৩১. ব্যাস-আদেশে ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির গঙ্গাতীরে গমন

ব্যাস-আদেশে ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির গঙ্গাতীরে গমন

বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহর্ষি বেদব্যাস কুন্তীকে এই কথা কহিয়া গান্ধারীকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভদ্রে! তুমি অবিলম্বেই পুত্র, ভ্রাতা ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবগণকে সুপ্তোত্থিতের ন্যায় সন্দর্শন করিবে। কুন্তী কর্ণকে, সুভদ্রা অভিমন্যুকে এবং দ্রৌপদী পঞ্চপুত্র, পিতা ও ভ্রাতাদিগকে দর্শন করিবেন। আমি পূর্ব্বেই পরলোকগত বন্ধুবান্ধবগণের সহিত তোমাদের সাক্ষাৎকার করাইতে বাসনা করিয়াছিলাম। এক্ষণে তুমি, কুন্তী ও নরপতি ধৃতরাষ্ট্র আমাকে ঐ বিষয়ে অনুরোধ করিতে আমার সেই ইচ্ছা বলবতী হইয়াছে। অতঃপর সেই সমরনিহত মহাত্মাদিগের নিমিত্ত শোক করা তোমাদিগের কর্ত্তব্য নহে। তাঁহারা ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন। উঁহারা অবশ্যম্ভাবী দেবকাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত স্বর্গ হইতে মহীতলে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে যেসমুদয় বীর নিহত হইয়াছেন, উঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ গন্ধৰ্ব্ব, কেহ কেহ অপ্সরা, কেহ কেহ পিশাচ, কেহ কেহ গুহ্যক, কেহ কেহ রাক্ষস, কেহ কেহ যক্ষ, কেহ কেহ সিদ্ধ, কেহ কেহ দেবতা, কেহ কেহ দানব এবং কেহ কেহ বা দেবর্ষি।

“ধৃতরাষ্ট্রনামে যে গন্ধর্ব্বাধিপতি বিখ্যাত আছেন, তিনিই এই মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হইয়া তোমার পতি হইয়াছেন। পাণ্ডুরাজ দেবশ্রেষ্ঠ বিষ্ণুর অংশে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন। বিদুর ও রাজা যুধিষ্ঠির ইঁহারা ধর্ম্মের অংশ। দুর্য্যোধন কলি, শকুনি দ্বাপর, দুঃশাসনাদি তোমার অন্যান্য পুত্রগণ রাক্ষস, মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন বায়ু, মহাত্মা ধনঞ্জয় পুরাতন ঋষি নর, কৃষ্ণ নারায়ণ, নকুল ও সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং সপ্তমহারথিতে পরিবেষ্টন করিয়া যে মহাবীরকে বিনাশ করিয়াছেন, সেই অৰ্জ্জুননন্দন অভিমন্যু চন্দ্রস্বরূপ। মহাবীর কর্ণ সূৰ্য্যের, দ্রৌপদীর সহোদর ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নির, শিখণ্ডী রাক্ষসের, দ্রোণাচাৰ্য্য বৃহস্পতির, অশ্বত্থামা রুদ্রদেবের এবং গাঙ্গেয় ভীষ্ম বসুর অংশে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন। এইরূপে দেবগণ মনুষ্যলোকে অবতীর্ণ হইয়া স্বকাৰ্য্যসাধনপূৰ্ব্বক পুনরায় স্বর্গলোকে প্রস্থান করিয়াছেন। যাহা হউক, আজ আমি তোমাদিগের চিরসঞ্চিত মনোদুঃখ দূর করিব। এক্ষণে তোমরা সকলে ভাগীরথীতীরে গমন কর। সেই স্থানে সমরনিহত বন্ধুবান্ধবগণকে সন্দর্শন করিবে।”

মহর্ষি বেদব্যাস এই কথা কহিবামাত্র তত্রত্য সকল লোকেই সিংহনাদপরিত্যাগপূৰ্ব্বক গঙ্গাভিমুখে ধাবমান হইল। রাজা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবগণ, অমাত্যগণ, মুনিগণ ও সমাগত গন্ধৰ্ব্বগণসমভিব্যাহারে ভাগীরথীতীরে যাত্রা করিলেন। অনন্তর সেই সমুদয় লোক ক্রমশঃ গঙ্গাতীরে সমুপস্থিত হইয়া স্বেচ্ছানুসারে অবস্থান করিতে লাগিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্রও সস্ত্রীক হইয়া পাণ্ডব ও স্বীয় অনুচরগণের সহিত অভিলষিত স্থানে বাস করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহারা সকলে মৃত নরপতিদিগের দর্শনবাসনায় গঙ্গাতীরে অবস্থানপূর্ব্বক নিশাসমাগম প্রতীক্ষা করাতে সেই দিবাভাগ তাঁহাদিগের পক্ষে শত বৎসরের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল।