০৩৮. যুধিষ্ঠিরের পুরপ্রবেশ-অভিনন্দন

৩৮তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের পুরপ্রবেশ-অভিনন্দন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবগণের পুরপ্রবেশকালে সহস্র সহস্র পুরবাসী প্রজা দর্শনাকাঙ্ক্ষী হইয়া তথায় আগমন করিতে লাগিল। তখন সেই বিবিধ মাল্যদ্রব্যে সুশোভিত রাজমার্গ জনতায় পরিপূর্ণ হইয়া চন্দ্রোদয়ে পরিবর্দ্ধিত মহোদধির [সমুদ্রের] ন্যায় শোভা ধারণ করিল। রাজপথের সমীপবর্তী সমলঙ্কৃত অট্টালিকাসমুদয় রমণীগণের ভারে যেন কম্পিত হইয়া উঠিল। কামিনীগণ লজ্জানম্রমুখে মৃদুস্বরে পঞ্চপাণ্ডবকে ধন্যবাদ প্রদানপূর্ব্বক দ্রৌপদীকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিল, “হে পাঞ্চালি! তুমি ধন্যা; গৌতমী যেমন মহর্ষিগণকে আশ্রয়। করিয়াছেন, তুমিও তদ্রূপ এই মহাত্মাগণকে আশ্রয় করিয়াছ। তোমার ব্রত ও কৰ্ম্মসমুদয় সার্থক।” বরবৰ্ণিনী[উত্তমা নারী]গণ এই বলিয়া দ্রৌপদীর প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহাদিগের প্রশংসাবাক্য ও হর্ষসূচক শব্দে সমুদয় পুর পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

অনন্তর মহারাজ যুধিষ্ঠির ক্রমে ক্রমে সেই রাজমার্গ অতিক্রম করিয়া সমলঙ্কৃত রাজভবন সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন পুরবাসী প্রজাগণ তাঁহার সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া শ্রুতিসুখকর বাক্যে কহিতে লাগিল, “মহারাজ! আপনি সৌভাগ্য ও পরাক্রমপ্রভাবে ধর্ম্মানুসারে শত্রুগণকে পরাজয় ও পুনৰ্ব্বার রাজ্যলাভ করিয়াছেন। এক্ষণে আমাদিগের অধীশ্বর হইয়া ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্রের ন্যায় শত বৎসর প্রজাপালন করুন।” ধৰ্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মরাজ এইরূপে বিবিধ মঙ্গলবাক্য শ্রবণ ও ব্রাহ্মণগণের আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিতে করিতে সেই ইন্দ্রালয়তুল্য রাজভবনে প্রবেশ করিয়া রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন এবং অচিরাৎ গৃহমধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক নানাবিধ রত্ন ও গন্ধমাল্যদ্বারা দেবতাদিগের অর্চ্চনা করিয়া পুনৰ্ব্বার পুরদ্বারে আগমন করিলেন। ব্রাহ্মণগণ যুধিষ্ঠিরকে অবলোকন করিয়া আশীর্ব্বাদ করিবার মানসে তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মরাজ সেই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বিপ্রগণে পরিবৃত হইয়া নক্ষত্রমালামণ্ডিত চন্দ্রের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। অনন্তর তিনি গুরু ধৌম্য ও জ্যেষ্ঠতাতের সহিত অসংখ্য মোদক, রত্ন, সুবর্ণ, গাভী, বস্ত্র ও অন্যান্য বিবিধ বস্তুদ্বারা সেই সমস্ত ব্রাহ্মণের যথাবিধি পূজা করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সুহৃদগণের প্রীতিকর শ্রুতিসুখাবহ পবিত্র পুণ্যাহনির্ঘোষে গগনমার্গ পরিব্যাপ্ত হইল। ধৰ্ম্মরাজ বিজ্ঞ ব্রাহ্মণগণের অর্থসংযুক্ত বিবিধ বাক্য শ্রবণ করিতে লাগিলেন। চতুর্দিকে জয়শব্দ, মনোহর দুন্দুভিধ্বনি ও শঙ্খনিস্বন হইতে আরম্ভ হইল।

চার্ব্বাকমন্ত্রীর মিথ্যা চতুরতা—যুধিষ্ঠিরের আক্রোশ

হে মহারাজ! ঐ সময় সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে ধৰ্ম্মরাজকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুৰ্য্যোধনের সখা দুরাত্মা চাৰ্ব্বাকরাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণপূৰ্ব্বক অবস্থান করিতেছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলেতাঁতাহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়াই নির্ভীকচিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্ব্বিতবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “মহারাজ! এই ব্রাহ্মণগণ আপনাকে জ্ঞাতিঘাতী ও অতি কুৎসিত রাজা বলিয়া ধিক্কার প্রদান করিতেছেন। ফলতঃ এইরূপ জ্ঞাতিসংক্ষয় ও গুরুজনদিগের বিনাশসাধন করিয়া আপনার কি লাভ হইল! এক্ষণে আপনার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ। জীবনধারণ করিবার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।” তখন তত্ৰত্য অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ চার্ব্বাকের সেই বাক্যশ্রবণে সাতিশয় ক্রুদ্ধ, ব্যথিত ও লজ্জিত হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে তদবস্থ দেখিয়া লজ্জিতভাবে ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া দীনবাক্যে তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে বিপ্রগণ! আমি প্রণত হইয়া আপনাদিগের নিকট প্রার্থনা করিতেছি যে, আপনারা আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। আমি অচিরাৎ প্রাণত্যাগ করিব, আপনারা আর আমাকে ধিক্কার প্রদান করিবেন না।”

তখন সেই ব্রাহ্মণগণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমরা আপনাকে ধিক্কার প্রদান করি নাই; আপনার মঙ্গল হউক।” তপানুষ্ঠানসম্পন্ন বেদবেত্তা দ্বিজাতিগণ যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলিয়া জ্ঞানচক্ষুদ্বারা চাৰ্ব্বাককে বিশেষ জ্ঞাত হইয়া পুনরায় ধৰ্ম্মরাজকে কহিলেন, “মহারাজ! যে ব্যক্তি আপনার প্রতি কটুক্তি করিল, ঐ দুরাত্মা দুর্য্যোধনের পরমবন্ধু চার্ব্বাকনামক রাক্ষস। ঐ পাপাত্মা দুর্য্যোধনের হিতকামনায় আপনার প্রতি কুবাক্য প্রয়োগ করিয়াছে, আমরা কোন কথাই কহি নাই। অতএব আপনার কিছুমাত্র শঙ্কা করিবার প্রয়োজন নাই। আপনি ভ্রাতৃগণের সহিত কল্যাণভাজন হউন।”

অনন্তর সেই ব্রাহ্মণগণ চার্ব্বাকের প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া ভৎর্সনা করিয়া হুঙ্কার শব্দ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন চার্ব্বাক সেই মহাত্মাদিগের ক্রোধাগ্নিতে দগ্ধপ্রায় হইয়া অশনিদগ্ধ পাদপের ন্যায় অচিরাৎ ভূতলে নিপতিত হইল। মহারাজ যুধিষ্ঠির তদ্দর্শনে ব্রাহ্মণগণকে যথোচিত সম্মান করিতে লাগিলেন। অনন্তর সেই বিপ্রগণ যুধিষ্ঠিরকে অভিনন্দনপূৰ্ব্বক তথা হইতে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। যুধিষ্ঠিরও যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া সুহৃদগণের সহিত অবস্থান করিতে লাগিলেন।