৩. দ্রৌপদী প্রভৃতির স্বর্গারোহণ

দ্রৌপদী প্রভৃতির স্বর্গারোহণ

বৈশম্পায়ন বলিলেন, ধৰ্ম্মরাজ ধৰ্ম্মনন্দন এইরূপে কিয়দ্দুর গমন করিলে দেবরাজ ইন্দ্র রথশব্দে ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল নিনাদিত করিয়া, ধর্ম্মরাজের নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! তুমি অবিলম্বে এই রথে সমারূঢ় হইয়া স্বর্গারোহণ কর।” তখন ধৰ্ম্মরাজ ভ্রাতৃগণের পতননিবন্ধন শোকাকুল হইয়া দেবরাজকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “সুররাজ! সুখসংবর্দ্ধিতা সুকুমারী পাঞ্চালী ও আমার পরমপ্রিয় ভ্রাতৃগণ ধরাতলে নিপাতিত রহিয়াছে। উহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গারোহণ করিতে আমার কিছুমাত্র বাসনা নাই; অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার সহিত উহাদিগকে স্বর্গারোহণ করিতে অনুজ্ঞা করুন।”

ধর্ম্মরাজ বিনীতভাবে এই কথা কহিলে, দেবরাজ তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! দ্রৌপদী ও তোমার ভ্রাতৃচতুষ্টয় মানুষদেহ পরিত্যাগপূর্ব্বক তোমার অগ্রেই স্বর্গারোহণ, করিয়াছেন। অতএব তাঁহাদিগের নিমিত্ত শোক করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। তুমি এই নরদেহেই স্বর্গারূঢ় হইয়া তাঁহাদিগের সহিত সাক্ষাৎকার করিতে পারিবে, সন্দেহ নাই।”

যুধিষ্ঠিরের আশ্রিতবাৎসল্যে কুক্কুরত্যাগে অনিচ্ছা

সুররাজ এইরূপে আশ্বাস প্রদান করিলে ধৰ্ম্মরাজ পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “দেবরাজ! এই কুক্কুর আমার একান্ত ভক্ত। এ বহুদিন আমার সমভিব্যাহারে রহিয়াছে, অতএব আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক ইহাকে আমার সহিত স্বর্গারোহণ করিতে আদেশ করুন। ইহাকে পরিত্যাগ করিয়া গমন করিলে আমার নিতান্ত নৃশংস ব্যবহার করা হইবে।”

ধৰ্ম্মনন্দন এইরূপ অনুরোধ করিলে দেবরাজ তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আজ তুমি অতুল সম্পদ, পরমসিদ্ধি, অমরত্ব ও আমার স্বরূপত্ব লাভ করিবে। অতএব অচিরাৎ এই কুক্কুরকে পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গে গমন করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। ইহাকে পরিত্যাগ করিলে তোমার কিছুমাত্র নৃশংস ব্যবহার করা হইবে না।”

তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দেবরাজ! অকর্ত্তব্য কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হওয়া ভদ্রলোকের কদাপি বিধেয় নহে। এক্ষণে যদি স্বর্গীয় সম্পত্তিলাভের নিমিত্ত আমাকে এই পরমভক্ত কুক্কুরকে পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহা হইলে আমার সম্পদে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।”

ইন্দ্র বলিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি কুকুরের সহিত একত্র অবস্থান করে, সে কখনও স্বর্গে বাস করিতে সমর্থ হয় না। ক্রোধবশনামক দেবগণ তাহার যজ্ঞদানাদির ফল বিনষ্ট করিয়া থাকেন। অতএব তুমি অবিলম্বে এই কুক্কুরকে পরিত্যাগ কর। ইহাতে তোমার কিছুমাত্র নৃশংস ব্যবহার করা হইবে না।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দেবেন্দ্র! ভক্তজনকে পরিত্যাগ করিলে ব্রহ্মহত্যাসদৃশ মহাপাপে লিপ্ত হইতে হয়। অতএব আজ আমি আত্মসুখের নিমিত্ত কখনই এই কুক্কুরকে পরিত্যাগ করিব না। ভীত, ভক্ত, অনন্যগতি, ক্ষীণ ও শরণাগত ব্যক্তিদিগকে আমি প্রাণপণে রক্ষা করিয়া থাকি।”

ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক কুকুরের দোষদর্শন

ইন্দ্র কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ। কুকুরের যজ্ঞ, দান ও হোমক্রিয়া দর্শন করিলে, ক্রোধবশনামক দেবগণ ঐ সমুদয় কার্য্যের ফল ধ্বংস করিয়া থাকেন। কুক্কুর অতি অপবিত্র জন্তু; অতএব তুমি অচিরাৎ এই কুক্কুরকে পরিত্যাগ কর, তাহা হইলে তোমার অনায়াসে পরমপবিত্র দেবলোকলাভ হইবে। যখন তুমি প্রাণাধিকা দ্রৌপদী ও ভ্রাতৃগণকে পরিত্যাগ করিয়া স্বীয় উৎকৃষ্ট কৰ্ম্মফলে স্বর্গলাভে অধিকারী হইয়াছ, তখন তোমার এই কুক্কুরকে পরিতাগ করিবার বাধা কি? তুমি সৰ্ব্বত্যাগী হইয়া এক্ষণে এরূপ বিমোহিত হইতেছ কেন?”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দেবরাজ! ইহলোকে কাহারও মৃতব্যক্তিদিগের সহিত সন্ধি বা বিগ্রহ করিবার ক্ষমতা নাই। আমার ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদী মৃত্যুমুখে নিপতিত হইলে, আমি তাহাদের জীবন দান করিতে সমর্থ নহি বিবেচনা করিয়াই উহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছি। উহারা জীবিত থাকিতে আমি উহাদিগকে ত্যাগ করি নাই। আমার মতে ভক্তজনকে পরিত্যাগ করা শরণাগত ব্যক্তিকে ভয়প্রদর্শন, স্ত্রীহত্যা, ব্রহ্মস্বাপহরণ [৩] ও মিত্রদ্রোহ এই চারিটি কার্য্যের ন্যায় মহাপাপজনক।”

