০৯. কর্ণনাশে ধৃতরাষ্ট্রের শেষ-আশা ভঙ্গ

৯ম অধ্যায়

কর্ণনাশে ধৃতরাষ্ট্রের শেষ-আশা ভঙ্গ

সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপবাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে মহারাজ! সাধুগণ আপনাকে কুল, যশ, শ্ৰী, তপস্যা ও বিদ্যাতে নহুষনন্দন যযাতির ন্যায় বোধ করিয়া থাকেন। আপনি শাস্ত্রজ্ঞানবিষয়ে মহর্ষিদিগের ন্যায় কৃতকাৰ্য্য হইয়াছেন। অতএব এক্ষণে আর শোক করিবেন না, ধৈৰ্য্যাবলম্বন করুন।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! যখন শালতরুসন্নিভ সূতনন্দন সমরে নিহত হইয়াছেন, তখন দৈবই বলবান্; পুরুষকারে ধিক! উহা কোন কার্য্যকারক নহে। মহারথ কর্ণ শরনিকরে অসংখ্য যুধিষ্ঠিরসৈন্য ও পাঞ্চালদেশীয় রথীগণকে নিপাতিত, দিক তাপিত এবং বজ্রহস্ত বাসব যেমন অসুরগণকে মোহিত করেন, তদ্রূপ পাণ্ডবগণকে বিমোহিত করিয়া কিরূপে বায়ুভগ্ন বৃক্ষের ন্যায় সমরাঙ্গনে নিপতিত হইল? সূতপুত্রের নিধন নিতান্ত আশ্চর্য্যজনক। আমি কর্ণের নিধন ও অর্জ্জুনের জয়লাভ শ্রবণ করিয়া শোকসাগরের পারদর্শনে অসমর্থ হইয়াছি। আমার চিন্তা অতিশয় পরিবর্ধিত হইতেছে, কোনওক্রমেই আর প্রাণধারণ করিতে ইচ্ছা হয় না। হে সঞ্জয়! আমার হৃদয় নিশ্চয়ই বজ্রসারময় ও দুর্ভেদ্য; নতুবা পুরুষপ্রধান কর্ণের বিনাশবার্ত্তা শ্রবণে উহা কি নিমিত্ত বিদীর্ণ হইতেছে না? নিশ্চয়ই দেবতারা আমার সুদীর্ঘ পরমায়ু কল্পনা করিয়াছেন; সেই নিমিত্ত সূতপুত্রের নিধনবার্ত্তাশ্রবণে যারপরনাই দুঃখিত হইয়াও জীবিত রহিয়াছি। হে সঞ্জয়! এই বন্ধুহীন হতভাগ্যের জীবনে ধিক। অদ্য আমার এই গর্হিত দশা উপস্থিত হওয়াতে আমি নিতান্ত দীন ও সকলের শোচ্য [শোকাবহ] হইলাম। পূৰ্ব্বে সকল লোকেই আমাকে সৎকার করিত; এক্ষণে আমি শত্রুকর্ত্তৃক পরিভূত হইয়া কিরূপে জীবনধারণ করি? মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণের নিধনে আমি যারপরনাই দুঃখ ও ব্যসন প্রাপ্ত হইলাম। যখন সূতপুত্র নিহত হইয়াছে, তখন আমার সৈন্যগণও নিঃশেষিত হইল। যে মহাবীর কর্ণ আমার পুত্রগণকে সংগ্রামসাগর হইতে উত্তীর্ণ করিত, আজ সে অসংখ্য শর পরিত্যাগপুর্ব্বক সমরে নিহত হইয়াছে। সেই মহাবীর ব্যতীত আমার জীবনে প্রয়োজন কি? হায়! আজ সেই অধিরথনন্দন কর্ণ শরাৰ্দিত ও রুধিরাক্তকলেবর হইয়া রথ হইতে বজ্রবিদারিত পর্ব্বতশৃঙ্গের ন্যায়, মত্তমাতঙ্গবিনিপাতিত কুঞ্জরের ন্যায় সমরাঙ্গনে নিপতিত হইয়া ভূমণ্ডল সুশোভিত করিতেছে। যে মহাবীর মিত্রগণের অভয়প্রদ, আমার পুত্রগণের বল, পাণ্ডবগণের ভয়স্থান ও ধনুর্দ্ধরদিগের উপমাস্থল ছিল, সেই মহাধনুর্দ্ধর কর্ণ এক্ষণে দেবরাজবিদারিত পর্ব্বতের ন্যায় অর্জ্জুনশরে নিহত হইয়া রণশয্যায় শয়ন করিয়াছে। এক্ষণে দুর্য্যোধনের অভিলাষ পঙ্গুর গমনেচ্ছা, দরিদ্রের মনোভিলাষ ও তৃষিতের জলবিন্দুর ন্যায় কোন ফলোপধায়ক হইল না। আমরা যেরূপ কাৰ্য্য করিবার চিন্তা করি, তাহার বিপরীত কাৰ্য্য হইয়া উঠে। অতএব দৈবই বলবান ও কাল নিতান্ত দুরতিক্ৰমণীয়।

দারুণ দুঃশাসনশোকে ধৃতরাষ্ট্রের আত্মগ্লানি

“হে সঞ্জয়! আমার পুত্র দুঃশাসন কি দীনাত্মা হীনপৌরুষের ন্যায় পলায়নপরায়ণ হইয়া নিহত হইয়াছে? সে কি ক্ষত্রিয়প্রধান বীরগণের ন্যায় বীরত্ব প্রকাশ না করিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে? মহামতি যুধিষ্ঠির বারংবার যুদ্ধ করিতে নিষেধ করিয়াছিল, কিন্তু মূঢ়াত্মা দুর্য্যোধন যুধিষ্ঠিরের সেই ঔষধসদৃশ হিতকর বাক্যে আস্থা প্রদর্শন করে নাই। মহাত্মা ভীষ্মদেব শরশয্যায় শয়ান হইয়া অর্জ্জুনের নিকট পানীয় প্রার্থনা করিলে, পার্থ অবনী বিদারণপূর্ব্বক জলধারা উত্তোলিত করিয়াছিল। মহাবাহু শান্তনুনন্দন তদ্দর্শনে দুৰ্য্যোধনকে কহিয়াছিলেন, বৎস! আর সংগ্রাম করিও না; আমার নিধনেই তোমাদের যুদ্ধের শেষ হউক। তুমি এক্ষণে সন্ধি সংস্থাপনপূর্ব্বক শান্তিলাভ করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত ভ্ৰাতৃভাবে পৃথিবী ভোগ কর। হে সঞ্জয়! আমার পুত্র তৎকালে শান্তনুতনয়ের সেই বাক্যানুসারে কাৰ্য্য না করিয়া এক্ষণে শোকসন্তপ্ত হইতেছে। হায়! দীর্ঘদর্শী মহাত্মা বিদুর পূর্ব্বে যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহাই ঘটিতেছে। সর্ব্বনাশকর দুরোদর [পাশাখেলা] প্রভাবে আমার পুত্র ও অমাত্যগণ নিহত হইয়াছে; আমি নিতান্ত কৃচ্ছ্রে [কষ্টে] নিপতিত হইয়াছি। বালকগণ বিহঙ্গমের পক্ষচ্ছেদনপূর্ব্বক তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া তাড়ন করিতে আরম্ভ করিলে সে যেমন পক্ষহীন ও গমনে অসমর্থ হইয়া দারুণ যন্ত্রণা ভোগ করে, আমিও তদ্রূপ জ্ঞাতিবন্ধুহীন, অর্থহীন, নিতান্ত ক্ষীণ ও শত্রুগণের বশীভূত হইয়া যারপরনাই কষ্টভোগ করিতেছি। হায়! এখন কোথায় গমন করিব?”