২২. অন্তর্যাগসাধনোপায়

অন্তর্যাগসাধনোপায়

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘হে শোভনে! অনন্তর অন্তর্যাগনিরত সপ্ত হোতার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ঘ্রাণ, চক্ষু, জিহ্বা, ত্বক্‌, শ্রোত্র, মন ও বুদ্ধি এই সাতটি অন্তর্য্যাগনিরত হোতা। ইহারা সূক্ষ্ম লিঙ্গশরীরে অবস্থান করিয়া থাকে, কদাপি পরস্পর পরস্পরের গুণ প্রত্যক্ষ করিতে পারে না।

“ব্রাহ্মণী কহিলেন, ‘নাথ! ঐ সপ্ত হোতা লোকের সূক্ষ্ম লিঙ্গ শরীরে পরস্পর পরস্পরের অপ্রত্যক্ষে কিরূপে অবস্থান করিতেছে এবং উহাদের স্বভাবই বা কিরূপ, আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন।

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘ভদ্রে! পরমাত্মা সৰ্ব্বজ্ঞ, তিনিই সকলের গুণ অবগত আছেন। ইন্দ্রিয়গণ সৰ্ব্বজ্ঞ নহে, সুতরাং উহারা কখনই পরস্পর পরস্পরের গুণ অবগত হইতে পারে না। দেখ, জিহ্বা, চক্ষু, শ্রোত্র, ত্বক্, মন ও বুদ্ধি গন্ধ আঘ্রাণ করিতে সমর্থ নহে; একমাত্র নাসিকাই উহা আঘ্রাণ করিয়া থাকে। নাসিকা, চক্ষু, কর্ণ, ত্বক্‌, মন ও বুদ্ধি রসাস্বাদনে সমর্থ হয় না; একমাত্র জিহ্বাই উহার আস্বাদ প্রাপ্ত হয়। নাসিকা, জিহ্বা, কর্ণ, ত্বক্‌, মন ও বুদ্ধি কখনই রূপ দর্শন করিতে পারে না; একমাত্র চক্ষুই উহা দর্শন করিয়া থাকে। নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু, কর্ণ, মন ও বুদ্ধি কদাপি স্পর্শানুভব করিতে সমর্থ হয় না; একমাত্র ত্বকই উহা অনুভব করে। নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু, ত্বক্‌, মন ও বুদ্ধি কখনই শব্দ শ্রবণ করিতে পারে না; একমাত্র কর্ণই উহা শ্রবণ করিয়া থাকে। নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু, ত্বক, কর্ণ ও বুদ্ধি কদাপি সংশয় করিতে সমর্থ হয় না; একমাত্র মনই উহা করিয়া থাকে। নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু, ত্বক্‌, কর্ণ ও মন কখন নিশ্চয়জ্ঞান লাভ করিতে পারে না; একমাত্র বুদ্ধিই উহা লাভ করে।

‘এক্ষণে আমি ইন্দ্রিয়মনঃসংবাদনামক এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা মন অন্যান্য ইন্দ্রিয়গণের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিল, “হে ইন্দ্রিয়গণ! আমা ব্যতীত তোমরা কোন কাৰ্য্য করিতে পার না, আমি না থাকিলে নাসিকা আঘ্রাণ, জিহ্বা রসাস্বাদন, চক্ষু রূপসন্দর্শন, ত্বক স্পর্শানুভব এবং কর্ণ শব্দ শ্রবণ করিতে কখনই সমর্থ হয় না। আম ভিন্ন তোমরা সকলেই জনশূন্য গৃহের ন্যায়, প্রশান্তশিখ [শিখারহিত—নিৰ্ব্বাণপ্রাপ্ত] অগ্নির ন্যায় একেবারে প্রভাশূন্য হইয়া থাক। আমি না থাকিলে জীবগণ কেবল তোমাদিগের সহায়বলে কখনই বিষয়জ্ঞানে সমর্থ হয় না; অতএব আমি তোমাদের সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান।”

“মন গর্ব্বিতভাবে এই কথা কহিলে, ইন্দ্রিয়গণ তাহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, ভদ্র! যদি তুমি আমাদিগের সাহায্য ব্যতীত সমুদয় বিষয় সম্ভোগ করিতে সমর্থ হইতে, তাহা হইলে তুমি যাহা বলিলে, তাহা আমরা যথার্থ বলিয়া স্বীকার করিতাম। যদি আমাদের উপর তোমার সম্পূর্ণ প্রভুত্ব থাকে, তাহা হইলে তুমি ঘ্রাণরূপদর্শন, চক্ষুদ্বারা রসাস্বাদন, শ্ৰোত্ৰদ্বারা গন্ধ গ্রহণ, জিহ্বদ্বারা স্পর্শানুভব, বৃদ্বারা শব্দগ্রহণ এবং বুদ্ধিদ্বারা স্পর্শানুভব করিতে যত্নবান হও। বলবান্ ব্যক্তিরা কখনই নিয়মের বশীভূত হয় না, দুৰ্ব্বল ব্যক্তিরাই নিয়মের বশীভূত হইয়া থাকে। যদি তুমি আপনাকে বলবান্ বোধ কর, তাহা হইলে এক্ষণে অপূৰ্ব্ব ভোগসমুদয় সম্ভোগ করাই তোমার উচিত। আমাদিগের উচ্ছিষ্ট ভোগ করা তোমার কখনই কর্ত্তব্য নহে। শিষ্য যেমন গুরুপ্রদর্শিত বেদার্থের অনুগমন করে, তদ্রূপ তুমি নিদ্রাবস্থায় হউক, আর জাগরণাবস্থায় হউক, আমাদিগের প্রদর্শিত অতীত ও অনাগত বিষয়সমুদয় সম্ভোগ করিয়া থাক।

“বিমনায়মান সামান্যবুদ্ধি জীবগণ কেবল আমাদিগের প্রভাবেই প্রাণধারণ করিয়া থাকে। মনুষ্য বিবিধ সঙ্কল্প ও স্বপ্নজনিত বিষয় ভোগ করিয়া ও ক্ষুধায় কাতর হইয়া আমাদের সাহায্যগ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। আর দেখ, আমরা বিষয়ভোগে নিবৃত্ত হইলেও জীব কেবল তোমারই নিমিত্ত সঙ্কল্পজনিত বিষয়ভোগে ব্যাপৃত হইয়া মুক্তিলাভে সমর্থ হয় না। তোমার লয় হইলেই জীব নিরিন্ধন [কাষ্ঠহীন] হুতাশনের ন্যায় নির্ব্বাণপদলাভে সমর্থ হইয়া থাকে। যাহা হউক, আমরা পরস্পর পরস্পরের গুণ অবগত নহি, সতত স্ব স্ব বিষয়েই অবস্থান করিয়া থাকি যথার্থ বটে, কিন্তু আমাদিগের সহায়তা ভিন্ন তোমার কোন জ্ঞানলাভ হয় না। তোমার অভাবে আমাদিগের কেবল হর্ষেরই হানি হয়।”