১৩. কামনাত্যাগের উপদেশ—কামগীতা

কামনাত্যাগের উপদেশ—কামগীতা

কৃষ্ণ কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! কেবল রাজ্যাদি পরিত্যাগ করিয়া সিদ্ধিলাভ করা কদাপি সম্ভবপর নহে। ইন্দ্রিয়সমুদয়কে পরাজয় করিতে পারিলেও সিদ্ধিলাভ হয় কি না সন্দেহ। যাহারা রাজ্যাদি বিষয়সমুদয় পরিত্যাগ করিয়াও মনে মনে বিষয়ভোগের বাসনা করে, তাহাদিগের ধর্ম্ম ও সুখ আপনার শত্রুগণ লাভ করুক। মমতা সংসারপ্রাপ্তির ও নির্ম্মমতা ব্ৰহ্মালাভের কারণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। ঐ বিরুদ্ধধর্ম্মাবলম্বী মমতা ও নির্ম্মমতা লোকসমুদয়ের চিত্তে অলক্ষিতভাবে অবস্থানপূর্ব্বক পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ ও পরাজয় করিয়া থাকে।

“যে ব্যক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বের অবিনশ্বরতানিবন্ধন জগতে অস্তিত্ব অবিনশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করেন, প্রাণীগণের দেহনাশ করিলেও তাঁহাকে হিংসাপাপে লিপ্ত হইতে হয় না; যে ব্যক্তি স্থাবরজঙ্গমসম্বলিত সমুদয় জগতের আধিপত্যলাভ করিয়াও মমতা পরিত্যাগ করিতে পারেন, তাঁহাকে কখনই সংসারপাশে বদ্ধ হইতে হয় না। আর যে ব্যক্তি অরণ্যে ফলমূলাদিদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করিয়াও বিষয়বাসনা পরিত্যাগ করিতে না পারে, তাহাকে নিশ্চয়ই সংসারজালে জড়িত হইতে হয়। অতএব ইন্দ্রিয় ও বিষয়সমুদয় মায়াময় বলিয়া নিশ্চয় করা আপনার অবশ্য কৰ্ত্তব্য। যে ব্যক্তি ঐ সমুদয়ের প্রতি কিছুমাত্র মমতা না করেন, তিনি নিশ্চয়ই সংসার হইতে মুক্তিলাভে সমর্থ হয়েন।

“কামপরতন্ত্র মূঢ় ব্যক্তিরা কদাচ প্রশংসার আস্পদ হইতে পারে না। কামনা মন হইতে সমুৎপন্ন হয়, উহা সমুদয় প্রবৃত্তির মূল কারণ। যে সমুদয় মহাত্মা বহুজন্মের অভ্যাসবশতঃ কামনাকে অধৰ্ম্মরূপে পরিজ্ঞাত হইয়া ফললাভের বাসনাসহকারে দান, বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, ব্রত, যজ্ঞ, বিবিধ নিয়ম, ধ্যানমার্গ ও যোগমার্গ আশ্রয় না করেন, তাহারাই এককালে কামনাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন। কামনিগ্রহই যথার্থ ধৰ্ম্ম ও মোক্ষের বীজস্বরূপ, সন্দেহ নাই।

“অতঃপর পুরাবিৎ পণ্ডিতগণ যে কামগীতা কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন, আমি এক্ষণে তোমার নিকট তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। কামনা স্বয়ং কহিয়াছে যে, নির্ম্মমতা ও যোগাভ্যাস ভিন্ন কেহ আমাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি জপাদি কাৰ্য্যদ্বারা আমাকে জয় করিতে চেষ্টা করে, আমি তাহার মনে অভিমানরূপে আবির্ভূত হইয়া তাহার কাৰ্য্য বিফল করিয়া থাকি। যে ব্যক্তি বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা আমাকে পরাজিত করিতে চেষ্টা করে, আমি তাহার মনে জঙ্গমমধ্যগত জীবাত্মার ন্যায় ব্যক্তরূপে উদিত হই। যে ব্যক্তি বেদবেদান্ত সমালোচনাদ্বারা আমাকে শাসন করিতে যত্নবান হয়, আমি তাহার মনে স্থাবরান্তর্গত জীবাত্মার ন্যায় অব্যক্তরূপে অবস্থান করি। যে ব্যক্তি ধৈৰ্য্যদ্বারা আমাকে জয় করিতে চেষ্টা করে, আমি কখনই তাহার মন হইতে অপনীত হই না। যে ব্যক্তি তপস্যাদ্বারা আমাকে পরাজয় করিতে যত্ন করে, আমি তাহার তপস্যাতেই প্রাদুর্ভূত হই এবং যে ব্যক্তি মোক্ষার্থী হইয়া আমাকে জয় করিতে বাসনা করে, আমি তাহাকে লক্ষ্য করিয়া নৃত্য ও উপহাস করিয়া থাকি। পণ্ডিতেরা আমাকে সৰ্ব্বভূতের অবধ্য ও সনাতন বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন।’

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এই আমি আপনার নিকট কামগীত সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। অতএব কামনাকে পরাজয় করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। আপনি বিধিপূৰ্ব্বক অশ্বমেধ ও অন্যান্য সুখসমৃদ্ধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া, কামনাকে ধৰ্ম্মবিষয়ে নীত করুন। বারংবার বন্ধুবিয়োগে অভিভূত হওয়া আপনার নিতান্ত অনুচিত। আপনি অনুতাপদ্বারা কখনই তাঁহাদিগের পুনর্দ্দর্শনলাভে সমর্থ হইবেন না। অতএব এক্ষণে মহাসমারোহে সুখসমৃদ্ধ যজ্ঞসমুদয়ের অনুষ্ঠান করুন, তাহা হইলেই ইহলোকে অতুল কীৰ্ত্তি ও পরলোকে উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে সমর্থ হইবেন।”