১৬. স্ত্রীবিলাপপার্বাধ্যায়–সমরভূমিদর্শনে গান্ধারী প্রভৃতির বিলাপ

১৬শ অধ্যায়

স্ত্রীবিলাপপার্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ব্রহ্মচারিণী পতিপরায়ণা গান্ধারী দ্রৌপদীকে এই কথা বলিয়া মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়নপ্রদত্ত বরপ্রভাবে দিব্যচক্ষুদ্বারা সেইস্থানে থাকিয়াই কৌরবগণের রণভূমি দেখিতে পাইলেন। ঐ স্থান ভগ্নরথ, অস্থি, কেশ ও শোণিতে সমাবৃত এবং নর, অশ্ব ও গজসমুদয়ের রুধিরোক্ষিত মৃতদেহে পরিপূর্ণ ছিল। অসংখ্য অশ্ব, গজ ও নারীগণ ঐ স্থানে ভীষণরবে চীকার করিতেছিল এবং শৃগাল, বক, কাকোল, কঙ্ক, কাক, গৃধ্র ও রাক্ষসগণ মহা-আহ্লাদে ইতস্ততঃ ধাবমান হইতেছিল। দিব্যজ্ঞানসম্পন্না গান্ধারী দূর হইতে সেই রণস্থল অবলোকন করিয়া করুণস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন।

সমরভূমিদর্শনে গান্ধারী প্রভৃতির বিলাপ

অনন্তর যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডবগণ বেদব্যাসের অনুজ্ঞাক্রমে বাসুদেব ও বন্ধুবিহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রসর করিয়া কৌরবমহিলাগণসমভিব্যাহারে সংগ্রামভূমিতে গমন করিলেন। অনাথা কৌরববণিতাগণ কুরুক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তাঁহাদের কাহারও ভ্রাতা, কাহারও পুত্র, কাহারও পিতা, কাহারও বা ভর্ত্তা প্রাণপরিত্যাগপূর্ব্বক ভূতলে শয়ান রহিয়াছেন। গোমায়ু, বক, বায়স, ভূত, পিশাচ ও রাক্ষসগণ পরমানন্দে সেই সমস্ত ব্যক্তিদিগের মাংস ভক্ষণ করিতেছে। কামিনীগণ এইরূপে সেই শ্মশানসদৃশ সমরভূমি নিরীক্ষণ করিয়া হাহাকার করিতে করিতে বিচিত্র যান হইতে নিপতিত হইতে লাগিলেন। কেহ কেহ অদৃষ্টপূর্ব্ব ভীষণ ব্যাপার দর্শনে স্থলিতদেহ হইয়া ধরাশয্যায় শয়ন করিলেন এবং কেহ কেহ নিতান্ত পরিশ্রমবশতঃ বিচেতন হইয়া পড়িলেন। ঐ সময় পাঞ্চাল ও কৌরবকামিনীগণের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না।

