৩৭. শল্যসারথ্যে কর্ণের যুদ্ধযাত্রা

৩৭ম অধ্যায়

শল্যসারথ্যে কর্ণের যুদ্ধযাত্রা

“দুর্য্যোধন কহিলেন, ‘হে কর্ণ! এই মদ্ররাজ শল্য অর্জ্জুনসারথি কৃষ্ণ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট; ইনি তোমার সারথ্যকাৰ্য্য করিবেন। মাতলি যেমন ইন্দ্রের অশ্বযুক্ত রথ পরিচালন করেন, তদ্রূপ অদ্য এই মহাত্মা শল্য তোমার রথসঞ্চালনে প্রবৃত্ত হইবেন। তুমি যোদ্ধা ও মদ্ররাজ সারথি হইলে পার্থগণ সমরে পরাভূত হইবে সন্দেহ নাই।’ ”

সঞ্জয় কহিলেন, ‘হে মহারাজ! অনন্তর প্রাতঃকাল হইলে দুৰ্য্যোধন পুনরায় মহাবলপরাক্রান্ত শল্যকে কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! আপনি সংগ্রামে কর্ণের সুশিক্ষিত অশ্বসকলকে পরিচালিত করুন। আপনি রক্ষক হইলে সূতপুত্ৰ ধনঞ্জয়কে অবশ্যই পরাজিত করিতে পারিবেন। তখন মদ্ররাজ দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণে ‘তথাস্তু’ বলিয়া কর্ণের রথে আরোহণ করিলেন।’ শল্য সারথি হইলে কর্ণ সুস্থির চিত্তে তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে সারথে! তুমি অবিলম্বে আমার রথ সুসজ্জিত কর। তখন মদ্ররাজ ‘জয় হউক’ বলিয়া কর্ণের সেই গন্ধর্ব্বনগরোপম শ্রেষ্ঠ রথ সুসজ্জিত করিয়া তাঁহার নিকট আনয়ন করিলেন। ঐ রথ পূর্ব্বকালে বেদবিৎ পুরোহিতকর্ত্তৃক সংস্কৃত হইয়াছে। মহারথ কর্ণ সেই রথকে যথাবিধি পূজা ও প্রদক্ষিণ করিয়া ভগবান্ ভাস্করের উপাসনা সমাধানপূর্ব্বক সমীপস্থ মদ্ররাজকে রথারোহণে আদেশ করিলেন। মহাতেজাঃ শল্য কর্ণের, আদেশানুসারে সিংহ যেমন পৰ্বতে আরোহণ করে, তদ্রূপ কর্ণের সেই প্রধান রথে সমারূঢ় হইলেন। তখন মহাবীর কর্ণ শল্যকে রথারূঢ় দেখিয়া সত্বর স্যন্দনে আরোহণপূর্ব্বক বিদ্যুৎসম্বলিতনীরদমধ্যস্থ দিনকরের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয় একরথে অধিরূঢ় হইলে তাঁহাদিগকে আকাশপথে মেঘসম্মিলিত সূৰ্য্য ও অনলের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। অনন্তর যজ্ঞস্থলে ঋত্বিগণ যেমন ইন্দ্র ও অগ্নির স্তব করে, তদ্রূপ বন্দিগণ সেই বীরদ্বয়ের স্তব করিতে আরম্ভ করিল। তখন শরনিরধারী পুরুষব্যাঘ্ৰ কর্ণ সেই মহারথে। আরোহণপূর্ব্বক শরাসন বিস্ফারণ করিয়া, মণ্ডলান্তর্গত মন্দরভূধরস্থ দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।

কর্ণের প্রতি দুর্য্যোধনের জয়াশীর্ব্বাদ

“অনন্তর দুৰ্য্যোধন সেই সমরোদ্যত মহাবাহু সূতপুত্রকে কহিলেন, ‘হে কর্ণ! মহাবীর ভীষ্মদেব ও দ্রোণাচাৰ্য্য সমরে যে কর্ম্ম করিতে পারেন নাই, এক্ষণে তুমি সমস্ত ধনুর্দ্ধরগণের সমক্ষে সেই দুষ্কর কর্ম্ম সম্পাদন কর। আমি মনে করিয়াছিলাম, ভীষ্ম দ্রোণ নিশ্চয়ই অর্জ্জুন ও ভীমসেনকে নিপাতিত করিবেন; কিন্তু তাহারা তাহা করেন নাই। অতএব তুমি এক্ষণে দ্বিতীয় বজ্ৰপাণির ন্যায় বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজকে গ্রহণ অথবা ধনঞ্জয়, ভীমসেন এবং মাদ্রীপুত্র নকুল ও সহদেবকে সংহার কর। হে সূতনন্দন! তোমার জয় ও মঙ্গললাভ হউক, তুমি যুদ্ধে গমনপূর্ব্বক পাণ্ডবসেনাগণকে ভস্মীভূত কর।’

“হে মহারাজ! অনন্তর মেঘনিঃস্বনের ন্যায় সহস্র সহস্র তূৰ্য্য ও অযুত ভেরীর ঘোরতর শব্দ হইতে লাগিল। রথারূঢ় মহারথ কর্ণ দুর্য্যোধনবাক্যে অঙ্গীকার করিয়া যুদ্ধবিশারদ শল্যকে কহিলেন, ‘হে মহাবাহো! এক্ষণে অশ্বচালনা কর। আমি অচিরাৎ ধনঞ্জয়, ভীমসেন, নকুল, সহদেব ও রাজা যুধিষ্ঠিরকে সংহার করিব। আমি সহস্র সহস্র শরনিক্ষেপে প্রবৃত্ত হইতেছি; ধনঞ্জয় আমার বাহুবল দর্শন করুক। অদ্য আমি পাণ্ডববিনাশ ও দুর্য্যোধনের জয়লাভের নিমিত্ত সুতীক্ষ্ণ শরজাল বর্ষণ করিব।’

“শল্য কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! সাক্ষাৎ শতক্রতুও যাঁহাদের ভয়ে ভীত হইয়া থাকেন, তুমি সেই সর্ব্বাস্ত্রজ্ঞ মহাধনুর্দ্ধর মহাবল পাণ্ডবগণকে কি সাহসে অবজ্ঞা করিতেছ? সেই মহাবীরগণ কদাপি সমরে প্রতিনিবৃত্ত বা পরাজিত হইবে না। যখন শুনিবে, সংগ্রামস্থলে ধনঞ্জয়ের অশনিনির্ঘোষসদৃশ ভীষণ গাণ্ডীবনিঃস্ব হইতেছে এবং যখন দেখিবে, ভীমসেন কৌরবপক্ষীয় কুঞ্জরগণকে বিশীর্ণদন্ত [ভগ্নদন্ত] ও নিহিত করিতেছেন, ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির নকুলসহদেবসমভিব্যাহারে নিশিতশরনিকরে নভোমণ্ডলকে ঘনঘটা সমাচ্ছন্নের ন্যায় করিয়াছেন ও অন্যান্য লঘুহস্ত দুরাসদ [দুর্দ্ধর্ষ কূটযোধী] পার্থিবগণ শত্রুগণের প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতেছেন, তখন আর এরূপ কথা মুখে আসিবে না। হে মহারাজ! তখন কর্ণ মদ্ররাজের বাক্যে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক তাহাকে রথচালনা করিতে আদেশ করিলেন।”