০৩৬. ভক্ষ্য-অভক্ষ্য—পাত্র-পাত্র—দেয়-অদেয় নির্ণয়

৩৬তম অধ্যায়

ভক্ষ্য-অভক্ষ্য—পাত্র-পাত্র—দেয়-অদেয় নির্ণয়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বেদব্যাস কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ক্ষণকাল মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক তাঁহাকে পুনরায় কহিলেন, “পিতামহ! কোন বস্তু ভক্ষ্য আর কোন বস্তু অভক্ষ্য? কোন্ বস্তু দান করিলে লোকে প্রশংসাভাজন হয় এবং কাহাকে পাত্র আর কাহাকেই বা অপাত্র বলা যায়, এই সমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

বেদব্যাস কহিলেন, “মহারাজ! পূৰ্ব্বকালে স্বায়ম্ভুব মনু সিদ্ধগণকে যাহা কহিয়াছিলেন, কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সত্যযুগে ব্রতপরায়ণ মহর্ষিগণ, সুখাসীন ভগবান মনুর সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘প্রজাপতে! অন্ন, পাত্র, দান, অধ্যয়ন, তপস্যা ও কার্য্যাকার্য্যের বিষয় সবিস্তর বর্ণন করুন।’

“তখন ভগবান স্বায়ম্ভুব মনু সেই মহর্ষিগণকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “হে তপোধনগণ! আমি সংক্ষেপে ও সবিস্তরে ধৰ্ম্মকথা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। জপ, হোম, উপবাস, আত্মজ্ঞান, পবিত্র নদী, জপহোমাদি কাৰ্য্যনিরত অসংখ্য ব্যক্তির অধিষ্ঠিত দেশ, পবিত্ৰ পর্ব্বত এবং সুবর্ণভক্ষণ রত্নাদিদ্বারা স্নান, দেবস্থানে অভিগমন ও আজ্য [ঘৃত]-ভোজনদ্ধারা মনুষ্য পবিত্রতা লাভ করে, সন্দেহ নাই। লোকে গৰ্ব্বপ্রকাশ করিলে কখনই প্রাজ্ঞ বলিয়া নির্দিষ্ট হইতে পারে না। বিজ্ঞ লোক যদি অহঙ্কার প্রকাশ করেন, তাহা হইলে তাঁহার ত্রিরাত্রি উষ্ণবস্তু পান [তপ্তকৃচ্ছ্রব্রত আচরণ—তিনদিন উষ্ণ দুগ্ধ, তিনদিন উষ্ণ ঘৃত, তিনদিন উষ্ণ জল পানরূপ ব্রত] করা কর্ত্তব্য। অদত্ত বস্তুর অনাদান[অগ্রহণ—গ্রহণ না করা], দান, অধ্যয়ন, তপস্যা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ ও যজ্ঞ এই কয়েকটি ধর্ম্মের লক্ষণ। সুলবিশেষে গ্রহণ[প্রতিগ্রহ দানগ্রহণ], মিথ্যা ব্যবহার ও হিংসাও ধৰ্ম্মরূপে পরিগণিত হইয়া থাকে। অপ্রবৃত্তি ও প্রবৃত্তিনিবন্ধন ধর্ম্ম ও অধৰ্ম্ম দুইপ্রকার; আর লৌকিক ও বৈদিকব্যবস্থানুসারে প্রবৃত্তি ও অপ্রবৃত্তিরও দুইপ্রকার ভেদ হইয়া থাকে। কর্ম্মত্যাগী পুরুষ মুক্তিলাভ করেন, আর কৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিকে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করিতে হয়। যে ব্যক্তি অশুভকাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হয়, তাহার অশুভ ফল ও যে ব্যক্তি শুভকাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হয়, তাহার শুভ ফল লাভ হইয়া থাকে। অতি নীচ লোকেও যদি দৈব, শাস্ত্র, প্রাণ ও প্রাণধারণোপযোগী দ্রব্যের উপর দৃষ্টিপাত করিয়া কাৰ্য্য করে, তাহা হইলে সে অবশ্যই শুভ ফল লাভ করিতে পারে। ক্রোধমোহাদিবশতঃ মন দূষিত হইলে ঔষধ, মন্ত্র