১. মহাপ্রস্থানিকপর্ব্বাধ্যায়—পাণ্ডব কর্ত্তব্যনির্ণয়

মহাপ্রস্থানিকপর্ব্বাধ্যায়—পাণ্ডব কর্ত্তব্যনির্ণয়

নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।

জনমেজ কহিলেন, ব্রহ্মন্! আমার পূৰ্ব্বপিতামহগণ মুষলপ্রভাবে বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের ক্ষয় এবং মহাত্মা বাসুদেবের স্বর্গগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কি করিলেন তাহা কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ধৰ্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনের মুখে বৃষ্ণিবংশীয়দিগের বিনাশ ও কৃষ্ণের স্বর্গগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া স্বয়ং মহাপ্রস্থান করিবার মানসে অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভ্রাতঃ! কালই প্রাণীগণের কাৰ্য্যসমুদয় সম্পাদন করিয়া থাকে। কালপ্রভাবেই মনুষ্যের বিনাশ হয়। আমি অচিরাৎ সেই কালের অপরিহার্য্য কবলে নিপতিত হইব বলিয়া স্থির করিয়াছি। এক্ষণে তোমার যাহা কর্ত্তব্য হয় স্থির কর।”

ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিবামাত্র অর্জ্জুন জ্যেষ্ঠভ্রাতার বাক্যে অনুমোদনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমিও অচিরাৎ মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে বাসনা করি।” তখন ভীমসেন, নকুল ও সহদেব অর্জ্জুনের অভিপ্রায় অবগত হইয়া ‘আমরাও অচিরাৎ প্রাণত্যাগ করিব’ বলিয়া অঙ্গীকার করিলেন।

পরীক্ষিতের রাজ্যাভিষেক

এইরূপে সকলে প্রাণপরিত্যাগে কৃতনিশ্চয় হইলে, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পরীক্ষিৎকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া, বৈশ্যাপুত্র যুযুৎসুর প্রতি রাজ্যপালনের ভার সমর্পণপূৰ্ব্বক সুভদ্রাকে কহিলেন, “ভদ্রে! তোমার এই পৌত্র অভিমন্যুতনয় কৌরবরাজ্যে অভিষিক্ত হইলেন আর আমি পূৰ্ব্বেই বাসুদেবের পৌত্রকে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্য প্রদান করিয়াছি। অতঃপর এই অভিমন্যুতনয় হস্তিনায় অবস্থানপূর্ব্বক আমাদের রাজ্য এবং বজ্র ইন্দ্রপ্রস্থে অবস্থানপূর্ব্বক হতাবশিষ্ট যাদবগণকে প্রতিপালন করিবেন। তুমি এই বালকদ্বয়ের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখিয়া উহাদিগকে সাবধানে রক্ষা করিবে।”

যুধিষ্ঠির এই কথা কহিয়া ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে ধীমান বাসুদেব, মাতুল বসুদেব ও বলদেব প্রভৃতি অন্যান্য বৃষ্ণিবংশীয়দিগকে জলাঞ্জলি প্রদান ও তাঁহাদের শ্রাদ্ধকাৰ্য্য সম্পাদনপূর্ব্বক বাসুদেবের উদ্দেশে মহর্ষি বেদব্যাস, নারদ, মার্কণ্ডেয় ও যাজ্ঞবল্ক্যকে সুস্বাদু দ্রব্যসকল ভোজন করাইয়া ব্রাহ্মণদিগকে রত্ন, পরিধেয় বস্ত্র, গ্রাম, অশ্ব, রথ ও দাসীসমুদয় প্রদান করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি কুলগুরু কৃপাচার্য্যকে অর্চ্চনা করিয়া পরীক্ষিৎকে তাঁহার হস্তে সমর্পণপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! আপনি যত্নসহকারে এই অভিমন্যুতনয়কে ধনুৰ্ব্বেদ শিক্ষা করাইবেন।”

পাণ্ডবগণের মহাপ্রস্থানের উদ্‌যোগ

অনন্তর ধর্ম্মরাজ প্রকৃতিমণ্ডলকে সমানীত করিয়া তাহাদিগের নিকট স্বীয় অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলে, তাহারা একান্ত উদ্বিগ্ন হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “মহারাজ! আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া গমন করা আপনার কর্ত্তব্য নহে!” প্রজাগণ এইরূপে বারংবার অনুনয় করিলেও কালতত্ত্বজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠির তাহাদিগের বাক্যে সম্মত হইলেন না। পরিশেষে তাহাদিগকে সমুচিত সম্মান করিয়া, ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে বনগমনে কৃতনিশ্চয় হইয়া, দিব্যআভরণসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বল্কল পরিগ্রহ করিলেন। তখন মহাত্মা ভীমসেন, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব ও মনস্বিনী দ্রেীপদীও তাঁহার ন্যায় বেশধারণে প্রবৃত্ত হইলেন।

