২১. অন্তর্যাগ—সূক্ষ্মবায়ুর স্বররূপে পরিণত

অন্তর্যাগ—সূক্ষ্মবায়ুর স্বররূপে পরিণত

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে ভামিনি! এক্ষণে দশহোতৃ বিহিত অন্তর্যাগের বিষয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। কর্ণ, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা, নাসিকা, মুখ, চরণ, কর, উপস্থ ও পায়ু এই দশবিধ হোতা। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ, বাক্য, ক্রিয়া, গতি, ত্যাগ, মূত্র ও পুরীষ পরিত্যাগ এই দশবিধ হবনীয় দ্রব্য। দিক্‌, বায়ু, সূৰ্য্য, চন্দ্র, পৃথিবী, অগ্নি, বিষ্ণু, চন্দ্র, প্রজাপতি ও মিত্র এই দশবিধ অগ্নি। কর্ণাদি দশবিধ হোতা দিগাদি দশবিধ অগ্নিতে শব্দাদি দশবিধ হবনীয় দ্রব্য আহুতি প্রদান করেন। চিত্ত ঐ যজ্ঞের স্রুব এবং পাপপুণ্য উহার দক্ষিণাস্বরূপ। এই যজ্ঞ সমাপন হইলে অতি উৎকৃষ্ট বিশুদ্ধ জ্ঞানলাভ হয়। ঐ জ্ঞান জগৎ হইতে ভিন্ন পদার্থ। জ্ঞাতব্য বস্তুকে জ্ঞেয়, সমুদয় দ্রব্যের প্রকাশককে জ্ঞান এবং স্থূল-সূক্ষ্ম শরীরাভিমানী জীবকে জ্ঞাতা বলিয়া কীৰ্ত্তন করে। ঐ জ্ঞাতা জীবাত্মা গার্হপত্য অগ্নিস্বরূপ। উনি শরীর হইতে পৃথকভাবে অবস্থান করিতেছেন। আস্যদেশ আহবনীয় অগ্নিস্বরূপ। ঐ অগ্নিতে অন্নাদি বস্তুসমুদয় প্রক্ষিপ্ত হইলেই বাক্যরূপে পরিণত হয়। মন প্রাণ-বায়ুসহকারে সেই বাক্যের পর্য্যালোচনা করিয়া থাকে।’

“ব্রাহ্মণী কহিলেন, ‘ভগবন্! যখন মনোমধ্যে বাক্যের পর্য্যালোচনা না করিলে কখন তাহার আবির্ভাব হয় না, তখন বাক্য মনেরই অধীন; কিন্তু আপনার কথাদ্বারা বোধ হইতেছে, মন বাক্যের অধীন। এক্ষণে মন বাক্যের অধীন, কি বাক্য মনের অধীন, তদ্বিষয়ে আমার অত্যন্ত সন্দেহ হইতেছে। আর সুষুপ্তিকালে প্রাণ মনের সহিত একত্র অবস্থান করিয়াও মনের ন্যায় লয় প্রাপ্ত হয় না কেন? ঐ সময়ে কে উহাকে রুদ্ধ করিয়া রাখে?’

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘প্রিয়ে! সুষুপ্তিকালে অপান-বায়ু প্রাণকে আপনার বশীভূত ও রুদ্ধ করিয়া রাখে। মনই প্রাণের গতির অধীন; কিন্তু প্রাণ মনের গতির অধীন নহে। এই নিমিত্তই মনের লয়ে প্রাণের লয় হয় না। অতঃপর তুমি বাক্য ও মনের বিষয়ে। যে প্রশ্ন করিয়াছ, তাহার উত্তর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর।

‘একদা বাক্য ও মন জীবাত্মার নিকট গমনপূৰ্ব্বক জিজ্ঞাসা করিল, “প্রভো! আমাদের উভয়ের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ?”

তখন জীবাত্মা কহিলেন, “আমার মতে মনই শ্রেষ্ঠ।” জীবাত্মা এই কথা কহিলে বাক্য তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “প্রভো! আমার প্রভাবে ত’ আপনার অশেষবিধ বিষয়ভোগ হইয়া থাকে, তবে মন কি নিমিত্ত আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইল?” বাক্য এই কথা কহিলে জীবাত্মা তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন মন জীবাত্মার অভিপ্রায় অবগত হইয়া বাক্যকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “ভদ্র! ইহলৌকিক দৃশ্যপদার্থসমুদয় ও পারলৌকিক স্বর্গাদি এই উভয়েই আমার অধিকার আছে। তন্মধ্যে ইহলৌকিক দৃশ্যপদার্থসমুদয় আমি সাক্ষাৎসম্বন্ধে অধিকার করিয়া থাকি; কিন্তু পারলৌকিক স্বর্গাদিতে তোমার সাহায্যদ্বারাই আমার অধিকার জন্মে। তুমি মন্ত্রাদিরূপে পরিণত হইয়া স্বর্গাদি পারলৌকিক বিষয়সমুদয় প্রকাশ না করিলে উহাতে আমার অধিকার হয় না। অতএব ইহলৌকিক বিষয়ে আমার ও পারলৌকিক বিষয়ে তোমার প্রাধান্য আছে। তুমি আপনার প্রাধান্যলাভের নিমিত্ত নিতান্ত সচেষ্টিত হইয়াছিলে বলিয়াই আমি এই কথা কহিলাম।”

‘ব্রাহ্মণ এইরূপে ব্রাহ্মণীর নিকট বাক্য ও মনের বিয়য়ভেদে প্রাধান্য কীৰ্ত্তন করিয়া পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ভদ্রে! মন অপেক্ষা বাক্যের প্রাধান্য কিছুতেই স্বীকার করা যায় না। প্রাণ ও অপান মনের বৃত্তিবিশেষ। বাক্য সেই প্রাণ ও অপানের প্রভাবে উৎপন্ন হইয়া থাকে। পূৰ্ব্বে বাক্য প্রাণ-ব্যাপারের অভাবে নিতান্ত নীচ-ভাবাপন্ন হইয়া প্রজাপতির নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাহার শরণাপন্ন হওয়াতে প্রজাপতি প্রাণকে সতত বাক্যের সাহায্য করিতে অনুমতি করিয়াছিলেন। সেই অবধি প্রাণ সৰ্ব্বদা বাক্যের সাহায্য করিয়া তাহাকে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত করে। প্রাণের সাহায্য ব্যতীত বাক্য কখনই উচ্চারিত হইতে পারে না। এই নিমিত্তই কুম্ভককালে কোন বাক্যই উৎপন্ন হয় না।

“বাক্য দুই প্রকার;—ব্যক্ত ও অব্যক্ত। তন্মধ্যে ব্যক্ত বাক্যই প্রাণের অধীন। অব্যক্ত বাক্য জাগ্ৰত-স্বপ্নাদি সমুদয় অবস্থাতেই মনুষ্যের অন্তরে হংসমন্ত্র[‘হং’ মন্ত্রে বায়ুঃ গ্রহণ ও ‘সঃ’ মন্ত্রে বায়ু ত্যাগরূপ প্রাণায়াম মন্ত্র]রূপে বিদ্যমান থাকে। এই নিমিত্তই অব্যক্ত বাক্যকে ব্যক্ত বাক্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত করা যায়। কিন্তু ব্যক্ত বাক্য মনুষ্যের অশেষবিধ শুভকাৰ্য্য সম্পাদন করিয়া থাকে। ধেনু যেমন দুগ্ধদ্বারা লোকের সবিশেষ হিতসাধন করে, তদ্রূপ আগমনরূপ ব্যক্ত বাক্য স্বর্গাদি ফলপ্রদাপূৰ্ব্বক তাহার সবিশেষ উপকার হয়। ব্রহ্মপ্রকাশক উপনিষরূপ মহাবাক্য মনুষ্যগণকে মোক্ষপ্ৰদান করিয়া থাকে।’

‘ব্রাহ্মণী কহিলেন, ‘নাথ! বাক্য কি উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক উচ্চারিত ও শ্রুত হইয়া থাকে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।

‘ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘প্রিয়ে! আত্মা প্রথমতঃ বিপক্ষ হইয়া মনকে বাক্যোচ্চারণের নিমিত্ত প্রেরণ করিলে মন জঠরানলে সন্ধুক্ষিত করে। জঠরানল সন্ধুক্ষিত হইলেই তাহার প্রভাবে প্রাণ-বায়ু সঞ্চালিত হইয়া অপানে গমন করে। তৎপরে ঐ বায়ু উদান-বায়ুর প্রভাবে ঊর্দ্ধে নীত ও মস্তকে প্রতিহত এবং ব্যান-বায়ুর প্রভাবে কণ্ঠতাল্বাদি স্থানে অভিহত হইয়া বেগবশতঃ বর্ণোৎপাদনপূর্ব্বক বৈখরীরূপে [স্বররূপে] লোকের শ্রবণপথে প্রবিষ্ট হয়। অনন্তর যখন উহার বেগ এককালে নিবৃত্ত হইয়া যায়, তখন উহা পুনরায় সমানভাবে পরিণত হয়।