তখন ধর্ম্মশীলা গান্ধারী দুঃখাৰ্ত্ত নারীগণের রোদনশব্দে সমরভূমির চতুর্দ্দিক পরিপূর্ণ দেখিয়া পুণ্ডরীকলোচন[কমলনয়ন] মধুসূদনকে সম্বোধনপূর্ব্বক করুণবচনে কহিলেন, “বৎস! ঐ দেখ, আমার বন্ধুগণ অনাথা হইয়া আলুলায়িতকেশে কুররীযূথের ন্যায় রোদন করিতে করিতে তোমার নিকট আগমনপূর্ব্বক স্ব স্ব পতি, পুত্র, পিতা ও ভ্রাতাদিগকে স্মরণ করিয়া তাঁহাদের মৃতদেহের নিকট ধাবমান হইতেছে। ঐ দেখ, সমরাঙ্গন পুত্রহীনা, বীরজননী ও পতিহীনা বীরপত্নীগণে পরিপূর্ণ হইয়াছে। তেজস্বী পুরুষব্যাঘ্র ভীষ্ম, কর্ণ, অভিমন্যু, দ্রোণ, দ্রুপদ ও শল্য প্রাণপরিত্যাগ করিয়াও প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় দেদীপ্যমান রহিয়াছেন। ঐ দেখ, সমরভূমি মহাবীরগণের কাঞ্চনময় কবচ, দিব্যমণি, অঙ্গদ, কেয়ুর, মাল্য, শক্তি, পরিঘ, সুতীক্ষ্ণ খড়্গ, শর ও শরাসনসমূহে সমলঙ্কৃত হইয়াছে। ক্রব্যাদগণ স্থানে স্থানে অবস্থান, ক্রীড়া ও শয়ন করিতেছে। হে মধুসূদন! সমরভূমির এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার হৃদয় শোকানলে দগ্ধ হইতেছে। কৌরব ও পাঞ্চালগণ নিহত হওয়াতে বোধ হইতেছে, এককালে পঞ্চভূত বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। ঐ দেখ, সুপর্ণ [কাকাদি মাংসাশী পক্ষী] ও গৃঘ্রগণ শোণিতসিক্ত সহস্র সহস্র বীরকে গ্রহণপূর্ব্বক ভক্ষণ করিতেছে। মহাবীর জয়দ্ৰথ, কর্ণ, দ্রোণ, ভীষ্ম ও অভিমন্যুর বিনাশ চিন্তা করিলে কাহার হৃদয় বিদীর্ণ না হয়? হায়! আজ ঐ সকল দুৰ্য্যোধনবশবর্তী অমর্যপরায়ণ অবধ্যকল্প বীরগণ নিহত ও শান্তভাবাপন্ন হইয়া গৃধ্র, কঙ্ক, বক, শ্যেন, কুকুর ও শৃগালগণের ভক্ষ্য হইয়াছেন। যাঁহারা পূর্বে সুকোমল নির্ম্মল শয্যায় শয়ন করিতেন, আজ তাঁহারা নিহত হইয়া বিস্তৃত বসুধাতলে শয়ান রহিয়াছেন। যাঁহারা যথাসময়ে বন্দিগণের স্তুতিবাদ শ্রবণ করিতেন, আজ তাঁহাদিগকে শিবাগণের বিবিধ অশুভধ্বনি শ্রবণ করিতে হইতেছে। পূর্বে যাঁহারা অগুরুচন্দনে চর্চিত হইয়া শয়ন করিতেন, আজ তাঁহারা ধূলিজালে ধূসরিত হইয়াছেন। গৃধ্র, গোমায়ু ও বায়সগণ এক্ষণে উঁহাদিগের আভরণ হইয়াছে। ভয়ঙ্কর জম্বুকগণ [শৃগাল] বারংবার ভীষণ চীৎকার করিয়া উঁহাদিগকে আকর্ষণ করিতেছে। যুদ্ধাভিমানী নিহত বীরগণ নিশিত শরনিকর, খড়্গ ও বিমল গদা ধারণপূর্ব্বক জীবিতের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। বিচিত্রমাল্যসমলঙ্কৃত ঋষভতুল্য অসংখ্য বীর নিশাচরগণকর্ত্তৃক ধরাতলে বিঘট্টিত হইতেছেন। পরিঘধারী সহস্র সহস্র মহাবীর প্রিয়তমার ন্যায় গদা আলিঙ্গনপূর্ব্বক শয়ান রহিয়াছেন। রাক্ষসগণ বর্ম্ম ও আয়ুধধারী অসংখ্য যোদ্ধাকে জীবিত বিবেচনা করিয়া ভয়ে আকর্ষণ করিতেছে না। রাক্ষসসমাকৃষ্ট বহুসংখ্যক বীরপুরুষের সুবর্ণময় বিচিত্র হার চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইতেছে। শৃগালেরা ভীত হইয়া নিহত বীরগণের কণ্ঠাবলম্বী হার আকর্ষণ করিতেছে। সুশিক্ষিত বন্দিগণ পূর্বে উৎকৃষ্ট স্তুতিবাদদ্বারা যাঁহাদিগকে আনন্দিত করিত, এক্ষণে রমণীগণ দুঃখশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া তাঁহাদিগের নিকট করুণস্বরে বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছে। এই দেখ, কৌরবকামিনীগণের মনোহর বদনমণ্ডল নিতান্ত পরিশুষ্ক হইয়া গিয়াছে। উহারা অবিরল বাষ্পকুললোচনে দুঃখিতমনে ইতস্ততঃ গমন করিতেছে। উহাদিগের মুখমণ্ডল অনবরত রোদন ও রোষপ্রভাবে রক্তবর্ণ হইয়া রক্তোৎপলবনের ন্যায় শোভা পাইতেছে। উহারা ভীষণ রোদনকোলাহলপ্রভাবে পরস্পরের অপরিস্ফুট বিলাপশব্দ শ্রবণ করিয়া তাহার অর্থগ্রহণ করিতে সমর্থ হইতেছে না। অনেকে বারংবার বিলাপ ও দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক দুঃখে নিস্পন্দ হইয়া প্রাণত্যাগ করিতেছে। অনেকে ভর্ত্তৃগণের মৃতদেহ দর্শন করিয়া মুক্তকণ্ঠে বিলাপ ও শিরে করাঘাত করিতেছে। এই দেখ, বীরগণের ছিন্ন মস্তক, হস্ত ও স্তুপাকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রণভূমি সমাচ্ছন্ন হইয়াছে। মহিলাগণ বীরগণের মস্তকশূন্য দেহ ও দেহশূন্য মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বিমোহিত হইতেছে। কোন কোন কামিনী এক বীরের দেহে অন্য বীরের মস্তক যোজনা করিয়া ‘হায়! কাহার মস্তক কাহার দেহে যোজিত করিলাম’ বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতেছে। কেহ কেহ বীরগণের দেহে শরসংছিন্ন [১] বাহু, ঊরু ও চরণ সংযোজিত করিয়া দুঃখিতমনে বারংবার মূর্চ্ছিত হইতেছে। কতকগুলি নারী পশুপক্ষীর নখদন্তাঘাতে ক্ষতবিক্ষত ছিন্নমস্তক ভর্ত্তৃগণকে সন্দর্শন করিয়াও আপনার পতি বলিয়া জ্ঞাত হইতে সমর্থ হইতেছে না। কেহ কেহ ভর্ত্তা, ভ্রাতা, পিতা ও পুত্রদিগকে শত্রুগণের হস্তে নিহত দেখিয়া বারংবার শিরে করাঘাত করিতেছে। সখড়্গ বাহু, কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক ও মাংসশোণিতসঞ্জাত কর্দ্দমে রণভূমি নিতান্ত দুর্গম হইয়া উঠিয়াছে। দেখ, যে কামিনীগণ পূৰ্বে দুঃখের লেশমাত্রও জানিত না, এক্ষণে তাহারা ভ্রাতা, পিতা ও পুত্রগণের মৃতদেহে রণস্থল সমাচ্ছন্ন দেখিয়া এককালে দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইতেছে। হে কেশব! আমার সুকেশী পুত্রবধূগণ যে এক্ষণে এরূপ মলিন ভাব অবলম্বন করিয়াছে, ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি আছে? যখন আমাকে পুত্র, পৌত্র ও ভ্রাতৃগণকে নিহত নিরীক্ষণ করিতে হইল, তখন নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, আমি পূর্বে ঘোরতর পাপানুষ্ঠান করিয়াছিলাম।” অন্ধরাজমহিষী এইরূপ বিলাপ করিতে করিতে রণনিহত দুৰ্য্যোধনকে অবলোকন করিলেন।