মহাপ্রস্থান যাত্রা

অনন্তর পাণ্ডবগণ তৎকালোচিত যজ্ঞ সমাপনপূৰ্ব্বক সলিলে অনল নিক্ষেপ করিয়া পত্নীর সহিত বনগমনার্থ বহির্গত হইলেন। কৌরবকামিনীগণ পূর্ব্বের ন্যায় তাঁহাদিগকে বনপ্রস্থান করিতে অবলোকন করিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। তখন পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী হস্তিনানগর হইতে বহির্গত হইলেন। ঐ সময় এক কুক্কুর তাঁহাদিগের অনুগামী হইল। পুরবাসী ও নগরবাসী লোকসমুদয় বহু দূর পর্য্যন্ত তাঁহাদিগের অনুগমন করিল; ‘কিন্তু মহারাজ! প্রতিনিবৃত্ত হউন’ এ কথা কাহারও মুখ হইতে বহির্গত হইল না। পরিশেষে তাহারা সকলেই প্রতিনিবৃত্ত হইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল। কৃপাচার্য্য প্রভৃতি মহাত্মারা যুযুৎসুর নিকট অবস্থান করিতে লাগিলেন। ভুজগনন্দিনী [নাগকন্যা] উলুপী জাহ্নবীজলে প্রবিষ্ট হইলেন, চিত্রাঙ্গদা মণিপুরে প্রস্থান করিলেন এবং অবশিষ্ট পাণ্ডবপত্নীগণ পরীক্ষিতের নিকট অবস্থানপূর্ব্বক তাহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন।

এ দিকে পাণ্ডবগণ যশস্বিনী দ্রৌপদীর সহিত উপবাস করিয়া ক্রমাগত পূর্ব্বাভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাত্মা যুধিষ্ঠির সর্ব্বাগ্রে, তৎপশ্চাৎ মহাবীর ভীমসেন, তৎপশ্চাৎ মহাবলপরাক্রান্ত অৰ্জ্জুন, তৎপশ্চাৎ যমজ নকুল ও সহদেব এবং তৎপশ্চাৎ যশস্বিনী দ্রৌপদী গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের হস্তিনা হইতে বহির্গমনকালে যে কুক্কুর তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারী হইয়াছিল, সে তাঁহাদের সকলের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল।

পাণ্ডবগণের পৃথিবীপরিক্রমা—অর্জ্জুনের অস্ত্রত্যাগ

অনন্তর তাঁহারা ক্রমে ক্রমে অসংখ্য দেশ, নদী ও সাগরসমুদয় সমুত্তীর্ণ হইয়া লোহিত-সাগরের কুলে সমুপস্থিত হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় এ কাল পর্য্যন্ত রত্নলোভনিবন্ধন গাণ্ডীবধনু ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় পরিত্যাগ করেন নাই। পাণ্ডবগণ ঐ সমুদ্রের উপকূলে উপস্থিত হইবামাত্র ভগবান্ হুতাশন অর্জ্জুনকে সেই শরাসন পরিত্যাগ করাইবার নিমিত্ত পুরুষবিগ্রহ পরিগ্রহপূর্ব্বক পৰ্ব্বতের ন্যায় তাঁহাদের পথরোধ করিয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, “পাণ্ডবগণ! আমি অগ্নি; আমি পুর্ব্বে মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেবের পরাক্রমপ্রভাবে খাণ্ডববন দগ্ধ করিয়াছিলাম। ভগবান হৃষীকেশের নিকট যে চক্র ছিল, তিনি এক্ষণে তাহা পরিত্যাগ করিয়াছেন; অবতারভেদে পুনরায় ঐ চক্র তাঁহার হস্তগত হইবে। এক্ষণে অর্জ্জুনও গাণ্ডীবধনু পরিত্যাগ করিয়া বনগমন করুন। এখন ঐ শরাসনে উঁহার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। পূর্ব্বে আমি উঁহার নিমিত্ত বরুণের নিকট হইতে ঐ শরাসন আহরণ করিয়াছিলাম। এক্ষণে উনি উহা বরুণকে প্রত্যর্পণ করুন।”

হুতাশন এই কথা কহিলে, যুধিষ্ঠিরাদি সকলেই অর্জ্জুনকে গাণ্ডীবধনু পরিত্যাগ করিতে কহিলেন। তখন মহাত্মা অৰ্জ্জুন সেই গাণ্ডীবশরাসন ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় অচিরাৎ সলিলে নিক্ষেপ করিলেন। অর্জ্জুন শরাসন ও তূণীর নিক্ষেপ করিবামাত্র ভগবান হুতাশন সেই স্থানে অন্তর্হিত হইলেন।

অনন্তর পাণ্ডবগণ দক্ষিণাভিমুখে গমন করিয়া, লবণ-সমুদ্রের উত্তরতীর দিয়া দক্ষিণ-পশ্চিমাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন এবং পরিশেষে প্রতিনিবৃত্ত ও পুনরায় পশ্চিমাভিমুখী হইয়া সমুদ্রজলপ্লাবিত দ্বারকাপুরী সন্দর্শনপূৰ্ব্বক পৃথিবী-প্রদক্ষিণবাসনায় তথা হইতে উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন।