০২৭. যুধিষ্ঠিরের কৃষ্ণনির্ভরতা

২৭তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের কৃষ্ণনির্ভরতা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সঞ্জয়! ধৰ্মই শ্রেষ্ঠ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই; কিন্তু আমি ধর্ম্ম কি অধর্ম্মাচরণ করিতেছি, তুমি তাহা সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইয়া আমাকে তিরস্কার কর। কোন স্থানে অধৰ্ম ধৰ্মরূপ ধারণ করে, কোন স্থানে ধর্ম্ম অধৰ্মরূপ ধারণ করে, আর কোন স্থানেই বা বাস্তবিক ধর্ম্ম ধর্মের ন্যায় প্রতীয়মান হয়, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা অনায়াসে প্রজ্ঞাবলে তৎসমুদয় বুঝিতে পারেন। বর্ণচতুষ্টয়ের পৃথক পৃথক ধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট থাকিলেও আপৎকালে তাহারা পরস্পর, পরস্পরের ধর্ম্ম পরিগ্রহ করিতে পারে; কিন্তু ব্রাহ্মণের ধর্মে কদাচ অন্যের অধিকার নাই। হে সঞ্জয়! এক্ষণে আপদ্ধর্ম্ম [শাস্ত্রের অবিরোধে ধর্মের সঙ্কোচ] কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“যে ব্যক্তি বিপন্ন না হইয়াও লোভপ্রযুক্ত আপদ্ধর্মের অনুসরণ করে, সে নিতান্ত নিন্দনীয়। মনুষ্যের জীবিকানির্ব্বাহোপযোগী মূলধন ক্ষয় হইলে সে নিত্যনৈমিত্যিক ক্রিয়ানুষ্ঠানের নিমিত্ত অন্য বর্ণের ধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক অর্থোপার্জ্জন করিতে পারে। যে ব্যক্তি মূলধন ক্ষয় না হইলেও আপদ্ধর্মের অনুসরণ করে এবং যে বিপন্ন হইয়াও আপদ্ধর্ম্মানুসরণে পরাঙ্মুখ হয়, এই উভয়বিধ লোকই নিন্দনীয়। যেসকল ব্রাহ্মণ আপৎকালে অন্যধর্ম্মাবলম্বনানন্তর স্বীয় ব্রাহ্মণ্য রক্ষা করিতে বাসনা করেন, বিধাতা তাঁহাদের আপদুত্তরণানন্তর [বিপদের শেষ হইলে–বিপদ কাটিয়া গেলে] প্রায়শ্চিত্তবিধান করিয়াছেন; অতএব যাহারা আপদ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া কর্ম্মকাণ্ডে নিযুক্ত থাকে, তাঁহারা প্রশংসনীয়, আর যাঁহারা আপৎকাল অতীত হইলেও কর্ত্তব্য-কর্ম্মানুষ্ঠানে বিরত থাকে, তাঁহারা সজ্জনগণের নিন্দাস্পদ হয় মনীষিগণের তত্ত্বজ্ঞানান্বেষণার্থ সজ্জনসমীপে ভিক্ষা করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করা শাস্ত্রসম্মত, কিন্তু যাহারা অব্রাহ্মণ অথচ তত্ত্বজ্ঞানান্বেষী নহে, তাহাদের স্বস্ব জাতিধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক কালাতিপাত করাই শ্ৰেয়ঃ। আমাদিগের পিতা, পিতামহ প্রভৃতি পূর্ব্বপুরুষসকল অন্যান্য প্রজ্ঞান্বেষী [জ্ঞানলিপ্সু] মহাত্মাগণ এবং কর্ম্মসন্ন্যাসি [কর্ম্মত্যাগী] সমুদয় পূর্বোক্ত পথ অবলম্বন করিয়া গিয়াছেন, আমি অনাস্তিক, সুতরাং অন্যপথ অবলম্বন করিতে পারি না। হে সঞ্জয়! এই পৃথিবীতে দেবগণেরও প্রার্থনীয় যে সমস্ত ধনসম্পত্তি আছে, তৎসমুদয় এবং প্রাজাপত্য [প্রজাপতিলোক-পিতৃলোক], স্বৰ্গ ও ব্রহ্মলোক, এই সকলেও অধৰ্মতঃ লাভ করিতে আমার বাসনা নাই। যাহা হউক, মহাত্মা কৃষ্ণ ধর্ম্মফলপ্ৰদাতা, নীতিসম্পন্ন ও ব্রাহ্মণগণের উপাসক। উনি কৌরব ও পাণ্ডব-এই উভয় কুলেরই হিতৈষী এবং বহুসংখ্যক মহাবলপরাক্রান্ত ভূপতিগণকে শাসন করিয়া থাকেন। এক্ষণে উনিই বলুন যে, যদি আমি সন্ধিপথ পরিত্যাগ করি তাহা হইলে নিন্দনীয় হই, আর যদি যুদ্ধে নিবৃত্ত হই, তাহা হইলে আমার স্বধর্ম্মপরিত্যাগ করা হয়, এ স্থলে কি কর্ত্তব্য? মহাপ্রভাব শিনির নাপ্তা [পৌত্র] এবং চেদি, অন্ধক, বৃষ্ণি, ভোজ, কুকুর ও সৃঞ্জয়বংশীয়গণ বাসুদেবের বুদ্ধিপ্রভাবেই শত্রুদমনপূর্ব্বক সুহৃদগণকে আনন্দিত করিতেছেন। ইন্দ্ৰকল্প উগ্ৰসেন প্রভৃতি বীর সকল এবং মহাবল পরাক্রান্ত মনস্বী সত্যপরায়ণ যাদবগণ কৃষ্ণকর্ত্তৃক সততই উপদিষ্ট হইয়া থাকেন। কৃষ্ণ ত্ৰাতা ও কর্ত্তা বলিয়াই কাশীশ্বর বভ্রূ উত্তম শ্ৰী প্রাপ্ত হইয়াছেন; গ্ৰীষ্মাবসানে জলদজাল যেমন প্রজাদিগকে বারি দান করে, তদ্রূপ বাসুদেব কাশীশ্বর সমুদয় অভিলষিত দ্রব্য প্রদান করিয়া থাকেন। কর্ম্মনিশ্চয়জ্ঞ কেশব ঈদৃশগুণসম্পন্ন, ইনি আমাদের নিতান্ত প্রিয় ও সাধুত্তম; আমি কদাচ ইহার কথার অন্যথাচরণ করিব না।”