ও উপবাসাদিদ্বারা প্রায়শ্চিত্ত করা কর্ত্তব্য। রাজা অপরাধীর প্রতি দণ্ডবিধান না করিলে তাহাকে একরাত্রি ও পুরোহিত পরিত্যাগ করিলে তাহাকে তিনরাত্রি উপবাস করিয়া শুদ্ধ হইতে হয়। যে ব্যক্তি পুত্ৰবিয়োগশোকে অভিভূত হইয়া শস্ত্রাদিদ্বারা আত্মহত্যা করিতে উদ্যত হয়, তাহার তিনরাত্রি প্রায়োপবেশন করা কর্ত্তব্য। যাহারা জাতি, শ্রেণী ও জন্মভূমি পরিত্যাগ করে, তাহারা নিতান্ত দুরাত্মা; তাহাদিগের সেই অধৰ্ম্মক্ষয়ের নিমিত্ত কোন প্রায়শ্চিত্তই নাই। ধৰ্ম্মসংশয় সমুপস্থিত হইলে দশজন বেদশাস্ত্রজ্ঞ অথবা তিনজন ধর্ম্মপাঠক পণ্ডিত যাহা ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দেশ করেন, তাহাই ধৰ্ম্মস্বরূপ গণনা করা কর্ত্তব্য। বৃষ, মৃত্তিকা, ক্ষুদ্র পিপীলিকা, শ্লেষ্মত্মক[তন্নামক কীট], বিষ, শল্ক[আঁশ]বর্জ্জিত মৎস্য, কচ্ছপ ভিন্ন চতুষ্পদ জন্তু, মণ্ডূক প্রভৃতি জলচর, ভাস[কুক্কুট], হংস, সুপর্ণ, চক্রবাক, প্লব[হংসাদি জলচর পাখী।], বক, কাক, মদ্‌গু, গৃধ্র, শ্যেন, উলূক ও চতুষ্পদনামক পক্ষী, মাংসাশী জন্তু ও দ্বিদন্ত বা চতুর্দ্দন্ত প্রাণীর মাংসভোজন এবং মেষ, বড়বা, গর্দ্দভী, উষ্ট্রী, সূতিকাবস্থা[প্রসূতি] গাভী, মানুষী ও মৃগীর দুগ্ধ পান করা ব্রাহ্মণের পক্ষে নিতান্ত নিষিদ্ধ। প্রেতান্ন[প্রেতের উদ্দেশে প্রদত্ত অন্ন], সূতিকান্ন[অশৌচ অন্ন] ও অনির্দ্দশান্ন[প্রসবের ১০ দিন মধ্যে গাভীর দুগ্ধে পান্ন—পায়সাদি] ভোজন এবং অনির্দ্দশ[প্রসবকালের দশ দিনের মধ্যে] ধেনুর দুগ্ধ পান করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। ভূপতির অন্ন তেজের, শূদ্ৰান্ন ব্রহ্মতেজের এবং সুবর্ণকার ও অবীরা[পতিপুত্রহীনা] স্ত্রীর অন্ন আয়ুর হানি করে। বৃদ্ধিজীবীর[সুদখোর] অন্ন বিষ্ঠা এবং বেশ্যা, পরপুরুষাভিলাষিণী স্ত্রী ও স্ত্রীজিত[স্ত্রীর ব্যভিচারে উপেক্ষাকারী—ভেডুয়া] ব্যক্তির অন্ন শুক্ৰস্বরূপ। অগ্নিষোমীয় বসাহোমের পূর্ব্বে দীক্ষিত ব্যক্তির অন্ন ভোজন করিবে না। দানভোগ পরাঙ্মুখ, যজ্ঞবিক্রয়ী[মূল্যগ্রহণে নিজের অনুষ্ঠিত যজ্ঞের ফলদাতা], সূত্রধর, চর্মকার, রজক, চিকিৎসক, গ্রামপাল[কোটাল], পাতকী, রঙ্গস্ত্রীজীবী[নিজের স্ত্রীর দ্বারা নৃত্যগীত করাইয়া জীবিকাকারী], বন্দী[স্তূতিপাঠক সূতাদি জাতি] ও দূতবেত্তাদিগের অন্ন, বামহস্তে আহৃত, পর্য্যুষিত[বাসি], সুরামিশ্রিত, উচ্ছিষ্ট ও অবশিষ্ট অন্ন, পিষ্টক, ইক্ষু, শাক, দুগ্ধ, শক্তু[ছাতু], ভৃষ্টযব[ভাজা যব] দধিশক্তুর বহুদিনস্থিত বিকার এবং দেবতার উদ্দেশ্যে অপ্রদত্ত পায়স, তিলমিশ্রিত ভক্ষ্য ও পিষ্টক গৃহস্থ ব্রাহ্মণের অভক্ষ্য ও অপেয়। দেবতা, ঋষি, মনুষ্য, পিতৃ ও গৃহদেবতাগণের যথোচিত তৃপ্তিসাধন করিয়া পশ্চাৎ ভোজন এবং প্রব্রজিত ভিক্ষুকের ন্যায় স্বীয় গৃহে বাস করা গৃহস্থের কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম। যে ব্যক্তি ঐরূপ নিয়মে আপনার স্ত্রীসমভিব্যাহারে গৃহস্থধৰ্ম্ম প্রতিপালন করে, তাহার উৎকৃষ্ট ধর্ম্মলাভ হয়।

