০৫০. যুধিষ্ঠিরাদির ভীষ্ম-সাক্ষাৎকার

৫০ম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরাদির ভীষ্ম-সাক্ষাৎকার

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন রাজা যুধিষ্ঠির পরশুরামের সেই অসামান্য কাৰ্য্যশ্রবণে নিতান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া বাসুদেবকে কহিলেন, “জনার্দ্দন! মহাত্মা পরশুরাম ইন্দ্রের ন্যায় পরাক্রমশালী ছিলেন। ঐ মহাবীর রোষপরবশ হইয়া সমুদয় পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয়া করেন; ক্ষত্রিয়গণ উহার ভয়ে গো, সমুদ্র, গোলাঙ্গুল[কৃষ্ণমুখ বানর], ভল্লুক ও বানরগণকে আশ্রয়পূৰ্ব্বক পরিত্রাণ লাভ করিয়াছিল। যখন একজন ব্রাহ্মণ এরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন, তখন অবশ্যই এই মর্ত্যলোককে ধন্য ও মানবগণকে সৌভাগ্যশালী বলিতে হইবে।”

রাজা যুধিষ্ঠির ভগবান্ বাসুদেবের সহিত এইরূপ কথোপকথন করিতে করিতে কুরুপিতামহ ভীষ্মের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহাবীর শান্তনুতনয় সায়ংকালীন সূর্য্যের ন্যায় প্রভাশূন্য হইয়া শরশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। দেবগণ যেমন ইন্দ্রের চতুর্দিকে উপবিষ্ট থাকেন, তদ্রূপ মুনিগণ তাঁহার চতুর্দ্দিকে উপবেশন করিয়াছেন। ভগবান বাসুদেব, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও তাঁহার চারিভ্রাতা এবং কৃপাচার্য্য প্রভৃতি বীরগণ দূর হইতে ওঘবতীনদীর সমীপে ভীষ্মকে অবলোকন করিবামাত্র স্ব স্ব বাহন হইতে অবতীর্ণ ও স্থিরচিত্ত হইয়া ব্যাসাদি মহর্ষিগণের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাদিগকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক অচিরাৎ ভীষ্মের সহিত সাক্ষাৎকার করিয়া সকলে তাঁহার চতুর্দিকে উপবেশন করিলেন।

সনাতন-ধর্ম্মকথনে কৃষ্ণের ভীষ্ম-অনুরোধ

অনন্তর মহামতি বাসুদেব প্রশান্ত পাবকসদৃশ ভীষ্মকে ক্ষণকাল অবলোকন করিয়া দীনমনে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “শান্তনুতনয়! আপনার জ্ঞানসকল পূৰ্ব্বের ন্যায় প্রসন্ন আছে ত’? আপনার বুদ্ধি ত’ পর্য্যাকুল হয় নাই এবং শরাঘাতনিবন্ধন আপনার গাত্র ত’ নিতান্ত অবশ হইতেছে না? মানসিক দুঃখ অপেক্ষা শারীরিক দুঃখ সমধিক বলবান। আপনার পিতা ধর্ম্মপরায়ণ রাজা শান্তনুর বরপ্রভাবেই আপনি এরূপ ইচ্ছামৃত্যুতে অধিকারী হইয়াছেন। আমি আপনার ইচ্ছামৃত্যুর কারণ নহি। একটি সূক্ষ্ম শল্য শরীরমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে যারপরনাই ক্লেশ উপস্থিত হয়, কিন্তু আপনি শরসমূহে সমাচিত হইয়াছেন; শরদ্বারা শরীরভেদনিবন্ধন আপনার ত’ কোন ক্লেশ হইতেছে না? যাহা হউক, আপনি যখন দেবগণকেও উপদেশ প্রদান করিতে পারেন, তখন আপনার নিকট প্রাণীগণের জন্মমৃত্যুবিষয় কীৰ্ত্তন করা নিতান্ত অবিধেয়। আপনি জ্ঞানবৃদ্ধ; ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান কিছুই আপনার অবিদিত নাই। প্রাণীগণের মৃত্যু ও সৎকার্য্যের ফলোদয়ের বিষয় আপনি সবিশেষ অবগত আছেন। আপনি ধর্ম্মময়। আপনি পূর্বে যে বিশাল রাজ্যে সুস্থশরীরে সহস্র মহিলাগণে পরিবৃত থাকিয়াও অস্বলিত ব্রহ্মচর্য্যসম্পন্ন থাকিতেন, উহা এখনও আমার চিত্তে বর্ত্তমানের ন্যায় জাগরূক্ রহিয়াছে। আপনি সত্যধর্ম্মপরায়ণ ও মহাবলপরাক্রান্ত। আপনি ব্যতীত ত্রিলোকমধ্যে তপঃপ্রভাবে মৃত্যু অতিক্রম করে, এমন আর কোন ব্যক্তিই আমার শ্রবণগোচর হয় নাই। হে কুরুপিতামহ! আপনি সততই সত্য, দান, তপস্যা, যজ্ঞ, বেদ, ধনুৰ্বেদ, নীতি, প্রজারক্ষণ, সরলতা, পবিত্রতা ও প্রাণীগণের দয়াপরতাতেই তৎপর ছিলেন, আপনার সদৃশ মহারথ আর কেহই নাই। আপনি এক রথে সমুদয় দেব, দানব, যক্ষ, রক্ষ ও গন্ধৰ্ব্বগণকে পরাজিত করিতে সমর্থ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। আপনি বসুগণের শ্রেষ্ঠ, আমি আপনাকে বিলক্ষণ অবগত আছি। আপনি বলবীর্য্যপ্রভাবে স্বর্গলোকেও বিখ্যাত হইয়াছেন। মর্ত্যলোকে আপনার সদৃশ গুণশালী আর কেহই দর্শন বা শ্রবণগোচর হয় নাই। আপনি স্বীয় গুণগ্রামপ্রভাবে দেবগণকেও অতিক্রম করিয়াছেন। আপনি যখন তপোবলে চরাচর বিশ্বের সৃষ্টি করিতে সমর্থ, তখন স্বীয় উত্তম গুণপ্রভাবে যে উত্তম লোকসমুদয় লাভ করিতে সমর্থ হইবেন, তাহা বিচিত্র নহে।

“যাহা হউক, এক্ষণে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব রাজা যুধিষ্ঠির জ্ঞাতিসংক্ষয়নিবন্ধন নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়াছেন; অতএব আপনি উহার শোকাপনোদন করুন। চাতুৰ্ব্বিদ্য[চারিবেদ], চাতুর্হোত্র[চতুৰ্ব্বেদোক্ত যজ্ঞসাধক গ্রন্থ] ও সাংখ্যযোগে যে যে ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তিত আছে, তৎসমুদয় এবং চারিবর্ণের ও চারি আশ্রমের সনাতন ধর্ম্মসকল আপনার অবিদিত নাই। বর্ণসঙ্করদিগের দেশ, জাতি ও কুলের ধৰ্ম্মলক্ষণও আপনি বিলক্ষণ অবগত আছেন। বেদোক্ত ধৰ্ম্ম, শিষ্টাচারপ্রণালী এবং ইতিহাস, পুরাণ ও ধর্ম্মশাস্ত্র আপনার হৃদয়ে বিলক্ষণ জাগরূক রহিয়াছে। হে পুরুষোত্তম! ইহলোকে কোন বিষয়বিশেষে সন্দেহ উপস্থিত হইলে আপনি ভিন্ন তাহার ভঞ্জনকৰ্ত্তা আর কেহই নাই। অতএব আপনি পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ রাজা যুধিষ্ঠিরের হৃদয়শোষক শোকাবেগ নিবারণ করুন। ভবাদৃশ বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরা মোহাবিষ্ট মানবের সান্ত্বনার একমাত্র উপায়।”