২১. পাণ্ড্যরাজ প্রবীরসহ অশ্বত্থামার যুদ্ধ

২১তম অধ্যায়

পাণ্ড্যরাজ প্রবীরসহ অশ্বত্থামার যুদ্ধ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি পূৰ্বেই লোকবিশ্রুত পাণ্ড্যরাজ প্রবীরের নাম কীৰ্ত্তন করিয়াছ; কিন্তু তাঁহার সংগ্রামকাৰ্য্য বর্ণন কর নাই; অতএব এক্ষণে বিস্তারপূর্ব্বক আমার নিকট সেই বীরের বিক্রম, শিক্ষাপ্রভাব, বীৰ্য্য ও দর্প কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! যে মহাবীর ধনুর্ব্বিদ্যাপারগ, আপনার মতে সৰ্বশ্রেষ্ঠ, মহারথ ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, অর্জ্জুন ও বাসুদেবকে পরাক্রমদ্বারা পরাভূত-করিতে পারেন, যিনি কাহাকেও কখন আত্মতুল্য বোধ করেন না, যিনি আপনাকে কর্ণ ও ভীষ্মের সমকক্ষ এবং বাসুদেব ও অর্জ্জুন হইতে ন্যূন বলিয়া কখনই স্বীকার করেন না, সেই শস্ত্রধারাগ্রগণ্য ভূপালশ্রেষ্ঠ পাণ্ড্য প্রকোপিত অন্তকের ন্যায় কর্ণের সৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। সেই অসংখ্য রথ, অশ্ব ও পদাতিসঙ্কুল সেনাগণ পাণ্ড্যশরে নিপীড়িত হইয়া সমরে কুলালচক্রের ন্যায় ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। বায়ু যেমন মেঘমণ্ডল ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ অরাতিঘাতন পাণ্ড্য শরনিকরে অশ্ব, রথ, ধ্বজ, আয়ুধ, মাতঙ্গ ও সারথিসমুদয়কে বিধ্বস্ত করিয়া সৈন্যগণকে ছিন্নভিন্ন করিতে লাগিলেন। আরোহিসমবেত দ্বিরদগণ [হস্তী] পাণ্ড্যের ভীষণশরে ধ্বজ, পতাকা ও আয়ুধবিহীন হইয়া পারক্ষকদিগের সহিত প্রাণত্যাগপূর্ব্বক বজ্রাহত পৰ্ব্বতের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। ঐ মহাবীর সুতীক্ষ্নশরনিকরে শক্তি, প্রাস ও তূণীরধারী, সংগ্রামনিপুণ, অশ্বারূঢ়, মহাবলপরাক্রান্ত পুলিন্দ, খশ, বাহ্লীক, নিষাদ, অন্ধক, কুণ্ডল, দাক্ষিণাত্য ও ভোজগণকে শস্ত্র ও বর্ম্ম বিবর্জ্জিত করিয়া তাহাদিগকে নিহত করিলেন।

“ঐ সময় মহাবীর অশ্বত্থামা অশঙ্কিত পাণ্ড্যকে শরনিকরে সেই চতুরঙ্গিণী সেনা নিহত করিতে দেখিয়া অসম্ভ্রন্তচিত্তে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন এবং হাস্যমুখে মধুরবাক্যে তাঁহাকে সম্ভাষণপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে কমললোচন মহারাজ! তুমি সদ্বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছ; তোমার বল ও পৌরুষ সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধ রহিয়াছে এবং তোমার পরাক্রম ইন্দ্রের সদৃশ। তুমি বিশাল বাহুযুগলদ্বারা বিস্তৃত মৌৰ্ব্বীসম্পন্ন শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক মহাজলদের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়া শত্রুগণের প্রতি শরনিকর বর্ষণ করিতেছ। এক্ষণে আমি এই সমরে আমা ভিন্ন অন্য কাহাকেও তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী দেখিতে পাই না। অরণ্যে ভীমপরাক্রম সিংহ যেমন নির্ভীক চিত্তে মৃগগণকে বিনষ্ট করে, তদ্রূপ তুমি একাকী অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতির প্রাণসংহার করিতেছ এবং ভীষণ রথনিঃস্বনে ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডল কম্পিত করিয়া শস্যঘ্ন [শস্যনাশক] শব্দায়মান শরৎকালীন মহামেঘের ন্যায় শোভা পাইতেছ, অতএব তুমি এক্ষণে তূণীর হইতে সর্পসদৃশ সুনিশিত শরনিকর সমুদ্ধত করিয়া, অন্ধক যেরূপ ত্র্যম্বকের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল, তদ্রূপ কেবল আমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও।

