্ৰ ধেনু প্রদান করিলাম, ব্রাহ্মণ তথাপি প্রসন্ন হইলেন না। পরে আমি তাঁহার সৎকার করিয়া সর্ব্বোপকরণসম্পন্ন গৃহ ও সমস্ত ধন প্রদান করিলাম; কিন্তু তিনি তাহাও প্রতিগ্ৰহ করিলেন না। অনন্তর তিনি আমাকে প্রযত্নসহকারে অপরাধ মার্জনা করিবার নিমিত্ত প্রার্থনা করিতে দেখিয়া কহিলেন,-হে সূত! আমি যাহা কহিয়াছি, তাহা কদাচ অন্যথা হইবে না। মিথ্যাবাক্য কথিত হইলে প্রজা বিনষ্ট এবং তদ্দারা আমাকেও পাপগ্রস্ত হইতে হইবে। অতএব আমি ধর্ম্মরক্ষাৰ্থ মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিতে পারিব না। হে সূত! তুমি আমার সত্যের প্রতি হিংসা করিও না, মৎপ্রদত্ত শাপ তোমার গোবধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ হইবে। কেহই আমার বাক্য অন্যথা করিতে সমর্থ হইবে না। অতএব তুমি মত্ত অভিশাপের ফলভোগ কর। হে শল্য! আমি তোমাকর্ত্তৃক তিরস্কৃত হইয়াও বন্ধুতানিবন্ধন তোমাকে এই কথা কহিলাম। এক্ষণে তুমি তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক আরও যাহা যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর।”