০২. কৃপকর্ত্তৃক দৈব-পুরুষকারে দোষগুণবর্ণন

২য় অধ্যায়

কৃপকর্ত্তৃক দৈব-পুরুষকারে দোষগুণবর্ণন

কৃপাচার্য্য কহিলেন, “হে বীর! আমি তোমার বাক্য শ্রবণ করিলাম; এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। মনুষ্যেরা দৈব ও পুরুষকারসাধ্য কর্ম্মে আবদ্ধ হইয়া আছে। দৈব ও পুরুষকার অপেক্ষা আর কিছুই বলবান্ নাই। একমাত্র দৈব বা একমাত্র পুরুষকার প্রভাবে কোন কাৰ্য্যই সিদ্ধ হয় না। ঐ উভয়ের একত্র সমাবেশ না হইলে সিদ্ধিলাভ হওয়া নিতান্ত সুকঠিন। কি উৎকৃষ্ট, কি অপকৃষ্ট, সমস্ত কাৰ্য্যই দৈব ও পুরুষকার-সাপেক্ষ। পর্জন্য পর্ব্বতোপরি সলিল-বর্ষণ করিয়া কোন ফল উৎপাদনে সমর্থ হয় না। কিন্তু কৃষ্ট ক্ষেত্রে বারি-বর্ষণ করিলে প্রচুর ফল উৎপন্ন করিতে পারে। দৈবহীন পুরুষকার আর পুরুষকারশূন্য দৈব উভয়ই নিতান্ত নিষ্ফল। দৈব ও পুরুষকার উভয়েরই আনুকূল্য থাকিলে মনুষ্যের অবশ্যই সিদ্ধিলাভ হইয়া থাকে। ক্ষেত্র বারিধারাসংসিক্ত ও সম্যক্ কর্ষিত হইলে তাহাতে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয়। অনেক স্থানে দৈব পুরুষকারের অপেক্ষা না করিয়া স্বয়ংই ফল প্রদান করে, কিন্তু বিবেচক লোকেরা দৈববল অবলম্বনপূর্ব্বক পুরুষকারেই মনোনিবেশ করিয়া থাকেন। যাহা হউক, মনুষ্যের সমস্ত কাৰ্য্যই দৈব ও পুরুষকার-সাপেক্ষ, সন্দেহ নাই। পুরুষকার সহকারে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলে উহা দৈব বলযোগে সুসিদ্ধ হয় এবং সেই দৈববল-প্রভাবেই কর্ম্মকর্ত্তা ফল লাভ করিয়া থাকে। মনুষ্য দৈববলশূন্য পুরুষকার প্রকাশ করিলে তাহা নিতান্ত নিষ্ফল হয়। আর অলস ও নির্বোধেরা পুরুষকারে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়া থাকে; কিন্তু তাহা প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদিগের মতে যুক্তিসঙ্গত নহে। কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে তাহা প্রায় নিষ্ফল হয় না, কিন্তু কার্য্যানুষ্ঠানের পরাঙ্মুখ হইলে নিশ্চয়ই অতিশয় দুঃখভোগ করিতে হয়। যাহা হউক, যদি কেহ কোন কাৰ্য্য অনুষ্ঠান না করিয়া সদৃট্ঠাক্রমে তাহার ফলভোগ করে, আর যদি কেহ কোন কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়াও তাহার ফলভোগে বঞ্চিত হয়, তাহা হইলে সেই উভয়বিধ ব্যক্তিকেই নিতান্ত দুর্দ্দশাপন্ন বলিতে হইবে, সন্দেহ নাই। কার্য্যদক্ষ ব্যক্তি অক্লেশে কালাতিপাত করিতে পারে, কিন্তু অলস কিছুতেই সুখলাভে সমর্থ হয় না। এই জীবলোকে সুনিপুণ ব্যক্তিরা প্রায়ই হিতৈষী হইয়া থাকে। কার্য্যদক্ষ ব্যক্তি অনুষ্ঠিত কার্য্যের ফলভাগে সমর্থ হউক বা না হউক, কিছুতেই নিন্দনীয় হয় না; কিন্তু যে