৩৬. গুণবৈষম্যে জীবের বদ্ধাবস্থা

৩৬তম অধ্যায়

গুণবৈষম্যে জীবের বদ্ধাবস্থা

ব্ৰহ্মা বলিলেন, “হে মহর্ষিগণ! ওই সমুদয়ের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণ অক্ষুব্ধভাবে অবস্থান করিলে উহাদিগকে অব্যক্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। এই গুণত্রয় সৰ্ব্বকার্য্যব্যাপী, অবিনাশী ও স্থির। আর যখনই সেই গুণত্রয় ক্ষুভিত হয়, তখন উহা পঞ্চভূতাত্মক নবদ্বারযুক্ত পুররূপে পরিণত হইয়া থাকে। ওই পুরমধ্যে একজন ইন্দ্রিয় অবস্থানপূর্ব্বক জীবকে বিষয়বাসনায় আক্রান্ত করে। মন ওই পুরমধ্যে অবস্থান করিয়া বিষয়সমুদয় অভিব্যক্ত করিয়া দেয়। বুদ্ধি ওই পুরের কর্ত্রী। লোকে ভ্রান্তিবশতঃ এই পুরকেই জীবাত্মা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকে, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে। জীব ওই পুরমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক দুঃখ ভোগ করিয়া থাকেন।

“সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণাত্মক তিনটি প্রণালী স্ব স্ব বিষয় প্রবাহিত করিয়া এই পুরমধ্যস্থ জীবাত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। এই গুণত্রয় পরস্পর পরস্পরকে আশ্রয়পূর্ব্বক অবস্থান করিয়া থাকে। যে স্থানে উহাদের মধ্যে একের আধিক্য হয়, তথায় অন্যের হীনতা লক্ষিত হইয়া থাকে। পৃথিব্যাদি পঞ্চভূত ওই গুণত্রয় অপেক্ষা পরিহীন নহে। যে স্থানে সত্ত্বগুণের আধিক্য হয়, সে স্থানে রজঃ ও তমোগুণের এবং যে স্থানে রজোগুণের বা তমোগুণের আধিক্য হয়, সে স্থানে সত্ত্বগুণের হীনতা দৃষ্ট হইয়া থাকে। তমোগুণের হ্রাস হইলেই রজোগুণ প্রকাশিত ও রজোগুণের হ্রাস হইলেই সত্ত্বগুণ আবির্ভূত হয়।

তমোগুণের কাৰ্য্য

“তমোগুণ অপ্রকাশাত্মক [আবরণধৰ্ম্ম—জ্ঞানের আচ্ছাদক], উহাকে মোহ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। উহার প্রভাবেই মনুষ্যের অধর্ম্মে প্রবৃত্তি হইয়া থাকে এবং উহার প্রাদুর্ভাবদর্শনে মনুষ্যকে পরমাত্মা বলিয়া পরিগণিত করা যায়। রজোগুণ সৃষ্টির কারণস্বরূপ। উহা প্রথমতঃ আকাশাদি সূক্ষ্ম ভূতসমুদয় উৎপাদন করিয়া তৎপরে তৎসমুদয় হইতে পৃথিব্যাদি স্থূলভূতসমুদয় উৎপাদন করে। রজোগুণ সকল ভূতেই অবস্থিত রহিয়াছে। দৃশ্য পদার্থসমুদয় এই গুণ হইতে উৎপন্ন রহিয়াছে। সত্ত্বগুণ প্রকাশাত্মক। উহার প্রভাবে জীবের গৰ্ব্বরাহিত্য ও শ্রদ্ধাশীলতা জন্মে।

“এক্ষণে আমি এই তিনগুণের কাৰ্য্যসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মোহ, অজ্ঞানতা, অত্যাগ, অনিশ্চয়তা, স্বপ্ন, স্তম্ভ [গৰ্ব্ব], ভয়, লোভ, শোক, সৎকাৰ্য্যদূষণ [সৎকার্য্যের নিন্দা], অস্মৃতি, অফলতা, নাস্তিকতা, দুশ্চরিত্রতা, সদসদ্‌ বিবেকরাহিত্য, ইন্দ্রিয়বর্গের অপরিস্ফুটতা, নিকৃষ্ট ধর্ম্মের প্রবৃত্তি, অকার্য্যে কার্য্যজ্ঞান, অজ্ঞানে জ্ঞানাভিমান, অমিত্ৰতা, কাৰ্য্যে অপ্রবৃত্তি, অশ্রদ্ধা, বৃথাচিন্তা, অসরলতা, কুবুদ্ধি, অক্ষমতা, অজিতেন্দ্রিয়তা, অন্যের অপবাদ, ব্রাহ্মণের নিন্দাবাদ, অভিমান, মোহ, ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা, মৎসরতা, নীচকৰ্ম্মে অনুরাগ, অসুখকর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান, অপাত্রে দান ও অতিথি প্রভৃতিকে দান না করিয়া ভোজন, এইগুলি তমোগুণের কার্য্য। যেসকল পাপাত্মা ঐ সমস্ত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া শাস্ত্রমৰ্য্যাদা অতিক্রম করে, তাহাদিগকেই তামসিক বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। ঐ তামস প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিরা জন্মান্তরে স্থাবর পদার্থ, রাক্ষস, সর্প, কৃমি, কীট, পক্ষী, বিবিধ চতুস্পদজন্তু এবং উন্মত্ত, বধির, মূক ও অন্যান্য। পাপরোগাক্রান্ত মনুষ্য হইয়া জন্মগ্রহণ করে। যাহাদিগের মনোবৃত্তি নিতান্ত নিকৃষ্ট, তাহারাই তামস বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। এক্ষণে ইহাদিগের যেরূপে ক্রমশঃ উৎকর্ষলাভ ও পুণ্যের আবির্ভাব হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“স্বকৰ্ম্মনিরত শুভার্থী ব্রাহ্মণেরা, মূকাদি তামস প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিদিগকে বৈদিক সংস্কারদ্বারা সংস্কৃত করিলে উহারা স্বর্গে গমন করিয়া থাকে। আর যাহারা তামস প্রকৃতিপ্রভাবে পশুপক্ষী প্রভৃতির দেহ পরিগ্রহ করে, তামস যজ্ঞাদি কাৰ্য্যে নিহত হইলে, প্রথমতঃ চণ্ডালাদি যোনিতে জন্মপরিগ্রহ করিয়া থাকে এবং তৎপরে সেই সমস্ত যোনি হইতে উত্তরোত্তর উৎকৃষ্ট যোনি প্রাপ্ত হয়। মনুষ্য উৎকৃষ্ট যোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াও যদি কুকর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, তাহা হইলে তাহার পরজন্মে অপকৃষ্ট যোনি লাভ হয়, সন্দেহ নাই। শাস্ত্রে তামস প্রভৃতি পাঁচ প্রকার বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে, অবিবেকরূপ তমঃ, চিত্তবিভ্রমাত্মক মোহ, বিষয়াসক্তিরূপ মহামোহ, ক্রোধাত্মক তামি ও মৃত্যুসংজ্ঞক অন্ধতামিস্র।

“এই আমি স্বরূপ, গুণ ও যোনি অনুসারে তোমাদিগের নিকট এই তমোগুণের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। ভ্ৰান্তচিত্ত ব্যক্তিরা কখনই উহা বিশেষরূপে অবগত হইতে পারে না। যে ব্যক্তি উহা বিশেষরূপে অবগত হইতে পারে, সে কদাপি উহাতে অভিভূত হয় না।”