“মলয়ধ্বজ পাণ্ড্য এইরূপে অশ্বত্থামার বাক্যবাণে তাড়িত হইয়া ‘তথাস্তু’ বলিয়া কর্ণি দ্বারা দ্রোণতনয়কে বিদ্ধ করিলেন। তখন দ্রোণপুত্র হাস্য করিয়া প্রথমতঃ অগ্নিস্ফুলিঙ্গসদৃশ উগ্র মর্ম্মভেদী শরনিকরে পাণ্ড্যকে নিপীড়িত করিয়া পুনরায় তাঁহার প্রতি দশমী গতিসংযুক্ত মর্ম্মভেদী নারাচসকল পরিত্যাগ করিলেন। মহাবীর পাণ্ড্য নিশিতনয়বাণে তৎক্ষণাৎ সেই নারাচনিকর খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তিনি চারিবাণে দ্রোণপুত্রের অশ্বগণকে নিপীড়িত ও নিহত করিয়া শরজালে তাঁহার শরনিকর ও বিস্তৃত জ্যা ছেদন করিলেন। অনন্তর অমিত্রঘাতন দ্রোণনন্দন স্বীয় শরাসনে অন্য জ্যারোপণপূর্ব্বক দেখিলেন যে, পরিচারকগণ অচিরাৎ তাঁহার রথে অন্যান্য উৎকৃষ্ট অশ্বসমুদয় সংযোজিত করিয়াছে। তখন তিনি সহস্র সহস্র শর পরিত্যাগপূর্ব্বক আকাশমণ্ডল ও দিঙ্মণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। পুরুষপ্রধান পাণ্ড্য অশ্বত্থামার শরনিকর নিঃশেষিত হইবার নহে জানিয়াও তৎপ্রযুক্ত সায়কসমুদয় খণ্ড খণ্ড করিয়া তাঁহার চক্ররক্ষকদ্বয়কে বিনাশ করিলেন।

“অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা পাণ্ডের হস্তলাঘব নিরীক্ষণপূর্ব্বক শরাসন আকর্ষণ করিয়া জলধরনিক্ষিপ্ত জলধারার ন্যায় শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তিনি দিবসের অন্ধ্রপ্রহরমধ্যে আট আটটি বৃষভসংযোজিত অষ্ট শঙ্কটপূর্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া নিঃশেষিত করিলেন। তৎকালে যে যে ব্যক্তি অন্তকেরও অন্তকসদৃশ রোষপরবশ অশ্বত্থামাকে নিরীক্ষণ করিল, তাঁহারা প্রায় সকলেই বিমোহিত হইল। এইরূপে মহাবীর অশ্বত্থামা মেঘ। যেমন গ্রীষ্মবসানে পৰ্বতপাদপপরিপূর্ণ পৃথিবীতে বারিবর্ষণ করে, তদ্রূপ শত্রুসৈন্যের উপর শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ড্য হৃষ্টমনে বায়ব্যাস্ত্রদ্বারা সেই দ্রোণকুমারনির্ম্মুক্ত শরজাল নিরাকরণ করিয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা পাণ্ড্যমহীপতির সিংহনাদ শ্রবণে ক্রুদ্ধ হইয়া তাহার চন্দনাগুরুভূষিত মলয়প্রতিম ধ্বজ ও চারি অশ্ব নিপাতিত করিয়া একশরে সারথিকে সংহারপূর্ব্বক অর্দ্ধচন্দ্রবাণে জলদনিঃস্বন শরাসন খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন এবং তৎপরে তাঁহার রথ চূর্ণ করিয়া অস্ত্রজাল বিস্তারপূর্ব্বক তন্নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসকল নিবারণ করিলেন। ঐ সময় দ্রোণতনয় পাণ্ড্যকে নিহত করিবার সুযোগ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার সহিত, সমর করিবার বাসনায় তাঁহাকে সংহার করিলেন না।

