৩৪. মৃতশরীরে আত্মার আবির্ভাবের যুক্তি

মৃতশরীরে আত্মার আবির্ভাবের যুক্তি

সৌতি কহিলেন, মহর্ষিগণ! মহারাজ জনমেজয় এইরূপে বৈশম্পায়নের মুখে দুৰ্য্যোধনাদির পুনরায় মর্ত্যলোকে আগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া প্রীতমনে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ব্রহ্মন্! আপনার বাক্যশ্রবণে আমার পরম পরিতোষ হইল। এক্ষণে আমার মনে এই সন্দেহ সমুপস্থিত হইয়াছে যে, আমার পূর্ব্বপিতামহ দুর্য্যোধনাদি মহাত্মারা সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগপৰ্ব্বক পরলোকে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহারা কিরূপে সেই শরীরে পুনরায় মর্ত্যলোকে আগমন করিলেন?

মহারাজ জনমেজয় এই কথা কহিলে, মহাপ্রভাবসম্পন্ন ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, নরনাথ! ভোগ ব্যতীত কখনই কর্ম্মসমুদয়ের বিনাশ হয় না। কৰ্ম্মপ্রভাবেই লোকের শরীর উৎপন্ন হইয়া থাকে। ঐ শরীর যেসমুদয় মহাভূতদ্বারা নির্ম্মিত হয়, তৎসমুদয়ে পরমাত্মার অধিষ্ঠান থাকে বলিয়া দেহনাশ হইলেও তাহাদের নাশ হয় না। লোকে পূর্ব্বতন অদৃষ্ট প্রভাবে কৰ্ম্মানুষ্ঠান করিয়া থাকে। কৰ্ম্ম অনুষ্ঠিত হইলে নিশ্চয়ই যথাকালে উহার ফল উৎপন্ন হয়। আত্মা সেই কৰ্ম্ম ও মহাভূতসমুদয়ে লিপ্ত হইয়া সুখদুঃখ ভোগ করেন। আত্মার নাশ নাই এবং উনি মহাভূতসমুদয়কে কখন পরিত্যাগ করেন না। লোকের যে পৰ্য্যন্ত কর্ম্মক্ষয় না হয়, সে পর্য্যন্ত তাহাকে পূর্ব্বতন রূপ অবলম্বন করিয়া থাকিতে হয়; কর্ম্মক্ষয় হইলেই তাহার রূপের অন্যথা হইয়া থাকে। লোকে পরলোকে আত্মকৃত কর্ম্মের ফলভোগ করিয়া পুনরায় যখন ইহলোকে প্রত্যাগমন করে, তৎকালে উহার রূপের পরিবর্ত্তন হয় বটে; কিন্তু যখন তাহার সেই শরীর পূর্ব্বতন শরীরের মহাভূতসমুদয়দ্বারা নির্ম্মিত হয়, তখন ঐ শরীর যে পূর্ব্বতন শরীর, তাহার আর সন্দেহ নাই।

অশ্বমেধযজ্ঞে অশ্বচ্ছেদনসময়ে এই শ্রুত্যনুযায়ী বাক্য কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে যে, জন্তুগণ লোকান্তরে গমন করিলেও উহাদের প্রাণ ও শরীর উহাদিগকে পরিত্যাগ করে না। আর তুমিও যজ্ঞভূমিতে উপবিষ্ট হইয়া শ্রবণ করিয়াছ যে, পশুগণ যজ্ঞে নিহত হইয়া দেবতাদিগের পথ অবলম্বনপূর্ব্বক দেবলোকে গমন করে। তুমি যজ্ঞ আরম্ভ করিলে, তোমার হিতার্থী দেবগণ যজ্ঞস্থলে আগমনপুৰ্ব্বক নিহত পশুদিগকে স্বর্গে নীত করিয়াছেন। যখন পঞ্চভূত ও আত্মা নিত্য বলিয়া স্থিরসিদ্ধান্ত হইয়াছে, তখন লোকের শরীর অনিত্য হইবে কেন? যাহারা মোহবশতঃ আত্মা নানা শরীর পরিগ্রহ করেন বলিয়া বিবেচনা করে, তাহারাই আত্মীয়বিয়োগে বালকের ন্যায় রোদন করিয়া থাকে। যাঁহারা সংযোগ ও বিয়োগ এই উভয়কে অকিঞ্চিৎকর বিবেচনা করিয়া নিঃশঙ্ক হইয়া অবস্থান করেন, তাঁহাদিগকে কখনই সংযোগজনিত সুখ ও বিয়োগজনিত দুঃখে অভিভূত হইতে হয় না।

জীবাত্মা কেবল অভিমাননিবন্ধন পরমাত্মা বলিয়া অভিহিত হয়েন না। উনি উৎকৃষ্ট বুদ্ধিপ্রভাবে মোহ হইতে বিমুক্ত হইলে পরমাত্মার সহিত অভিন্ন হইয়া থাকেন। ফলতঃ মনুষ্যের শরীর ও আত্মা উভয়ই অবিনশ্বর। লোকে যে শরীর পরিগ্রহ করিয়া যে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে সেই শরীরেই তাহার ফলভোগ করিতে হয়। সে মনঃদ্বারা মানসিক ও শরীরদ্বারা শারীরিক কর্ম্মের ফলভোগ করিয়া থাকে।