“ধার্ম্মিক ব্যক্তি কদাচ যশোলাভার্থ বা ভয়প্রযুক্ত দান করিবে না। উপকারী, নৃত্যগীতপরায়ণ, পরিহাসপর[পরিহাসরসিক-ভাঁড়], ভণ্ড, মদমত্ত, উন্মত্ত, তস্কর, নিন্দক, মূর্খ, বিবর্ণ, বিকলাঙ্গ, বামন, দুর্জ্জন, দুষ্কুলজাত, অশ্রোত্রিয়, বেদানভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও ব্ৰতহীন ব্যক্তিকে দান করা বিধেয় নহে। অসম্যক[অবিহিত] দান ও অসম্যক প্রতিগ্রহ দাতা ও গৃহীতা উভয়েরই অমঙ্গলের হেতু হইয়া থাকে। খদিরফলক[খদিরকাঠের ফলা—খদিরকাঠ স্বভাবতঃ ভারী হয়, উহা জলে ভাসে না] অবলম্বনপূর্ব্বক সাগরে সন্তরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলে সেই ফলক যেমন স্বয়ং নিমগ্ন হয় ও আশ্রিত ব্যক্তিকে নিমগ্ন করে, তদ্রূপ অসম্যক্ দাতা আপনাকে ও প্রতিগ্রহীতাকে পাপসাগরে নিমগ্ন করিয়া থাকে। অগ্নি যেমন আকাষ্ঠে সমাচ্ছন্ন হইলে প্রজ্বলিত হয় না, তপঃস্বাধ্যায়শূন্য দুশ্চরিত্র প্রতিগ্রহীতাও তদ্রূপ কোন ফলই প্রদান করিতে পারে না। নরকপালে জল ও কুকুরচৰ্ম্মনির্ম্মিত কোষে দুগ্ধ রাখিলে যেমন উহা স্থানদোষে অপবিত্র হয়, ব্রতবিহীন ব্যক্তির অধ্যয়নও তদ্রূপ ব্যর্থ হইয়া থাকে। নিৰ্ম্মন্ত্র[গায়ত্ৰাদি উপাসনাবর্জ্জিত], নির্ব্রত[উপনয়নাদি দীক্ষাহীন], মূর্খ, অসূয়াপরবশ, হীনচরিত্র ও ব্রতবিহীন ব্যক্তিকেও দান করিলে কেবল দয়াই প্রকাশ করা হয়, উহাতে ধৰ্ম্মের লেশমাত্র নাই। দীন ও আতুর ব্যক্তিদিগকে অনুগ্রহ করিয়া দান করা কর্ত্তব্য। ধর্ম্মলাভ উদ্দেশ্যে মন্ত্রপাঠপূৰ্ব্বক উহাদিগকে দান করা কর্ত্তব্য নহে। অবৈদিক ব্রাহ্মণকে দান করিলে উহা নিতান্ত নিষ্ফল হইয়া যায়, সন্দেহ নাই। অনুধ্যায়ী ব্রাহ্মণ দারুময় হস্তী ও চর্মময় মৃগের ন্যায় কেবল নামমাত্র ধারণ করিয়া থাকে। বৎসহীন, গাভী, পক্ষহীন বিহঙ্গম, জনশূন্য স্থান ও জলশূন্য কূপ যেমন নিতান্ত নিষ্ফল, নির্ম্মন্ত্র ব্রাহ্মণও তদ্রূপ কোন কাৰ্য্যকারক নহে। মুর্খকে দান করিলে উহা অগ্নিশূন্য প্রদেশে হোমের ন্যায় কোন ফলোপধায়ক হয় না। দেবতা ও পিতৃগণের হব্যকব্য-বিনাশক অর্থহারী মূর্খ ব্যক্তি কদাচ উকৃষ্ট লোকসমুদয় প্রাপ্ত হইবার উপযুক্ত নহে। হে ধৰ্ম্মরাজ! তুমি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, এই তাহা সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিলাম।”