অশ্বত্থামার অস্ত্রে পাণ্ড্যরাজবধ

“ইত্যবসরে মহারথ কর্ণ পাণ্ডবগণের নাগবল [গজারোহী সৈন্য] ও অন্যান্য সৈন্যসমুদয় বিদ্রাবিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি রথীগণকে রথশূন্য করিয়া বহুসংখ্যক শরে অশ্ব ও হস্তীদিগকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। ঐ সময় এক সুসজ্জিত মহাবলপরাক্রান্ত মাতঙ্গ আবরাহিবিহীন ও অশ্বত্থামার শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া প্রতিদ্বন্দ্বী হস্তীর প্রতি তর্জনগর্জনপূর্ব্বক মহাবেগে পাণ্ড্যের অভিমুখে গমন করিল। তখন হস্তিযুদ্ধসুনিপুণ মলয়ধ্বজ পাণ্ড্য সত্বর সিংহনাদপরিত্যাগপূর্ব্বক কেশরী যেমন গিরিশিখরে আরোহণ করে, তদ্রূপ সেই মাতঙ্গে আরোহণ করিলেন এবং অঙ্কুশাঘাতদ্বারা উহার ক্রোধোদ্দীপন করিয়া ‘নিহত হইলি, নিহত হইলি’ বলিয়া বারংবার অশ্বত্থামাকে তর্জন করিয়া ক্রোধভরে তাহার প্রতি এক সূৰ্য্যকরপ্রখর তোমর প্রয়োগপূর্ব্বক আনন্দসহকারে সিংহনাদপরিত্যাগপুরঃসর তাহার মণি, হীরক, সুবর্ণ, অংশুক [সূক্ষ্মবস্ত্র] ও মুক্তাহারে সমলঙ্কৃত কিরীট ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সেই চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ ও পাবকের ন্যায় দ্যূতিসম্পন্ন কিরীট পাণ্ডের শরে ছিন্ন হইয়া বজ্রাভিহত অদ্রিশৃঙ্গের ন্যায় শব্দ করিয়া ভূতলে নিপতিত ও চূর্ণ হইয়া গেল। তখন মহারথ অশ্বত্থামা পদাহত ভুজঙ্গের ন্যায় রোষানলে প্রজ্বলিত হইয়া যমদণ্ডসন্নিভি চতুর্দ্দশ শর গ্রহণপূর্ব্বক পাঁচশরে হস্তীর পদচতুষ্টয় ও শুণ্ড, তিনশরে পাণ্ড্যর বাহুদ্বয় ও মস্তক এবং ছয়শরে তাঁহার ছয় অনুচরকে সমাহত ও নিপতিত করিলেন। তখন পাণ্ড্যরাজের চন্দনচর্চিত, সুবর্ণ মুক্তা মণি ও হীরকে সমলঙ্কৃত, সুদীর্ঘ, সুবৃত্ত [সুগোল] ভুজযুগল ধরাতলে নিপতিত হইয়া গরুড়নিহত উরগদ্বয়ের ন্যায় বিলুণ্ঠ্যমান হইতে লাগিল। তাঁহার কুণ্ডলালঙ্কৃত পূর্ণশশিসমপ্রভ রোষকষায়িতলোচনযুক্ত আননও ক্ষিতিতলে নিপতিত হইয়া বিশাখানক্ষত্রদ্বয়ের মধ্যগত চন্দ্রের ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। সমরনিপুণ মহাবীর অশ্বত্থামা এইরূপে পাণ্ড্যরাজের দেহ তিনশরে চারি অংশে এবং তাঁহার হস্তীর কলেবর পাঁচশরে ছয় অংশে বিভক্ত করাতে ইন্দ্রের বজ্ৰদ্বারা ছিন্ন সেই দেহদ্বয় দশধা বিভক্ত দশদৈবত হবির ন্যায় সমরাঙ্গনে নিপতিত রহিল।

“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর পাণ্ড্য বিপক্ষপক্ষীয় অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যকে খণ্ড খণ্ড করিয়া রাক্ষসগণের তৃপ্তিসাধনপূর্ব্বক শ্মশানাগ্নি যেমন মৃত কলেবরস্বরূপ স্বধা লাভ করিয়া সলিল দ্বারা উপশমিত হইয়া থাকে, তদ্রূপ দ্রোণপুত্রের শরাঘাতে প্রশান্তভাব অবলম্বন করিলেন। তখন আপনার আত্মজ রাজা দুৰ্য্যোধন সুহৃদৰ্গসমভিব্যাহারে সেই কৃতকাৰ্য্য আচাৰ্য্যপুত্ৰসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া, দেবরাজ যেমন বলাসুরবিজয়ী বিষ্ণুকে অর্চনা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ হৃষ্টমনে তাঁহাকে যথোচিত উপচারে সৎকার করিলেন।