০২. বৈশম্পায়ন-প্রত্যুত্তর—সঞ্জয়ধৃতরাষ্ট্র-সংবাদ

২য় অধ্যায়

বৈশম্পায়ন-প্রত্যুত্তর—সঞ্জয়ধৃতরাষ্ট্র-সংবাদ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর কর্ণ বিনষ্ট হইলে মহামতি সঞ্জয় রজনীযোগে উদ্বিগ্নমনে বায়ুবেগগামী অশ্বসমুদয় সঞ্চালনপূর্ব্বক সত্বর হস্তিনানগরীতে গমন করিয়া রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন এবং সেই হততেজাঃ কুরুরাজকে নিরীক্ষণপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার পাদবন্দন ও ন্যায়ানুসারে সৎকার করিয়া অতি কষ্ট সহকারে কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! আমি সঞ্জয়। কেমন, আপনি ত’ সুখে আছেন? আপনি আপনার দোষে ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইয়া ত’ বিমোহিত হয়েন নাই? বিদুর, দ্রোণ, ভীষ্ম, কেশব, রাম [বলরাম] এবং নারদ ও কণ্বপ্রমুখ মহর্ষিগণ আপনাকে সভামধ্যে হিতোপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, কিন্তু তৎকালে আপনি তাহাতে কর্ণপাতও করেন নাই। এক্ষণে কি তৎসমুদয় স্মরণ করিয়া ব্যথিত হইতেছেন না? ভীষ্ম ও দ্রোণপ্রমুখ আপনার সুহৃদগণ আপনার হিতানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া শহস্তে নিহত হইয়াছেন, ইহা স্মরণ করিয়া কি আপনার মন ব্যথিত হইতেছে না?”

রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণ করিয়া দুঃখিতমনে দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে সঞ্জয়! দিব্যাস্ত্রবেত্তা মহাবীর ভীষ্ম ও দ্রোণ নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছে। যিনি প্রতিদিন দশসহস্র রথীর প্রাণসংহার করিয়াছিলেন, সেই ভীষ্ম পাণ্ডব সুরক্ষিত শিখণ্ডীর হস্তে নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ নিতান্ত কাতর হইতেছে। ভৃগুনন্দন রাম [পরশুরাম] বাল্যকালে যাঁহাকে ধনুর্ব্বেদে উপদেশ ও দিব্যাস্ত্র প্রদান করিয়াছিলেন, যাঁহার অনুগ্রহে পাণ্ডবগণ ও অন্যান্য মহীপালগণ মহারথ বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন, সেই সত্যসন্ধ মহাধনুর্দ্ধর দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল হইয়াছে। এই ভূমণ্ডলে যাঁহাদের তুল্য চতুৰ্ব্বিধ [বাণ, খড়্গ, গোলা, মুগর] অস্ত্রে পারদর্শী আর কেহই নাই, সেই বীরবরাগ্রগণ্য ভীষ্ম ও দ্রোণ কালকবলে নিপতিত হইয়াছেন, শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ নিতান্ত ব্যথিত হইতেছে। হে সঞ্জয়! ত্রৈলোক্যে যাঁহার তুল্য অস্ত্রবেত্তা আর কেহই নাই, সেই দ্রোণাচাৰ্য্য নিহত হইলে আমার পক্ষীয়েরা কিরূপ অনুষ্ঠান করিল? মহাবীর ধনঞ্জয়ের বিক্রমে সংশপ্তকসৈন্যগণ বিনষ্ট, দ্রোণপুত্রের নারায়ণাস্ত্র প্রতিহত ও অন্যান্য সৈন্যগণ পলায়িত হইলে কৌরবেরা কি কার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইল? আমার বোধ হইতেছে, উহারা দ্রোণের নিধনানন্তর অর্ণবমধ্যস্থ নৌকার ন্যায় শোকসাগরে নিমগ্ন ও পলায়িত হইয়াছে। হে সঞ্জয়। সৈন্যগণ পলায়নপরায়ণ হইলে কর্ণ, ভোজরাজ কৃতবর্ম্মা, মদ্ররাজ শল্য, অশ্বত্থামা, কৃপ এবং দুর্য্যোধনপ্রমুখ আমার অবশিষ্ট আত্মজগণের মুখবর্ণ কিরূপ হইল? তুমি এক্ষণে এই সমস্ত বৃত্তান্ত এবং পাণ্ডবপক্ষীয় ও অস্মপক্ষীয় বীরগণের পরাক্রম কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার অপরাধবশতঃ কৌরবগণের যেরূপ দুর্দ্দশা উপস্থিত হইয়াছে, তাহা শ্রবণ করিয়া আপনি ব্যথিত হইবেন না। পণ্ডিত ব্যক্তি দৈবদূর্ঘটনায় অনুতাপ করেন না। মনুষ্যগণের অভিলষিত অর্থলাভ দৈবায়ত্ত। অতএব ইষ্টের অপ্রাপ্তি বা অনিষ্টপ্রাপ্তিনিবন্ধন শোক করা পণ্ডিতের কর্ত্তব্য নহে।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি স্বীয় অশুভ ঘটনা শ্রবণে সমধিক ব্যথিত হই না। দৈবই আমার অনিষ্টের কারণ; অতএব তুমি নিঃসন্দিগ্ধচিত্তে সমুদয় বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন কর।”