০০৩. কর্ণের ব্রহ্মাস্ত্ৰবৈফল্যে দুৰ্য্যোধনসহ যোগদান

৩য় অধ্যায়

কর্ণের ব্রহ্মাস্ত্ৰবৈফল্যে দুৰ্য্যোধনসহ যোগদান

নারদ কহিলেন, “মহারাজ! এ দিকে মহাবীর পরশুরাম কর্ণের বাহুবল, প্রণয়[বিনীত ভাব], দমগুণ [সংযম] ও শুশ্রুষায় একান্ত পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে বিধিপূর্বক প্রয়োগসংহার-মন্ত্ৰসমবেত সমুদয় ব্রহ্মাস্ত্র শিক্ষা করাইলেন। মহাবীর কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়া যত্নপূর্বক ধনুৰ্বেদ আলোচনা করিয়া পরমসুখে সেই পর্বতে বাস করিতে লাগিলেন। একদা উপবাসপরিক্লিষ্ট পরশুরাম আশ্রমের সন্নিধানে, কর্ণের সহিত ভ্রমণ করিতে করিতে নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া সূতপুত্রের ক্রোড়ে মস্তকসংস্থাপনপূর্বক বিশ্বস্তচিত্তে নিদ্রাগত হইলেন। ঐ সময় এক শ্লেষ্মশোণিতভোজী [ক্লেদ রক্তপায়ী] মেদমাংসললালুপ [বসামাংসলোভী] দারুণ কীট কর্ণসমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার ঊরুদেশ ভেদ করিতে লাগিল। মহাবীর কর্ণ পাছে গুরুর নিদ্রাভঙ্গ হয়, এই ভয়ে সেই কীটকে দূরে নিক্ষেপ বা বিনাশ করিতে পারিলেন না; ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্বক সেই কীটদংশনজনিত দারুণ বেদনা সহ্য করিয়া কম্পিতদেহে গুরুকে ধারণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কর্ণের ঊরু হইতে রুধির বিনির্গত হইয়া পরশুরামের গাত্রে সংলগ্ন হওয়াতে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন জমদগ্নিতনয় জাগরিত ও ব্যস্তসমস্ত হইয়া কর্ণকে কহিলেন, “আঃ! আমি অশুচি হইলাম। তুমি কি কর্ম করিতেছ? ভয় পরিত্যাগপূর্বক আমার নিকট সবিশেষ কীৰ্ত্তন কর।” তখন কর্ণ গুরুর নিকট কীটদংশনবৃত্তান্ত নিবেদন করিলে পরশুরাম কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া সেই অষ্টপদ কীটের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। ঐ কীট অলর্ক[ক্ষিপ্ত কুকুর-পাগলা কুকুর]জাতীয়। উহার কলেবর শুকরের ন্যায়; দংষ্ট্রা তীক্ষ্ণ এবং সৰ্বাঙ্গ সূচিসদৃশ লোমজালে সমাকীর্ণ। জমদগ্নিনন্দন দৃষ্টিপাত করিবামাত্র কীট সেই শোণিতমধ্যে প্রাণপরিত্যাগ করিল। ঐ সময় অন্তরীক্ষে এক কৃষ্ণাঙ্গ লোহিতগ্রীব রাক্ষস দৃষ্টিগোচর হইল। নিশাচর পরশুরামকে সম্বোধনপূর্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিল, “হে ভৃগুবংশাবতংস! আপনার মঙ্গল হউক, আপনি আমাকে এই দারুণ নরক হইতে মুক্ত করিলেন। এক্ষণে আমি স্বস্থানে চলিলাম।” তখন প্রবলপ্রতাপান্বিত মহাবাহু জনদগ্নিতনয় তাহাকে কহিলেন, “হে বীর! তুমি কে, কি নিমিত্তই বা নরকগামী হইয়াছিলে? আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।” রাক্ষস কহিল, ‘ভগবন্! আমি সত্যযুগে দংশনামে মহাসুর ছিলাম। আপনার পূর্বপিতামহ মহর্ষি ভৃগুর অপেক্ষা আমার বয়ঃক্রম ন্যূন ছিল না। আমি বলপূর্বক ঐ মহর্ষির প্রিয়তমা ভাৰ্য্যাকে হরণ করাতে তিনি আমাকে “শ্লেষ্মমূত্রভোজী কীট হও” বলিয়া অভিসম্পাত করেন। আমি তাঁহার শাপে ভীত হইয়া শাপমোচনের নিমিত্ত তাঁহার নিকট বারংবার প্রার্থনা করিলাম। তখন তিনি আমার কাতরোক্তি শ্রবণে দয়াপরবশ হইয়া কহিলেন, “আমার বংশসম্ভূত রাম হইতে তোমার মুক্তিলাভ হইবে।” হে মহাত্মন! সেই মহর্ষির শপপ্রভাবে আমার এইরূপ দুর্গতি হইয়াছিল। এক্ষণে আপনার প্রসাদে আমি পাপযোনি হইতে নিষ্কৃতি পাইলাম। মহাসুর এই কথা বলিয়া পরশুরামকে নমস্কার করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিল।

“রাক্ষস প্রস্থান করিলে জমদগ্নিতনয় ক্রোধাবিষ্টচিত্তে কর্ণকে কহিলেন, “হে মূঢ়! তুমি কীটদংশনে যে কষ্ট সহ্য করিয়াছ, ব্রাহ্মণে কখনই সেরূপ কষ্ট সহ্য করিতে পারে না। ক্ষত্রিয়ের ন্যায় তোমার সহিষ্ণুতা দেখিতেছি, অতএব অচিরাৎ আমার নিকট সত্য পরিচয় প্রদান কর।”

“তখন কর্ণ ভীত হইয়া গুরুকে প্রসন্ন করিবার মানসে কহিলেন, “ব্রহ্মন্! আমি সূতপুত্র, সূতনন্দিনী রাধা আমার মাতা, আমার নাম কর্ণ। আমি অস্ত্রলোভে আপনার শিষ্য হইয়াছি, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। বেদবিদ্যাপ্রদ গুরু পিতার তুল্য, এই নিমিত্ত আপনার নিকট আমি ভৃগুবংশসম্ভূত বলিয়া আত্মপরিচয় প্রদান করিয়াছিলাম।” মহাবীর কর্ণ এই বলিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কম্পিতশরীরে ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন পরশুরাম কর্ণকে তদবস্থ দেখিয়া ক্রোধভরে ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘সূতপুত্র! তুমি অস্ত্রলোভে আমার নিকট মিথ্যা কথা কহিয়াছ, অতএব এই ব্রহ্মাস্ত্র তোমার বিনাশকালে বা সঙ্কটসময়ে স্ফূর্তি পাইবে না। আর এই স্থান মিথ্যাবাদীর বাসের উপযুক্ত নহে, অতএব তুমি এ স্থান হইতে যথা ইচ্ছা হয় গমন কর। যাহা হউক, অতঃপর কোন ক্ষত্রিয়ই তোমার সমান যুদ্ধ করিতে পারিবে না।’ তখন মহাবীর কর্ণ পরশুরামকৰ্তৃক অভিহিত হইয়া দুৰ্য্যোধন সমীপে আগমনপূর্বক কহিলেন, মহারাজ! আমি সমুদয় অস্ত্রশস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করিয়াছি।’ ”