২০. অভিমন্যুর জন্য মনস্বিনী গান্ধারীর শোক

২০তম অধ্যায়

অভিমন্যুর জন্য মনস্বিনী গান্ধারীর শোক

“হে মধুসূদন! যাহার বলবীৰ্য্য তোমার ও অর্জুনের অপেক্ষা অৰ্দ্ধগুণ অধিক ছিল, যে সিংহপরাক্রম মহাবীর সহায়হীন হইয়াও আমার পুত্রের একান্ত দুর্ভেদ্য সৈন্যব্যূহ ভেদ করিয়াছিল, যে বীর বিপক্ষগণের সাক্ষাৎ কৃতান্তস্বরূপ ছিল, সেই অভিমন্যু এক্ষণে স্বয়ং কৃতান্তের বশবর্তী হইয়াছে। অর্জুনতনয় নিহত হইয়াও কিছুমাত্র প্রভাহীন হয় নাই। দেখ, অনিন্দনীয়া বিরাটনন্দিনী ভর্ত্তা অভিমন্যুকে অবলোকন করিয়া নিতান্ত দুঃখিত মনে বিলাপ করিতে করিতে নিজ কোমল করপল্লবদ্বারা উহার কলেবর পরিমার্জিত করিতেছে। পূর্বে ঐ লোকললামভূতা [সৌন্দর্য্যে নারীসমাজে গণ্যা] ললনা মধুপানে মত্ত হইয়া অভিমন্যুর বিকশিত পুণ্ডরীক[প্রস্ফুটিত পদ্ম]সদৃশ কমনীয় মুখমণ্ডল আঘ্রাণপূর্ব্বক সলজ্জভাবে উহাকে আলিঙ্গন করিত, এক্ষণে সেই নিতম্বিনী ভৰ্ত্তার বর্ম্ম উন্মোচিত করিয়া উহার শোণিতলিপ্ত কলেবর বারংবার নিরীক্ষণ করিয়া তোমাকে কহিতেছে, “হে পদ্মপলাশলোচন! আমার এই স্বামীর নেত্রদ্বয় তোমার চক্ষুর ন্যায় সুদীর্ঘ; ইহার রূপও তোমার ন্যায় মনোহর; এই বীর বলবীৰ্য্য এবং তেজেও তোমারই সদৃশ ছিলেন; এক্ষণে ইনি নিহত হইয়া সমরশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। ঐ দেখ, ঐ বালিকা পতিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতেছে, ‘মহাবাহো! তুমি পূর্বে অতি সুকুমার ও রাঙ্কবচর্ম্মে[মৃগচর্ম্মে] শয়ন করিতে, এক্ষণে তোমার দেহ ভূতলে সন্নিবেশিত হইয়া কি ব্যথিত হইতেছে না? তুমি জ্যাঘাত-কঠিন অঙ্গদসমলঙ্কৃত করিশুসদৃশ প্রকাণ্ড ভুজদণ্ড প্রসারণপূর্ব্বক শয়ান থাকাতে বোধ হইতেছে যেন বারংবার ব্যায়ামসাধনে একান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া নিদ্রাসুখ অনুভব করিতেছ। আমি নিতান্ত কাতর হইয়া বিলাপ করিতেছি, কিন্তু তুমি আমার সহিত সম্ভাষণ করিতেছ না। পূর্বে তুমি আমাকে দূর হইতে নিরীক্ষণ করিয়া সম্ভাষণ করিতে, কিন্তু এক্ষণে আমি নিতান্ত দুঃখিত হইয়া রোদন করিতেছি, তথাপি তুমি কি নিমিত্ত আমার সহিত আলাপ করিতেছ না? নাথ! আমি ত’ তোমার নিকট কিছুমাত্র অপরাধ করি নাই। হে আৰ্য্যপুত্র! তুমি আৰ্য্যা সুভদ্রা, অমরোপম পিতা ও পিতৃব্যগণ এবং একান্ত দুঃখিনী এই অনাথাকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গমন করিলে?’ হে মধুসূদন! ঐ দেখ, উত্তরা অভিমন্যুর মুখমণ্ডল স্বীয় উৎসঙ্গে [ক্রোড়ে] সন্নিবেশিত ও শোণিতলিপ্ত কেশকলাপ সংযত করিয়া উহাকে জীবিতের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিতেছে, ‘আৰ্য্যপুত্র! তুমি বাসুদেবের ভাগিনেয় ও ধনঞ্জয়ের তনয়; মহারথিগণ রণমধ্যে তোমাকে কিরূপে সংহার করিল? যাহারা তোমাকে বিনাশ করিয়া আমাকে চিরদুঃখিনী করিয়াছে, সেই ক্রুরকর্ম্মা কৃপাচার্য্য, কর্ণ, জয়দ্ৰথ, দ্রোণ ও অশ্বত্থামাকে ধিক্‌! হায়! ঐ মহারথগণ যখন তোমাকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক বিনাশ করে, তৎকালে তাহাদিগের মন কিরূপ হইয়াছিল? হে বীর! তুমি অসংখ্য বন্ধুবান্ধবসম্পন্ন হইয়াও অনাথের ন্যায় পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের সমক্ষে কিরূপে নিহত, হইলে? তোমার পিতা অর্জুন তোমাকে বহু সংখ্যক বীরগণের হস্তে নিহত দেখিয়া কিরূপে জীবিত আছেন? হে কমললোচন! এক্ষণে একমাত্র তোমার বিরহে পাণ্ডবগণের বিপুল রাজ্যলাভ ও শত্ৰুজয় কোনক্রমেই প্রীতিকর হইতেছে না। আমি ধর্ম্ম ও ইন্দ্রিয়সংযমদ্বারা অবিলম্বে তোমার শস্ত্রবিজিতলোকে গমন করির; তোমাকে তথায় আমার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে। নিয়মিত সময় উপস্থিত না হইলে কলেবর পরিত্যাগ করা নিতান্ত সুকঠিন; সেই নিমিত্তই এই মন্দভাগিনী তোমাকে নিহত দেখিয়াও জীবিত রহিয়াছে। হে জীবিতনাথ! তুমি পরলোকে গমন করিয়া এক্ষণে আমার ন্যায় আর কাহাকে হাস্যমুখে মধুরবাক্যে সম্ভাষণ করিবে? আমার বোধ হইতেছে, সুরলোকে তোমার রমণীয় রূপ দর্শন ও মধুরবাক্যশ্রবণে নিশ্চয়ই অপ্সরাদিগের মন মোহিত হইবে। তুমি অপ্সরাদিগের সহিত সমাগত হইয়া বিহার করিতে করিতে সময়ে সময়ে আমার কার্য্যসকল স্মরণ করিও। তুমি এই পৃথিবীতে আমার সহিত ছয়মাস বাস করিয়া সপ্তমমাসে দেহ বিসৰ্জন করিলে।

“হে জনার্দ্দন! ঐ দেখ, বিরাটকুলকামিনীগণ বিরাটদুহিতাকে দুঃখিতমনে এইরূপে বিলাপ করিতে দেখিয়া উহাকে আকর্ষণ করিতেছে। উহারা বিরাটকে নিহত দেখিয়া শোকে ব্যাকুল হইয়াছে। ঐ দেখ, গৃধ্র ও শৃগালগণ দ্রোণশরসংচ্ছিন্ন, রুধিরলিপ্তকলেবর, সমরাঙ্গনে শয়ান বিরাটকে পরিবেষ্টন করিয়া কোলাহল করিতেছে। এক্ষণে বিরাটকুলরমণীগণ বিরাটের মৃতদেহ বিবর্তিত [অধোমুখে পতিত দেহ উল্টাইতে] করিতে সমর্থ হইতেছে না। আতপসন্তপ্ত [প্রজ্বলিত অগ্নিসম] মহিলাগণের মুখমণ্ডল শ্রান্তিনিবন্ধন একান্ত বিবর্ণভাব প্রাপ্ত হইয়াছে এবং কলেবরও নিতান্ত পরিশুষ্ক হইয়া গিয়াছে। ঐ দেখ, অপ্রাপ্তযৌবন উত্তর, সুদর্শন, লক্ষ্মণ ও কাম্বোজদেশীয় সুদক্ষিণ নিহত হইয়া রণশয্যায় শয়ান রহিয়াছে।”