ব্যক্তি কোন কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান না করিয়া ফললাভ করে, সে নিতান্ত নিন্দনীয় ও সকলেরই বিদ্বেষভাজন। এই নিমিত্তই বুদ্ধিমান লোকেরা কহিয়া থাকেন যে, যে ব্যক্তি পুরুষকারকে অনাদর করে, সে আপনার অনিষ্টসাধন করিয়া থাকে। ‘দৈব ও পুরুষকার ব্যতীত কোন কার্য্যই সিদ্ধ হয় না, যদি পুরুষকারসম্পন্ন ব্যক্তি দৈববল অবলম্বন করিয়া কোন কাৰ্য্যানুষ্ঠান করে, তাহার কাৰ্য্য অবশ্যই সফল হয়। সকলেরই বৃদ্ধ লোকদিগের সহবাস এবং তাঁহাদিগের পরামর্শ গ্রহণ ও উপদিষ্ট কার্য্যের অনুষ্ঠান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অভ্যুদয়কালে সর্ব্বদা বৃদ্ধদিগকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিবে। বৃদ্ধেরা অলব্ধ বস্তুর লাভ ও কার্য্যসিদ্ধির মূল কারণ। যে ব্যক্তি বৃদ্ধের বাক্য শ্রবণ করিয়া পুরুষকার প্রদর্শন করে, সে অচিরাৎ ফললাভে সমর্থ হয়। যে ব্যক্তি ক্রোধ, ভয় ও লোভপরতন্ত্র হইয়া, কাহারও সহিত মন্ত্রণা করিয়া কার্য্যানুষ্ঠান করে, সে অচিরাৎ শ্রীভ্রষ্ট হয়। দেখ, অদূরদর্শী লুব্ধ প্রকৃতি দুৰ্য্যোধন হিতবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদিগকে অনাদরপ্রদর্শন ও অসাধু লোকের পরামর্শ গ্রহণপূর্ব্বক আমাদিগের কর্ত্তৃক বারংবার নিবারিত হইয়াও গুণশালী পাণ্ডবগণের সহিত বৈরাচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিল; সেই নিমিত্তই এক্ষণে পরিতাপিত হইতেছে। আমরা সেই পাপাত্মার অভিপ্রায়ানুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিতেছি বলিয়া আমাদের এইরূপ ভয়ঙ্কর দুর্দ্দশা সমুপস্থিত হইয়াছে। আমি ঐ দুরাত্মার নিমিত্তই দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইয়াছি। এক্ষণে দুঃখপ্রভাবে আমার বুদ্ধি নিতান্ত আকুল হওয়াতে আমি কোনক্রমেই সদবিবেচনা করিতে সমর্থ হইতেছি না। মনুষ্য মোহান্ধ হইলে সুহৃদ্‌ব্যক্তিকে সৎপরামর্শ জিজ্ঞাসা করিবে। তৎকালে সেই সুহৃদই তাহার বুদ্ধি, বিনয় ও শ্রেয়োলাভের একমাত্র কারণ; সুতরাং তাহার বাক্যানুসারে কার্য্যানুষ্ঠানই সর্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। অতএব চল, আমরা রাজা ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও বিদুরের নিকট গমনপূর্ব্বক এই বিষয়ে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি। তাঁহারা বিবেচনাপূর্ব্বক যাহা হিতকর বলিয়া অবধারণ করিবেন, আমরা তাহাই করিব। কাৰ্য্য আরম্ভ না করিলে কদাচ ফললাভ হয় না; কিন্তু পৌরুষ প্রকাশপূর্ব্বক কার্য্যারম্ভ করিলেও যদি তাহা নিষ্ফল হয়, তবে দৈবকেই তাহার প্রতিবন্ধক বলিতে হইবে, সন্দেহ নাই।”