০১০. ধৃতরাষ্ট্রসভায় মৈত্ৰেয় মুনির আগমন

১০ম অধ্যায়

ধৃতরাষ্ট্রসভায় মৈত্ৰেয় মুনির আগমন

ধৃতরাষ্ট্র ব্যাসবোক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে মহাপ্রাজ্ঞ! আপনি যাহা অনুমতি করিতেছেন, আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াছি ও এই সকল মহীপালেরাও তাঁহার মর্ম্মগ্রহণ করিয়াছেন। কৌরবহিতার্থে আপনি যেরূপ সদ্বিবেচনা করিয়াছেন, মহামতি বিদুর, ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্য আমাকে তাহাই কহিয়াছেন। অতএব যদি আমি আপনার অনুগ্রহভাজন হই ও কুরুগণের প্রতি আপনার অকৃত্রিম স্নেহ থাকে, তাহা হইলে দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনকে বিশেষরূপে অনুশাসন করুন।”

ব্যাসদেব কহিলেন, “হে রাজন! ভগবান মৈত্ৰেয় পাণ্ডবগণের অন্বেষণ করিয়া আমাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত এখানে আসিতেছেন; তিনি কুলের হিতার্থে তোমার পুত্ৰ দুৰ্য্যোধনকে ন্যায়ানুরূপ অনুশাসন করিবেন। মহারাজ! তিনি যে কার্য্যের আদেশ কিরবেন, তাহা অবিমঙ্কিতচিত্তে নির্ব্বাহ করিতে হইবে; তদীয় আজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইলে তিনি ক্রোধাভরে তোমার পুত্ৰকে অভিসম্পাত করিবেন, সন্দেহ নাই।” মহামুনি ব্যাসদেব এই কথা বলিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলে, মহর্ষি মৈত্ৰেয় আসিয়া সমুপস্থিত হইলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁহার পুত্ৰ দুৰ্য্যোধন অর্ঘ্যাদি প্রদানপূর্ব্বক মহর্ষির সৎকার করিলেন। তিনি যথাযোগ্য আসনে উপবিষ্ট হইয়া বিগতক্রম হইলে রাজা জিজ্ঞাসিলেন, “ভগবন্‌! কুরুজঙ্গল হইতে আসিবার সময় পথিমধ্যে ত’ কোন প্রকার কষ্ট হয় নাই? পাণ্ডবেরা ত’ কুশলে আছেন? তাঁহারা কি প্ৰতিজ্ঞা-ভঙ্গ করিতে ইচ্ছা করেন? কৌরবদিগের সৌভ্রাত্ৰ ত’ উচ্ছিন্ন হইবে না?”

মৈত্ৰেয়ের কুরুপাণ্ডব-সন্ধি প্রস্তাব

মৈত্ৰেয় কহিলেন, “মহারাজ! তীৰ্থপৰ্য্যটন করিতে করিতে যদৃচ্ছাক্রমে একদা কুরুজঙ্গলে উপনীত হইয়া দেখিলাম, ধর্ম্মরাজ কাম্যাকবনে বাস করিতেছেন। সেই জটাজিনধারী তপোবনানিবাসী মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত কতিপয় তাপস সমাগত হইলেন। তথায় তোমার পুত্ৰগণের গহিত্যাচরণের বিষয় শ্রবণ করিয়া সেই কপটদ্যূতরূপ অন্যায়াচরণনিবন্ধ মহাদ্‌ভয় উপস্থিত হইল। অনন্তর কুরুকুলের কুশলার্থে আমি তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। হে মহারাজ! তোমার প্রতি আমার বিশেষ প্রীতি ও স্নেহ আছে, এই নিমিত্ত বলিতেছি, তুমি ও ভীষ্ম জীবিত থাকিতে তোমার পুত্রেরা পরস্পর এরূপ বিরোধ করে, ইহা নিতান্ত যুক্তিবিরুদ্ধ, তাহাতে সন্দেহ নাই। তুমি স্বয়ং সন্ধিবিগ্ৰহকাৰ্য্যে অদ্বিতীয় হইয়া উপস্থিত এই ঘোরতর অন্যায়ের প্রতি কি নিমিত্ত উপেক্ষা করিতেছ? হে কুরুনন্দন! সভামধ্যে যে সকল দুষ্টলোকচারিত বিগহিত কর্ম্ম সম্পন্ন হইয়াছে, অনুক্ষণ তপস্বিসংসর্গ করিলেও তোমার সেই দোষধ্ববান্ত [দোষান্ধকার—পাপমালিন্য] অপসৃত হইবে না।

অনন্তর ভগবান মৈত্ৰেয় প্রত্যাবৃত্ত হইয়া মধুর বাক্যে দুৰ্য্যোধনকে কহিতে লাগিলেন, “হে মহাবাহো দুৰ্য্যোধন! আমি তোমাকে হিতকর বাক্য কহিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি পাণ্ডবদিগের অনিষ্টচেষ্টা করিও না। কুরুকুল, পাণ্ডবকুল ও পৃথিবীর সমস্ত লোকের প্রিয়কাৰ্য্য-সাধনে তৎপর হও। সেই নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা মহাবলপরাক্রান্ত, অনুপম যোদ্ধা, সত্যসন্ধ, দৃঢ়কায়, বজ্রসার [হাতীর শুড়ের ন্যায়] প্রাণ ও পুরুষকারসম্পন্ন। তাহারা দেবদ্বেষী হিড়িম্ব, বক, কিমীর প্রভৃতি কামরূপী রাক্ষস-সকল নিহত করিয়াছেন। একদা সেই মহাত্মারা রজনীযোগে বারণাবতনগর হইতে প্ৰস্থান করিতেছিলেন, পথিমধ্যে দুরাত্মা কিমীর নিশাচর তাঁহাদিগের মার্গারোধ করিয়া পর্ব্বতের ন্যায় দণ্ডায়মান হইল। ব্যাঘ যেমন অবলীলাক্রমে ক্ষুদ্রপ্রাণ মৃগকুল নিমূল করে, তদ্রূপ সাহসপ্রিয়, রণবিশারদ ভীমসেন সেই দুৰ্বৃত্ত নিশাচরের প্রাণসংহার করিলেন। তিনি দিগ্বিজয়ে নিৰ্গত হইয়া অমিতবলশালী জরাসন্ধকে বিনষ্ট করিয়াছেন, তাহা কি বিস্মৃত হইয়াছ? বাসুদেব তাহার পরম আত্মীয় ও দ্ৰৌপদেরা তাঁহার শ্যালক। অতএব জরামরণশালী মনুষ্যের মধ্যে এমন বীর কে আছে যে, ভীমের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়? হে রাজন! আমি বলিতেছি, অবিলম্বে পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি কর, ক্ৰোধের বশবর্ত্তী হইও না।”

দুৰ্য্যোধনের প্রতি মৈত্ৰেয়ের অভিশাপ

দুর্বুদ্ধি দুৰ্য্যোধন মৈত্ৰেয়ের বচন শ্রবণ করিয়া করিকরাকার [দারুণ আশঙ্কাযুক্ত] স্বীয় ঊরুদেশে করাঘাত করিল ও হাসিতে হাসিতে চরণাঙ্গুষ্ঠীদ্বারা ভূমি বিলিখন করিয়া অবাঙ্মুখে রহিল, কিছুমাত্র উত্তর করিল না। মহামুনি মৈত্ৰেয় দুৰ্য্যোধনের এইরূপ উপেক্ষা সন্দর্শনে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ ও বিধিকর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া আচমনপূর্ব্বক তাহাকে অভিসম্পাত করিলেন, “হে অভিমানিন ধার্ত্তরাষ্ট্র! তুমি আমাকে অনাদর করিয়া যেমন আমার বাক্য উপেক্ষা করিলে, অচিরাৎ সেই অভিমানের সমুচিত ফল প্রাপ্ত হইবে। অনতিকালমধ্যে ত্বদীয় বিদ্রোহমূলক ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইবে, সেই যুদ্ধে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন গদাঘাতে তোমার উরু ভগ্ন করিবেন।” মহীপতি ধৃতরাষ্ট্র মুনির শাপ-শ্রবণে ভীত হইয়া বহুবিধ উপায় দ্বারা তাহাকে প্ৰসন্ন করিলেন ও শাপবিমোচনের নিমিত্ত অশেষ প্রকার অনুনয় করিতে লাগিলেন। মৈত্ৰেয় কহিলেন, “রাজন! যদি তোমার পুত্ৰ পাণ্ডবদিগের সহিত সন্ধি করে, তাহা হইলে শাপবিমোচন হইবে, নতুবা কখন আমার এ শাপ নিস্ফল হইবে না।” তখন ধৃতরাষ্ট্র মৈত্রেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্ৰভো! ভীমসেন কিরূপে কিমীর-নামক নিশাচরকে নিপাতিত করিয়াছিলেন?” মুনি কহিলেন, “তোমার পুত্র আমার বাক্যে আস্থা করে নাই, অতএব আমি আর কিছুই বলিব না। আমি প্রস্থান করিলে তুমি বিদুরকে জিজ্ঞাসা করিও, তিনি আনুপূর্ব্বিক সমস্ত বৃত্তান্ত তোমার নিকট বর্ণনা করিবেন।” এই কথা বলিয়া মৈত্ৰেয় স্বস্থানে প্রস্থান করিলে দুৰ্য্যোধন সাতিশয় উৎকলিকাকুল হইয়া গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন।

আরণ্যকপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।