যুধিষ্ঠিরের ধর্ম্মপরীক্ষান্তে সশরীরে স্বর্গারোহণ

মহাত্মা যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, তাঁহার সমভিব্যাহারী সেই কুক্কুর সাক্ষাৎ ধৰ্ম্মরূপী হইয়া প্রীতমনে মধুরবাক্যে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! আমি তোমাকে পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত কুক্কুরবেশে তোমার সহিত আগমন করিয়াছিলাম। এক্ষণে বুঝিলাম, তুমি নিতান্ত ধৰ্ম্মপরায়ণ, বুদ্ধিমান ও সৰ্ব্বভূতে দয়াশীল। পূর্ব্বে আমি দ্বৈতবনে একবার তোমাকে পরীক্ষা করিয়াছিলাম। ঐ সময় তোমার ভ্রাতৃগণ জল অন্বেষণার্থে গমন করিয়া প্রাণত্যাগ করিলে, তুমি ভীম ও অৰ্জ্জুনের জীবন প্রার্থনা না করিয়া মাদ্রীকে স্মরণপূৰ্ব্বক নকুলের জীবন প্রার্থনা করিয়াছিলে এবং এক্ষণেও কুক্কুরকে আশ্রিত বিবেচনা করিয়া দেবরথ পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হইয়াছ। আমি তোমার এই দুই কার্য্য-দর্শনে নিতান্ত প্রীত হইয়াছি। তোমার তুল্য ধর্ম্মপরায়ণ স্বর্গলোকে আর কেহই নাই। তুমি এই দেহেই স্বর্গারোহণপূৰ্ব্বক অক্ষয়লোক লাভ করিতে পারিবে।”

ভগবান ধর্ম্ম এই কথা কহিবামাত্র ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, মরুদ্‌গণ এবং অন্যান্য দেবতা ও দেবর্ষিসমুদয় তাঁহার সহিত সমবেত হইয়া, যুধিষ্ঠিরকে দিব্যরথে আরোপিত করিয়া আপনারা দিব্যবিমানসমুদয়ে সমারূঢ় হইলেন। তখন ধৰ্ম্মরাজ সেই দিব্যরথে আরোহণপূৰ্ব্বক তেজোদ্বারা নভোমণ্ডল পরিব্যাপ্ত করিয়া দেবলোকে গমন করিলেন।

স্বর্গারূঢ় যুধিষ্ঠিরের প্রতি নারদ-অভ্যর্থনা

তিনি দেবলোকে উপস্থিত হইবামাত্র লোকতত্ত্ববেত্তা তপোধনাগ্রগণ্য দেবর্ষি নারদ দেবগণের মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন, “যে সমুদয় রাজর্ষি স্বর্গারোহণ করিয়াছেন, আজ মহারাজ যুধিষ্ঠির স্বীয় যশঃ ও তেজোদ্বারা তাঁহাদিগের সকলেরই কীৰ্ত্তি আচ্ছাদনপূৰ্ব্বক সশরীরে স্বর্গারূঢ় হইলেন। পুৰ্ব্বে আর কোন ব্যক্তিই সশরীরে স্বর্গারোহণ করিতে সমর্থ হয়েন নাই।”

দেবর্ষি এই কথা কহিলে, ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা যুধিষ্ঠির দেবগণ ও স্বপক্ষীয় পার্থিবগণকে সম্ভাষণপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে মহাপুরুষগণ! আমার ভ্রাতৃগণ যে লোকে গমন করিয়াছে, তাহা উৎকৃষ্ট হউক বা অপকৃষ্ট হউক, আমি সেই লোকেই গমন করিব। তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য লোকে অবস্থান করিতে আমার কিছুমাত্র বাসনা নাই।”

যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতৃবাৎসল্য

ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির সরলভাবে এই কথা কহিলে, দেবরাজ তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! তুমি স্বীয় কৰ্ম্মফলে স্বর্গারোহণ করিয়াছ; অতএব এই স্থানেই অবস্থান কর। কেন তুমি অদ্যাপি মনুষ্যবৎ স্নেহের বশীভূত হইতেছ? আর কেহই কখন তোমার তুল্য সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয়েন নাই। তোমার ভ্রাতৃগণ এ স্থানের অধিকারী নহে। এই স্বর্গভূমিতে সমুপস্থিত হইয়া মানুষভাবে সমাক্রান্ত হওয়া তোমার নিতান্ত অনুচিত। এই দেখ, মহর্ষি ও দেবগণ এই স্থানে অবস্থান করিতেছেন।”

দেবরাজ এই কথা কহিলে, মহাত্মা যুধিষ্ঠির পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “সুররাজ! আমার প্রণয়িনী বুদ্ধিমতী দ্রৌপদী ও আমার পরমপ্রিয় ভ্রাতৃগণ যে স্থানে বাস করিতেছে, সেই স্থানেই গমন করিতে নিতান্ত বাসনা হইতেছে। তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া এই স্থানে বাস করিতে আমার কিছুতেই ইচ্ছা হইতেছে না।”

মহাপ্রস্থানিকপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত